জাকিয়া শিমু
মোহন মিঁয়ার বাড়ির দক্ষিণকোণায়, ন্যাড়া একটি আমগাছ বহুকালের সাক্ষী হয়ে কোনমতে শতায়ু বৃদ্ধের নড়বড়ে দাঁতের মতো ন্যুব্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে! বেশ ক’বছ আগে বজ্রপাতে গাছের একাংশ ক্ষয়ে গেলে- আগে, যাও কিছু আম ধরতো এখন তাও হয় না। গাছটি অযথা বাড়ির দরকারি জায়গা দখল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে’- বাড়ির সকলের এমনতর ধারণা হলেও মূখ্যত মোহন মিঁয়ার কারণে গাছটি উপড়ে ফেলা যাচ্ছে না! তিনি ফলহীন সেই গাছের গোঁড়ায় দিনভর ঝিম মেরে বসে থাকেন!
তাঁর মনটা সারাক্ষণ বিচ্ছিন্ন-বিবাগি হয়ে অসোয়াস্তিতে ভরে থাকে! চোখজোড়ায় রাজ্যের বিবর্ণ ঘোলাটে-ভাব! শান্তির বাস- স্বপ্নের ভেতর কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছেন! পাড়ার লোকজন তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করে ! শুধু কী পড়শি ! নিজের ঘরের মানুষ কি কম করে! পুরনো ঘুণে-খাওয়া আসবাবের মতো জীবনটা বয়ে নেওয়া মোহন মিয়াঁর ভুলটা আসলে কোথায়? তিনি নিজে ঠিকঠাক হিসাব মেলাতে পারেন না ! অযথা জীবনের ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের দিকে অসহায়,মুমূর্ষু দৃষ্টি মেলে শুধু তাকিয়ে থাকেন!
গত প্রায় চল্লিশটি বছর দুর্দান্ত ব্যতিব্যস্ত সময় ছিল তাঁর। অন্যের স্বপ্নের পেছনে আজীবন ছুটে চলা মানুষটি, বুঝতেই পারেনি নিজ জীবনের সুখের ঘুড়িটা সুতো ছিঁড়ে কখন পালিয়ে গেছে অধরা হয়ে! জীবনভর মানুষের দেখভাল করলেন। জীবনের নানান অধ্যায় বিচরণ শেষে,শেষবয়সে যা পেলেন, তা কী আসলে প্রাপ্য ছিল ! এমন হাজারো ভাবনা আজকাল অনেকটা জোর করে জেতে চেপে বাস করে তাঁর মনের ঘরে। অবুঝ শিশুর মতো আকাশমুখি উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকেন! মাথার ওপর আকাশটা ক্ষণে ক্ষণে সুরত বদলায় কিন্তু তাঁর মনের আকাশটায় ঘন মেঘ জমে অনড়ে বসে আছে! মনের-মেঘ বড্ড তাতায়, বেদনার অতলে ডুবিয়ে রাখে!
উঠোনের পশ্চিমে বাপ-দাদার আমলের একখানা আধ-পাকা রান্নাঘর। তার ছাল-ওঠা মেঝেতে পা ছড়িয়ে মোহন মিয়াঁর স্ত্রী, চুলার মুখে পাটকাঠি গুঁজে আর নিজমনে বিড়বিড় করে খিস্তি আওরায়! নিজেকে নিজে অভিশাপ দেয়, অদৃষ্টকে শাপশাপান্ত করে ! হাঁড়িতে ঝিঙ্গেশাইল চালের ভাত টগবগিয়ে ফুটে। তাতিয়ে-ওঠা চুলার পাশে চৌকোনা কাঠের পিঁড়িতে জবুথবু হয়ে বসে থাকা বউটার জন্য বড্ড মায়া জমে আছে তাঁর মনে। সেই পনের ষোলো বছর বয়সে লাল জমিনের ওপর সোনালি পাড়ের বেনারসি জড়িয়ে, এ-বাড়ির বউ করে নিয়ে এলেন। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা! চোখের তারায় সেসব ঝলমলে দিনগুলো আজও জায়গা নিয়ে জোর দখলে বসে আছে।
তারপর কতোটা বছর চলে গেল, দুজনে পাশাপাশি বসে একবেলা মনেরকথা বলার সময় হয়ে উঠে নি! নিজের জীবনযৌবন, সাধ-আহ্লাদ অমাবস্যার রহস্যে-ভরা অন্ধকারেই রয়ে গেছে। বউটার ওপর অবিচার কম করা হয়নি। এবং আজও তা সমানতালে চলছে! মোহন মিঁয়ার বিবেকের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এখনো ক্ষয়ে যায়নি, ভাবনার বলয় বহুদূর অবধি চলে যায়। নিজের ওপর খুব রাগ হয়, ঘৃণা ধরে। মনে মনে অদৃষ্টের চৌদ্দগুষ্ঠীকে মনের খায়েশ মিটিয়ে অভিশাপ দেন। দিনরাত নিজেকে অভিসম্পাত করেন। তারপরও মনটায় একদ- স্থিতি ফিরে আসে না!
