এখন সময়:রাত ৯:০৯- আজ: শনিবার-১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ৯:০৯- আজ: শনিবার
১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

অন্তরের অনুরণন

সৈয়দ মনজুর কবির

 

আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ফোর্ট লুডারডেল হলিউড ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। দুপুর ২.৪৫ মিনিট। প্লেন থেকে নেমে ফ্লিন্ট ববকে নিয়ে কার পার্কিং এ দাঁড়িয়ে আছে। গন্তব্য সংরক্ষিত প্রাকৃতিক এলাকা পাইন আইল্যান্ড রিজ। ওখানেই প্লান্টেশন জেনারেল হাসপাতালের বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী মিস ইমানুয়েল স্যান্ডি থাকেন। পার্কিং-এ দাঁড়ানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কালো নিশান এক্স ট্রেইল জিপ এসে দাঁড়ায় ওদের সামনে। ঝকঝকে সাদা সাফারি পরা অল্প বয়সী ড্রাইভার দ্রুত নেমে এসে হাসি মুখে বলে, আমাকে ক্ষমা করবেন। পথে পাহাড়ের কিছু নূড়ি পাথর রাস্তায় গড়িয়ে পড়ায় রাস্তায় গাড়ি চলাচলে সাময়িক বাধা আসে। ওগুলো সরাতেই সময় নষ্ট হয়ে যায়। আর এখানে সময় মতো পৌঁছাতেও দেরি হয়। আমি ভীষণ দুঃখিত।

ফ্লিন্টকে অবাক করে খুবই স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে বব, আরে না, না। কই তেমন তো কিছু হয়নি। তোমার দুঃখ পাবার কোনই দরকার নেই। আমরা কিছুই মনে করি নি। আচ্ছা, এখন চলো – আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে।

ববকে লক্ষ্য করে ফ্লিন্ট। এই এমন স্বাভাবিক আচরণ শুরু হয় যখনই ওরা ফ্লোরিডার আকাশসীমায় প্রবেশ করে। এর ঠিক সেকেন্ড সময় আগেও চরম অস্থিরতায় ছিল।

 

ববের সাথে অনেকটা বিস্ময় নিয়েই গাড়িতে উঠে বসে। আর হাস্যোজ্জ্বল ড্রাইভার ঝটপট ব্যাগগুলো গাড়িতে তুলেই ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে দ্রুত গতিতে।

সোজা পাহাড়ি রাস্তার পাশে হঠাৎই কিছুটা ফাঁকা। প্রকৃতির তৈরি খুবই সরু উপত্যকার উপর দিয়ে যে রাস্তা পাহাড় ভেদ করে ভিতরে চলে গেছে সেই পথেই গাড়িটা  উঠে এলো। সরু রাস্তার দুপাশের উঁচু উঁচু বার্চ ট্রিগুলো এক দৃষ্টিতে দেখছিল বব। কি সুন্দর সেই স্বাভাবিকতা। ফ্লিন্টের কাছে কেবলি যেনো এক অজানা আশা উঁকি দিচ্ছে। হয়তো এই ফ্লোরিডাই হবে প্রিয় বন্ধুকে পুনরায় ফিরে পাবার জায়গা। মনে হচ্ছে এবার হয়তো বন্ধু সম্পূর্ণ সেরে উঠবে। চোখ ক্রমশ ভিজে আসছে ফ্লিন্টের। বন্ধু আসলে কেমন হয়? মাঝে মাঝেই ভীষণ ভাবায় ওকে। সেই ছোট্ট বেলায় ওদের গাড়ি দুর্ঘটনায় সে মা বাবা দুজনকেই হারালো, তখন দাদা ওর দ্বায়িত্ব নিয়ে নেয়। আর একজন ওর জীবনের সাথী হিসাবে আসে – সে হলো এই বব। কোস্টারিকার এক সুন্দর গ্রামে দুজনেই বড় হতে থাকে। স্কুল জীবন থেকেই তুখোড় মেধাবী আর এক আকাশ সমান কল্পনার জগতে ভাসছে এই বব। ওর অনুরোধেই সেও কোস্টারিকা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে হয় গ্র্যাজুয়েট। বব কল্পকাহিনির বাস্তব রূপ দিতেই হয়ে উঠে পরের তিন বছরেই অসাধারণ এনিমেশন এক্সপার্ট। তৈরী করে ছোটদের শিক্ষা বিকাশে সহায়ক এক অনন্য এনিমেশন প্রোগ্রাম। পৃথিবীর মানুষও তাকে মূল্যায়ন করতে এতটুকুও ভুল করেনি। ইউনেস্কো থেকে ববের হাতে তুলে দিয়েছে বছরের সেরা স্বীকৃতি এই তো দুবছর আগেই। আর পেয়েছে ওয়াল্ট ডিজনি প্রোডাকশন থেকে এনিমেটেড মুভি ফরমেশন বিভাগের প্রধান পদটি। বন্ধু বলে কথা – বব-ই তো কিভাবে যেন শর্ত তর্ট দিয়ে আই টি বিভাগে তারও ঢোকার ব্যবস্থা করে ফেলে। যোগদান করার কথাও ছিল চার মাস আগেই। কিন্তু কি হতে যে কি হয়ে গেলো। এমন হাসিখুশি বন্ধুর জীবনই হঠাৎ  হয়ে গেলো ওলটপালট। তার মানসিক অবস্থা এমনি খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে যে এখন কাউকেই সহ্য করতে পারছে না। তবে ভাগ্য ভালো মাঝে মাঝে শুধু ফ্লিন্টকেই সহ্য করছে। সেই সাথে মেনেও নিচ্ছে কিছু কিছু আবদারও। সেই সামান্যতম অংশের সুবাদেই আজ তারা মনোবিজ্ঞানী মিস স্যান্ডির নিজ পাহাড়ি বাড়িতে যাচ্ছে। এখানেও ফ্লিন্টের মনে একটু খটকা থেকেই গেছে। কারণ ববের মানসিক পরিস্থিতি কথা এই মিস কীভাবে জানলেন? আর যিনি সব সময় হাসপাতালের চেম্বার ছাড়া কাউকে দেখেই না, সেখানে নিজ থেকেই ববকে তার নিজের বাড়িতে ডেকেছেন। এসব মাথায় ঢুকেছিল তবে বন্ধুর ভালো হবে আশ্বাস পেয়ে দ্রুত কোস্টারিকা থেকে প্লেনে উঠেছে। কত কিছুই না করছে বন্ধুর জন্য। এবার যদি…..

