হানিফ ওয়াহিদ
বউ বিড়বিড় করে ডায়রি পড়ছে, তুমি হাওয়া আমি চাঁদ, ভাঙবো মোরা প্রেমের ফাঁদ! তুমি হাওয়া…
আমরা দু’জনেই পড়ছি। বউ কবিতা পড়ছে, আমি চোখ বুজে দোয়া ইউনুস পড়ছি।
হঠাৎ ডায়েরি বন্ধ, এরপর চোখ গরম করে বলল, হাওয়া কে? তার সাথে তোমার কী সম্পর্ক?
আমি চুপ করে রইলাম। বউ রাগান্বিত গলায় বলল, চুপ করে থাকবা না, এইটা তোমার শ্বশুরবাড়ি, আজিমপুর কবরস্থান না। আমার বিশ্বাস, তুমি এখনো জীবিত আছো। আজিমপুর কবরস্থানে কথা বলা যায় না, এখানে যায়। মুখ খোলো।
আমরা বসে আছি পাশাপাশি চেয়ারে। ঘরের দরজা বন্ধ। দৌড় দেওয়ার উপায় নাই।
ভাবলাম, তাকে আরেকটু রাগিয়ে দেই, দেখি কী করে। গুলি টুলি তো আর করবে না।
আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম, মুখ খুলে কোথায় রাখবো? তোমার কোলে? বাড়তি চেয়ার তো নাই… তাছাড়া কাল রাতে দাঁত মাজি নাই…
তীর্যক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ম্যাডাম ধমকের সুরে বলল, মোটেও আমার সাথে রসিকতা করবা না, আমি তোমার বউ, শালি না।
আমি তো সেটাই বলছি,তুমি আমার বউ, পাজি ম্যাজিস্ট্রেট না।
মহিলা হুংকার দিয়ে বলল, শোন, তুমি ঘুঘু দেখেছো ফাঁদ দেখো নাই… আজকে তুমি ঘুঘু দেখবা, সাথে ফাঁদও দেখবা।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। মনে মনে একটা কবিতা আউরালাম,
আমি ধরা খাওয়া কবি রণ-ক্লান্ত,
ওগো বউ,কখন হবে তুমি শান্ত!
বউ শান্ত হচ্ছে না, তার রেডিওর আওয়াজ ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। ভাবছি, কখন তার ব্যাটারির চার্জ শেষ হবে। চার্জ শেষ হচ্ছে না, ভাঙ্গা রেডিও বেজেই যাচ্ছে।
ভাবছি, আমার সামনে যে রাগী মহিলা বসে আছে, সে তেলাপোকা দেখলে ভয় পায়। আর আমি এই মহিলাকে বাঘের চেয়ে বেশি ভয় পাই। তাহলে জীবন যুদ্ধে কে এগিয়ে আছে, আমি না তেলাপোকা?
তেলাপোকা দেখলেই আমার হিংসা হয়। আহা! যদি তেলাপোকা হইতে পারতাম!
ঘটনা হলো, আমার জীবনের একটাই শখ, কবি হওয়া। কবি হলে বিরাট সুবিধা। বড় বড় দাড়ি মোচ রাখা যায়। সেলুনে গিয়ে মাসে মাসে চুল কাটাতে হয় না। ছেঁড়া ফাটা জামা পরলেও সমস্যা নাই, বরং তালি দেওয়া জামা পরলে একটা ভাব আসে। পনেরো দিন পর একবার গোসল করলেই চলে।
ইচ্ছেটা পাথর চাপা দেওয়া ছিল, কিন্তু একদিন শাহবাগের মোড়ে এমন একজন কবির সাথে আমার দেখা হয়ে গেল। গোপন ইচ্ছে জাগিয়ে উঠলো। বিড়ি ভাগাভাগি করে খেয়ে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।
আমার বউয়ের তখন প্রথম বাচ্চা হবে। কয়েক মাসের জন্য সে বাপের বাড়ি চলে গেল। এটাই হলো আমার কবি হওয়ার মোক্ষম সুযোগ।
আমিও দাড়ি মোচ বড় করা শুরু করলাম। গোসল করা বন্ধ করে দিলাম। সপ্তাহে একদিন গোসল করি। একটা ডায়রি কিনে আনলাম। দিনরাত কবিতা লিখি। এবার আমার কবি হওয়া ঠেকায় কে?
একটা কবিতা হলো-
তুমি হলে গরু, আমি হবো ঘাস
তুমি হলে নদী আমি হবো মাছ।
তুমি হলে মরিচ, আমি হবো জ্বাল,
তুমি হলে নদী,আমি হবো খাল।
তুমি হলে নৌকা, আমি হবো বৈঠা,,,
আরেকটা কবিতা-
ছেড়ায় কয় ছেড়ি রে
সয় না আর দেরি রে,
আয় আয় যাইগা
তুই আর আমি ভাইগা!