বাবার বিষয়আশয় বলতে- ভাঙাচোরা দু’টি তাঁতকল আর পনের ষোলো শতাংশের একখ- ভিটেমাটির ওপর পক্ষঘাতগ্রস্ত দেহের ন্যায় ঢলে-পড়া একখানা দু’চালা টিনকাঠের ঘর। এর থেকে একরত্তি বেশি কিছু নয়! ওটুকু ঘরে ঠাসাঠাসি করে- চার ভাইবোন, দাদিসহ বাবা মায়ের হা-ভাতের সংসার। ভাঙা তাঁতকলে সপ্তাহে বড়জোর চার পাঁচ জোড়া লুঙ্গি, পরিবারের সবার একত্রে হাড়ভাঙা খাটুনী শেষে নামানো যেত। তা বিক্রিবাট্টায় যা জুটত তার দৌলতে সংসার্রে নুনপান্তার জোগারযতœ কোনোমতে চলছিল। বহু কষ্টে প্রাইমারিটা শেষ করে সে। হাইস্কুলে পড়ার যোগ্যতা থাকলেও সামর্থ্যরে সংকুলান ছিল না। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে সংসারের জোয়ালটা আলগোছে তাঁর কাঁধে নেমে পড়ে।
সে সময়ে দেশজুড়ে বাঁধে আরেক ফ্যাসাদ! প্রাচীন হাতে-বোনা তাঁতকলের জায়গা দখল করে নিতে আসে যন্ত্রচালিত তাঁতকল! প্রথমে যদিও যন্ত্রকলের সাথে বিগ্রহ ঘটে আদি তাঁতকলের কিন্তু একটা সময় পর যন্ত্রচালিত কলের তা-বে কুলাতে না পেরে দেশ থেকে হাতেবোনা তাঁতকল প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়! এমন দুর্যোগে গ্রামগুলোর হাজার বছর ধরে চলে আসা জীবনযাত্রায় বিস্তর প্রভাব পড়ে। তাদের সাথে সুতোর সম্পর্ক ছিল মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কের মতো গভীর। টাকু টানা,চরকি ঘূর্ণন,কাপড়ে শান দেওয়া কিংবা কাপড়ে মিহি ভাঁজ এসব কাজের সাথে তাদের জীবন ছিল আপনজনের সম্পর্কের মতো ঘোর মায়াময়। ধীরে ধীরে চিরাচরিত সেসব শব্দ জীবন থেকে প্রায় নিভে যেতে থাকে ! এবং বংশ পরম্পরায় অভ্যস্ত জাত ব্যবসা হারিয়ে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে!