স্যার, দয়া করে নামবেন কি। আমরা এসে গেছি। ম্যাডাম আপনাদের অভ্যর্থনা জানাতে নিজেই এসেছেন, ওই যে উনি, ড্রাইভার হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলো।

ফ্লিন্ট ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে দেখতে পায় ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। ওর একটু দুরেই এক মধ্য বয়সী মহিলাও দাঁড়িয়ে আছেন। ইনিই মিস স্যান্ডি! সে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে মহিলার দিকে হাত বাঁড়িয়ে দিলো।

কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাস্যমুখী মহিলাটি হাত বাড়িয়ে বললেন, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য পাইন আইল্যান্ড রিজে আপনাকে স্বাগতম। আপনিই বোধ হয় মি. ফ্লিন্ট। তো আপনার প্রাণ প্রিয় বন্ধুটি কোথায়?

হাঁ আমিই ফ্লিন্ট। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, কথাটা বলতে বলতেই বব যেখানে বসেছে সেদিকে তাকায়। আর তার কথাও বন্ধ হয়ে যায়। দেখে সেখানে বন্ধু নেই।

এবার ড্রাইভারের এর দিকে তাকাতেই বলল, উনি তো গাড়ি থামতেই নেমে বাড়ির দক্ষিণ দিকটার দিকে হাঁটতে থাকলেন। আমি ভাবলাম সৌন্দর্য্য দেখার জন্যই বোধ হয় যাচ্ছেন। ওদিকের ভিউটা আবার খুবই সুন্দর কিনা।

মিস স্যান্ডি তাড়াতাড়ি বললেন, তাহলে আমাদেরকেও তো ওদিকেই যেতে হয় মি. ফ্লিন্ট।

হাঁ হাঁ, তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিত। ওর যা অবস্থা, তাতে আবার কি না কি হয়ে যায়।

না না, আর খারাপ কিছু ভাববার কোনো প্রয়োজনই নেই। এখন যা হবে, সব ভালোই হবে। আপনি নিশ্চয়ই  প্লেন থেকে নামবার আগেই বব এর কিছু পজিটিভ পরিবর্তন দেখে ফেলেছেন।

ফ্লিন্ট ওনার শেষ কথাটা শুনে ওর বিস্ময় ভাবটা আটকাতে পারলো না। বলেই ফেললো, কিক্ কি? কি বললেন?

মানে বলতে চাচ্ছি, ববের মাঝে কি কোনো শান্ত শান্ত ভাব লক্ষ করেছেন?

হাঁ, হাঁ। বিশ্বাস করেন, ফ্লোরিডার আকাশে প্লেন আসা মাত্রই ওর মাঝে অস্থিরতা নিভু হয়ে গেলো। কার পারকিং এ ড্রাইভার এর সাথে খুবই স্বাভাবিকভাবেই কথা বললো। আর এখানে আসার পথে কি সুন্দর দৃষ্টিতে প্রকৃতি দেখছিল। আচ্ছা, আসলে ব্যাপারটা কি হচ্ছে? আপনি কিভাবে ওর ব্যাপারে এগুলো বলছেন?

আসলে তেমন কিছু না। ওই আপনাদের কোস্টারিকার স্বনামধন্য মনোবিজ্ঞানী ড. রিচার্ড এর পাঠানো কেস স্টাডি রিপোর্ট থেকে যতটুকু জানা।

ও হা, ড. রিচার্ডই তো বব এর চিকিৎসক। আপনি ওনাকে পেলেন কিভাবে?

ও আমার প্রিয় ছাত্রের মাঝে অন্যতম একজন। ওর কাছ থেকেই মেইলের মাধ্যমে জানলাম। অবশ্যই একটা কারণ বশতঃ ববকে সরাসরি দেখার জন্য আপনার সাথে যোগাযোগ করি। আচ্ছা, বব এর ব্যাপারে আপনি কি সব খুলে বলতে পারবেন। যদি নতুন কিছু জানা যায়।

মুখ হা করে ফ্লিন্ট কথা শুনছিল। ভাবছে ইনি তাহলে আমাদের রিচার্ড সাহেবের কাছেই শুনেছেন। কিন্তু সেটা প্রথম অনুরোধ কার কাছ থেকে গেছে? রিচার্ড সাহেব যতদূর সম্ভব নিজস্ব কেস শেষ পর্যন্ত নিজেই দেখেন। কদাচিৎ বেশি খারাপের দিকে গেলে অন্যের পরামর্শও নাকি নেন। এ ক্ষেত্রে কি হয়েছে? আর মিস স্যান্ডি শুধু ই-মেইলে প্রাপ্ত পেপার ওয়ার্ক দেখেই এতোখানি আত্ম বিশ্বাসের সাথে কীভাবে ববের এখনকার আচরণ বলছেন। তাহলে কি ইনি ববকে সহজেই ভাল করে তুলতে পারবেন?