ছেড়ি কয় ছেড়া রে
তুই তো খুবই ম্যাড়া রে,
তোর তো গাল চাপা ভাঙ্গা
তোরে কেমনে করি সাঙ্গা?
কবিতা লিখে বন্ধু বান্ধবকে উৎসর্গ করি, কেউ প্রশংসা করে, কেউ কেউ গালি দেয়। এক বন্ধু বিয়ে করেছে, তাকেও উৎসর্গ করে লিখলাম। প্রথম দুই লাইন এরকম –
দোস্ত তুই খুবই ভাগ্যবান,
যদিও বিয়া করছোস মা’র সমান!
সেই ব্যাটা আমাকে এই মারে তো সেই মারে! পারে তো কবিগিরি ছুটিয়ে দেয়!
যখনই দুই চার লাইন কবিতা মাথায় আসে, সাথে সাথে টুকে ফেলি। কিছু লাইন হলো এইরকম –
১। তুমি চানাচুর আমি মুড়ি,
চিপাচাপায় আসো, প্রেম করি।
২। বাঁশ বাগানের মাথার উপর
চাঁদ উঠেছে ঐ,
গাঁজা খাইয়া পইড়া আছি
ডার্লিং তুমি কই?
৩। তুমি হাওয়া আমি চাঁদ
ভাঙ্গবো মোরা প্রেমের ফাঁদ,
আমি কলসি তুমি দড়ি,
আসো দু’জন প্রেমে পড়ি।
ওগো সেরা সুন্দরী,
চলো দু’জন প্রেম করি,,,
আমার সবই প্রেমের কবিতা। যখন ভাবছি, নিজেকে নিজেই যুগশ্রেষ্ঠ প্রেমের কবি উপাধি দিবো,তখনই বউয়ের হাতে কট খেয়ে গেলাম।
ডায়েরিতে কবিতা লেখা সমস্যা ছিল না, সমস্যা বাঁধলো ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করতে গিয়ে। একদিন তুমি হাওয়া আমি চাঁদ কবিতাটা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। কেউ একজন বউকে সেই পোস্টে মেনশন দিয়েছে।
পোস্ট করার পরদিনই শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার ডাক এলো। এরপর শুরু হলো হাওয়া নিয়ে তদন্ত। কে এই সুন্দরী!
আমার রিমান্ড শুরু হয়েছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা আমার ম্যাডাম। দুইদিন পর তার বাচ্চা হওয়ার ডেট, এরমধ্যেই সে কোকাতে কোকাতে কঠিন তদন্ত শুরু করেছে। জামাইকে ঘায়েল করার জন্য মহিলারা এতো এনার্জি কই পায় কে জানে!
বউকে কিছুতেই বুঝাতে পারছি না, হাওয়া নামের কোনো সুন্দরীর সাথে আমার লটরপটর কিংবা ইটিশপিটিশ নাই।
হঠাৎ যেন নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করে ফেলেছে এমন উল্লসিত গলায় বলল, এই শোনো,স্কুলে থাকতে গ্রামের একটা মেয়ে পড়তো না তোমার সাথে, যার নাম হাওয়া?
বউ উল্লসিত হলে কী হবে, আমার হাঁটু কাঁপতে লাগল। ওরে সর্বনাশ! একদিন কথার ছলে এই মেয়ের নাম বলেছিলাম, তাকে বলেছিলাম আমাদের ক্লাসে একটা সুন্দরী মেয়ে পড়তো,ওর নাম হাওয়া।
মনে রেখে দিবে কে জানতো!
বলদা আমি, তখন তো আর বুঝি নাই, বউয়ের সামনে সুন্দরী ক্লাসমেটের তারিফ করা আর পেট্রোল পাম্পের ভিতরে গিয়ে সিগারেট ধরানো সমান কথা!
ওরে নিয়া এই কবিতা লিখছো,ঠিক না?
আমি চুপ করে রইলাম। সে লাফিয়ে উঠল, কথা বলছো না কেন? হাওয়ার কথা ভাবতেছো? তার কথা খুবই মনে পড়তেছে?
বুঝলাম সে আমাকে ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে গেছে। উপরে উপরে রাগ দেখালেও ভিতরে ভিতরে সে দারুণ খুশি। শত্রু বধ করার অস্ত্র পেলে কে না খুশি হয়?