মোহন মিঁয়ার গাঁয়ের প্রায় আশিভাগ লোকের মুখ্যত বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল এই তাঁতকর্ম। এসব তাঁতীদের পূর্বপুরুষরা তাঁতকর্ম করেই এযাবতকাল টিকে ছিলেন। তাদের জমিজমা যেমন নেই অন্য পেশায় দক্ষতাও নেই। এমন অবস্থায় তারা বেকার হয়ে পড়ে, নিরুপায়ে নি¤œশ্রেণির কাজের খোঁজে শহরে ভিড় জমায়। যাদের সে সামর্থ্যটুকু নেই তাঁরা আশপাশের গাঁয়ে খুব অল্প মূল্যে পৈরত দিতে শুরু করে।
মোহন মিঁয়ার বাবা ছিলেন শ্বাসের রোগি। খুব কষ্ট করে শুয়ে-বসে-জিরিয়ে তাঁতের কাজ করতেন। তার পক্ষে বাড়ি ছেড়ে যত্রতত্র কাজ করা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে সে-বয়সে মোহন মিঁয়া গ্রাম ছেড়ে কাজের খোঁজে শহরে গেলেন। দূর সম্পর্কের এক খালার বাসায় কোনোমতে থাকার জায়গাও পেলেন। খালুর পুরান ঢাকায় রাস্তারপাড়ে ঝুপরি ঘরের তেহারির দোকান। খালুর তেহারির নামডাক শহরজুড়ে। মানুষজন তাঁর দোকানে খাবার খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সে সূত্রে অনেকের সাথে তার জানাশোনা। তেমন এক খদ্দেরের মাধ্যমে মোহন মিঁয়া থান কাপড়ের দোকানে কাজ পেয়ে গেলেন।
তার কিছুকাল পরে,একদিন খালু সন্যাস রোগে সবাইকে তাজ্জব বনে ফেলে পরপারে চলে গেলেন! খালুর বড় ছেলে মোহন মিঁয়ার সমবয়সী। তখন কেবল সে কলেজ যাওয়া শুরু করেছে। সংসার চালাতে তাকে যেতে হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশে। বাড়ির বড় ছেলে বিদেশে, কাজেই সংসারের দেখভালোর দায়িত্ব এসে পড়ে মোহন মিঁয়ার কাঁধে।
খালুর একমাত্র মেয়ে হাইস্কুলে পড়ে। মোহন মিয়ার দায়িত্ব পড়ে তাঁকে স্কুলে পৌঁছে দিতে। বছর না ঘুরতে মেয়েটি তিরতিরিয়ে তালগাছের মতো হাতেপায়ে বেড়ে উঠে। এবং বয়সের একটা প্রকৃতিপ্রদত্ত-সৌন্দর্য অন্যান্যদের মতো তাঁর মধ্যেও পরিপুষ্টভাবে ধরা দেয়। মোহন মিঁয়া অবশ্য তাকে নিজবোনের মতোই দেখেন। সত্যি বলতে-মনে তখনকার ভাবনায় খালুর মেয়ের বিষয়ে তেমন কিছুই ছিল না।
কিন্তু বছর দুই ঘুরতে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। খালুর মেয়ে মোহন মিঁয়ার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করলে তাঁকেও সবাছন্দে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। শেষতক অবশ্য জুটঝামেলা ছাড়াই পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়।
শ্রাবণের এক ভরাবর্ষা দিনে তাদের বিয়ে হয়।
দিনটির কথা এখনো গতকালের সময়ের মতো আগাগোড়া স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। টানাসপ্তাহ ভরে দিনমান ঘোর বর্ষণ। আকাশ ভরা সিসারঙা ভারি মেঘ, গর্ভবতীগাভির মতো হেলেদুলে ছুটে বেড়াচ্ছিল। সূর্যের দেখা নেই। এমন ঘোর বাদলদিনে, ডিঙিনৌকায় জনাদশেক লোক নিয়ে বরযাত্রী রওনা করে বাড়ির কাছের ইছামতী নদী ধরে। নৌকা ধলেশ্বরী নদীর বুকে পৌঁছতে ঘোলাজলের আকাশ সমান ঢেউ তেড়েফুঁড়ে আসে ! নৌকা ডুবে যাওয়ার আশঙ্কায় তটস্থ সবাই। শেষে অবশ্য কাগজের নৌকার মতো ভেসেছুটে অবশেষে ভরসন্ধ্যায় নাও ভিড়ে বুড়িগঙ্গা নদীপাড়ে। রাতে বিয়ের কাজ শেষে পরেরদিন ভোরসকালে বউ নিয়ে তারা গাঁয়ে ফেরত আসে।