এসব ভাবনার মাঝেই বাধা পড়ে মিস স্যান্ডির কথায়, আমি কিন্তু অপেক্ষা করছি মি. ফ্লিন্ট।

ও হাঁ হাঁ। বলছি বলছি। আপনি তো আগেই জেনেছেন আমার আর ববের সাথে বন্ধুত্বের গভীর সম্পর্কটা। আর লিজ এর সাথে প্রথম পরিচয় হয় দু বছর আগে নিউ ইয়র্কে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে। বব তখন তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ওয়ার্ল্ড বেস্ট এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করতে গেছে। লিজ হলো আসলে মেক্সিকান নাগরিক আর পেশায় আর্কিটেক্ট। পেশাগত কারণেই গিয়েছিল ইউনেস্কোর অনুষ্ঠানটির স্ট্রাকচারাল নির্দেশক হিসেবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন দুজনের হঠাৎ সামনাসামনি হয় তখন দুজনেই একে অপরের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল প্রায় বিশ সেকেন্ড। মনে হচ্ছিল ওরা দুজনকে অনেক অনেক বছর ধরে চেনে। সবাই প্রথম পরিচয়ে হাত মেলায়, আর ওরা হয়েছিল আলিঙ্গন বদ্ধ। তারপর মাস তিনেক বাদেই দুজনে বিয়ে করে। বব আার লিজ উঠে আসে ববের কোস্টারিকার নিজ পৈত্রিক বাড়িতে। একে অপরের মাঝে ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। সময় গড়ায়। লিজ ওখানেই ছোট খাটো কাজ পেয়ে গেলো। আর বব নিজের ছোট্ট ক্রিয়েটিভ ফার্মটি চালাচ্ছিলো। মাস চারেক আগে ওয়াল্ট ডিজনি প্রোডাকশন থেকে ববের নতুন চাকরির অফার আসে। কিন্তু, সে তো একা আমেরিকা পাড়ি দিতে নারাজ। তখন লিজও হলিউডের প্রসিদ্ধ ইন্টেরিওর প্রতিষ্ঠানে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে ফেলে। কন্ট্রাক্ট সাইন করতে যেতে হবে সেখানে। ববের সামান্য কিছু কাজ গোছাতে বাকি ছিলো, তাই ঠিক হলো লিজ একাই যাবে। তিন দিন পরেই বব সেখানে যাবে।

এই বার মিস স্যান্ডি কথা বলে উঠেন, কিন্তু আপনি তো বললেন মি. ফ্লিন্ট, ওরা একে অপরের এতো আপন, তো লিজ কে একা যাওয়ার অনুমতি দিল কিভাবে বব?

দিতে তো চায়ই নি বব। কিন্তু পরিস্থিতি তেমন ছিল  না। ববের কাজ গোছানোর তাগিদেই কয়েকবারই ওই প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করে করে লিজের যাওয়া পেছানো হয়েছিল। কিন্তু আর পারা গেলো না। এদিকে ববও সব গুছিয়ে নিয়েছিল, শুধু সামান্য একটু ঝামেলা হওয়ায় ও সেই তারিখে এক সাথে হওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। নতুন ঠিকানায় এক সাথে থাকার সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখতেই লিজই শেষমেশ একাই যাবে তা বব কে রাজি করালো। এদিকে আরেকি বিষয়ও দুজনকেই ভাবিয়ে তুললো। আর সেটা হলো, লিজ তখন মা হতে চলেছে। সাত মাস চলছিল।

বলেন কি, ওই সময় লিজ একা যাওয়ার সাহস পেলো কিভাবে? মিস স্যান্ডি অবাক হয়ে বললেন।

আমি জানি না, ফ্লিন্ট আবার বলতে শুরু করল – কিভাবে কি হলো। আমি একটু আপত্তি করে ছিলাম। কিন্তু লিজ বললো, অসুবিধা হবে না। তখনতো শুধু কন্ট্রাক্ট সাইন ব্যাপার। আর কাজ করা বলতে তখন কিছু পেপার ওয়ার্ক ছিল। কথা ছিল সন্তান জন্মের পরেই সরেজমিনে কাজ করবে। এই তো এই ভাবনাই লিজ সেদিন প্লেনে উঠে। ববের সহযোগিতায় আমিও ওয়াল্ট ডিজনি প্রোডাকশনে সিস্টেম অপারেশনে চাকরি পেয়ে যাই। আমি তিন সপ্তাহ আগেই ওখানে জয়েন করেছিলাম। আমি নিজেই বব আর লিজের থাকার বাড়ি খুঁজে সব ঠিকঠাক করে রাখলাম আগে থেকেই। সেদিন আমি এয়ারপোর্টে লিজকে আনতে গেলাম ঘন্টা দুয়েক আগেই। বসে অপেক্ষা করছি তখন-ই খবরটা শুনতে পাই। লিজের প্লেনটি ফ্লোরিডার কাছাকাছি আসতেই সামুদ্রিক ঝড়ের মাঝে পড়ে। নিখোঁজ হয়ে যায়। আমি নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। আর বব, বব তো সপ্তাহখানেক পাথর হয়ে যায়। স্বাভাবিক হয়ে আসলেও মাঝে ওর বর্তমান রোগটার শুরু হয়। প্রথম অবস্থায় মাঝে মাঝে লিজ কে তার সামনে দেখতো। দু একটা কথাবার্তা হতো ওদের মাঝে। মানে আমরাতো  শুধু ববকেই কথা বলতে দেখতাম সামনে কোনো অদৃশ্যের সাথে। এই রোগ দিনকে দিন বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। সব সময়ই লিজের সাথে কথা বলছে। কখনো হাসছে, কখনো কাঁদছে।

ঘুমাতেন কেমন?

ঘুম! নাহ্ গত তিন মাস ও একদম নির্ঘুম। ক্রমাগত অস্থিরতা বাড়তেই থাকে। আর যারা ভাবে ববের কথা বার্তার বিষয়টি সত্য নয়, তাদেরকে একদম সহ্য করতে পারে না। ড. রিচার্ডের কথা অনুযায়ী আমি ববের প্রতিটা কথাই বিশ্বাস করছি বোঝাই। আর তাতে ও শুধু আমাকেই ওর কাছে আসতে দেয়। আমার অনুরোধ মাঝে মাঝে শোনেও।

উনি কি লিজের হাতের কিংবা শরীরের স্পর্শের কথা কিছু বলতেন?

