হানিফ ওয়াহিদ
ফারিয়ার বয়স যখন আঠারো, তখনই তার বিয়ের সম্পর্কটা আসে। পাত্রের বয়স তার চেয়ে দ্বিগুণ। প্রথম পক্ষের বউ আছে, প্রায় তার সমবয়সী সন্তানও আছে।
পাত্রেরা নয় ভাই। বিশাল পরিবার। সবাই উচ্চশিক্ষিত। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কাস্টম অফিসার, পুলিশ অফিসার, আইটি এক্সপার্ট সবই আছে তাদের পরিবারে। পাত্র ছাড়া সবাই শহরে থাকেন। পাত্র নিজেও একজন সিনিয়র অ্যাডভোকেট। ভবঘুরে জীবন যাপন করেন। তাবলীগ জামায়াতে অংশগ্রহণ করেন।
ফারিয়ার বাবা প্যারালাইজড হয়ে বিছানায়। একমাত্র উপার্জনক্ষম ভাই সৌদি আরবের জেলখানায়। বাবা মা পাত্রকে দেখলেন সোনার টুকরা হিসেবে।
ফারিয়া বেঁকে বসলো।
তারা তিন বোন দুই ভাই। প্রথম ভাইয়ের পর তিন বোন। তারপর ছোট এক ভাই। ফারিয়া বোনদের মধ্যে ছোট। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
তার বয়স যখন চৌদ্দ, তখনই লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়তে পেরেছিল, ছাত্রী হিসেবে সে ছিল ব্রিলিয়ান্ট।
স্কুলে পড়তে না পারলেও আউট বই পড়তো। বড়বোনের কল্যাণে হুমায়ূন আহমেদের বেশ কয়েকটা বই পড়েছে। আনোয়ার হোসেন, মোতাহার হোসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলামসহ, বহু লেখকের বই সে পড়েছে। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে সে বই এনে পড়তো।
টুকটাক কবিতা লিখতো একটা ডায়রিতে। গল্প লেখার চেষ্টাও চলতো।
তারা তিনবোন যথেষ্ট সুন্দরী। রাত্রে তিনজন জড়াজড়ি করে ঘুমাতো। কী যে ভালো লাগতো! কখনোই মনে হতো না, একজন আরেকজনকে ছেড়ে যাবে। মাঝে মাঝে গল্প করতে করতে রাত পার করে দিতো।
সময়ের ব্যবধানে দুইবোনের বিয়ে হয়ে গেলো। বড়বোনের ধনী পরিবারে বিয়ে হলো। সে তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। ফারিয়াদের কথা আর তার মনে রইলো না। প্রথম প্রথম তার বাড়ি যাওয়া হতো,তারপর আস্তে আস্তে যাওয়া কমে গেল। গরীবলোক হয়ে ধনী পরিবারে বেড়াতে যেতে সংকোচ লাগতো। তাদের পোশাক মলিন ছিল। বোনও বোধহয় তেমন পছন্দ করতো না। তার সাথে দূরত্ব তৈরী হয়ে গেলো।
মেঝো বোনের বিয়ে হলো মধ্যবিত্ত পরিবারে। সে মাঝে মাঝে খোঁজখবর রাখতো। সংসারের চাপে পড়ে সেও যোগাযোগ কমিয়ে দিলো।
ফারিয়া একা হয়ে গেল।
বাবা প্যারালাইসিস রোগী। ছোট ভাইটা এখনো সাবালক হয়নি। টুকটাক কাজ করে। বড় ভাই বিদেশের জেলে। মাকে সংসার চালাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়। এই সময় এমন পাত্র পাওয়া আর হাতের কাছে চাঁদ পাওয়া সমান কথা! তাছাড়া পাত্রের কোনো ডিমান্ড নেই। বিয়ের খরচ সে নিজে বহন করবে।
সে তার নিজের কথা, কষ্টের কথা কাকে বলে! একা একা কেঁদে বুক ভাসায়। গল্প উপন্যাসের পাতায় এমন কাহিনি সে পড়েছে,বাস্তবে তার সাথেও ঘটবে,চিন্তাও করে নাই।
সব’চে কষ্ট পেল বোনদের আচরণে। যে বোনদের সে জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসতো, তারা বিপদে এগিয়ে এলো না। তাদের কাছে সাহায্য চাইল, কেউ গুরুত্ব দিলো না। বিয়ে হয়ে গেলে অন্তত একজনের খাওয়া খরচ তো কমবে,এটাই হলো সবার চিন্তাভাবনা। এই সময় তাদের কোনো আত্মীয় স্বজনেরও দেখা পাওয়া না!
সে কাঁদতে কাঁদতে মাকে গিয়ে বলল, মাগো, এই সম্পর্ক তুমি ভেঙে দাও। আমি বাবার বয়সী কোনো লোককে বিয়ে করতে চাই না। তাছাড়া লোকটা তো বিবাহিত, আমার বয়সী তার মেয়ে আছে!
মা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন, গরীবের মাইয়ার আবার পছন্দ অপছন্দ! তুই রাজি হ, মা। ওদের অনেক টেকা পয়সা আছে। তুই রাজরানি হইয়া থাকবি।
ফারিয়া মায়ের হাত চেপে ধরে বলল, রাজরানি হইতে চাই না,মা। আমি সুখী হতে চাই।
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,টেকা ছাড়া সুখ নাই রে মা! টেকাই সুখ!
বাবার পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি মইরা যামু ,বাবা। আমারে এমন জায়গায় বিয়া দিও না।
প্যারালাইসিস রোগী বাবা শোয়া থেকে উঠার চেষ্টা করলেন,পারলেন না। মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,মা রে, লোকটা পরহেজগার লোক। তাবলীগ কইরা বেড়ায়। টেকা পয়সা আছে। খানদানি পরিবার। তুই অনেক সুখী হইবি,আমি তোরে দোয়া করতেছি! তাছাড়া তোর বিয়া হইলে জামাই তোর ছোট ভাইটারে একটা ব্যবসা ধরাইয়া দিবো। আমাগো সংসারে আর অভাব থাকবো না রে মা!
ফারিয়া চোখের পানি মুছতে মুছতে বাবার ঘর থেকে বের হয়ে এল। একবার মনে হলো বাড়ি থেকে দূরে চলে যায়,পরে মনে হলো এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একজন কুমারী মেয়ের জন্য নিরাপদ জায়গা কই? সব জায়গায় যে পুরুষ নামক কিছু শকুন ওত পেতে আছে!
গরিব ঘরের মেয়ে হওয়ায় সবাই সুযোগ নিতে চাইতো। তার বোনেরা সুন্দরী হওয়ায় অনেকেই আগ বাড়িয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিতো। রাস্তাঘাটে বিরক্ত করতো। তারা তিনবোন একসাথে স্কুলে যেত। ফলে বড়ো কোনো সমস্যায় পড়তে হয় নি। বোনদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সে সম্পূর্ণ একা হয়ে গেল। বয়সের তুলনায় শারীরিক গড়ন ভালো ছিল। অনেকেই সুযোগ নিতে চাইতো। বাধ্য হয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হলো।
একদিন শুক্রবার দুইজন স্বাক্ষীসহ লোকটা তাদের বাড়ি এলো। কাজী সাহেব বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। এতো খানদানি পরিবার অথচ তার পরিবারের কাউকে দেখা গেলো না।
বরের নাম অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম।
বিয়ের পর তাদের বাড়িতেই বাসর করতে হলো। কামরুলের গ্রামের বিশাল বাড়িতে তার প্রথম পক্ষের বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে। সেখানে তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। প্রথম পক্ষের বউয়ের বাপের বাড়ির লোকজনও বেশ ধনী। জামাইয়ের টাকা পয়সা না হলেও তার চলে যায়। তাছাড়া প্রথম পক্ষের বউকে এডভোকেট সাহেব বেশ ভয় পান। তিনি জানালেন, কিছুূদিনের মধ্যেই বাড়ি ভাড়া করে সেখানে তিনি তাকে উঠাবেন।
বাসর রাতেই কামরুল ফারিয়ার ওপর পুরুষত্ব দেখাতে চেষ্টা করলেন। সে রক্ষণশীল পরিবারে বড়ো হয়েছে। প্রেম ভালোবাসা, শারীরিক সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিলো একেবারেই কম। তারপরও তো কমবেশি বুঝে। ফারিয়ার মনে হলো,তার স্বামী একজন প্রায় নপুংশক! একজন নারীকে পরিপূর্ণ শারীরিক সুখ দিতে সে অক্ষম।
দুই.
এমন একজনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করা তার মতো মেয়ের জন্য কঠিন। তবে তার জন্য একটা সান্ত¡না, লোকটা তাবলীগ করে বেড়ায়। সে দেখেছে, যারা তাবলীগ করে বেড়ান,তারা মানুষ হিসেবে চমৎকার হন,বিনয়ী হন। তারা কখনোই অন্যকে কষ্ট দেন না।
লোকটাকে তার বিনয়ী বলেই মনে হলো।
স্বামীর লম্বা লম্বা দাড়ি,সব সময় পাজামা পান্জাবি টুপি পরে থাকতেন। নিয়মিত মেসওয়াক করতেন। তাকে পরহেজগার লোক বলেই মনে হতো। এমন একজন লোকের কেন তার বউয়ের সাথে, আত্মীয় স্বজনের সাথে বনিবনা হয় না, তা কিছুতেই মাথায় আসে না।
তিনদিন থেকে চলে গেলেন বড় বউয়ের কাছে। বড় বউকে তিনি সমঝে চলতেন,কেননা বড় বউকে খোরপোশ দেওয়ার দরকার হতো না, সে তার বাপের বাড়ির টাকা দিয়েই ভালো চলতে পারতো। তিনমাসে তিনদিন তিনি এ বাড়ি এলেন,তারপর ছয়মাসের জন্য তাবলীগে চলে গেলেন।
ভাই জেলখানায়, বাবা শয্যাশায়ী। এমন অবস্থায় ফারিয়া বাড়িতে মাটি কামড়ে পড়ে রইল। সেই দিনগুলি ছিল অবর্ণনীয় কষ্টের। তার পাশে কেউ ছিল না। সে কাঁদতো আর আল্লাহকে ডাকতো। আশেপাশের মানুষের অনেক কথা তাকে শুনতে হতো। তখন তার কাছে মোবাইল ছিল না, যে স্বামীর সাথে যোগাযোগ করবে।
ছয় মাস অবর্ণনীয় কষ্ট অপমান সহ্য করার পর তিনি আসেন এবং ফারিয়াকে একটা ভাড়া বাড়িতে নিয়ে রাখেন। তখন সে অন্তঃসত্ত্বা। প্রথম ছেলে তখন গর্ভে। তিনি কোথা থেকে যেন একটা কাজের মেয়ে জোগাড় করে নিয়ে আসেন।
ভাড়া বাড়িতে আসার এক মাস পরেই স্বামীর আসল চরিত্র ধরা পড়ে। তিনি কাজের মেয়েকে অশ্লীল প্রস্তাব দিতে গিয়ে ফারিয়ার হাতে ধরা পড়ে যান।
তার পিছু ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। কই যাবে সে? কে তাকে আশ্রয় দিবে? সে লজ্জায় অপমানে এই কথা কাউকে বলতেও পারে নাই। বললেও কেউ বিশ্বাসও করতো না,এমন পরহেজগার লোক এমন আচরণ করতে পারে!
একবার মনে হয়েছিল,এই সংসার নামক নরক যন্ত্রণা থেকে পালিয়ে যাবে। লেখাপড়া না জানা একটা মেয়ের জন্য দুনিয়া বড়োই কঠিন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো যোগ্যতা যেসব মেয়ের নেই,তাদেরকে পদে পদে অপমান, অবহেলা সহ্য করতেই হয়।
কামরুল ধনী পরিবারের সন্তান।
সদর থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে গ্রামে তাদের একটা বাড়ি আছে। সেই বাড়ি ঠিকঠাক করে তিনি বউকে সেখানে নিয়ে উঠালেন।
আধা সেমিপাকা বিশাল বাড়ি। নির্জন। গাছপালা ভরপুর। সেখানেই শুরু হলো একলা জীবন। স্বামীকে তেমন পেতো না। তিনি হুটহাট চলে যেতেন। ফিরতেন অনেকদিন পর।
সেই একলা জীবনে এখানেই পর পর দুটো সন্তানের জম্ম হয়। সন্তানের জম্মের সময় কেউ পাশে ছিল না,না নিজের বাড়ির লোকজন, না শ্বশুরবাড়ির কেউ!
এরমধ্যে বাবা মারা গেছেন। মা শয্যাশায়ী। বাড়ি থেকে যোগাযোগ করার মতো কেউ ছিল না। সেও যোগাযোগ রাখে নি। শ্বশুরবাড়ির নাক উচু লোকজন তার মতো তুচ্ছ মেয়ের খবর রাখতে যাবেন কেন!
আশেপাশে কথা বলার মতো কেউ ছিল না। গাছগাছালি, লতাপাতা, পশুপাখির সাথে সে সুখদুঃখের আলাপ করতো। মনে হতো তারা কথা বুঝতে পারে।
দুই বাচ্চাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করল। আল্লাহ তায়ালা তাকে এক ছেলে এক মেয়ে দান করেছেন।ওদেরকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে । যে ভুল সে করেছে,তা যেন তার মেয়েকে স্পর্শ না করে। ওর পায়ের নিচে শক্ত মাটি তৈরি করা না পর্যন্ত মরেও শান্তি পাওয়া যাবে না।
ফারিয়া যখন বাচ্চাদের মানুষ করার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে , মেয়ে জম্মের দুই মাসের মাথায় তার স্বামী একদিন বিকেলে তৃতীয় বউ নিয়ে হাজির!