বিয়ের পাঁচমাসের মাথায় পৌষের এক পইলভরা সকালে ডাকপিয়ন এসে মোহন মিঁয়ার হাতে নীলখামের একখানা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে যায়। সেই বিচ্ছেদের শুরু! সেই চিঠি,তাদের আনন্দযজ্ঞেভরা জীবনটাকে তছনছ করে দিয়ে যায়! কথাটা মনে পড়তে চোখটা টলমলে জলে ভরে উঠল! স্বার্থপর দুনিয়ার চেহারাটা সৃষ্টিকর্তা তাঁর সামনে উন্মূক্ত করেছিল সেদিন ঠিকই কিন্তু সে ধরতে পারেনি।
চিঠিটা পাঠায় স্ত্রীর বড় ভাই, মধ্যপ্রাচ্যে যাবার আহ্বানে। সেসংবাদে বাড়িসুদ্ধ লোক খুশির বানে ভাসে। শুধু বউয়ের চোখে কষ্টের জল আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো টপটপ করে ঝরছিল। আচমকা এমন সংবাদে কষ্টটা তাঁর বুককে বিক্ষত করলেও পরিবারের মানুষগুলোর আক্ষেপ তাঁকে ভিন্ন কিছু ভাবতে সাহস দেয়নি।
তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। যখন দেশ ছাড়েন, ঘরে যোগান ছিল মাত্র পাঁচ কেজি চাল! ঘরে নতুন বউ। লজ্জায় তাঁর মরে যেতে ইচ্ছে করছিল! নতুন বউটাকে নিয়ে ভয়টা সবচেয়ে বেশি ছিল,অথচ অতোটুকু মেয়ে একহাতে সব সামলে নিয়েছিল।
এরপর অনেক বছর এভাবেই কেটে যায়। মরুদেশে দিনরাত স্বপ্ন দেখতেন- একদিন ভরা সংসারে ফেরত যাবেন। স্বপ্নতো দেখাই যায় যতদূর মন চায় কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন হয়। সঠিক সময়ে তাঁর আর ফেরা হয় না। মা চলে গেলেন পরপারে। শেষসময়ে দেখার সুযোগটুকু হয়নি। বোন দু’টোকে ধুমধাম করে বিয়ে দিতে হয়েছে। ভাতের হাড়ি উপচে পড়া বলকের মতো ভাইদের সংসারে সুখ বইছে অথচ তার জোগান দিতে মরুর দাবদাহে পুড়ে ক্ষয়ে তাঁকে গাধার মতো পৈরাত দিতে হয়েছে। সংসার নিয়ে তারা এখন মহা অস্থির সময় পার করছে ! এমন ব্যস্ত অবশ্য একসময় তিনি নিজেও ছিলেন তবে তাতে তফাৎ ছিল বিস্তর ! তার ব্যাপৃত সময়ের ফসল ভোগ করেছে সকলে মিলে আর এদের ব্যস্ততা শুধু নিজের বউ-বাচ্চাদের ঘিরে!
হেমন্তের বেলা চটজলদি পড়ে যায়। বউটা এ বয়সে একা হাতে রান্নাবান্না সামলে উঠতে হিমসিম খায়। সকালের জলখাবারের ঝামেলা না চুকতে, দুপুরের আয়োজনে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ার তাগিদ আসে। দু’ছেলের বউ নিজেদের ঘরবন্দি করে রেখেছে, অযথা রেষারেষিতে। সংসারের কাজে এরা খুব একটা বিপদে না পড়লে ঘেঁষে না। একজন কাজেরলোক অবশ্য আছে। সেও বউদের ফুট ফরমায়েশ খেটে দম ফেলার ফুসরৎ পায় না। বউদের এমন আচরণ মোহন মিঁয়া কিংবা তার বউ’র না বোঝার কথা নয়। এরা খয়রাতি মনমানসিকতার মেয়েছেলে। তাদের এ সংসারের ওপর কোনো মায়া নেই। মায়া, বড্ডো জটিল বিষয় এবং পুরোটাই মনের ভেতর জন্ম নেয়, তা জোর-জবরদস্তি করে মনে বসানোর চেষ্টা বিফল। একান্নবর্তী সংসারে তাদের বড়ো অনীহা,ছেলেরাও ইনিয়ে বিনিয়ে আলাদা সংসারের গুণকীর্তন শোনায়।