হাঁ, শুধু কি স্পর্শ! লিজ কে নিজ হাতে খাওয়ায়, লিজ কাঁদলে তা হাত দিয়ে মুছে দেয়। সারাক্ষণ শুধু লিজ আর লিজ।

আচ্ছা, মি. ফ্লিন্ট, আপনারা কি লিজের কোনো খোঁজ  নেননি?

কি যে বলেন? গাল্ফ অব মেক্সিকো সাগরে প্লেনটির টুকরা টুকরা অংশ পাওয়া যায়। অনেক যাত্রীদের কোনো হদিস নাই। কতগুলো লাশে কোনো রাক্ষুসী হাঙ্গরের খুবলে খুবলে খাওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। ধারণা করা হয় বাকিরা সব ওদের পেটেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আশে পাশে কত জায়গায় খোঁজ নেয়া হয়, কিন্তু লিজকে পাওয়া গেলো না। লিজ যে আর নেই সেটা ববকে বোঝানোর হাজারো প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ওর ধারণা লিজতো ওর সাথেই।

বুঝতে পেরেছি। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন মিস স্যান্ডি। এ ধরনের রোগীরা এ্যাকিউট হ্যালুশুনেশনে ভোগে। ফলে এরা দ্রুত খারাপের দিকে যায়। একসময় ঘুমায় না আর শেষে খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দেয়। আর মানসিক সাম্যাবস্থা হারানোর দরুন এক সময় আত্মহত্যা করে বসে।

বলেন কি? তাহলে বব কি সেই দিকেই চলে যাচ্ছে? কিন্তু, আপনিই তো বললেন কি সব পজিটিভ লক্ষণ টক্ষণ না যেনো কি?

হাঁ, বলেছি বটে। এসব রোগীদের মাঝে এক অভাবনীয় শক্তি কাজ করে। সেটা হচ্ছে তাদের অত্যন্ত সক্রিয় এক যষ্ঠ ইন্দ্রিয়, যার মাধ্যমে তারা ভালোবাসার মানুষের আত্মার সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখে। মানে একটা মোটামুটি দূরত্বের বৃত্তের মাঝে একে অপরের আত্মার উপস্থিতি সহজেই বুঝতে পারে। আর এরা যখনই প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্যে আসবে তখনই, সেই মুহূর্তেই একদম ভালো হয়ে যাবে। আচ্ছা যা ই হোক, বব কে যখন কাছে পেয়েছি তখন আমার মতো চেষ্টা করে দেখি কিছু করা যায় কি না।

মিস স্যান্ডির কথার মাথামু- কিছুই বুঝছে না, ফ্লিন্ট। কেবলই মনে হচ্ছে – হয়তো এখানে আসাটাই বেকার, নিরর্থক হতে যাচ্ছে।

কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই মিস স্যান্ডি ববকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, হ্যাল্লো বব। কেমন আছেন? তারা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দক্ষিণ দিকের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। ওখানেই উঁচু টিলাটার প্রান্ত ঘেষে টানা লোহার শক্ত বেড়ার কাছেই ববকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কিন্তু আশ্চর্য্যরে বিষয় – বব বেড়ার ওধারের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখছে না। উল্টো কাঠের তৈরি বাড়িটার দোতলার কোণার এক বন্ধ জানালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কাঁচের জানালা, ভেতরে ভারী পর্দায় ঢাকা।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই বব উত্তর দিলো, ওই তো জানালাটা দেখছিলাম।

কেনো, কাউকে দেখতে পেয়েছেন বুঝি? মিষ্টি হেসে ববকে প্রশ্ন করে মিস স্যান্ডি।

ঠিকই বলেছেন। আমার মন বলছে লিজ জানালার ওধারে দাঁড়িয়ে আছে। ও আমাকে দেখছে আর অঝরে কাঁদছে।

বা-রে! আপনি কি সত্যিই লিজকে দেখতে পাচ্ছেন না?

ববকে করা মিস স্যান্ডির এই প্রশ্নে ফ্লিন্ট একটু অবাকই হয়। তাই তো, বব তো যখন-তখন, যেখানে-সেখানে লিজকে দেখে। তা আজ আবার কি হলো! সে ববের দিকে তাকিয়ে থাকে উত্তর শোনার জন্য।

বব বলল, কেনো জানি না। তবে মনের ভেতরে কেমন যেন অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।

বুঝতে পারছি আপনি বেশ অবসাদগ্রস্ত, স্যান্ডি হেসে হেসে বলে। আচ্ছা, চলুন বাড়ির ভেতরে যাওয়া যাক। একটু রেস্ট নেবেন। এদিক দিয়ে আসুন, বলে মিস স্যান্ডি নিজে সামনে হেঁটে চললেন।