ফোঁস করে আমার বুক থেকে কিছু হাওয়া বের হয়ে গেল। অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, সত্যি সত্যি হাওয়া মেয়েটার চেহারা আমার চোখের সামনে ভাসছে!
কোন কুক্ষণে যে হাওয়া নিয়ে কবিতা লিখতে গেলাম! নিজেকে কেমন যেন বেআক্কল বেআক্কল লাগছে। অথচ, আমার ঠিকই আক্কেল দাঁত উঠেছে!
আক্কেল দাঁত থাকা সত্ত্বেও আমি বেআক্কল!
হঠাৎ বউ উঠে গিয়ে একটা চাকু বের করলো। আমি মনে মনে যতো দোয়া দরুদ জানি সব পড়তে শুরু করলাম। হায় আল্লাহ! এই মহিলা তার স্বামীকে খুন করতে চাইছে কেন? কবি হতে গিয়ে খুন হবো?
বউ ফ্রিজ খুলে দুইটা হিমসাগর আম বের করে চাকু দিয়ে কেটে আমার সামনে রাখলো,খাও।
আমার শরীরে প্রাণ ফিরে এলো। যাক, মারবে না তাহলে। শত হলেও আমি তার একমাত্র স্বামী। বাচ্চার মুখ না দেখতেই মেরে ফেলবে এটা মোটেই কাজের কথা না।
আম খেতে খেতে মনে মনে ভাবছি, আচ্ছা, রিমান্ডে কী আসামিকে কিছু খেতে দেয়? জানতে হবে। হাওয়া মেয়েটা কাছে থাকলে প্রশ্ন করতে পারতাম, বউকে করার সাহস পাচ্ছি না। হাতে চাকু নিয়ে ঘুরছে, বলা যায় না কী হয়।
আমি ভয়ে ভয়ে আম খাচ্ছি। বেশ মিষ্টি আম। এই দূর্যোগের সময়ও মনে হলো, হিমসাগর, আম্রপালি, ফজলি আমের মতো এতো সুস্বাদু আম থাকতে কোন ব্যাটা যে জাতীয় ফল কাঁঠাল রাখতে বুদ্ধি দিল! তারে সামনে পেলে ফাঁসি দিতাম।
পরক্ষনেই হেসে উঠলাম, শালা আমি নিজেই তো ফাঁসির আসামি। অন্যকে ফাঁসি দিবো কীভাবে!
আমি হিসেব করে দেখেছি, মেয়েরা চালাক চতুর জামাই পছন্দ করে না, তারা পছন্দ করে হাবাগোবা বউপাগল জামাই। জামাই যতো হাবাগোবা হয়, বউ তাকে নিয়ে ততই গর্ব করে। এরা মনে করে চালাক জামাই মানেই সংসারে সোয়া সর্বনাশ!
আমি হাবাগোবা সেজে বসে রইলাম। সে যতোই কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে, আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসি। এতে সে ভীষণ রেগে যায়। তার রাগ দেখেও আমি হাসি। হাসি দেখে তার কথা হারিয়ে যায়। আমি ভালো করে জানি, এটাই হচ্ছে বউকে ঘায়েল করার মোক্ষম অস্ত্র। তাদের সাথে কখনোই যুক্তিতে পারা যায় না। যুক্তিতে আমি যদি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র হই, সে তবে ভার্সিটির শিক্ষক।
আমি যুক্তি শিখতে যাব কই? বউ যে নিজেই একটা কোচিং সেন্টার!
বহু হুমকি ধামকি দিয়ে আমার মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে না পেরে অবশেষে মহিলা ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল। সে বুঝে গেল, আমি মাল বেশি সুবিধার না। সে রাগ দেখিয়ে চলে গেল, তবে তক্কে তক্কে থাকলো, কোনো হাওয়া যেন আমার কাছে ঘেঁষতে না পারে।
সে পারে তো দুনিয়ার যতো হাওয়া নামের মেয়ে আছে, সবাইকে মেরে ফেলে!
রিমান্ড শেষে খাওয়া দাওয়া করে বিকেলে শুয়েছি, ঘুম আসছে না। মাথায় কবিতার লাইন ঘুরঘুর করছে। ভাবছি, যেহেতু ম্যাডাম রাগ দেখিয়ে চলে গেছে, নিশ্চয় সহজে কাছে ঘেঁষবে না। তাছাড়া সে অসুস্থ।
আমার ধারণা ভুল প্রমান করতে বউ চা নিয়ে এসে দেখে, আমি উদাস হয়ে একদিকে তাকিয়ে আছি। সে আমার হাতে চায়ের কাপ দিতে দিতে বলল, কী ঘুম আসছে না? হাওয়ার কথা মনে পড়ছে? আহা! বেচারা!