মোহন মিঁয়া এসব ভাবেন আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন বউটার দিকে। সে যন্ত্রের মতো একমনে রান্নাঘরে কাজ করে যাচ্ছে। ভাতের মাড় কাটতে হাঁড়ি ঠেকা দেওয়া হচ্ছে। গরম ফেনের ক্ষুধা-সৃষ্টি সুবাস পুরোবাড়ি বইছে। মসুর ডালে চলছে পাঁচমিশালির ফোঁড়ন-মৌরীর কড়াগন্ধটা নাকে এসে লাগছে। জোড়াচুলার একপাশে বসেছে ডালের বড়িতে ভাঁজা কই মাছের ঝোল। সরষে বাটায় ইলিশপাতুরির আয়োজনও আছে। এসবই মোহন মিঁয়ার পছন্দের খাবার।
বউটা বেছে বেছে স্বামীর পছন্দের খাবার রান্না করে। যদিও এ বয়সে এসে এসব খাবার এখন আর পেট নিতে পারে না। তাছাড়া অবহেলিত খাবারে অভ্যস্ত, দুঃসহ পরিশ্রমী শরীরটা আসলে এসব খাবারের স্বাদ আগের মতো পায় না। ইলিশ মাছের পেটির টুকরোগুলোতে তেলমসলা মেখে বউটা লাউয়ের মাচায় লাউপাতা তুলতে এসে মোহন মিঁয়াকে গোসলের তাড়া দিয়ে যায়। তারপরও মোহন মিঁয়া স্থানুর মতো বসে থাকে কারণ স্মৃতি তাকে তাড়িত করে বহুদিন আগের মায়ের রান্নাঘরে-
তাদের সাধারণ দিনগুলোতে তিনবেলা ডালভাত চলত, সাথে বড়োজোর গাঁয়ের মরাখালে ধরা গোরাগারা ছোট ম্ছা। তবে শনিবার আসলেই বাড়িতে একটা উৎসবের সুবাতাস বয়ে যেত। কারণ শনিবার হাটবার- সপ্তাহভর রাতদিন খাটুনীর ফসল তাঁতে-বোনা লুঙ্গি, বেচাবিক্রির দিন। বাবা সাতসকালে লুঙ্গির গাঁটরি মাথায় তুলে হাঁটের পথে দ্রুত পা চালাতেন যাতে বেলা থাকতে বাড়ি ফিরতে পারেন কিন্তু বাবার ফেরা হতো ভরসন্ধ্যায়, নয়তো তারও পরে; পুবহাটির মসজিদের এশার আযানেরও পরে। আমাদের হয়তো সেই সাতসকালে পেটে পান্তা আর গতকালের বেঁচে যাওয়া ডাল-ঝোলের মিশ্রন পড়েছিল। পেট ক্ষুধার ধকল সইতে না পেরে মেঘের ডাকের আওয়াজ তুলত,তারপরও বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষার সে সময়টা ছিলো আমাদের জন্যে পুরোটাই কঠিন জখমের পরও প্রাণেবেঁচে যাওয়ার মতো কঠিন আনন্দের।
সন্ধ্যা নামতে মা বাইরবাড়ি থেকে রোদখাওয়া নাড়াকুটো উঠোনের ডালিম গাছটার কাছঘেঁষা মাটির দু’চুলা পাড়ে জড়ো করতেন। মায়ের এই আয়োজন আমাদের মন শান্ত¦না পেত, আমরা বুঝতাম বাবার ফেরার সময় হয়েছে। বাবা ফিরতেন গালভরা হাসি নিয়ে, হাতেধরা শেষ-বাজারের চোখ-বসে যাওয়া জোড়াইলিশ ! লুঙ্গি বেচা হয়ে যেত সকাল সকাল কিন্তু ইলিশ যে সস্তায় মিলবে ভাঙাবাজারে। বাবা মাছের দোকান ঘেঁষা চায়ের দোকানে ঘাপটি মেরে বসে থাকতেন। বাজার তখন সবে মেলতে শুরু হয়েছে। সমানতালে মাছ বেচাকেনা চলছে-তাজা ইলিশের গন্ধে বাজার ম ম করে উঠত! বাবার অপেক্ষার সময় শেষ হত না, সময় কাটাতে বগলের নিচে ভাঁজে রাখা প্লাস্টিকের আঁশটে গন্ধের মাছের ব্যাগটা বারকয়েক ভাঁজ ভেঙে খুলতেন আবার যতœ করে ভাঁজ করে বগলে আঁকড়ে ধরে রাখতেন। কান পেতে থাকতেন মাছের দরদামের আলাপে।