রাতের খাবার খুব দ্রুত শেষ করে যে যার মতো নিজ রুমে চলে যায়। ববও সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে ওর নির্দিষ্ট রুমে চলে আসে। এটাই সেই কর্নারের রুমটা, যার জানালার দিকে সে এখানে এসেই তাকিয়ে ছিল। কেমন জানি অদ্ভুত রুমটি। শুধু মাত্র একটা বড়সড়ো বিছানা আর একটা বেশ ভারী কাঠের আরাম কেদারা। জানালায় বিশাল মোটা ঝুল পর্দা – কেউ এপাশে দাঁড়ালে পর্দা ভেদ করে ছায়া পর্যন্ত ওপাশ থেকে বোঝা যায় না। দরজায় ভেতর থেকে বন্ধ করার কিছুই নেই, শুধুই একটা গোলাকার হাতল। মনে হচ্ছে কোনো উদ্দেশ্য নিয়েই এই রুমটি তৈরি করা হয়েছে। সেটা কি তা বব বুঝতে পারলো না। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখ ভারী হয়ে আসছে। কতদিন পর মনে হচ্ছে সে ঘুমাবে। হয়তো কিছুক্ষণ আগে মিস স্যান্ডির দেয়া তিনটা ওষুধের মধ্যে একটা কোনো গভীর ঘুমের হবে। যদিও উনি বলেছেন নার্ভের প্রশান্তির জন্য দেয়া ওষুধ। ববের পা টলছে। ধীরে ধীরে বিছানায় কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বিছানার মাঝে ওটা কি? বিস্ময়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে বব। এই প্রথম সে কোনো ছোট্ট বাচ্চাকে দেখতে পাচ্ছে, বিছানায় শুয়ে শূন্যে হাত পা ছুড়ছে তো ছুড়ছেই। কি মায়া ভরা মুখ, তাকিয়ে আছে তারই দিকে। ছেলে না মেয়ে? বয়স কত হবে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে। অনুমান করতে পারে, হয়তো তিন চার মাস হবে। ও কি তার সাথে কথা বলতে চায়! চ্ম্বুুকের মতো কাছে টানছে সে। বব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ঢুলুঢুলু ভাবেই ছোট্ট বাচ্চাটাকে কোলে তুলে আদরে ওর কপালে চুমু খায়। হাত, শরীর নিঃস্তেজ হয়ে আসছে ক্রমশ। বব আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, সে বাচ্চাটাকে বুকে রেখে বিছানায় এলিয়ে পড়ে। আশ্চর্য্যরে ব্যাপার বাচ্চাটাও ববের প্রশস্ত বুকে উপুড় হয়ে শুয়ে হাত দুটো দুদিকে প্রসারিত করে দেয়। ছোট্ট হাতের মুঠি আঁকড়ে ধরে ববের বুকের সোনালি পশমগুলো। আলতো করে রাখে তুলতুলে গাল বুকের উপরে। মাথাটাকে ঈষৎ ঘুরিয়ে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে ববের অবাক দৃষ্টির দিকে। বব আর চোখ মেলে রাখতে পারে না, সে হারিয়ে যায় অতল ঘুমে অনেক দিন পরে।

পর দিন সকালে, আসলে ঠিক সকাল বলা যাবে না, এই প্রায় দুপুর হয় হয় এমন সময়ে ববের ঘুম ভাঙে ফ্লিন্টের ঝাঁকুনিতে। এত সতেজ ববকে অনেকদিন হলো দেখেনি ফ্লিন্ট। ওর মুখে সুপ্রভাত সম্ভাষণ শুনে আনন্দে চোখে পানি এসে যায়। মনে মনে মিস স্যান্ডির প্রতি কৃতজ্ঞতা বেড়ে যায় অনেক গুণ। কি ওষুধ দিলেন যে এক রাতেই ওর প্রিয় বন্ধুকে ফিরে পেতে যাচ্ছে। নিরবে চোখের জল মুছে হাত বাড়িয়ে দেয় ববের দিকে। ববও হাত বাড়াতেই শক্ত করে চেপে ধরে। টেনে তুলে ববকে বিছানা থেকে।

আর তখনই বব চিৎকার করে উঠে, এ কি করলে ফ্লিন্ট? বাচ্চাটা পড়ে গেলো তো!

ফ্লিন্ট হতভম্ব, এ আবার কি! এতোদিন তো লিজ নিয়েই সব কিছু। এখন বাচ্চা! ড. রিচার্ড এর কথা অনুযায়ী ববের এসব দেখাদেখিতে না বলা যাবে না। তাই তাড়াতাড়ি বললো, বাচ্চা! কোথায় ছিল?

এই যে আমার বুকের ওপর। ওকে বুকে নিয়েই তো শুয়েছিলাম। আর তখনই কিভাবে যে ঘুমিয়ে গেলাম। আহ্ ছোট্ট বাচ্চাটা গেলো কোথায়?

ফ্লিন্ট হাসি হাসি মুখে বলে, তোমার যা কথা। ছোট্ট বাচ্চা তোমার বুকের ওপর এতক্ষণ থাকে কীভাবে?  পরে যেতো না? হয়তো তুমি ঘুমিয়ে যাবার পর কেউ এসে নিয়ে গেছে। যাও, তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আস। নাস্তা খাবে, তখন বাড়ির লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানা যাবে। চলোতো, তাড়াতাড়ি।

বব ফ্লিন্টের কথা মানলো ঠিকই, কিন্তু সে যে আবার আগের মতো অস্থির হয়ে পড়েছে তার ছাপ ওর চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। ফ্লিন্টের মনেও দ্বিধা, এ কোন নতুন বিপত্তি শুরু হতে যাচ্ছে।

অস্থিরতা নিয়েই খাবার টেবিলে এসেছে বব। আগে থেকে উপস্থিত মিস স্যান্ডি আর ফ্লিন্টের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি ঝরে পড়ে। বলে, আমি বুঝতে পারছি আমার দেখা ছোট্ট ছেলেটার কথা কেউ বিশ্বাস করছেন না আবার। এটা কিভাবে সম্ভব, একটা জলজ্যান্ত মানুষকে আপনারা কীভাবে দেখতে পান না।

মিস স্যান্ডি উত্তর দিলেন হেসে, আহা, রাগ করছেন কেনো? আমরা কি আপনাকে বলেছি যে দেখছি না। আমরাও দেখি। যা বাস্তব তাকে অস্বীকার করি কিভাবে। আপনি দয়া করে কিছু নাস্তা করুন তো। আপনার সাথে আমার বিশেষ একটা কাজ আছে।

