আ.ম.ম.মামুন :
২০১৭ এর শেষের দিকে দেশ জুড়ে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘হালদা’ চলচ্চিত্র নিয়ে বোদ্ধাদর্শকদের আগ্রহ আর হালদার পারের জনগণের উৎসাহ উদ্দীপনার রেশ না কাটতেই চলচ্চিত্রটির কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার আজাদ বুলবুল ২০১৮ এর বইমেলায় উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁর ইতিহাসাশ্রিত মহাকাব্যিক উপন্যাস অগ্নিকোণ (২০১৮) নিয়ে। চট্টগ্রামের হালদা এশিয়ার একমাত্র স্বাভাবিক মাছ প্রজননের নিরাপদ কেন্দ্র। অধুনা অনিরাপদ হয়ে ওঠা আর নদীখেকোদের দখলে চলে যাওয়া বিপন্ন হালদা এবং হালদা তীরবর্তী জেলে সম্প্রদায়ের জীবনযুদ্ধের বিশ্বস্ত চিত্রায়ন হালদা। লেখকের সদ্য প্রকাশিত ‘অগ্নিকোণে’র বিপুল আয়তন এলাকা জুড়ে আছে আবারও চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মানুষ। তবে এবার হালদার মত সীমাবদ্ধ অঞ্চলে, সীমাবদ্ধ জীবিকার, সীমাবদ্ধ জনজীবন আর সীমাবদ্ধ ভাষায় আজাদ বুলবুল নিজেকে সীমাবদ্ধ করেননি। এবার তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন বিস্তৃত পরিসরে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জীবনভাষ্য চিত্রায়নে। ঔপন্যাসিক হিসেবে এটা তার বিস্তার, উত্তরণও।
তেষট্টি অধ্যায়ে বিভক্ত চারশত আটচল্লিশ পৃষ্ঠার এই ওজনদার উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ঐতিহাসিক। পটভূমি চট্টগ্রাম থেকে সুদূর বার্মা বিস্তৃত। সময়কাল ১৯২০ – ১৯৩৪। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ও চট্টগ্রাম-বার্মা সম্পর্ক আলোচ্য উপন্যাসে বিষয় হিসেবে মুদ্রিত হয়েছে।
ইতিহাসের উত্তপ্ত সড়ক আর সমাজজীবনের জটিল জীবনযাত্রার কোন্ বিবরণ উপন্যাসিক এই ভারি উপন্যাসে আমাদের জন্য তুলে এনেছেন? এমন প্রশ্নের সহজ জবাব মিলবে প্রথম ফ্ল্যাপে মুদ্রিত লেখাটিতে চোখ বুলালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সমাজমানসে হতাশা, নৈরাশ্য, যুগযন্ত্রণা একদিকে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন,অন্যদিকে অগ্নিপুরুষ সূর্যসেনের সশস্ত্র সংগঠনের সহিংস অপারেশন,অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, রেললাইন উপড়ানো, টেলিফোন অফিস ধ্বংস, সাথে ইউরোপিয়ানদের হত্যা করে ব্রিটিশ শাসকদের সন্ত্রস্ত করে তোলা। অন্যদিকে যুদ্ধোত্তর মন্দা ও বেকারত্বে অসহায় চট্টগ্রামের আরেকদল লোক ভাগ্যান্বেষণে থিতু হতে চায় বার্মায়। বেপর্দা বর্মি সুন্দরীদের বিয়ে করে রঙিন রেঙ্গুনে গড়ে তুলেছে এক নতুন জেরবাদি প্রজন্ম। অনেকে বর্মী বউ বগলদাবা করে ফিরে এসেছে স্বভূমে, চট্টগ্রামে। জন্ম দিয়েছে নানা কল্পকাহিনির। আর এই অম্ল মধুর কাহিনির অন্তরালে উদার,নিম্নকন্ঠী বর্মীরা জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ক্রমশ বাঙালি বিরোধী হয়ে ওঠে।
মোট কথা চট্টগ্রাম ও বার্মার রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যচেতনা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে অভিঘাত তৈরী করেছিল তাঁরই আনুপূর্বিক বিবরণ ’অগ্নিকোণ’।
উপন্যাস কী ? কোনো বিস্তারিত, জটিল আলোচনায় না গিয়ে বলা যায় ‘শৈল্পিক কৌশলের সঙ্গে জীবনের বৃহৎ রূপায়ণ হচ্ছে উপন্যাস।’ অনেকে জীবনার্থ সন্ধানের রুপান্বিত রূপকও বলতে চান উপন্যাসকে। উপন্যাস হলো জীবনের নিকটতম ঘনিষ্ঠ শিল্পমাধ্যম। জীবন অর্থহীন হলেও শিল্প অর্থযুক্ত। আজাদ বুলবুল তার মহাকাব্যিক ’অগ্নিকোণ’ উপন্যাসে জগৎ ও জীবনের পারিপাস্বিকতাকে কীভাবে মুদ্রিত করেছেন- সেটি মূল্যায়নের আগে আমাদের জেনে নেওয়া দরকার উপন্যাসে, যার যাত্রা পল্লবিত কথাবিস্তারে – সে কাহিনিকে কীভাবে সাজিয়েছেন তিনি। ৪৬৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির শুরু ফতেয়াবাদ স্কুলের চিরচেনা পরিবেশটি ক্রমশ বদলে যাওয়ার সংবাদ দিয়ে। স্কুলের বদমেজাজি শিক্ষক কল্যাণ দত্ত স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সময়ে অসময়ে নবম দশম শ্রেণির ছাত্রদের সাথে ফুসুর ফুসুর করে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিস্ময় মানা স্কুলের মুসলিম ছাত্র শামসু একদিন ওই কল্যাণ দত্ত স্যারের কাছে গিয়ে স্বদেশী মন্ত্রের দীক্ষা নেবার আকুতি জানায়। কল্যাণ দত্ত বিস্মিত হন। কারণ, স্বদেশী আন্দোলনে মুসলিম সমাজ বরাবরই নিষ্ক্রিয়,অনীহ। তবুও ছাত্রের আকুতিতে তিনি মুগ্ধতা মানেন।
“দেশ স্বাধীনের নেশা যদি তোমাকে গ্রাস করে তাহলে ভূতগ্রস্ত লোকের মত তোমার ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুতে তা ছড়িয়ে পড়বে। আত্মীয়,বন্ধু, সামাজিকতা, প্রতিষ্ঠা, আরো কত কত জিনিস তোমাকে ছাড়তে হবে। পারবে এসব?আমি পারবো, স্যার।পরাধীনতার তিলক মাথায় নিয়ে ঘুরার থেকে ঐসব কিছু ত্যাগ করা সামান্য মাত্র।”(পৃষ্ঠা ১১)
স্বদেশীমন্ত্রে দীক্ষিত শামসু একসময় রেঙ্গুন পাড়ি জমায়। বার্মায় বসবাসরত চাটগাইয়া মুসলমান বারি চৌধুরী বার্মা এসেম্বলির সদস্য। তার বিশাল বিস্তৃত ব্যবসার মধ্যে কাঠের বাণিজ্যের দেখভাল করে শামসু, যে কবিতা লেখে, পত্রিকা বার করে আর সাহিত্য রচনার মাধ্যমে মুক্তির স্বপ্ন দেখে। শামসু চরিত্রের বিপরীতে আরেক যুবক সুরত জামাল কাহিনির মোড়কে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। অবিবাহিত কামুক এই যুবক সারাক্ষণ শুধু খোঁজে নারীর শরীর সংস্পর্শের বিশেষ ইঙ্গিতবাহী রক্তিম দুটি চোখ, সচল হাত, বেফাঁস মুখ সারাক্ষণ শুধু মেয়েদের উত্তপ্ত করে। মুজারিপাড়ার নিরুদ্দেশ কাশিমার স্ত্রী পুকুরে স্নানরতা সুফিয়ার সাথে জোরপূর্বক আকাম করতে গিয়ে ধরা পড়ে গ্রাম সালিশের মুখোমুখি হয় সুরত জামাল।
অমীমাংসিত সালিশের এক পর্যায়ে মাঝরাতে পালিয়ে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে চাটগাঁ শহরে উঠে সুরত। আশ্রয় নেয় সদরঘাট পতিতালয়ের বিনোদবালার ঘরে। পতিতা হয়েও বিনোদবালা অন্য সুষমায় উদ্ভাসিত। শিক্ষিত মার্জিত রুচির বিনোদবালা স্বদেশী আন্দোলনে উদ্দীপ্ত শুধু নয়, আন্দোলনরত পলাতক বিদ্রোহী আহত কর্মী অনুশীলন বা যুগান্তর গ্রুপের বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতাও। কামুক সুরত জামালও স্বদেশী বিবেচনায় আশ্রয় পায় বিনোদের ঘরে। একদিন আর দশ জন বাঙালি মুসলিম যুবকের মত ভাগ্যান্বেষণে সুরতও বার্মায় পাড়ি জমায়, জীবিকার প্রয়োজনে চাকরি নেয়, বর্মী মেয়ে লামাচিঙের পাণি গ্রহণ করে গার্হস্থ্য জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা সুরত বর্মী যুবকদের বাঙালি বিরোধী আন্দোলনের শিকার হয়। রেঙ্গুনে ক্রমবর্ধমান মুসলমান সমাজের মধ্যে অনেক চরিত্রের মাঝে আমাদের দৃষ্টিকাড়ে হাজী আমিনুল্লাহ। বোম্বাইয়া হাজী বলে পরিচিত আমিনুল্লাহ বার্মার মসজিদের ইমামতি ছেড়ে সুপ্ত বাসনা চরিতার্থ করার আশায় বর্মী মেয়েকে বিয়ে করে দেশে ফিরে। মোজারিপাড়ায় রহমবলির ঘরে বর্মী বউ নিয়ে উঠে সে প্রথম বউ হাজেরার তীব্র রোষানালে পড়ে।
“আরে থাইমতো ন কইও বুজি। লাডর পোয়া লাট, দাড়ি টুপি ছাড়ি এনে ফোড়াংগিরি মারেদ্দে। ইতে অন হাবিলতি মারি বহুত হতা কইবো। সাম্মে আয় অমাইনসর ফোয়া। মা চোদা নাইট্যা পোয়ার ডইল্লা দেশত যেডে হেডে মুখ দিত্ ন পারি বর্মাত যায় এ্যান আকাম গল্লি। ঘরত্তুন বাইর অ হানকির পোয়া। চোয়াইয়েরে দাঁত ফালায় দিয়ুম। ” (পৃষ্ঠা ১১৪) বর্মী বউ ম্রাচাং এর তেলাসমাতিতে মুগ্ধ হাজেরা সতীনকে সস্নেহে মেনে নেয়। অগ্নিকোণের বার্মা চট্টগ্রাম দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্যে অনেকটা দুহাত বাড়িয়ে ঐক্যের দূত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন বার্মা এসেম্বলির সদস্য বাঙালি আব্দুল বারী চৌধুরী। কংগ্রেস নেতা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বারি চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করে বার্মায় একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করলে উদার অসাম্প্রদায়িক বারি চৌধুরী বলেন, ”দেড় কোটি বর্মির জন্য না বানিয়ে দশ লাখ মুসলমানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বানাবো? সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজ ধর্মীয় বর্মি বৌদ্ধদের রাহুগ্রাস থেকে স্বাধীন সত্তা নিয়ে আবির্ভূত হবার লক্ষ্যে একটি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পুনর্বার আহবান মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী জানালে বারী চৌধুরী প্রত্যুত্তরে পরিষ্কার জানিয়ে দেন—‘‘ইরাবতীর পাড়ে একটি সুন্দর জায়গা আপনি নির্বাচন করুন। বেঙ্গুন শহরেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় গড়বো। তবে তা আরবি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়।বার্মাকে ভালোবাসি এর মাটি এর মানুষ সবাই আমার আত্মার আত্মীয়। এদের বাদ দিয়ে আমি কখনো কিছু করিনি। কখনো কিছু করবো না। ” (পৃষ্ঠা ১৩০)।
‘অগ্নিকোণ’ উপন্যাসের ৪৪৮ পৃষ্ঠার কথাবিস্তারে অর্ধেকের চাইতেও বেশি বিবৃত হয়েছে অগ্নিপুরুষ সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহের আদ্যোপান্ত। যেকোনো পরিস্থিতিতে নিষ্ঠায় কর্তব্যে, নির্দেশে অবিচল মিতবাক সূর্যসেনের চোরা গোপ্তা হামলা পরিচালনার লোমহর্ষক বর্ণনা, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত স্বদেশীদের আত্মোৎসর্গ করার প্রাণান্ত শপথ, পরির পাহাড়, পাহাড়তলী জালালাবাদ, পাহাড়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের সাথে সূর্যসেন বাহিনীর মরণপণ সম্মুখযুদ্ধ, অপারেশন। ‘বন্ধুগণ আজকেই জীবনমরণ পরীক্ষা। আজকেই মোক্ষলাভের লড়াই। আজকে সব কিছু অর্জনের সংগ্রাম।’(পৃষ্ঠা ১৫১) পাহাড়তলী অস্ত্রাগার লুণ্ঠন রেললাইন উপড়ানোর সাথে বর্ণিত হয়েছে অগ্নিযুগের নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের মেমবউ নেলী সেনগুপ্তের শাড়ি পরে হিন্দু-মুসলিম দর্শনার্থীদের চা-বিস্কুট আপ্যায়ন, ঐতিহ্যবাহী বলিখেলা চট্টগ্রামের কিংবদন্তিতুল্য নুর আহমেদ চেয়ারম্যানের নগর উন্নয়ন ও জনসেবার নানামুখী কর্মকা- এবং যুব বিদ্রোহের প্রতি তারও অকুণ্ঠ সমর্থন- “শুনেন,আমি নুর আহমেদ যদি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান না হতাম তাহলে যুব বিদ্রোহে যোগ দিতাম। জালালাবাদে যুদ্ধ করতাম। প্রয়োজনে প্রাণ দিতাম। পরাধীন রাষ্ট্রের পৌরপিতা হবার চাইতে স্বাধীন দেশের পৌরসেবক হওয়া অনেক বেশি মহোত্তর।’ (পৃষ্ঠা ৩২৫) আরো আছে চট্টগ্রামে অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তের স্বদেশী আন্দোলনের সরাসরি যুক্ত হবার কথা এবং সর্বোপরি এই বিশাল আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকে অগ্নিপুরুষ সূর্য সেনের ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে ধরা পড়া, নির্মম নির্যাতনের শিকার এবং ফাঁসিতে ঝুলার গৌরবোজ্জ্বল মৃত্যুর সুনশান নীরবতা। দুই শতাধিক চরিত্রের এই বিপুলায়তন ভারি উপন্যাসটির কাহিনির পল্লবিত কথা বিস্তার এই ছোট্ট পরিসরে তুলে আনা কষ্টকর। আমি শুধু উপন্যাসটির শিল্পশৈলী প্রসঙ্গে কিছু কথা বলবার প্রয়োজনে আপনাদের কাহিনি সূত্র ধরিয়ে দিয়েছি।
এবার দৃষ্টি দিতে চাই অগ্নিকোণের শিল্পশোভার দিকে। প্রথমেই চরিত্রচিত্রন। যথাযথ চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমেই একজন মহৎ ঔপন্যাসিকের কৃতিত্ব ফুটে ওঠে। একজন উপন্যাসিক যে জীবনবোধ বা দর্শন তাঁর অন্তর্লোকে ধারণ করে উপন্যাস রচনায় ব্রতী হন তার চরিতার্থতা সিদ্ধ হয় চরিত্রকে অবলম্বন করে। কতটা নিলিপ্ত দৃষ্টিতে, কতটা নির্মোহ থেকে পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে উঠে আসা এক একটি চরিত্রকে প্রাণদান করতে সক্ষম হলেন, সেটাই শেষপর্যন্ত বিবেচ্য।আজাদ বুলবুল তাঁর এই মহাকাব্যিক উপন্যাসের কাহিনিতে মহাকাব্যের বিশালতা, ব্যক্তিকে ধারণ করলেও দুই শতাধিক চরিত্রের কোনো চরিত্রকেই শেষ পর্যন্ত মহাকাব্যিক ইমেজে নায়কোচিত করে তুলেননি। এমন কি উপন্যাসের অগ্নিপুরুষ সূর্যসেনকেও শেষ বিচারে মহাকাব্যিক মনে হয়নি। এর অন্যতম কারণ হয়তো এই যে, কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রকে আলাদা গুরুত্ব না দিয়ে দুশতাধিক চরিত্রকে নিয়ে এগোতে চেয়েছেন। এর একটা সুফল এই যে, পুরো উপন্যাসে সক্রিয় প্রায় পঞ্চাশোধিক চরিত্রের সবাইকে তিনি আলাদা করে চিনিয়ে দিতে পেরেছেন। ঐতিহাসিক উপন্যাসের ধরাবাঁধা রীতিনীতির মধ্যেও ঔপন্যাসিক সৃজনশীলতার যে ইতিহাস আর কল্পনার মিশেলে তিনি যে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছেন তা অপূর্ব। বিশেষ করে বিনোদবালা, ম্রাচাং, সুরুত জমাল কিংবা লামাচিঙ। বিনোদ-ম্রাচাং-লামাচিঙ এই ত্রয়ীরমণীর উপস্থিতি কবিতার শব্দের মতন। পতিতা বিনোদবালা যেন পতন থেকে উঠে আসা নয়, বরং সে যেন নষ্ট ভ্রষ্ট সমাজের পাপ ও পতনকে চুষে নিতে উদগ্রীব,যেন এক নিপুণ ব্লটিং পেপার। পেশায় সে বেশ্যা, সেবায় সে মাতৃতুল্য। ইতিহাসের কালো অক্ষরে পরিণত হওয়া এক একটি চরিত্রের মধ্যে লেখক প্রাণসঞ্চার করতে সক্ষম। মনে হয় কাজির দেউড়ি দাঁড়ালে এখনই দেখে উঠবো সফেদ পাঞ্জাবির ওহিদুল আলমকে, ডিসিহিলের দিকে হাঁটলেই দেখবো মঞ্চে ধীর পায়ে উঠে যাচ্ছেন শতবর্ষী বিপ্লবী বিনোদ বিহারী, খাস্তগীর স্কুলের সামনে দাঁড়ালেই দেখে উঠবো-এক ঝাঁক প্রজাপতির মতো চঞ্চল স্কুলবালিকার ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসছেন প্রীতিলতা কিংবা জালালাবাদ পাহাড়ের পাদদেশে দেখতে পাবো মাস্টারদা সূর্যসেন,একদল স্বদেশী বিপ্লবী নিয়ে মারাত্মক অস্ত্রহাতে পায়চারি করছেন। উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায়ে লম্পট সুরত জামালের লাম্পট্যের বিচার করার জন্য গ্রামবাসী সালিশ বসায়। সালিশের এই দৃশ্য আমাদের মানিক ব্যানার্জীর ’পদ্মা নদীর মাঝি‘র ময়নাদ্বীপের এনায়েতের কথা মনে করিয়ে দেয়। উগ্র প্রকৃতির বেপরোয়া যুবক এনায়েত বৃদ্ধ বশির মিয়ার যুবতী স্ত্রীর প্রতি কুনজর দেয়। এই অপরাধে এনায়েতের গর্হিত কর্মের বিচার করতে সালিশ বসে। সুরতজামাল- সুফিয়া, এনায়েত বসীরের বউ ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন চরিত্রের হলেও কৃতকর্ম (কুকর্ম?) এক ও অভিন্ন। তার কোনো স্থান-কাল-পাত্র নেই, ইতিহাস নেই। ‘এই চাঁদ আর পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হতে সংগ্রহ করে দেহের অভ্যন্তরে লুকিয়ে মানুষ পৃথিবীতে এসেছে তার কোন ইতিহাস নেই।’ এটা প্রাগৈতিহাসিক। বোম্বাইয়া হাজী আমিনুল্লার প্রথম স্ত্রী হাজেরার সাথে সতীন বর্মী বউ ম্রাচাং এর সম্পর্কও আমাদের মনে করিয়ে দেয় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু’র রহীমা-জামিলা সম্পর্কের কথা। নিঃসন্তান রহিমার মনে মাতৃত্বের তৃষ্ণা জেগে উঠে কন্যা বয়সী জামিলাকে কাছে পেয়ে। অগ্নিকোণে দেখি প্রাথমিক পর্যায়ের ঝগড়াঝাটি শেষ হবার পর লক্ষ¥ীমন্ত গার্হস্থ্য কর্মে নিষ্ঠ নানা গুণে গুণান্বিতা ম্রাচাঙের প্রতি হাজেরার অপত্য স্নেহ ঝরে পড়ে। মাতৃসম হাজেরা সতীনকে আপন করে নেয়। এভাবেই ঔপন্যাসিক আজাদ বুলবুল ব্যক্তি চরিত্রের সুখ-দুঃখ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, স্বপ্ন, দুর্জ্ঞেয় রহস্যময়তাকে এক একটি চরিত্রের রক্তেমাংসে সঞ্চালিত করে দিয়েছেন শৈল্পিক কৌশলের সঙ্গে। একজন সার্থক ঔপন্যাসিকের সফলতা ধরা দেয় বিষয় বক্তব্যোপযোগী ভাষা প্রয়োগে। ঔপন্যাসিক অগ্নিকোণে ভাষা ব্যবহারে কোনো নিরীক্ষার আশ্রয় নেননি। একেবারে সহজ সরল ভাষায় পাতার পর পাতা বর্ণনা করে গেছেন। তার ভাষা উপন্যাসের মত ভারি নয় হালকা, গতিশীল ভাষা সহজ সরল বলেই সহজ সুন্দর। চরিত্রের কথোপকথনে লেখক বিশেষ করে চাটগাইয়া মুসলিম চরিত্রগুলোর মুখে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে রাগ, অভিযোগ সংক্ষুদ্ধ, ক্ষোভ প্রকাশে চরিত্রগুলোকে খিস্তিখেউড় করতেও দেখা যায়। বোম্বাইয়া হাজী আমিনুল্লা আর মুনশি মিয়ার কথোপকথন – “বদ্দা তোঁয়ারা অইয়দে আল্লা অলা মানুষ। সারাক্ষণ ইবাদত বন্দেগি গর। মরণের পর বেহেশতত যাই হুর পরি লই ছোহবত গরিবা। ইতারার কাম ইতারারে গইততো দঅ।”
“চঁইয়ার কতা কয়দ্দে না তুঁই ? চোদন শিখোদ্দেনা আঁরে। আঁর বহুত পোয়া কচু ক্ষেতত্ ওঁয়া ওঁয়া গরের।ফুনি রাখ,দেশ বিদেশত ঘুরি আই বাল ফাগাই।”(পৃষ্ঠা ৮৭)
উপর্যুক্ত সংলাপে কিছু আপত্তিকর, অনুচ্চারণীয় শব্দের দিকে লক্ষ্য করে পাঠক হয়তো অশ্লীলতার প্রশ্ন উত্থাপন করবেন। মনে রাখতে হবে অশ্লীলতা সুনীতির কথা নয়, সুরুচির। অশ্লীলতা বিষয়ে নয়, উপস্থাপনায়। কাদের মধ্যে কথোপকথন হচ্ছে সেটাও বিবেচনায় থাকা চাই। চট্টগ্রামবাসীমাত্রই জানেন দুই বন্ধুর স্বতঃস্ফূর্ত কথোপকথনে উচ্চারিত আপত্তিকর গালিসমূহ কী স্বাভাবিক ও নির্দোষ এবং নির্মল আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটায়। লেখক উপযুক্ত চরিত্রের মুখেই নিপুণভাবে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ করেছেন। তবে উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে ভাষার উচ্চারণগত যে পার্থক্য -সেটা বিবেচনায় এনে কিছু আপত্তি তোলাই যায়। বিপ্লবী সূর্যসেনের মুখে কোনো আঞ্চলিক সংলাপ না দিয়ে ঔপন্যাসিক কি নেতার বিপ্লবে উদাত্ত আহ্বানের সার্বজনীনতাকে রক্ষা করতে চেয়েছেন?
৬৩ অধ্যায়ে বিভক্ত ৪৪৮ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসের প্রচ্ছদ অলংকরণ করেছেন শিল্পী উত্তম সেন। উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র সূর্যসেনের গুরুত্ব বিবেচনা করে হয়তো প্রচ্ছদের উপরিভাগে সূর্যসেনের ছবি মুদ্রিত। তবে এটি প্রীতিলতাসহ অন্যদের সাথে একত্রে স্থাপিত হলে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি বা সৌন্দর্যহানি ঘটতো না বলে বোধ হয়। চোখের জন্য বাড়তি স্বস্তির দিক হলো মুদ্রণ প্রমাদের অপ্রতুলতা, মুদ্রণপ্রমাদ নেই বললেই চলে। বইয়ের মূল্য কি আর একটু কমানো যেতো? নিম্ন মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা বলে কথা।
উপন্যাসের শেষে ঔপন্যাসিক প্রায় দু’শতাধিক ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গের নাম উল্লেখ করেছেন। সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে প্রায় ২৫ টির উপর গ্রন্থ ও বিশটির অধিক প্রবন্ধ-সাময়িক পত্রের উল্লেখ করে ঐতিহাসিক তথ্য ও ব্যক্তি সম্পর্কিত সম্ভাব্য যেকোনো বিতর্ক এড়াতে চেয়েছেন। এটাও লেখকের সততাকে চিহ্নিত করে।
দক্ষিণপূর্ব দিকের মধ্যবর্তী অগ্নিকোণ একটি প্রতীকী নাম। একদিকে পৌরাণিক অগ্নিদেব, অন্যদিকে অগ্নিপুরুষ সূর্যসেন। প্রথম দিনের সূর্য। আকাশজুড়ে সূর্যালোকের ঝিলিমিলি। মর্তলোকে সূর্যসেনের বিপ্লব এভাবে দেখলে ঐতিহাসিকতা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না-উপন্যাস শেষ পর্যন্ত উপন্যাসই। ইতিহাস নয়। উপন্যাস জীবনের ঘনিষ্ঠতম শিল্পমাধ্যম। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি “ইতিহাস পড়িব না আইভানহো পড়িব? ইহার উত্তর সহজ। দুই-ই পড়ো। সত্যের জন্য ইতিহাস পড়ো। আনন্দের জন্য আইভানহো পড়ো।” শেষ পর্যন্ত উপন্যাস ইতিহাস নয়, মানুষের আনন্দ বেদনার জীবনভাষ্য। আজাদ বুলবুলের মহাকাব্যিক ‘অগ্নিকোণ’ ইতিহাসের অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে ধারণ করেও শেষপর্যন্ত মানুষের যাপিতজীবনের সুখ দুঃখের, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের, পাওয়া না-পাওয়ার জীবনালেখ্যই, যার বহিরঙ্গে অগ্নিশিখা, অন্তরঙ্গে অশ্রুবিন্দু।
আ. ম. মামুন, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