আমি ভ্যাবদা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। বুঝলাম, পুরুষ মানুষের সর্বশেষ পাঠশালা হচ্ছে তার বউ,তারপর আর কোনো জ্ঞান নাই, তার পূর্বে অর্জিত জ্ঞানও কোনো কাজে লাগে না।
নিশ্চিত হলাম, জ্ঞান ফলাতে গেলেই সাড়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমি তসবিহ জপার মতো মনে মনে জপতে লাগলাম, বোবার শত্রু নাই, বোবার শত্রু নাই,,,আমার বউ অসুস্থ,, আমার বউ অসুস্থ,,,
সে আস্তে আস্তে বসতে বসতে বলল, বোবা হয়ে গেলা নাকি? বিড়বিড় করে কী বল? আমি কিন্তু হাওয়া না,তোমার বউ। তোমার কাজকাম দেখে তো টেনশনে আমার হার্টবিট বেড়ে গেল…তুমি আমাকে সুখে থাকতে দিবা না?
আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম, মোটেই না, কারণ আমি জানি সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। এই মূহুর্তে তোমার ভূতের কিল খাওয়া ঠিক হবে না,,,
সে ক্লান্ত গলায় বলল, টেনশনে টেনশনে কোন সময় জানি ফট করে মরে যাই,,,
আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, একদম ফাউল কথা বলবা না, মেয়েরা কোনোকিছু নিয়ে জীবনেও টেনশন করে না, ওটা পুরুষদের একচেটিয়া অধিকার। মেয়েরা টেনশন করার অভিনয় করে।
সে কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মেয়েরা টেনশন করে না, অভিনয় করে ? তুমি শিউর?
অবশ্যই। প্রমাণ চাও?
অবশ্যই প্রমাণ চাই।
আমি আমার হালকা টাক মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, এই দেখো,তোমার যন্ত্রণায় আমার মাথার চুল পড়তে শুরু করেছে। জীবনে বহু পুরুষ দেখেছি, টেনশন করতে করতে তাদের মাথার চুল পড়ে গিয়ে টাকলু হয়ে গেছে। তুমি চাইলে আমি হাজার জন দেখাতে পারবো। তুমি পারলে একজন টাক মাথার নারী দেখাও।
মহিলা কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। হয়তো মনে মনে ভাবছে, হায় আল্লাহ! এই ত্যাদোড় ব্যাটা আমার কপালে জুটলো কীভাবে!
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, শোনো, বিয়ের আগে তুমি একজনকে পছন্দ করতা এইটা আমি জানি, তবে এখন আফসোস করে লাভ নাই। প্রেমের বিয়েতেও ঝগড়া হয়, এরেন্জ ম্যারেজ হলেও ঝগড়া হয়। প্রেমের বিয়েতে আগে প্রেম হয়,তারপর ঝগড়া হয়। এরেন্জ ম্যারেজে আগে বিয়ে হয়,তারপর ঝগড়া হয়। দুটোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হতেই পারে। এটা সংসার, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কমিটির হেড অফিস না। অতএব নব পড়ড়ষ. সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে মোটেই পড়ড়ষ মনে হচ্ছে না।
আমি বললাম, এ যুগের স্ত্রীদের একটা ভয়াবহ সমস্যা কী জানো, স্বামীকে নিয়ে অকারণে ফালতু দুশ্চিন্তা করা। দুশ্চিন্তা করতে করতে এরা নানা অসুখে ভুগে। এজন্যই দেশে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের এতো চাহিদা। তুমি একজনও স্বামী বিশেষজ্ঞ দেখাতে পারবা? পারবা না। কেননা স্বামীরা বউ নিয়ে ফালতু টেনশন করে না বলেই স্বামী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রয়োজন হয় না। কেউ যদি স্বামী বিশেষজ্ঞ হয়,তাকে না খেয়ে মরতে হবে, ওদিকে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সিরিয়াল পাওয়া মুশকিল। টেনশন করা ছেড়ে দাও। আমি যে কী পরিমান তোমাকে ভালোবাসি তা তুমি নিজেও জানো না। প্রমাণ চাও?
দেও, প্রমান দেও।
এই দেখো,আমার মোবাইলের ডিসপ্লেতে তোমার ছবি। বলেই আমি মোবাইল এগিয়ে দিলাম।
সে মোবাইল হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, ব্যস, এতেই প্রমাণ হয়ে গেল তুমি আমাকে ভালোবাসো? আচ্ছা, এখন যদি তোমার শার্টের পকেটে ইঁদুর মারার বিষ পাওয়া যায়, এতে কি প্রমাণিত হবে তুমি ইঁদুর খুবই ভালোবাসো?
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার আমার মতো একটা গা-ু বিয়ে করা মোটেও উচিত হয় নাই। তোমার বিয়ে করা উচিত ছিল আইনস্টাইনকে। ও মাগো! তোমার এতো বুদ্ধি!
এবারও সে রাগ দেখিয়ে চলে গেলো। এই মহিলা কথায় কথায় রাগ করে। কোনো মানে হয়?
বিয়ের প্রথম দিকে আমার খুব মন খারাপ হতো বউ পাত্তা দেয় না বলে,এখন আর হয় না। আমি হিসাব করে দেখেছি, জগতের কোনো বউ-ই আসলে তার স্বামীকে পাত্তা দেয় না। মন খারাপ করে লাভ কী? চিকিৎসা দিয়ে তো আর এই সমস্যার সমাধান হবে না।
এরা পরের জামাইকে সাহেবজাদা মনে করলেও নিজের জামাইকে হারামজাদা মনে করে। বেশিরভাগ স্ত্রী তার স্বামীকে বুঝতে চায় না, যেন স্বামী হচ্ছে তাদের কাছে গনিত বই।
আমি মনে মনে কবিতার লাইন খোঁজার চেষ্টা করছি। পারছি না। কোনো এক বিচিত্র কারণে বারবার হাওয়া মেয়েটার চেহারা চোখে ভাসছে। মানে হয়? অথচ, সারাজীবনে একবারও মেয়েটার কথা মনে পড়ে নাই। এখন কেন পড়ছে কে জানে ? এটা কি ‘পাগল সাঁকো নাড়িস না’ অবস্থা হয়ে গেল?
রাতে অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে ফেসবুক চালালাম, ধরিয়েই নিয়েছি,বউ আমার কাছে আসবে না। কিন্তু বউ এসে হাজির। আমি ফেসবুক বন্ধ করে দিলাম। যখনই রাতে ফেসবুক বন্ধ করি, মনে হয় ফেসবুক নয় যেন ব্যবসা বাণিজ্যের হেড অফিসে তালা লাগাচ্ছি।
সে এসে আমার পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। আমিও ঘুমিয়ে যাওয়ার ভান করতে লাগলাম। হঠাৎ নীরবতা ভেঙ্গে বলল, আচ্ছা বল তো,সংসার মানে কী?
আমি অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে বললাম, সংসার হচ্ছে একটা ফাঁটা বাঁশ যেখানে পুরুষদের বিচি আটকে যায়। টান দিয়ে বিচি ছুটাতে গেলেও সর্বনাশ, ছিঁড়ে যাওয়ার ভয় থাকে।
তুমি কি আমার ওপর খুবই বিরক্ত।
আমি রাগী গলায় বললাম, না, রাগ করবো কেন? রাগ করার মতো কিছু তো করো নাই,,,আমার ধারণা বউ আর ছুরির মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। ছুরির জম্মই হয় অন্যকে কাটার জন্য।
এতো সুন্দর সুন্দর যুক্তি কোথা থেকে শিখলা? ঐ হাওয়া মেয়েটার কাছে?
আমি জবাব দিলাম না।
কিছুক্ষণ নীরব। তারপর আবার বলল, তোমাকে একটা কথা বলি শোন, মেয়েরা কার ওপর বেশি বেশি রাগ অভিমান করে জানো? যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। ভালোবাসার মানুষের পাশে তারা কাউকে কল্পনা করতে পারে না। কক্ষনো না।
আমি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, আমি অপরাধী। অন্য সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে কবিতা লিখেছি। যারা নিজের সুন্দরী স্ত্রী রেখে অন্য সুন্দরী নিয়ে কবিতা লিখে, তাদের ফাঁসি হওয়া উচিত।
সে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তুমি এখনো অভিমান করে আছো? মানুষ কিন্তু তার উপরই অভিমান করে, যার উপর তার পূর্ণ অধিকার আছে। ভালোবাসা আছে।
তোমার ওপর কোনো অভিমান নাই। তুমি ঘুমাও তো,,,
সে চুপ করে রইল। আমিও ঘুমাতে চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ সে নীরবতা ভেঙে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল, তোমরা শুধু মেয়েদের রাগ আর অভিমান দেখো, এর আড়ালে যে প্রচ- ভালোবাসা থাকে তা দেখতে পাও না। আফসোস!
হঠাৎ আমি উঠে বসলাম। কেন যেন চোখদুটো ঝাপসা হয়ে গেল।
আমি বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হানিফ ওয়াহিদ , রম্য লেখক