কি কাজ? ববের প্রশ্ন। এখন তাকে কিছুটা শান্ত মনে হচ্ছে।

সামান্যই কাজ। আসলে কাজটা আপনারই করা। ওই যে শিশুদের শিক্ষার জন্য আপনি যে সফটওয়ার তৈরি করেছিলেন তার একটা কপি আমি কিনেছিলাম। আমার বিশেষ প্রয়োজনে। কিন্তু কেনো জানি সেটা চলছে না। আমি এখানকার কিছু এক্সপার্টকে দেখিয়েছি। তারা শ্রেফ বলে দিয়েছে, তারা এখনো এই প্রোগ্রামের বিস্তারিত সম্মন্ধে অবগত হয়নি। আমি ইচ্ছা করলে যেখান থেকে কিনেছি সেখান থেকেই পালটিয়ে আনতে পারতাম। কিন্তু, আবার ভাবলাম যেখানে আবিস্কারকই স্বয়ং হাজির সেখান ওনাকে অনুরোধ করলেই পারি। আপনি রাজি হলে আপনাকে সেটা দেখাতে পারি। বলে ববের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ খুবই স্বাভাবিকভাবে ববও বলে, চলুন দেখা যাক কি সমস্যা হলো।

মিস স্যান্ডি কৃতজ্ঞতায় আপ্লূত হয়ে যায়। বলে, ওই তো ওই পাশের ঘরেই, আমার ছোট্ট স্টাডি রুমে। তার আগে ওই ছোট্ট কাপে রাখা ওষুধ দুটো খেয়ে নিন, দয়া করে।

ববও অনুগত হয়ে ওষুধ দুটো খেয়ে নেয় টুপ করে। সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে যায়, চলুন কোথায় যেতে হবে।

ফ্লিন্ট অবাক হয়ে দেখে ববকে। মূহুর্তেই সেই আগের বব, সেই আগের চাহুনি, আগের মতোই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদগ্রীবতা। মনে একরাশ আনন্দ নিয়ে সেও ওদের দুজনকে অনুসরণ করে মিস স্যান্ডির স্টাডি রুমে প্রবেশ কর। অসম্ভব সুন্দর সে রুম। চারদিকের দেয়াল জুড়ে কাচে ঘেরা মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বুক সেল্ফ। ভর্তি নানা রকমের বই দিয়ে। মেঝেতে মোটা কার্পেট। এক কোণায় এক্সিকিউটিভ ডেস্ক। মানানসই চেয়ার, টেবিলে বড়সড় কম্পিউটার মনিটর।

মিস স্যান্ডি একটু আগে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারটা টেনে ধরে বলে, বব আপনি এখানে বসুন।

বব গিয়ে বসে পরে। তারপর আর তাকে কিছু বলতে হলো না। সে নিজেই কিবোর্ডে তার আঙুলের ঝড় তোলে সেই আগের মতোই। আবারো আনন্দে ফ্লিন্টের চোখে জল জমে যায়। এটা মিস স্যান্ডির দৃষ্টি এড়ালো না ঠিকই। তিনি ফ্লিন্টকে চোখের ইশারায় রুমের বাইরে আসতে বলে নিজেও বের হয়ে আসে।

ফ্লিন্ট এবার আনন্দে বেশ জোরেই কেঁদে ফেলে। বলে, ম্যাম, আপনি কীভাবে কী করলেন? ও তো একেবারেই সেই আগের মত হয়ে উঠেছে। এতো দ্রুত কিভাবে, কী সম্ভব!

মি. ফ্লিন্ট, আপনে এতো অবাক হবেন না। এখানে আমার অবদান খুবই সামান্য। যা কিছু হয়েছে তা মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই হয়েছে। আর এই ধরনের অসুখ থেকে ভালো হবার ধরনও কিন্তু এমন হঠাৎই হয়। এরা সম্পূর্ণ আগের মতোই সুস্থ হয়। যেমনটা হলো ববের ক্ষেত্রেও। আমি ইচ্ছে করেই ওর নিজের করা প্রোগ্রামে এক্সপার্ট দিয়ে একটু কাজ করিয়েছি। খুব সামান্যই পরিবর্তন, তাও আবার মূল অংশে তো নয়ই। জেনেছি সেটি বব বিশেষ ভাবে সংরক্ষিত রেখেছে।

শুধু এক্সটারনাল অপারেটিংয়ের কিছু পরিবর্তন করেছে। বব যদি আগের মতোই চিন্তাভাবনা করতে পারে তো নিমিষেই ধরে ফেলবে। আর তাই যদি হয় তবে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হবো, বব পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে। তবে আরো সপ্তাহ দুয়েক কিছু  ওষুধ নিয়মিত খাওয়াতে হবে, এই ই যা।

কথা গুলো শুনে ফ্লিন্ট এবার চুপ থাকতে পারলো না। সে বলে উঠে, কিন্তু, কিন্তু, ও যে এখন ছোট্ট একটা বাচ্চাকে দেখা শুরু করেছে? তার কি হবে?

মিস স্যান্ডির মুখে ঈষৎ হাসি ফুটে উঠে। বলে, আহা সে তো বাস্তব ঘটনাই। তাকে তো অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার নাই।

মানে, মানে কি? কি বাস্তব ঘটনা? কি হচ্ছে, ম্যাম?

আচ্ছা, সেটা সময় হলেই তো..

মিস স্যান্ডির কথাটা শেষ না হতেই ববের ডাক শোনা যায়। মিস স্যান্ডি কে ডাকছে। দুজনেই তাড়াতাড়ি আবার স্ট্যাডি রুমে ঢুকে। দেখে বব হাসি মুখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

মিস স্যান্ডিই প্রথম কথা বলে, কি ব্যাপার মি. বব, আমি কি আপনার প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করতে পারবো।

বব বলে উঠে, অবশ্যই পারবেন। খুবই সাধারণত তবে একটু প্যাঁচ লাগানো ভুল ছিল। আমি শতভাগ নিশ্চিত এটা কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে করেছে। আমি এটা নোট করে নিচ্ছি। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাবো।

মিস্ স্যান্ডি হা হা করে উঠেন। আমার কি সৌভাগ্য। আপনাকে আমি পেয়েছি বলে। তা আপনার আর ওদেরকে বলবার দরকার নেই। প্রোগ্রাম না চলাতে আমি কিছু মনে করিনি। এখনতো ঠিকই হয়ে গেলো। আপনাকে অনেক.. বলে ধন্যবাদ আর বলতে পারলেন না। তার আগেই বব বলে উঠে, ওই যে, ওই যে শুনছেন? বাচ্চাটা কাঁদছে। বাচ্চাটা কাঁদছে। ববের আবার একটু একটু অস্থিরতা বাড়ছে।

ফ্লিন্ট অবাক। আর মিস্ স্যান্ডি আগের মতোই স্বাভাবিকভাবেই বলে, কোথা থেকে যে আসছে কান্নার শব্দটা!