শেষবেলায় মাছের বাজারে মানুষের ভিড় কমতে শুরু করত। তখন অল্পদামে মাছ ছেড়ে দেওয়া ছাড়া জেলেদের অন্যকূল থাকত না। বাবা ঠিক তখন ঝোপ বুঝে মাছের বাজারে ঢুকে পড়তেন। ততক্ষণে অবশ্য সেরা এবং তরতাজা মাছগুলো চলে গেছে অন্যেদের ঝুলিতে। তারপরও তিনি দক্ষ হাতে মাছের পেট টিপেটিপে একজোড়া ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। বাবার ডিমওয়ালা মাছ খুব পছন্দ ছিল। মা, মাছের পেটে ডিম দেখলে গলা চড়িয়ে হাঁ হুতাশের কাব্য খুলে বসতেন। আমরা মনোযোগ দিয়ে মায়ের সেসব গল্প শুনতাম। “ মাছের পেটের ডিম মাছের আসল স্বাদ নষ্ট করে দেয়। মাছের মা, শরীরের সমস্ত শক্তি শুষে নিয়ে ডিমে ভরে রাখে। যাতে বাচ্চাগুলো পরিপুষ্ট হতে পারে, সেজন্য মাছের গায়ে স্বাদ থাকে না”। কিন্তু বাবা সে-কথা কানে তুলতেন না। দু’চুলার একপাশে মোটা চালের ভাতের বলক ভুতভুত করে ফুলে ফেঁপে উঠত আরেকপাশে লম্বা ফালি করে কাটা কচু আর মিষ্টি কুমড়োয় ইলিশ মাছের ঝোল। মা ভাতের বলকের ওপর বসিয়ে দিতেন বাবার জন্য দু’টুকরো সরষে ইলিশে- পাতুরি। বাবার ইলিশ মাছের পাতুরি বড় পছন্দ। সবগুলো ভাইবোন চুলার চারপাশে ঘুমজড়ানো চোখে বসে থাকতাম রান্না শেষের অপেক্ষায়।
মোহন মিঁয়ার বউ’র রান্না শেষ হলে বাকি গোছগাছের কাজটা কাজের মেয়েটা করে দেয়। এ সময়ে মেজাজমর্জি ভালো থাকলে বউটা তাঁর পাশে বসে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেয়। তিনি প্রতিদিন এই সময়টার জন্যে অপেক্ষা করেন,দু’জনে পাশাপাশি বসবার এই এতটুকু সময়ই মেলে। এসময়ে নিজেদের একান্ত নয়, সংসারের দু’চারখানা টুকটাক জরুরি আলাপ পাড়ে তাঁর সাথে।
যেমন- বড় ছেলেটা আর বিদেশ করতে চায় না। ছোট ছেলে নিজের নামে জমি রাখতে চায় কিংবা মেয়ের জামাইদের চাওয়া-পাওয়া। এসব বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কোনো মতামত দিতে যান না তিনি। তাঁর জীবন কেটেছে মধ্যপ্রাচ্যের গাধাদের সাথে। সারাদিন তপ্ত রোদের আঁচে পুড়ে ভেড়া-গাধাদের মাঠে চড়িয়েছেন। গাধাদের চড়াতে মগজের জোর লাগে না, গতর খাটাতে হয়। সে হিসেবে সংসার, সম্পত্তি, বিষয়আশয় এসব কূট বিষয়ে তাঁর বুদ্ধি বিবেচনা এমন অবেলায় কাজ দেবার কথা নয়।
তিনি কঠোর পরিশ্রম করেছেন,অঢেল টাকা মা-ভাইদের কাছে পাঠিয়েছেন। তারও পরে বউ’য়ের কাছে। তারাই তাদের ইচ্ছেমতো খরচ করেছে। কখনো কেউ মোহন মিয়াঁর মতামত জানতে চায় নাই। অবশ্য এখন যে বউটা বলছেন- সেটা মতামত চাইতে নয়, বউ জানে সেটা দেবার ক্ষমতা তাঁর স্বামীর নেই। শুধু মানুষটার কাছে বলার জন্যে বলা!
বউটার অবশ্য তাতে তিনি কোনো দোষ দেন না। তাঁর পাশে জীবনে কেউ ছিল না। মোহন মিঁয়া নিজেও কখনো তাঁর পাশে থাকতে পারেননি। নিজের মতো বউটারও পোড়া কপাল। তিনি নিজেও একসময় কতো কথা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু ধু ধু মরুর বুকে গাধার বহর ছাড়া একটা কাকপক্ষীও ছিল না। বউটার অবশ্য আশেপাশে মানুষের অভাব ছিলো না কিন্তু নিজের কথাগুলো বলার মতো একটা মানুষও কি ছিল ! আজও যে আছে তাও হলফ করে বলার সুযোগ নাই। মোহন মিয়াঁ এতবছর পর ফিরে এসেছে ঠিকই কিন্তু কূটকৌশলের এই সংসারের সম্পূর্ণ বেমানান তিনি!
বউটা জীবনের সমস্ত চাওয়া-বিসর্জনের বিনিময়ে এ-সংসারটা করেছে। স্বামী বছরের পর বছর মরুভূমির তপ্ত বালুর ওপর জীবন পার করেছে। মানুষটার জন্যে তাঁর মনে ছিল অফুরান মায়া-ভালোবাসা। মনটা সারাক্ষণ বিক্ষিপ্ত থাকত, অসহনীয় দুঃখ হতো মানুষটার জন্যে। সে সময়ে, কষ্ট ভুলে থাকতে সমস্ত মনোযোগ দিত সে সংসারটার উপর। সংসার বিষয়টা তাঁর কাছে হেলাফেলার বিষয় নয়, সাক্ষাত উপচার।
এ-সংসারে একটা সময়ে বলতে গেলে কিছুই ছিল না। আব্রুহীন ছিল। এখন নেই, এমন একটা কিছু খুঁজে বের করা মুশকিল।
একটা সংসার গড়তে টাকাকড়ির চাইতেও যে বিষয়টা বেশি আবশ্যক, তা হলো- মায়া। বউটা খুব কষ্টে বিন্দু বিন্দু মায়া জমিয়ে মালা গেঁথে আজকের এই সংসার গড়েছে। সবার সংসারের ওপর দরদ থাকে না। যাদের অন্তরে সংসারের জন্যে দয়ামায়া নেই তাদের কাছে সোনার সংসারও হয়ে ওঠে তামস্রি। সংসারের মানুষগুলো বাস করে সংসার নামক যমালয়ে। তাই সংসারের গায়ে ছুরিকাচি চালিয়ে এখনই খ-বিখ- করতে বউটা নারাজ। মোহন মিঁয়া নিজেও বউকে সমীহ করে চলেন। বউর জ্ঞান বিবেচনা সাধারণ মেয়েছেলের মতো নয়। ছেলের বউরা দায়দায়িত্বের পাশ কাটিয়ে সোনার সংসারটা ভাগ বাটোয়ারা করে নিবে, তাতে মোহন মিঁয়ার নিজেরও আপত্তি আছে।
তিনি ছুটিতে দেশে ফিরতেন তাও পাঁচ সাত বছর পর পর। একবার হল কী, নিজের বড়ো মেয়েকেই ঠিকঠাক চিনতে ভুল করলেন। রেখে গেলেন হাতাকাটা ফ্রক পরা মেয়ে। পরের বারে এসে দেখেন গায়েগতরে বেড়ে ঝেরে মেয়ে লম্বায় মায়ের উপরে চলে গেছে। তারপর সে-মেয়ের বিয়ে হয়, ছোট মেয়েটারও বিয়ে হয়। পরিবারের কোনো দরকারি আয়োজনে তাঁর উপস্থিত থাকা হয় নি। মেয়ের জামাইদের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাত হয়- মরুর দেশে। তিনি দু’জামাইকে নিজের কাছে নিয়ে বিয়ের প্রথম শর্ত পূরণ করেন। ছেলেদের পড়াশুনার জন্য যদ্দূর করার করেছেন। ওরা ভালো করতে পারে নি। ভালো করতে গেলে একটা অভাব থাকতে হয় তিনি সেই অভাবটা তাদের দিতে পারেন নি।
এখন ভাবনাগুলো মাথায় এসে ছটফট করে! দোষটা আসলে তাঁর নিজের। ছেলেরা পড়ার মধ্যিখানে ঘোষণা দেয়, দেশ ছেড়ে বিদেশ যাবে। বড় বিদেশ ! বাবার মতো ছোট দেশে যেয়ে গাধা চড়ানো তাদের পোষাবে না। তারা পৃথিবীর নামকরা দেশে যাবে। অবশ্য তারা বড় দেশে যেতে পারেনি। ওসব দেশে যেতে শুধু বাবার-টাকা নয়, নিজের যোগ্যতাও লাগে ! যোগ্যতা বাবার- টাকা ক্ষয়ে কেনা সম্ভব হয় নয়।
ছেলেরা বিয়ের বয়সের আগেই নিজেদের পছন্দে ধুমধাম করে বিয়ে করেছে। যতটা দরকার ছিলো না তার চেয়ে বেশিই করেছে। মায়ের কথার বাইরে যেয়ে ছেলেরা খরচ করেছে। মোহন মিঁয়াকে ধারদেনা করে টাকার জোগান দিতে হয়েছে। ধারদেনা অবশ্য তিনি নতুন করেন নি, বহুবার করেছেন। ভাইদের ব্যবসার টাকা যোগাতে, বোনদের বিয়ের সময়। ছোট বাড়িতে ভাইদের আলাদা সংসারের সংকুলান হয় না বলে নতুন বাড়ির জায়গা কিনতে-এরকম বহুবার ধারদেনায় ডুবেছেন!
বিয়ের পরপর ছুটিতে দেশে না ফিরে বাড়তি কাজ করে গেছেন, ধারকর্জ শোধ করতে। পরিবারের সবার খুব দরকার মিটিয়েছেন নিজেকে অ-দরকারিতে রেখে। বউটা এসময় চোখের পানি ফেলত। তাঁকে দেশে ফিরে আসতে কত কাতরোক্তি করেছে ! মোহন মিয়াঁ বুকে পাথর বেঁধে সেসব সয়ে গেছেন।
ইদানীং মোহন মিয়াঁর বড়ো আফসোস হয়- নিজের জন্য যতটুকু, বউটার জন্য তার সহস্র গুণ বেশি।
প্রতি সপ্তাহে লম্বা চওড়া একটা চিঠি পেতেন বউয়ের গুটিগুটি হাতের লেখায়। যেদিন চিঠি হাতে পেতেন মনে হতো যেন মরুর বুকে সুখের অঝোর ধারার বর্ষণ বয়ে গেল। চিঠিতে দুজনের স্বপ্নগুলো ঠাসা করে বোনা থাকত। স্বপ্ন বুনে রাখত বউটা তার শাড়ির ভাঁজে, আঁচলের ছোঁয়ায়। সময়ের সাথে সাথে স্বপ্নরা ঝরে গেছে। মোহন মিঁয়া তপ্ত বালুর নিচে যতœ করে লুকিয়ে রাখা সেসব স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেন সময়ের ফেরে। বহুদিন পর সব হারিয়ে বসে বসে ভাবনাগুলোর জাবর কাটেন।
মাঝে মাঝে মনে হয়- এ বয়সে দেশে ফেরা মস্ত বড়ো ভুল হয়েছে। জীবনের বাকিকটা দিন মরুদেশে কাটিয়ে দিলে অন্তত দেশের মানুষগুলোর অবজ্ঞা থেকে বাঁচা যেত। বয়েস ষাটের ঘরে কিন্তু তার সময় স্থির হয়ে আছে সেই চল্লিশ বছর আগের সময়ে। সবাই যেমন তার সাথে স্বাভাবিক হতে পারে না, তিনি নিজেও তাদের সাথে মন খুলে মিশতে পারেন না। নিজে- বউ’য়ের সাথেও মন ভাগ করা কঠিন হয়ে উঠে। সবাই কেমন বদলে গেছে কিন্তু নিজের ভাবনাগুলো, সেই প্রথম বিদেশ যাত্রার সময়ে স্থির হয়ে আছে।
মোহন মিঁয়া ঘাঁটি গেঁড়ে বসে থাকেন। দুপুর গড়িয়ে সময় বিকেলে ঠেকে। বউটা দু’দুবার তাগাদা দিয়ে গেছে। আর ডাকবে বলে মনে হয় না। অতিরিক্ত কাজে বউটা তার শরীর- মন দুটোই ক্ষয়ে ফেলেছে। গাঁটের ব্যথায় বেচারা কাহিল। মেজাজ অতিরিক্ত খিটখিটে। ক্ষণেক্ষণে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে।
মোহন মিঁয়ার নিজের শরীরের অবস্থা আরো বেগতিক। তাঁর কর্কট রোগ ধরা পড়েছে, অবশ্য সে কাহিনি কাকপক্ষীও জানতে পারেনি।
প্রায় চল্লিশ বছর মরুভূমিতে একটানা একই কাজ করে গেছেন। ধীরে ধীরে শরীরে নানা রোগ ব্যামো বাসা বেঁধেছে। নিজের রোগশোকের খোঁজ করেন নি। শরীরের ওপর জুলুম করে গতরে খেটে গেছেন। শেষের দিকে শরীর আর পেরে উঠছিল না। বাধ্য হয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। ডাক্তার তাঁকে পূর্ণ বিশ্রামে পাঠান। এবং মালিকপক্ষ এই সুযোগে তাঁকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে। নিরুপায় মোহন মিয়াঁ, দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হন!
জাকিয়া শিমু, গল্পকার