তৃতীয় বউ দেখে তার মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। সে স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। মানসিক রোগী হয়ে গেল।
সে যখন পুরোপুরি পাগল হয়ে গেল,তার স্বামী চিকিৎসায় এগিয়ে এলো না। চোখের সামনেই তৃতীয় স্ত্রী নিয়ে ঘরসংসার করতে লাগলো। খবর পেয়ে ফারিয়ার ছোটভাই এসে নিয়ে গেলো।
বেশ কয়েক মাসের চিকিৎসায় সে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠল। এরমধ্যে স্বামী একবারও খোঁজ নেওয়ার দরকার মনে করলো না। ভাইয়ের অভাবের সংসারে ছেলেমেয়ে নিয়ে কয়দিন থাকবে সে?
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার স্বামীর বাড়ির দিকে রওনা দিল!
বিয়ের তিন মাসের মাথায় তালাক দিয়ে তৃতীয় বউ চলে যায়,লোকটা অক্ষম, নপুংশক বলে! যাওয়ার আগে সে পাড়ায় পাড়ায় এই কথা রটিয়ে দিয়ে যায়!
যে কাজটা ফারিয়া কখনোই করতে পারি নি,স্বামী প্রায় অক্ষম, লজ্জায় অপমানে কাউকে বলতে পারি নি, মেয়েটা অনায়াসে তা বলে দিয়ে যায়!
এতেও কামরুলের ভিতর কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখা গেল বলে মনে হলো না।
তিন.
তৃতীয় বউ চলে যাওয়ার পর সে কিছুূদিন শান্তু থাকে,তারপর আবারও চতুর্থ বিয়ের তোড়জোড় চলতে থাকে। ফারিয়ার মনে হয়, যারা সংকোচ ভেঙে একবার দ্বিতীয় বিয়ে করে ফেলতে পারেন, তৃতীয় বা চতুর্থ বিয়ে তাদের কাছে আর ব্যাপার মনে হয় না!
পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে,কিছুতেই তাদের শিক্ষা হয় না। তার স্বামী কামরুল এমনই একজন মানুষ। নপুংশক উপাধি দিয়ে,অপমান করে বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে, এটা তার কাছে বিষয় বলেই মনে হয় না। শুরু হয় সংসারে ঝগড়াঝাঁটি,মান অভিমান। সে কিছুদিনের জন্য আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ফারিয়া ছোট বাচ্চাদের নিয়ে আবারও মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। কই যাবে সে?
ছোটভাই বিয়ে করেছে। নতুন সংসার হয়েছে। তার দুঃখ শোনার মতো জগতে কেউ রইলো না।
বাবা মারা গেছেন,ভাইদের সংসার হয়েছে। ওদের ছেলেমেয়ে আছে। ওদের সংসারে বাড়তি বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার মানে হয় না। ভাইদের বউরা মেনে নেবে কেন? তাছাড়া বেশি লেখাপড়া জানা থাকলেও না হয় ভাইদের ওখানে গিয়ে নিজে কিছু করে চলতে পারতো। কিন্তু সে তো তা নয়!
শ্বশুরবাড়ির কেউ খবর নেয় না। ওদের ওখানে গিয়েও কোন লাভ হবে না। চোখের পানি ফালানো ছাড়া ফারিয়ার কোনো গতি রইলো না।
স্বামী কাউকে পাত্তা দেয় না,শুধু বড় বউকে ভয় পায়। বড় বউকে খোরপোষ দিতে হয় না, উল্টা বউ তাকে টাকা দেয়। মনে হয়, টাকার লোভেই সে বড় বউয়ের কাছে যায়,তার মন জুগিয়ে চলে!
কিছুূদিন পর কামরুল ফিরে আসলে ফারিয়া স্বামীর পা চেপে ধরে বলল, আপনার আল্লাহর দোহাই লাগে, সংসারে মনোযোগী হন। বাচ্চা দুইটারে আর কষ্ট দিয়েন না। ওরা তো কোনো অপরাধ করে নি। ওরা বাপের আদর ছাড়াই বড়ো হইবো?
কামরুল ফারিয়াকে আশ্বাস দেয়। সে এবার মন দিয়ে সংসার করবে।
তবুও ফারিয়া কান্নাকাটি করে। সে কথা দেয়, আর কোনো ঝামেলা হবে না ।
কয়েকটা দিন ভালোই কাটে।
একদিন অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, কামরুল চতুর্থ বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে।
আবার শুরু হয় সংসারে অশান্তি। ঝগড়াঝাঁটি চলতেই থাকে। ফারিয়া একদিন রাগের মাথায় চিৎকার করে বলল, ঐ হারামি,তুই কি আর মানুষ হবি না? বছর বছর তোর বিয়া করা লাগে কেন? তোর যদি এতোই বিয়া করার শখ, তাইলে আমাকে তালাক দিয়ে দে।
ফারিয়াকে অবাক করে দিয়ে কামরুল তালাক দিয়ে দেয়!
সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। স্বামীর হাতে পায়ে ধরে।
কামরুল খরপোষ বন্ধ করে দেয়।
এক ফোঁটা মাটি নাই, যেখানে অবলম্বন করে ফারিয়া দাঁড়াতে পারে। তাকে অনুনয় করে,তার ভিটেমাটি থেকে না তাড়ানোর জন্য। সে রাজী হয়। তার ভিটেতেই মাটি কামড়ে এককোণে পড়ে থাকে সে!
মানুষ বিপদে পড়লে খড়কুটোর আশ্রয় নেয়। সেও তাই করে। বিয়েতে পাওয়া কিছু গয়নাগাটি ছিলো। ওগুলো বিক্রি করে দেয়। কিছু হাঁস মুরগি এবং কয়েকটা ছাগল কিনে। শুরু হয় আরেক সংগ্রামী জীবন। সে কম শিক্ষিত হতে পারে,সহজে হারতে চায় না।
এই সংগ্রামে কেউ একফোঁটা অংশগ্রহণ করলো না,সাহায্য করলো না। সবাই অন্যের ভুল ধরতে পারে, কেউ ভালোবেসে এগিয়ে এসে সাহায্য করতে পারে না।
ফারিয়া সবসময় শুনে এসেছে,তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেশ ধনী। তাদের ধন সম্পদের অভাব নাই। একটা টাকা জাকাত নিয়েও এসে কেউ তার পাশে কোনোদিন দাঁড়ায়নি।
বিশাল বাড়ির এককোণে সেমি পাকা বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে থাকে। গয়না বেচার টাকায় একটা স্মার্ট ফোন কিনে। ফেসবুকে টুকটাক লেখালেখি করে। এতে অবসর সময়টা ভালোই কাটে।
হঠাৎ পাশের গ্রামের এক ছেলের সাথে ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ছেলের নাম রাজু। রাজু একদিন মোবাইলে মেসেজ দিয়ে জানায়, সে ফারিয়ার লেখা পড়ে মুগ্ধ। সে বন্ধু হতে চায়।
রাজু ছিল ফারিয়ার থেকে সাত বছরের ছোট। সে তাকে মজা করে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। ছেলেটা এক কথায় রাজি হয়ে যায়। সে তার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যায়। ফারিয়াও তাকে ফিরিয়ে দিতে পারে না। সে আবার নতুন যৌবন ফিরে পেতে শুরু করে।
সারাজীবনে, বিয়ের আগে বা পরে,ভালোবাসা কী জিনিস বুঝতে পারে নি। ছেলেটা তাকে ভালোবাসা শেখায়। ফারিায় যেন নতুন জীবন ফিরে পেল।
ফারিয়া নিজেই একদিন তাকে আমি বিয়ের প্রস্তাব দিল। রাজু এক কথায় রাজি । সে ভাবে, জীবনে কিছুই পায় নি,ওকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করলে মন্দ কী!
মা, ভাবী, আর এক খালাতো ভাইয়ের উপস্থিতিতে একদিন তারা বিয়ে করে ফেলে। ছেলেটা তাকে ভালোবাসা দিয়ে যেন পাগল করে ফেলল। একদিন সে ভালোবাসা না পেয়ে কেঁদেছে, এখন অতিরিক্ত ভালোবাসা পেয়ে কাঁদে।
অ্যাডভোকেট কামরুলের তখন করুণ অবস্থা। সেই বউও নেই। টাকা পয়সা জৌলুশ হারিয়ে সে নিঃস্ব। এখন আর নতুন ভ্রমরের সন্ধানে বের হতে পারে না!
ফারিয়া এখন তার চোখের সামনেই ভ্রমর নিয়ে ঘুরে!
চার.
কামরুল ছেড়ে দেওয়া বউকে ফিরিয়ে নিতে দেন দরবার শুরু করে। নতুন স্বামী সাজুকে অনুরোধ করে, ফারিয়াকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। সাজু রাজী হয় না। সেও তার কাছে ফিরে যেতে চায় না, কেননা সে তো জানে তার স্বামী কতোবড় লম্পট!
ফারিয়া একবার রোজার সময় তাকে হাতেপায়ে ধরে, কান্নাকাটি করে অনুরোধ করেছিল, সে যেন আর বিয়ে না করে। সে রোজা মুখে কথা দিয়েছিল। কথা রক্ষা করে না।
ফারিয়া তাকে মোটেই বিশ্বাস করতো না।
তখন এক ধরনের চায়না মোবাইল ছিল,ভয়েস পরিবর্তন করা যেতো। সে ভয়েস পরিবর্তন করে তাকে কল দিল। কয়েকদিন কথা বলতেই সে গলে গেল। ফারিয়া ভ- স্বামীকে প্রেমের প্রস্তাব দিল,সে সানন্দে রাজি হয়ে গেলো!
সে প্রায়ই তাকে কল দিতো এবং অশ্লীল কথাবার্তা বলতো। অথচ বাইরে সে আল্লাহ বিল্লাহ করে বেড়ায়!
একদিন সে সাথে দেখা করতে চাইল,কিন্ত জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। সে সিনিয়র অ্যাডভোকেট। অনেকেই তাকে চিনে। ফারিয়াকেই সে জায়গা নির্ধারণ করতে বলল। ফারিয়া কৌশলে একটা হোটেলে যাওয়ার প্রস্তাব দিল।
নির্দিষ্ট দিনে ভালো জামা কাপড় পরে, স্টাইলিশ বোরকা হিজাব চাপিয়ে মডার্ন সেজে সেই হোটেলে গেল। গিয়ে একটা রুম বুকিং দিল। হোটেলের ম্যানেজারকে ঘটনা সব খুলে বলল। তিনি অ্যাডভোকেট সাহেবকে চিনতেন। তাকে ভালো মানুষ হিসেবেই জানেন। ম্যানেজার সাহেব ফারিয়াকে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন।
ম্যানেজার আবার একটা পত্রিকায় স্থানীয় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন।
ফারিয়া যাওয়ার বিশ মিনিট পরই অ্যাডভোকেট সাহেব কোর্টে কাজ ফেলে হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির হলেন। ফারিয়া হিজাব নেকাব পরে থাকায় তাকে চিনতে পারলেন না। গদগদ হয়ে প্রেমালাপ শুরু করলেন। বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে চাইলেন। এদিকে মোবাইলে সব কথা রেকর্ডিং হচ্ছিল তা সে বুঝতে পারে নি।
কিছুক্ষন পর হিজাব নেকাব খুলতেই, সে চিৎকার দিয়ে মেঝেতে পরে গিয়ে বলল,’জায়েদের মা, তুমি এখানে’!
তাদের ছেলের নাম ছিল জায়েদ।
ফারিয়া চিৎকার চেঁচামেচি করে হোটেল কাঁপিয়ে তুলল, তাহলে চিনতে পারছিস শয়তান? এই তোর ভালোমানুষ হওয়ার নমুনা? তুই একটা বুইড়া খাটাশ, তোকে বিয়ে করে কী যে ভুল করেছি। শয়তান তুই আর মানুষ হবি না?,,,
কামরুল বউয়ের মুখ চেপে ধরল, জায়েদের মা, আমার ভুল হইছে, মাফ কইরা দেও। বিশ্বাস কর,এই ভুল আর হইবো না,,,,এই লাস্ট ওয়ান।
ফারিয়া ম্যানেজারকে ডাকল।
তার অশ্লীল কথাবার্তার সব রেকর্ড শোনাল। অ্যাডভোকেট সাহেব মাথা নিচু করে বসে রইলেন। ম্যানেজার হুমকি দিলেন, তিনি এই ঘটনা পত্রিকায় ছেপে দিবেন। লম্পট স্বামী ম্যানেজারের পা ধরে মাফ চেয়ে প্রতিজ্ঞা করলো,জীবনে সে আর এমন ভুল কাজ করবে না!
এরপরই সে চতুর্থ বিয়ে করে। এমন লোককে কী বিশ্বাস করা যায়?
এডভোকেট সাহেব সাজুর পরিবারে গিয়ে যোগাযোগ করলেন। তার সন্তানদের কথা চিন্তা করে তালাক দিতে বললেন।
ফারিয়াকেও তিনি তালাক দিতে চাপাচাপি শুরু করলেন। সে রাজি হলো না। সন্তানের দোহাই দিয়ে একটা লম্পট, নৃপুংশক স্বামীর সংসার করার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো মনে হলো।
তাদের উপর সামাজিক চাপ শুরু হলো। সাজু বলল,প্রয়োজনে আমরা এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবো,তবুও কেউ আলাদা হবো না। প্রয়োজনে মরে যাবো। চল ফারিয়া, আমরা পালিয়ে যাই।
বিচার গেলো স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে। একদিন এলাকার গণ্যমান্য লোকজন নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব বিচারে বসলেন। সবাই সাজুকে বুঝাতে লাগলো। সে বয়সে বউয়ের চেয়ে অনেক ছোট,তাছাড়া বাচ্চাকাচ্চা আছে। এমন একজন মহিলার সাথে ঘরসংসার করা তার উচিত হবে না।
তবুও সাজু বউকে ছাড়তে রাজি হলো না। সে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। সে একটা কথাই বারবার বলতে লাগল,আমি মরে যাবো! আমি মরে যাবো!!
চেয়ারম্যান এবং তার লোকজন বাধ্য করলো তাকে তালাক দিতে। সাজুর কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হলো, কিন্ত কারও হৃদয়ে সেই কান্না স্পর্শ করলো না!
অ্যাডভোকেট সাহেব ইদ্দত পালন শেষে ফারিয়াকে আবার বিয়ে করলেন।
সাজু তার কথা রেখেছিল।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এলাকার সবাই শুনতে পায়,সে মারা গেছে। বিষ পান করেছিল সাজু।
ফারিয়ার স্বামী এখন হিজড়া থেকেও অধম। মেয়ে মানুষ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। পরকীয়া, বিয়ে সবই বন্ধ হইছে। তাবলীগ করে বেড়ায়। সন্তানরা বাবাকে কাছে পায় না। এমনকি বছরে একটা দিন ঈদের দিনও নয়!
সারা বছরে একদিন ফোন করেও সন্তানের খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না!
ছাগল হাঁস মুরগি পালন করে ফারিয়া ভালোই আছে। সে স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছে। বাচ্চাদেরও স্কুলে ভর্তি করেছে।
জীবন এভাবেই এগিয়ে চলছে।
পাঁচ.
দিনগুলো ভালোই কাটছে ফারিয়ার। স্বামী থাকা আর না থাকা সমান হয়ে গেছে। এই লোক থাকলেও আপত্তি নেই, না থাকলেও আপত্তি নেই। মনে হয় সে সংসার থেকে বাঁচতেই তাবলীগ করে বেড়ায়। সংসার করেও তাবলীগ করা যায়, এটা সে বেমালুম ভুলে গেছে।
তবে সে সুন্দরী হওয়ায় বহু ভ্রমর তার পিছনে ঘুরঘুর করে। সে কাউকেই পাত্তা দেয় না। এলাকার মেম্বার সাহেব ইদানীং তার খোঁজ খবর একটু বেশিই করছে,যা তার পছন্দ নয়। লোকটার দুই বউ থাকা সত্বেও নারীর প্রতি ছোঁকছোঁক ভাব এখনো যায় নি।
সে অবসর সময় কাটায় ফেসবুকে অথবা বই পড়ে। টুকটাক গল্প কবিতা লিখে ফেসবুকে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। কতগুলো ফেসবুক সাহিত্য গ্রুপে সে যুক্ত হয়েছে। সেখানে লিখালিখি করে তার ভালোই উদ্যম বেড়েছে। পাঠকের প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝা যায় কিছু পাঠক তার লেখা ভালোই পছন্দ করছে।
তার মেসেঞ্জারে অনেক পুরুষ নক করে খাজুইরা আলাপ করতে চায়। সে কাউকে পাত্তা দেয় না। অনেকেই মানা করার পরও বিরক্ত করে। কেউ কেউ অশ্লীল ছবি ভিডিও পাঠায়। এসব করে তারা কী মজা পায় কে জানে!
একদিন ফেসবুক চালানোর সময় মেসেঞ্জারে টুং করে একটা মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা, আমরা কি পরিচিত হতে পারি? এই আইডি তার পরিচিত। তার প্রায় লেখায়ই সে লাইক কমেন্ট করে। উত্তর দেবে দেবে না মনে করেও উত্তর দিয়ে ফেলে,আপনার পরিচয়?
উত্তর আসে, আমি রাকিব, ‘উত্তর দক্ষিণ’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক।
ফারিয়া খুশিতে লাফিয়ে উঠে, পত্রিকা সম্পাদক নিজের ইচ্ছায় তার সাথে পরিচিত হতে চাইছে! এও সম্ভব!
জি ভাইয়া বলেন।
আপনার লেখা আমার মন কেড়েছে। আপনি তো চমৎকার লেখেন। আপনার আজকের লেখা কবিতাটা পড়ে আমি যারপর নাই মুগ্ধ হয়েছি। লেগে থাকলে একদিন আপনি ঠিকই ফাটিয়ে দেবেন।
ছিঃ ছিঃ ভাইয়া, লজ্জা দিচ্ছেন। আমি কবিতা তেমন বুঝি না। মনে যা আসে তাই লিখি।
কবিতা বুঝেন না তাতেই এই অবস্থা! বুঝলে না জানি কী হতো!
এই কথায় ফারিয়া গলে যায়। সে লিখে আপনাদের দোয়া ভাইয়া। আমার জন্য দোয়া করবেন।
রাকিব লিখে, অবশ্যই, অবশ্যই। আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার যাতে কবিতার বই বের হয় সেই ব্যবস্থা আমি করবো। আমি প্রকাশক খুঁজে দেবো। আগামী সপ্তাহে আপনার একটা কবিতা আমার পত্রিকায় ছাপা হবে।
এই কথা শুনে ফারিয়া গলে যায়।
এরপর প্রায়ই তাদের মধ্যে আলাপ হয়। রাকিব এখন নিয়মিত ফোন করে। ফারিয়া রাকিবের ফোনের জন্য অপেক্ষা করে। সে স্বপ্ন দেখে রাকিবের সাহায্য নিয়ে একদিন বড় লেখিকা হবে।
দিন যায় মাস যায়, রাতের পর রাত যায়, তাদের দুজনের মধ্যে নিয়মিত কথা হয়। পত্রিকায় কবিতা আর ছাপা হয় না। তাগাদা দিতেই রাকিব জানায়, এতো অস্থির হওয়ার দরকার নেই। সময় হলেই তার কবিতা পত্রিকায় ছাপানো হবে।
ফারিয়া আশায় বুক বাঁধে।
এক রাতে রাকিবের ফোন, কী করছো? তাদের সম্পর্ক আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে, রাকিবের আগ্রহেই।
ফারিয়া বলল, একটা গল্প লিখছি। একটা সাহিত্য গ্রুপে পোস্ট করবো।
শোন, আমি তোমাকে কিছু সাহিত্য সম্পাদকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই যাতে তোমার গল্প পত্রিকায় ছাপা হয়।
ফারিয়া উৎসাহিত হয়, তাহলে তো ভালোই হয়। দেখেন না, পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন কি না!
আরে, এটা কোনো ব্যাপার? কিন্তু এজন্য তো একদিন সময় করে ঢাকায় আসতে হবে।
ঢাকায় আসতে হবে কেন?
তুমি না আসলে ওদের সাথে পরিচিত হবে কীভাবে? শোনো,সাহিত্য জগৎ হয়ে গেছে এখন গিভ এন্ড টেক ব্যাপার। কিছু নিতে হলে কিছু দিতে হয়।
ফারিয়া উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, আমি গরিব মানুষ,কী দেবো?
রাকিব উৎসাহ দেয়, আরে টেনশন কইরো না। আমি আছি না! তুমি একদিন সময় করে আসো,আমি ওদের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেবো, ওরা আমার বন্ধু। আগামী সপ্তাহে একটা সাহিত্য উৎসব হবে, তুমি চলে আসো। সেখানে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।
ফারিয়া অন্যমনস্ক গলায় বলল, দেখি,,,
কোনো দেখাদেখি নাই। অবশ্যই তুমি আসবে। তাছাড়া তোমার সাথে আমার তো সরাসরি দেখা হয় নি। আমি তোমার অপেক্ষায় রইলাম।
এদিকে মেম্বার সাহেব খবর পাঠিয়েছেন, জরুরি দরকার আছে। ফারিয়া যেন অবশ্যই দেখা করে। ইউনিয়ন পরিষদের একটা পদ খালি হয়েছে। মেম্বার সাহেবের ইচ্ছা সেই পদে ফারিয়া যোগদান করে।
ফারিয়া ডিসিশন নেয়, সে মেম্বারের সাথে দেখা করবে না।
ছয়.
ঢাকার একটা বুক ক্যাফেতে সাহিত্য অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেখানে কবিদের স্বরচিত কবিতা পাঠ হচ্ছে। রাকিবের আগ্রহে ফারিয়া কবিতা পাঠ করে ব্যাপক হাততালি পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি হাততালি দিয়েছে রাকিব।
আজ সকালেই সে বাসা থেকে রওনা হয়েছে রাকিবের পীড়াপীড়িতে। রাকিব বাসস্টেশনে গিয়ে তাকে রিসিভ করে এখানে নিয়ে এসেছে। এখানকার প্রায় সবাই রাকিবকে চিনে। অনেকের সাথেই তার ঘনিষ্ঠতা আছে তা বুঝা যায়।
একের পর এক কবিতা পাঠ হচ্ছে, কবিদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা। সেই উত্তেজনায় কেউ কবিতা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। দর্শকদের মধ্যে বেশির ভাগই সেলফি তোলায় ব্যস্ত, কবিতা শোনায় তাদের আগ্রহ কম। ফাঁকে ফাঁকে চলছে চা পানের আসর। রাকিব দুইবার উঠে গিয়ে তার জন্য চা নিয়ে এসেছে।
নারী কবিদের অনেকেই আগ বাড়িয়ে এসে রাকিবের সাথে কুশল বিনিময় করছে। লেখা নিয়ে আলাপ করছে। রাকিব অনেককেই আশ্বাস দিচ্ছে, তাদের লেখা নিশ্চয় পত্রিকায় যাবে। অনেক নারী তো রাকিব ভাই রাকিব ভাই ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। অনেকে এসে তার সাথে সেলফি তুলছে।
বুঝা গেল রাকিব নারীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
কবি লেখকদের এই প্রথম তার কাছ থেকে দেখা। তার খুবই ভালো লাগছে। রাকিব অনেকের সাথেই তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফাইয়াজ। সে একজন কবি লেখক এবং সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা। যেচেই সে ফারিয়ার ফেসবুক আইডি চেয়ে নিয়েছে।
ফারিয়া তাদের সাথে পরিচিত হতে পেরে খুশি। তবে অনেকেই তার সাথে প্রথম আলাপেই ঘনিষ্ঠতা দেখাতে চাইছে কেন তা সে বুঝতে পারে না। কবিরা কি এমনই হয়?
রাকিব সারাক্ষণ আঠার মতো ফারিয়ার সাথে লেগে রইল। যেন তারা প্রেমিক প্রেমিকা। অনেক লেখককেই দেখা গেল রাকিবের প্রতি হিংসার দৃষ্টিতে তাকাতে। রাকিব যেন একদিনেই বন্ধুদের কাছে হিরে হয়ে গেছে।
ফারিয়া উসখুস করছে। বিকেলে গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাকে ফিরতে হবে। রাকিব যেন তাকে ছাড়তেই চায় না। বারবার পীড়াপীড়ি করাতে তারা দু’জনে বের হয়ে আসে। ফারিয়ার অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাকিব তাকে নিয়ে যায় একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। একটা নির্জন জায়গায় টেবিল খুঁজে বের করে সে।
ফারিয়া কখনো এসব চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আগে আসে নি। রেস্টুরেন্টের পরিবেশ তাকে মুগ্ধ করে। আলো আধারিতে অনেক প্রেমিক যুগলকে সে দেখতে পায় যারা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে।
রাকিব তাকে কেন এখানে নিয়ে এলো তা সে বুঝতে পারে না। তারা তো প্রেমিক প্রেমিকা নয়। তাহলে? সে বুঝতে পারে, রাকিব তাকে ইচ্ছে করে দেরি করাচ্ছে। সে কি তার প্রেমে পড়েছে?
রাকিব উসখুস করে বলল, তোমাকে একটা কথা বলি ফারিয়া। আজকে তুমি ঢাকায় থেকে যাও।
ফারিয়া অবাক হয়ে বলল, ঢাকায় আমি থাকবো কেন? আমার তো এখানে থাকার মতো কোনো আত্মীয় নেই।
আমি থাকার ব্যবস্থা করবো।
আপনি কীভাবে ব্যবস্থা করবেন? আপনি না মেসে থাকেন বললেন!
রাকিব ইতস্তত করে বলল,আমি তোমার জন্য হোটেলে একটা কামরা বুক করে রেখেছি।
ফারিয়া অবাক গলায় বলল,কেন?
আমি মনে করেছি, তুমি আজকে হয়তো বাসায় ফিরতে পারবে না,তাই।
ফারিয়া সরল মনে বিশ্বাস করে বলল, ও!
নানা পদের খাবার অর্ডার করে রাকিব। খেতে খেতে ফারিয়া বলল, রাকিব ভাই, আপনি তো কেবল আশ্বাস দিয়ে খালাস, আমার একটা কবিতাও তো পত্রিকায় ছাপালেন না। কোনো প্রকাশকের সাথেও পরিচয় করালেন না।
রাকিব খেতে খেতে বলল, এতো অধৈর্য হলে চলবে? আজকে রাতটা ঢাকায় থাকো, কালকে অনেকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। আর হা, একজন প্রকাশকের সাথে আলাপ হয়েছে। তুমি যে ভালো লিখো তা বলেছি, কিন্তু নতুন লেখক বলে টাকা ছাড়া বই প্রকাশ করতে চাচ্ছে না। প্রকাশকরা হারামি হয়ে গেছে, তারা ভালো লেখা চেনে না, টাকা চেনে।
ফারিয়া খেতে খেতে বলল, কেমন টাকা লাগতে পারে রাকিব ভাই?
ও নিয়ে তোমাকে টেনশন করতে হবে না। আমি খুব কম টাকায় করিয়ে দেবো। তুমি ফিরে গিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিও। আগামীকাল তোমাকে নিয়ে প্রকাশকের সাথে দেখা করতে যাবো।
ফারিয়া সফট ড্রিংকসে চুমুক দিতে দিতে বলল, তা হয় না রাকিব ভাই। আমাকে বাসায় ফিরতেই হবে। প্রকাশকের সাথে দেখা করেই কী হবে? আপনি আমার একটা লেখাও পত্রিকায় প্রকাশ করলেন না!
রাকিব হঠাৎ ফারিয়ার একটা হাত চেপে ধরে, প্লিজ, প্লিজ। তুমি তো জানো, আজকাল কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। এমনি এমনি কি কিছু পাওয়া যায়, বল? আজকে থাকো, কালকেই তোমার কবিতা পত্রিকায় যাবে।
এবার ফারিয়া বুঝতে পারে, রাকিব আসলে কি চায়। হঠাৎ তার শরীর রাগে জ্বলতে থাকে। প্রচ- জোরে চড় মারে সে বদমাশটার গালে। চেয়ার সুদ্ধ সে উল্টে পড়ে যায়। রেস্টুরেন্টের লোকজন অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। টেবিল পড়ে থাকা ভ্যানিটি ব্যাগটা সে উঠিয়ে নেয়। তারপর হনহন করে এগিয়ে যায় সামনের দিকে।
রাকিব হতভম্ব হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
সাত.
দুপর বেলা খাওয়াদাওয়ার পর দেবো না দেবো না করেও ধুরুধুরু বুকে ফারিয়া মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ লিখলো, কেমন আছেন?
দুপুর গেল,বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল,কোনো রিপ্লাই আসলো না। রাতে শুতে যাবার আগে আরেকবার মেসেজ চেক করলো, কোনো উত্তর আসে নাই।
ফারিয়া মন খারাপ করে উত্তর পাওয়ার আশা ছেড়ে দিল।
শোওয়ার পাঁচ মিনিট পরই টুংটাং আওয়াজ পেয়ে ফারিয়া লাফিয়ে উঠে মোবাইল চেক করলো। উত্তর এল, আপনি কে?
ফারিয়া সংকোচ ফেলে দিয়ে লিখলো,আমি ফারিয়া। একটা সাহিত্য অনুষ্ঠানে আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। রাকিব পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এখন চিনতে পারছেন?
জি, জি। অবশ্যই চিনেছি। আপনি ভালো আছেন?
ভালো আছি। আপনার আইডিতে ঢুকে আপনার লেখা পড়লাম। চমৎকার লিখেন আপনি। আমি আপনার লেখা পড়ে মুগ্ধ। আমি তো আপনার ফ্যান হয়ে গেছি।
আরে না, কী আর এমন লিখি।
না না, আপনি আসলেই ভালো লিখেন। আগামী বইমেলা থেকে আপনার বই সংগ্রহ করে পড়বো।
ধন্যবাদ, আপনিও নিশ্চয় ভালো লিখেন। আপনার লেখা এখনো পড়া হয় নি। সময় নিয়ে পড়বো।
ফারিয়া লজ্জিত হয়ে লিখলো,না না, আমার লেখা পড়ার মতো নয়। আমি এখনো শিখছি।
শিখতে শিখতেই একদিন হাত পেকে যাবে। আমার একটু তাড়া আছে। আরেকদিন কথা বলি?
আচ্ছা, ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
আপনিও।
এভাবেই সম্পর্ক গড়ে উঠে ফাইয়াজ আর ফারিয়ার। ফারিয়ার আগ্রহেই।
সে মনেপ্রাণে লেখক হতে চায়। সে আগ্রহ থেকেই সম্পর্ক গড়া। যদি এদের সাহায্য নিয়েও কিছু হয়। ফাইয়াজ ক্ষমতাবান মানুষ। নিশ্চয় তার অনেক জানাশোনা।
এরপর থেকে প্রায়ই রাতে ফারিয়া ফাইয়াজকে নক দেয়। দিনে ফোন দিতে ফাইয়াজ নিষেধ করেছে।
কথায় কথায় জানা যায়,সে বিপতœীক। দুই বছর আগে স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় বিচ্ছেদ হয়েছে। স্ত্রী একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে।
একদিন কথায় কথায় ফাইয়াজ বলল, রাকিব কি আপনার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু?
ফারিয়া বলল, কেন?
না, এমনিতেই কৌতূহল থেকে প্রশ্নটা করা।
ফারিয়া চাইনিজ রেস্টুরেন্টের ঘটনা চেপে গিয়ে বলল, আরে না, সে একটা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। সে হিসেবে জাস্ট পরিচয়।
আচ্ছা, আমি ভাবছিলাম আপনাদের মধ্যে কোনো গভীর সম্পর্ক আছে।
ফারিয়া উদাস গলায় বলল, না,না, আমাদের মধ্যে তেমন কিছুই নাই। ¯্রফে বন্ধুত্ব হয়েছিল।
হয়েছিল? এখন নাই? আপনাকে একটা কথা বলি,যদিও অযাচিত হয়ে যায়। এই রাকিব লোকটা বেশি সুবিধার মানুষ নন। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। আসলে সে ভুয়া সম্পাদক। এই পরিচয় দিয়ে সে নারীদের সাথে সম্পর্ক করে বেড়ায়। আসলে সে একজন প্রতারক। ওর সাথে লেনদেন করেন নি তো?
না। তবে একজন প্রকাশকের সাথে আলাপ করিয়ে দেবে বলছিল। ফেসবুকে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। আমাদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক নাই। উনাকে আমি ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ডিলিট করে দিয়েছি। উনার আচরণ আমারও ভালো লাগে নি। আচ্ছা, আপনার একটা পোস্ট দেখলাম, আগামী পরশু একটা গ্রুপ আপনাকে সংবর্ধনা দিচ্ছে,,,
ফাইয়াজ হাসতে হাসতে বলল, আমার এখন অনেক পাওয়ার, তাই না চাইলেও লেখক হিসেবে বহু গ্রুপ আমাকে সংবর্ধনা দেয়। আমারও ভালো লাগে,যদিও খুব একটা ভালো লিখি না। ভাবছি চাকরি থেকে অবসর নিলে কী হবে। তখন তো আমি শত ভালো লিখলেও এরা কেউ ফিরে তাকাবে না। এরা তো আমাকে সন্মান দেয় না, সম্মান দেয় পাওয়ারকে।
এভাবে ভাবছেন কেন? ওরা তো সত্যি সত্যিই সম্মান করতেও পারে।
ফাইয়াজ এবারও হেসে উঠল, আপনিও কি সত্যি সত্যি সম্মান করেন?
নিশ্চয়। আমি তো আপনার ভক্ত।
তাহলে পরশুদিন চলে আসুন অনুষ্ঠানে। আমার চেয়ে অনেক গুণী মানুষের দেখা পাবেন। দেখা সাক্ষাৎ হউক। কী আসবেন?
ফারিয়া উদাস গলায় বলল, দেখি।
কথা শেষ করেই দেখে, স্বামী কামরুল দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে উৎসুক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালো। ইদানীং কামরুলের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সে এখন বাচ্চাদের সময় দেয়। নিয়মিত কোর্টে যায়। আয় ইনকাম ভালোই। তবে বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। তার এই পরিবর্তন ভালোই লাগে। হয়তো সে সত্যি সত্যি ধর্মের পথে ফিরে এসেছে। তবে তাদের মধ্যে কথাবার্তা খুবই কম হয়।
কামরুল ফারিয়ার পাশে বসতে বসতে বলল, একটা কথা বলার ছিল।
ফারিয়া আবারও উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল।
অনেকদিন তো হলো বাসায় আছি। ভালো লাগছে না। আমি কিছুদিনের জন্য আবারও তাবলীগে যেতে চাই।
ফারিয়া কোনো জবাব দিল না। সে ভালো করেই জানে, বাধা দিয়ে লাভ নাই। কামরুল যাবেই।
সে ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, বাচ্চারা তোমাকে এতো পছন্দ করে…
কামরুল বউয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিল, আমি তো আর একেবারেই পালিয়ে যাচ্ছি না। তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো।
ফারিয়া আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ঠিক আছে, যাও।
কামরুল কামরা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সে মনে মনে ডিসিশন নিল, ফাইয়াজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাবে।
আট.
চারপাশে অনেক লোকজন। সবাই অচেনা। সরকারি কমকর্তা, লেখক, কবি, সাংবাদিক সবাই উপস্থিত। ফাইয়াজ একবার মঞ্চ থেকে উঠে এসে দেখা করে গেছে।
বক্তৃতা পর্ব চলছে। নামকরা লেখক কবিরা ফাইয়াজের লেখার ব্যাপক প্রশংসা করছে। অনেকেই তাকে নজরুল রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছে।
একেকজনের বক্তৃতা পর্ব শেষ হতেই হাততালির বন্যা বয়ে যায়।
একা একা বসে থাকতে ভালো লাগছে না। কেউ তার পরিচিত নয়। ফারিয়া কার সাথে কথা বলবে?
অনুষ্ঠান শেষ হতেই অনেক মানুষ ফাইয়াজকে ঘিরে ধরে সেলফি তোলার জন্য। ফারিয়া সেদিকে তাকিয়ে হাসে। সেই হাসি চোখ এড়ায় না ফাইয়াজের। সে তাকে ইশারায় ডাকে। ফাইয়াজ নিজের মোবাইল বের করে ফারিয়ার সাথে ছবি উঠিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। পিছনে পিছনে আসে ফারিয়া।
ফাইয়াজ তাকে একটা দামি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে খেতে খেতে আলাপ হয়। ফারিয়া তার প্রতিটি কথা মুগ্ধ হয়ে শুনে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আহা! তার জীবনে যদি এমন একজন সফল পুরুষ আসতো!
এরপর থেকে প্রায়ই নানা জায়গায় তাদেরকে একসাথে দেখা যায়। ঢাকার যেকোনো সাহিত্য অনুষ্ঠানে দুইজনকে একসাথে পাওয়া যায়। ফাইয়াজ নক দিলেই ফারিয়া সুড়সুড় করে চলে আসে।
এখন নিয়মিত নানা পত্রিকায় ফারিয়ার লেখা প্রকাশিত হয়। মাসিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকরা এখন ফাইয়াজের লেখার পাশাপাশি ফারিয়ার লেখাও ছাপাতে বাধ্য হন। অনেকেই বুঝে যান, একজন ছাড়া আরেকজনের লেখা পাওয়া যাবে না।
লেখক পাড়ায় গুঞ্জন উঠে, তারা গোপনে বিয়ে করেছেন। কেউ কেউ বলেন, তারা লিভ টুগেদার করছেন। তাদেরকে ইদানীং একসাথে মার্কেটেও দেখা যায়।
তাবলীগ জামায়াতে থেকেই বউয়ের বিষয়ে কিছু কিছু কথা কানে চলে আসে অ্যাডভোকেট কামরুলের। সে তাবলীগ সংক্ষিপ্ত করে বাসায় চলে আসে।
কামরুল যেন কিছুই হয় নাই এমন ভাবে খাওয়া দাওয়া শেষ করে। খানা পর্ব শেষ করে স্ত্রীকে কাছে ডেকে তেজের সাথে বলল, শুনলাম ইদানীং তুমি ঘনঘন ঢাকায় ছুটে যাও, বিষয় কী?
ফারিয়া বলল, আমি লেখালেখি করি, তাই মাঝেমধ্যে যেতে হয়।
অকারণে মেয়েছেলের বাইরে যাওয়া ঠিক না। গুনাহ হয়।
আর বউ রেখে অকারণে বারবার বিয়ে করলে, তাবলীগে মাসের পর মাস পড়ে থাকলে বুঝি খুবই সওয়াব হয়?
কামরুল রেগে গেল, বোকা মেয়েছেলের মতো কথা বলবা না। ইসলামে পুরুষ মানুষের একাধিক বিয়ে করা জায়েজ আছে। অকারনে মেয়েছেলে বাইরে যাওয়া জায়েজ নাই।
আমি তো অকারণে যাচ্ছি না, লেখালিখির কারনে যেতে হয়।
এখন থেকে লেখালিখিও বন্ধ, বাইরে যাওয়াও বন্ধ। মেয়েছেলের বাইরে যাওয়া শরীয়তে বিধান নাই।
ফারিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে যায়। এর সাথে তর্ক করতে ভালো লাগছে না। একে স্বামী হিসেবে মানতেও ইচ্ছে করছে না। সংসারে মন দিতেও ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে কোথাও পালিয়ে যেতে। কিন্তু যাবে কই?
মোটামুটি বেশ কয়েকটা পত্রিকা এখন নিয়মিত তার লেখা ছাপছে। কয়েকজন সাহিত্য সম্পাদকের সাথেও যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। লেখা শুধু ইমেইল করে দিলেই কাজ হয়ে যায়।
ফাইয়াজ ইদানীং খুবই ব্যস্ত। তাকে কমই পাওয়া যায়। মঝেমধ্যে মেসেঞ্জারে টুকটাক আলাপ হয়।
একদিন ফেসবুক স্ক্রোল করতে করতে একটা অনলাইন পত্রিকার নিউজ তার সামনে চলে আসে। তাতে লেখা, গতকাল এই সময়ের জনপ্রিয় লেখক ফাইয়াজ আহমেদের বাগদাদ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে।
সাথে দুজনের হাসিখুশি যুগল ছবি।
খবরটা পড়ে সে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে।
এর এক সপ্তাহ পর একটা জাতীয় পত্রিকার ভেতরের পাতায় ছোট্ট একটা নিউজ হয়, এই সময়ের উদীয়মান লেখিকা ফারিয়া আক্তার নিজ বাসায় আত্মহত্যা করেছেন।
তার এই রহস্যময় মৃত্যুর কারণ এখনো জানা যায় নি।
হানিফ ওয়াহিদ, রম্য সাহিত্যিক