বব আর স্থির থাকতে পারলো না। ও কান্নার শব্দকে অনুসরণ করে করে ওর নিজের থাকা রুমের সামনে দ্রুত এসে দাঁড়ায়। স্পষ্ট কান্নার শব্দ ভেতর থেকেই আসছে। নব ঘুরিয়ে রুমে ঢুকেই দেখে বিছানায় হাত পা নেড়ে গতকালের সেই বাচ্চাটা কাঁদছে। দৌঁড়ে কাছে গিয়ে কোলে তুলে নেয়। আর বাচ্চাটাও তাকে অবাক করে কান্না থামিয়ে দেয়। কিন্তু ববের চোখের দিকে তাকিয়ে মায়াবী চোখে ফোঁপাতে থাকে। ববের পাঁজরের ভেতর মোচড়ে উঠে। আবেগে দুহাতে বুকের মাঝে চেপে ধরে। অজান্তেই চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রু।

পিছনে মিস স্যান্ডির সাথে রুমের ভিতর ফ্লিন্টও এসে হাজির। সেও এখন ছোট্ট বাচ্চটাকে দেখতে পাচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে তার। মনে হচ্ছে ববের রোগটা তার মধ্যেও স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। সে বেশ জোড়েই চিৎকার করে উঠে, বব আমিও বাচ্চটাকে দেখতে পাচ্ছি। আমিও দেখতে পাচ্ছি।

 

চিৎকার শুনে বব ফিরে তাকিয়েই হঠাৎ শক্ত হয়ে যায়। বিস্ফোরিত চোখে সবার পিছনে এই মাত্র প্রবেশ করা এক মহিলাকে দেখে। অবাক বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়ে।

ববের দৃষ্টি অনুসরণ করে ফ্লিন্ট মাথা পিছনে ঘোরাতেই বিশাল ধাক্কা খায়। ওই মহিলা আর কেউ নয়, স্বয়ং লিজ দাঁড়িয়ে। সে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে থাকলে পাশে দাঁড়ানো মিস স্যান্ডি সঙ্গে সঙ্গেই ধরে ফেলে। ওনার মুখে অনাবিল হাসি।

ববকে উদ্দেশ্য করে লিজের সেই কন্ঠ ভেসে এলো, কি হলো প্রিয়, মেয়েকে পেয়ে মেয়ের মাকে ভুলে গেলে?

হঠাৎ ববের হৃদপি- ড্রামসের তালে বেজে উঠে। সেই আলোড়নে বুকে মাথা লাগানো ছোট্ট বাচ্চাটিও কেঁপে উঠে। শুধু সেই না আজ উপস্থিত সবাই লিজকে দেখছে, তার কথাও শুনছে। ববকে আরো হতভম্ব করে দৌড়ে এসে বাচ্চাসহ ববকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে লিজ। ববও বেষ্টনীর ভেতর থেকে একটি হাত বের করে লিজকে জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নেয়। বেশ শব্দ করেই কেঁদে উঠে।

বব বিস্মিত, কি, কি বললে প্রিয়। কতো কথাই তো বলো, কই এতদিন তো আমাকে বলনি যে আমাদের মেয়ে আছে?

লিজের কান্নার ধারা আরেকটু বেড়ে যায় ববের প্রশ্ন শুনে। ওর কি দোষ, ও তো লিজকে কল্পনায় জীবিত রেখেছে। ওদের সন্তান এই পৃথিবীতে কীভাবে আসলো সেতো দেখে নি। তাই তার কল্পনাতেও সন্তানের অস্তিত্বও ছিল না। মিস স্যান্ডি আগেই বলে রেখেছেন ববের পূর্বের কল্পনার ধরনে হঠাৎ আঘাত করা যাবে না। যে ভাবেই হোক এমন ভাবে ব্যাপারটা সমাধান করতে হবে যে সব কিছুই যেনো আগের মতো স্বাভাবিক চলে। তবেই বব ধীরে ধীরে ওর বিগত অস্বাভাবিক কল্পনার জগতের সমস্ত কাজ সে নিজেই ভুলে যাবে।

অসম্ভব বুদ্ধিদীপ্ত লিজ অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় ববের দিক, কেনো প্রিয়, তুমি তো কি সব প্রশ্ন করতে করতে আমাকে ব্যাস্ত রাখতে। আমাদের সন্তানের কথা বলবার সময়ই তো তুমি দিতে না। এখন সময় পেয়েই মেয়েকে তোমার বুকের মাঝে তুলে দিলাম। তুমি কি খুশি হও নি?

আমার মেয়ে! আমার মেয়ে! ববের অশ্রু থুতনি বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে বুকের সাথে লাগানো মেয়ের ছোট্ট কপালে। এ এক অন্যরকম দৃশ্য।

এ অবস্থায় মিস্ স্যান্ডি ইশারায় বাইরে ডেকে নিয়ে যায় ফ্লিন্টকে। নির্বাক ফ্লিন্ট বাধ্যগত হয়ে রুমের বাইরে এসে হতবাক দৃষ্টিতে মিস স্যান্ডির দিকে তাকায়।

নিজেকে সামলে নিন মি. ফ্লিন্ট, বলেন মিস স্যান্ডি। আপনাকে আগেই বলেছিলাম এখানে যাই কিছু ঘটছে তা সবই মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে অনুযায়ীই হচ্ছে। আমরা ব্যাখ্যা দিতে পারবো না, কিভাবে লিজ এই নির্জন পাইন আইল্যান্ড রিজে এলো। শুধু এতোটুকু জানুন চার মাস আগের সেই সামুদ্রিক ঝড়ো বাতাস লিজকে উড়িয়ে এনে ফেলে আমাদের লেকের পানিতে। ঝড় শেষ হলে গ্রামের লোকেরা ওকে উদ্ধার করে অবচেতন ভাবে। কিন্তু ওর পেটে সন্তান তখনো জীবিত, কাঁপছিল। ওই লোকগুলোই অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আমাদের হাসপাতালে পাঠায়। দেরি না করে প্রথমে ওর সন্তানটিকে অপারেশন কর বের করা হয়। অপরিপক্ব বাচ্চা, রাখা হয় ইনকিউবেটরে। আর লিজকে পরীক্ষা করে বোঝা যায় ও কমায় চলে গেছে। আমরা তো ভেবেছিলাম কোনো টুরিস্ট, ঝড়ে পরা রাতে রোড এক্সিডেন্টে এমন অবস্থা। আমরা আশে পাশের সবখানেই ওর প্রাপ্তির খবর জানিয়ে দেই। কিন্তু, আমাদের মাথায়ই আসে নি, সেই পৌঁনে দুইশ মাইল দূরের ঘটে যাওয়া প্লেনের যাত্রী ছিল ও। কি আর করা সবাই অপেক্ষা করতে লাগলো ওর কোমা থেকে ফিরে আসবার।

কথার এই অবস্থায় ফ্লিন্ট প্রশ্ন করে, আর ছোট্ট বাবুটার তখন কি হলো?

ছোট্ট বাচ্চাটা চার সপ্তাহ ইনকিউবেটরে রাখার পর স্বাভাবিক সুস্থ হলে ওকে আমিই নিজের দায়িত্বে তুলে নেই। আর লিজের জ্ঞান ফিরলে পরবর্তী মানসিক উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আমার দায়িত্বে থাকবে স্থির করা হয়।

তো কতদিন পর লিজ কোমা থেকে বের হয়ে এলো?

কোমা থেকে ও ফিরে এলো এইতো পাঁচ দিন আগে। নাম জানলাম লিজ। তারপর জানলাম সকল কিছু। আমরা সবাই ভীষণ অবাক। আর আমাদের চেয়েও বেশি অবাক হয় লিজ ওর সন্তানকে ফিরে পেয়ে। তারপর আনন্দে ববের খোঁজ নিতে গিয়েই হয় মর্মাহত। জানতে যখন বব অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে তখন ও মুষড়ে পরে। আমি ওকে আশ্বস্ত করি ওকে সর্বাত্মক সাহায্য করার।তখন আপনার সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ পাই। জানি বিস্তারিত। ড. রিচার্ডের কাছ থেকে জানি আরো কিছু। আমার মনে একটু আশা জাগে হয়তো স্বাভাবিক ববকেই লিজের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবো। কারণ আমি জানতাম এই রোগের উৎপত্তি অন্তরের গভীর অনুরণন থেকে। এই অনুভূতি সবার মাঝে থাকে না। পাওয়া যায় লাখে একটা। এরা ভালোবাসার একে অপরে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের মাঝে আসলেই বুঝতে পারে। এরা একে অপরের হঠাৎ বিচ্ছেদে যে কোনো পর্যায়ের হ্যালুশিনেশনে ভুগতে পারে। শুধু তাই নয় একসময় খাওয়া দাওয়া ছেড়ে মারা যায়। ববের ক্ষেত্রে খাওয়া দাওয়া ছাড়ার প্রাথমিক ধাপটি শুরু হয়েগিয়েছিল। ভাগ্য ভালো ঠিক সময়ে লিজের জ্ঞান ফিরে আসে। আপনি লক্ষ করেছেন বব ফ্লোরিডার আকাশে আসা মাত্রই দুজনার অন্তরের অনুরণনের আওতায় চলে আসে। আর বব পুনরায় স্বাভাবিক

 

আচরণ করতে থাকে। আবার মজার বিষয় দেখেন, বব এসে বাইরের দৃশ্য না দেখে এই রুমের ওই জানালাটার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আসলে এ পাশে যে লিজ দাঁড়িয়ে ছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে ববকে দেখছিল আর অঝোরে কাঁদছিল। আমার খুব কষ্ট লেগেছে। তারপরও রিস্ক নিই নি। ওষুধগুলো খাওয়াতেই হতো যে। আবার আমি দেখতে চেয়েছিলাম বব আবার স্বাভাবিকভাবেই কাজ করতে পারছে কিনা। যখন বুঝতে পারলাম সব ঠিক ঠাক, তখন স্টাডি রুম থেকে মোবাইলে সংকেত দিলাম লিজকে। সন্তানকে ববের রুমে রেখে কোনো ভাবে কাঁদাতে। আর বেরিয়ে লুকিয়ে থাকতে। তারপর আবার আমার সংকেত পেলে এখানে আসতে। পরের সব ঘটনাতো আপনার সামনেই ঘটলো।

ফ্লিন্টের কেবলি মনে হচ্ছে কোনো ফেইরি টেলের গল্প। মনের মাঝে আনন্দের তীব্র বন্যা দুচোখ বেয়ে ধেয়ে বের হতে চাচ্ছে। আর ধরেও রাখতে পারলো না। দেখতে না পেলেও তীব্রভাবে অনুভব করতে পারছে রুমের ভেতরে পরম আবেগঘন আলিঙ্গনে আবদ্ধ দুই হৃদয়ের অনুরণনের মাঝে নতুন আরেকটি যোগ সৃষ্টিকারী ছোট্ট এক মিষ্টি মুখ।

 

 

সৈয়দ মনজুর কবির, গল্পকার

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে