ফরিদুল ইসলাম নির্জন
‘তোমার প্রাক্তনের সাথে দেখা হলে কী বলবে সোমা’ গভীর রাতে সায়েমের এমন কথাতে আশ্চর্যবোধ হইনি। নৈমিত্তিক এমন প্রশ্নের সম্মুখীন আমাকে আহত করে। যার জবাব দিতে ডুকরে কেঁদে ফেলি। নরকের জীবন কেমন জানি না, তবে ইদানিং সায়েমের সাথে নরকে থাকার মতো মনে হয়। আগ্নেয়গিরিতে জ¦লে পোড়ার মত মনে হয়। জীবনে এক সময়কার পাপের প্রায়শ্চিত্ত প্রতিনিয়ত দিয়েই চলেছি। তবে সেটা পাপ ছিল কিনা আমার জানা নেই, সেটা আমার জীবনের উপভোগ ছিল, সেটা আমার জীবনপাঠে এক ধরনের অধ্যয়ন ছিল।
সায়েম কোনোদিন বলবে, ‘সত্যি তোমার সাথে কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়নি তার, একান্ত সময় ছাড়া বুঝি প্রেম হয়, তুমি মিথ্যা বলছো, আচ্ছা তুমি যখন তার বাসাতে যেতে তখন কেউ থাকতো সঙ্গে, রিকশায় চলার সময় হুড তুলতে, তোমরা ভার্সিটি থেকে যখন ট্যুরে যেতে তখন কী সে সাথে যেতো, তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে কোনো ওষুধ খেতে’।
এমন শত শত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। যা আমার হৃদয় বেত্রাঘাতের মতো ক্ষত বিক্ষত করে, কথাগুলো যেনো হৃদয়ে ধনুক ছোড়ার মতো এসে বিদ্ধ হয়।
আমার নীরবতা দেখে সায়েমের মুখে কথার খই ফোটে, ‘কি ব্যাপার! পুরানো স্মৃতিতে হারিয়ে গেলে নাকি। সোনালি সেই প্রেমময় দিন, সুখময় সময়। জীবন উপভোগের দিন। তাই হয়তো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপচাপ আছো?’
‘আমার প্রাক্তন সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকলে, সবগুলো প্রশ্ন আমাকে বলো। এভাবে প্রতিনিয়ত শুনতে ভালো লাগে না সায়েম। তোমাকে বলেছি আমি বর্তমান নিয়ে বেশ সুখে আছি। অতীতকে মনে আনতে চাই না। সেসব নিয়ে মানসিক টর্চার সহ্য করতে চাই না।’
‘কেউ অতীতকে ভুলে যেতে চাইলেই পারে। তোমাকে সহজ প্রশ্ন করেছি, সেটার উত্তর দিলেই হয়ে যায়। এত ঘুরানো প্যাঁচানোর কি আছে। সব কিছুকেই জটিল করে দেখা যেন তোমার কাজ।’
‘আমার প্রাক্তনের সাথে যদি কখনো দেখা হয়, আমি কথা বলব না। তাকে এড়িয়ে যাব। রাস্তায় তাকে দেখিয়ে থুতু ফেলে চলে যাবো।’
‘আর যদি কথা বলতে দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে তুমি কি বলবে তাকে।’
‘আমি বলবো তোমার মতো প্রতারকের সাথে বিচ্ছেদ হয়ে ভালো আছি। আমার সাথে যার বিয়ে হয়েছে, সে খুব যত্ন নেয় আমাকে। ভালোবাসার সৌরভে আমাকে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখে। বিশ^াস ও ভরসায় যার বুকে প্রশান্তি পাই। আমি কখনো তোমার ছায়া দেখতে চাই না।’
সায়েম বেড থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। আমার উত্তরে সে খুশি হয়েছে কিনা জানা নেই। তার খুশি আর অখুশি নিয়ে আমি ভাবছি না। আমি ভাবছি এখন বেঁচে থাকা নিয়ে। এরপর সায়েম রুমে এসে আমাকে বলে, ‘সরি সোমা। তোমাকে বারবার এভাবে কষ্ট দেবার জন্য। আজ মাথা ছুঁয়ে কথা দিলাম, তোমাকে কখনো আর এই বিষয়ে প্রশ্ন করব না। কখনো এসব নিয়ে কথা বলে, মানসিক যন্ত্রণাতে ফেলবো না।’
সায়েম এই কথা অনেকবার বলেছে। সে রাখতে পারেনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতার মতো ‘কেউ কথা রাখেনি।’ আমার প্রাক্তন আমাকে নিয়ে জীবন পাড়ি দেবে বলে কথা দিয়েও রাখতে পারেনি। আর সায়েম কথা দিয়েছিল সে কখনো আমার অতীত নিয়ে প্রশ্ন করবে না। কিন্ত সে হমেশাই প্রশ্ন করে। সায়েমও কথা রাখেনি। আসলে নারীদের সাথে কেউ কথা রাখতে পারে না।
আমার অতীত বলতে কিছু নেই। ধূসর অন্ধকার সেসব দিন যেনো পাগলাটে কেটেছে। আমি জীবনকে উপভোগ করেছি। অথচ সব কিছু ছেড়ে এখন শুধু সায়েমকে নিয়ে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু অভাগা কপাল আমার! যেখানেই পা দেই, সেখানেই পা ফসকে যায়। একটু শীতল জলের তৃষ্ণায় কাতর হতে চেয়েছি, কিন্তু পেয়েছি রোদ্দুরের উত্তাপ্ততা।
আমার পরিবার ছিল বেশ রক্ষণশীল। ছোটবেলা থেকেই গার্লস স্কুলে পড়তে হয়েছে। মা আমাকে সঙে করে নিয়ে যেতো। আমার ক্লাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতো। ক্লাস শেষে বাসাতে নিয়ে আসতো । কখনো কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে বা মিশতে দিত না। বাবার এ ব্যাপারে করা নির্দেশ ছিল। তার নির্দেশ অমান্য করার সাধ্য নেই কারোর। বাবা একসময় প্যারালাইসিস আক্রান্ত হন। ফলে তার ইচ্ছে, শক্তি ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। আমার ইচ্ছের চূড়ান্ত সফল হতে থাকে। মনের ভেতর আড়ালে থাকার ইচ্ছে সফল করতে মরিয়া হতে থাকি। সেই আমি ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটাতে ঢাবিতে চারুকলাতে ভর্তি হই। পরিবারের অনেকটাই ইচ্ছের বাইরে নিজের শৌখিনতাকে ভালোবেসে ভর্তি হই। সেখানে আমি খুঁজে পাই নতুন জীবন। যে জীবন আমাকে নতুন করে পথ চলতে শেখায়। আমি ভালো আর্টিস্ট ছিলাম কিনা জানা নেই। তবে সবার কাছে খুব প্রিয় ছিলাম। যে আমি কখনো কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে পারতাম না, সেই আমি দিনদিন মিশতে থাকি অনেক বন্ধুদের সাথে।
সন্ধ্যার পর সিগারেটের ধোঁয়াতে তামাটে করি মুখ। একটা জীবনের গতি পরিবর্তন করে ফেলি। কোনোদিন গাঞ্জা খেয়ে শরীর ঘাসের ওপর সটান করে দিয়ে রাখতাম। কোনোদিন
কেরু বা ভদকা খেয়ে টালমাতাল হয়ে যেতাম। সে জীবনের অন্ত নেই। রাশিয়ার ভদকা বেশ জনপ্রিয়, সেটাও খেয়েছি। একটি মদ সাপ্লাইয়ের অনলাইনে গ্রুপ ছিল। সেই গ্রুপে ২৩ জন মদখোর ছিলাম আমরা। আমি ফেইক পুরুষ মানুষের ছবি দিয়ে গ্রুপে এড ছিলাম। সময়মতো আমাদের সঠিক জায়গাতে পৌঁছে দিত মদ। আমি দিন দিন তথাকথিত অন্ধকার জগতে চলে যাই। আসলে আমার কাছে সেটা আমার আলোকময় জগৎ। যে জগৎ থেকে নিজেকে ফেরাতে পারি না। আমার মদ না খেলে, গাঞ্জায় টান না দিলে শরীর কেমন কেমন যেনো করতো। আমি ভাবতাম এই বুঝি মারা যাব। প্রেম বুঝতাম না, বিরহ বুঝতাম না। আমি বুঝতাম শুধু সিগারেটের ধোঁয়া ছড়ানো, মদের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা। বিরহ বেদনার সেসব গান যেনো আমার খুব আপন মনে হত। কেউ এক লাইন বিরহের গান গাইলে, তাকে ভীষণ আপন মনে হত। আমার ভয়েস কেমন ছিল জানা নেই। কিন্তু সবাই শুনতে চাইতো। কখনো খালিদের কন্ঠে ‘সরলতার প্রতিমা’ নিজে গেয়ে বন্ধুদের শুনাতাম, কখনো আইয়ুব বাচ্চুর ‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ গানটি গাইতাম। মনে যা আসতো তাই গাইতাম। আমাদের গ্রুপে একজন নতুন বন্ধু আসে। তার নাম রাফি। তার জীবনটা একটু ব্যতিক্রম। সে কোনো ধূমপান করতো না। তবে পাশে বসে আড্ডা দিত। তার এই সরলতা নিয়ে একদিন বন্ধু শেলিতো বলেই ফেলে, ‘তোর কী শিশ্ন আছে?’ বলতেই সবাই আমরা খিলখিল করে হেসে ফেলি। এই হাসিতে আকাশে, বাতাস কেমন অনুভূতি হয়েছিল জানা নেই। কিন্তু রাফি লাজুকতায় নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কোনো কথা বলে না, চোখে মুখে তার কিছু বলতে না পারার আক্ষেপ। শেলি তার সম্পর্কে আগে থেকেই অনেক গল্প বলে। যার ফলে তার প্রতি মায়া জন্মে।
এবার রাফি সেখান থেকে উঠে যায়। তাকে বসতে বললেও, সে কোনো জবাব না দিয়ে চলে যায়। পরেরদিন সে আর আসে না আমাদের আড্ডায়। আমার কেনো জানি একটু মনের ভেতর অনুতপ্ত বোধ হয়। কেন জানি মনে হয়, রাফি কষ্ট পেয়েছে। তার ভেতর জ¦লন পোড়ন হয়েছে। কথাগুলো এসিড ছোড়ার মতো লেগেছে তার হৃদয়ে। তার ডিপার্টমেন্টে গিয়েও দেখা পাই না। আসলে তাকে অবহেলিত করে কথা বলা হয়েছে, সে জন্য অনুতপ্ততা বেশি। এই প্রথম কাউকে দেখতে না পেরে হৃদয়টা কেমন যেনো অনুভব হয়। যে অনুভবের কথা আমার জানা নেই। তার নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দিয়ে বন্ধ পেলাম। পরীবাগ, শাহবাগ, টিএসসি, অনেক জায়গাতে খুঁজে কোথাও পেলাম না। কেনো জানি তার প্রতি প্রেম জাগে মনে। এমন প্রেম কখনো জেগেছে বলে মনে নেই। আসলে এটা প্রেম নাকি মোহ নাকি মায়া নাকি পাগলামি জানা নেই।
তাকে খুঁজে না পেয়ে অনেকটাই হতাশ হয়ে যাই। হতাশা কমাতে বাড়িয়ে দেই নেশা। আমার এই বিষণœতা দেখে পাশের বন্ধুরা হাসাহাসি করতো। ঠাট্টায় আর টিটকারিতে তারা আনন্দে মেতে থাকতো। আমার সাথে এসব নাকি বেমানান। আমি এসব কথাতে তোয়ক্কা না করে, রাফিমগ্নতায় থাকতাম। সত্যি বলতে এমন ছেলে জগতে আছে, যা আগে কখনো দেখিনি। সে যেনো একটি চাঁদ, হাজার তারার মাঝে একটি তারা। মনের কোঠায় সে দখল করে নেয়।
হঠাৎ একদিন পত্রিকা মারফত জানতে পারি, রাফি নামে একজন ছেলে ছিনতাইকারীদের কবলে নিহত হয়েছে। ছবিটি দেখে নিশ্চিত হই। খবরটি দেখার পর আমার মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ে। আমি কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না। গাঞ্জা টান দিয়ে জমিনে পড়ে থাকা বা চূড়ান্ত সঙ্গমের পর হাত পা বিছিয়ে দেবার মত নিজেকে বিছিয়ে দেই খোলা মাঠে। আমার শরীরের সব রক্ত যেনো পড়ে গেছে। আমি বেঁচে আছি নাকি মারা গেছি তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাই।
কিন্ত আশ্চর্যজনকভাবে কয়েকদিন পর আমার সে আবেগ বা মোহ ইরেজারে মুছে যায়। আমি চলতে থাকি আবার আগের মতো। বসন্তের কোকিল হয়ে কলতান তুলতে থাকি পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে। একদিন আমার বন্ধু শেলি জানায়, ‘আমার এলাকা থেকে এক ছেলে ভর্তি হবে। আমি ঢাকার বাইরে থাকবো। তুই যেনো তাকে একটু সহযোগিতা করিস। আমার হয়ে তার পাশে থাকিস। ‘এরপর সেই ছেলের নম্বর দেয়। আমি পরের দিন সকালে ক্যাম্পাসে আসতে বলি। ছেলেটা আমার চেয়ে দুই বছরের জুনিয়র। নাম শিমুল। হালকা পাতলা, শ্যামলা বর্ণের, টানা টানা চোখের ছেলেটি। দেখলেই প্রেমে পড়ে যাবার মত তা নয়। তবে চেহারার ভেতর একটা মায়া আছে, যে কেউ তার প্রতি আকৃষ্ট হবে। আবার এমনটি হয়তো আমার কাছেই মনে হয়। আমি যে খুব একটা অসুন্দরী ছিলাম, তা নয়। আমিও শ্যামাবতী মেয়ে, চোখ টানা টানা, হালকা গড়নের। সিগারেট খাবার জন্য ঠোঁট তামাটে। নিজের রূপের প্রশংসা করলে বলবো, অনেকটাই দেখতে ভারতীয় নায়িকা কাজল এর মতো।
যাই হোক আমি তাকে ভর্তির ব্যাপারে সহযোগিতা করি। সে আপু আপু বলে মুখে ফেনা তোলে। ভীষণ লাজুক স্বভাবের ছেলে। তার বিনয় ও নমনীয়তা আমার হৃদয়কে শীতল করে। মানুষ এক দেখাতে প্রেমে পড়ে, সেটা বাঙলা সিনেমাতে
দেখেছি। এখন যেনো আমার বাস্তব জীবনে উপলব্ধি করতে পাই। তার থাকার যায়গা নেই, সেই কুড়িগ্রাম থেকে এসেছে গভীর রাতে। মসজিদে রাত্রি পার করেছে। ভর্তি পর্যন্ত মসজিদে থাকবে, এমনটাই অনুরোধে ঈমাম সাহেব মেনে নিয়েছেন। ছেলেটির এমন সহজ স্বীকারোক্তি তার প্রতি আমাকে মায়া আরও বাড়িয়ে দেয়। আমার সুখ ব্যাপ্তি সহ্য হয় না। খুব কম সময়ে ফুরিয়ে যায়। একটু ভালো লাগার অনুভূতিতে হৃদয় কম্পিত, তখনি বাসা থেকে ফোন আসে আমার বাবা মারা গেছেন।
আমি ছেলেটিকে নিয়েই দ্রুত বাসাতে যাই। চারপাশে মানুষ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি যেনো কোনো জন্তু জানোয়ার। চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে এসেছি। মাকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমার সবকিছুই বাবা জেনেছিলেন একদিন। আমাকে অনেক চেষ্টা করেছেন তাদের মতে সঠিক পথে আনতে। আমি অনেকবার বাবার কাছে কথা দিয়েছি। শপথ করেছি। জীবনে কখনো নেশা করবো না, কোনো কিছু আর ছুঁয়ে দেখবো না। অসুস্থ বাবার শরীর ছুঁয়ে কথা দিয়েও রাখতে পারিনি। পরিবারকে বুঝতে দিতাম না। ঘরে থাকলে এক, আর বাইরে আমি আগের মতো নেশারু, ভবঘুরেই রয়ে যাই। এভাবেই বাবা মারা যাবার পর আমি কিছুটা পরিবর্তন আনি নিজের ভেতর। আমার কোনো ভাই-বোন ছিল না। সংসার চলার মতো অগাধ সম্পত্তি ছিলো। আমার চাচারা ও খালারা আমাকে দেখতে পেত না। আমি এসবের তোয়াক্কা করতাম না। আমি চলতাম আমার নিজের মতো করে।
এদিকে শেলির শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে, সে ভারত চলে যায়। কাছের বন্ধুরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কেউ মাদক কারবার ধরা পড়ে জেলে যায়, কেউ নারীদের হয়রানি মামলায় আটক হয়। পরে আমি একজন ভরসার ও বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে শিমুলকে পছন্দ করে ফেলি। শিমুলকে বলি আমরা দুজন সুন্দর পৃথিবী গড়বো। নিজেদের সেভাবে প্রস্তুত করবো। বিয়ে ও ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর হতে থাকি। সে আমার বয়সে ছোট, মার দ্বিমত ছিল। তবুও আমার ভালো থাকাকে মেনে নেয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আমি শিমুলকে বিযের কথা বলতেই এড়িয়ে যায়। সে সময় চায়।
সে আমাকে জানায়, পরিবারের সাথে কথা বলে, ভেবে জানাবে।
সে আমার সাথে ঘুরত, আড্ডা দিত, ফাস্টফুডে খেত। অথচ বিয়ের কথা বলতেই সে কেমন যেনো হয়ে যায়। এর কারণ হয়ত আমার আগের জীবন সম্পর্কে বলেছিলাম তাকে। একসময় সে জানায় গ্রামের ছেলে। এমন শহরে মেয়েকে পরিবার মেনে নেবে না। যতই সম্পত্তি থাকুক, বউ হিসেবে বাবা মায়ের অপছন্দ। তার বউ হিসেবে অন্য কাউকে পছন্দ করেছে তার মা-বাবা। তাকেই বিয়ে করবে। পরিবারের বাইরে সে কোনো কিছু করতে পারবে না। শহরে মেয়ে হওয়াটা যেনো আমার কাল হয়ে গেল।
আমি তার কথায় হতভম্ব হয়ে যাই। নিজেকে হতাশার চূড়ান্ত শিকলে বেঁধে ফেলি। একবার মনে হয় আত্মহত্যা করবো, নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলবো। আরেকবার মনে হয় কার জন্য আত্মহত্যা করবো। আমিতো আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে নই। নানান চিন্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। চোখে মুখে মরীচিকা ঘুরপাক খেতে থাকে। এভাবে রাস্তায় চলতেই প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা লাগে। যখন জ্ঞান ফেরে, তখন দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে। পাশে মা ও আমার এক কাজিন। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। আমি মাকে বলতে থাকি, আমি এমন জীবন চাইনি। তবে আমার জীবন এমন হলো কেন। আমার কাজিন এই করুণাময় অবস্থা দেখে বিব্রতবোধ হয়। মা আমার এই বেদনায় কাতর হয়ে পাথর হয়ে যায়। এক সময় আমাকে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। কাউন্সিলিং করে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যাই। আমি নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে থাকি। মনটা শক্ত করতে থাকি। একদিন আমার বড় চাচার ছেলে, সেই কাজিন আমাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি অতীত নিয়ে শুধু বলেছি একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো। সে তার জীবন সম্পর্কে বলে। এক মেয়ের সাথে রিলেশনে শারীরিক সম্পর্ক হয়। কিন্তু মেয়েটা নাকি এরকম অনেকের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে বেড়ায়, জানার পর তাদের ব্রেকাপ হয়। সে ব্যাংকে জব করে। আমি রাজী হই। আমাদের কমিটমেন্ট ছিলো অতীতকে নিয়ে আমরা কেউ কখনো কথা তুলবো না। কেউ কাউকে খোঁচা দেব না।
পরে সায়েমকে বিয়ে করি। নতুনভাবে পথ চলতে থাকি। নতুন স্বপ্ন বিভরোতায় সেভাবে নিজেকে নিয়ে মরিয়া হয়ে যায়। আমার ধ্যান,জ্ঞান, বেঁচে থাকাটা সংসারকেন্দ্রিক করে ফেলি। প্রথম প্রথম আমাদের জীবন ভালোই চলতে থাকে। হানিমুনে চলে যাই নেপাল। আমি জীবনের অতীতের সব স্মৃতি হত্যা করে ফেলি। সায়েমকে বিশ্বাসের ঘরে একমাত্র দীপশিখা ভাবতে থাকি। লতাপাতার মত তাকে আকড়ে ধরি। তার শারীরিক সক্ষমতা তেমন ছিল না। তারপরও আমি মেনে নেই। কাউকে এসব বললে, উল্টো আমাকে দোষারোপ করবে। আমি ওয়েস্টার্ন কালচারের, দেশের নাগর দিয়ে চলে না। এমনটি হয়তো বলে বেড়াবে।
কোনো এক চূড়ান্ত রজনীতে রোমাঞ্চ করার পর আমি যখন হাত পা ছেড়ে শুয়ে আছি, তখন সায়েম আমাকে বলে,‘তোমার প্রাক্তন কী তোমার ঠোঁটে চুমো এঁকে দিয়েছিল।’ তার এই আচমকা প্রশ্নে আমি তাকিয়ে থাকি। তাকে বলি, ‘হঠাৎ করে তোমার এই প্রশ্ন। তোমার সাথে কথা ছিল আমার অতীত টানবে না।’ সে খিলখিল করে হেসে দেয়। তারপর বলে, ‘তোমাকে এমনিতে এই প্রশ্ন করেছি। আচ্ছা বাদ দাও।’
সেদিন কথা না বাড়ালেও পরে আরেকদিন বলে,‘তুমি রিকশাতে কখনো ওঠেছো তার সাথে।’
আমি বললাম, ‘আমার প্রয়োজনে তার সাথে রিকশাতে গিয়েছি! শুধু তার সাথে কেনো আরও কতজন বন্ধুদের সাথে রিকশাতে ওঠেছি। ’
তারপর সে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘খানকি মাগি, বেশ্যা মাগি। এসবেই তোর জীবন পার করছিস।’ বলেই রুম থেকে চলে যায়।
আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। নীরবে সয়ে গেলাম। সে রাতে ফিরল না। হোয়াটসঅ্যাপে ছবি দিল সে পুরানো বান্ধবীকে নিয়ে রিকশাতে যাচ্ছে এক রেস্টুরেন্টে। ফিরবে না আজ। আমি বললাম, প্লিজ এমন করো না। বাসাতে এসো।’ সে কোনো জবাব দিল না, কিন্তু বাসাতে ফিরে আসে।
তারপর আগের মতো সায় দিয়ে বলতে থাকে, ‘সরি! আমার মাথা ঠিক ছিল না।’ এসব কথা আমি মাকে বলতাম না। কারণ মা এমনিতইে একাকী থাকে। একদিন আমাকে বলে, ‘ফেসবুকে যেনো কোনো ছেলে মানুষ লিস্টে না থাকে। কোনো মেয়ে কমেন্ট করলেও তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতো। কখনো কখনো বলতো, ‘তোমার প্রাক্তন মেয়ে আইডি খুলে তোমার সাথে কথা বলে নাতো।’
আমি বলি, ‘কি সব বলো সায়েম।’ তারপর আমি ফেসবুকই ডিএক্টিভ করে দিই। তাকে বলি আমি অনলাইনে তোমাকে ছাড়া কাউকে রাখবো না। সে সন্তুষ্ট হয়। তবে সেটাতেও শর্ত জুড়ে বলে,‘তার সাথে কথা বলার পর যেনো আমি নেটের লাইন বন্ধ রাখি।’ আমি তাই করি। খুব আশ্চর্যজনক হলেও সত্য আমি নিজেকে এতোটা পরিবর্তন করেছি, ভাবতেই অবাক হই। একদিন সময় কাটাতে ছবি আঁকতে থাকি। মনের ক্যানভাসে রং মেখে ছবি আঁকতে থাকি। কল্পনায় কোনো এক অচেনা পুরুষের ছবি আঁকছি। হঠাৎ সে আমার পাশে আসে। তারপর জোরে চিৎকার দিয়ে বলে, ‘তোর লজ্জা নাই। তোর মতো খারাপ মেয়ে জীবনে দেখি নাই। বেশ্যা মাগি।’ বলেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে জোরে এলোপাথারি থাপ্পড় দেয়। রংতুলি ছুড়ে মারে, আঁকানো ছবি ছিড়ে ফেলে। তার এই হিং¯্র আচরণ আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারি না। রুম থেকে চলে যায়। কি করবো ভেবে পাই না। আরেকদিন এসে বলল,‘তুমি ট্যুরে গেছো কক্সবাজার, রাত্রি যাপন কার সাথে করেছিলে।’ আমি বললাম, ‘আমরা মেয়েরা এক রুমে ছিলাম।’ কথাটি বলতেই চুলের খোপা ধরে ঘুরপাক দেয়। আমার পিঠে কিল ঘুষি দিয়ে চলে যায়। তার এমন আচরণে একবার মনে হয় আত্মহত্যা করি। কারণ ডিভোর্স দিলে মা হয়ত বুঝবে, কিন্তু অন্য সবাই ভাববে আমি খারাপ ছিলাম। এখনো আগেরমতো রয়ে গেছি। তার জন্য সমাজে মাকে অনেক হেনস্তা হতে হবে। তারচেয়ে নিজের ভেতর বিষয়টি অমীমাাংসিত হিসেবে রেখে দিই!
ফরিদুল ইসলাম নির্জন, গল্পকার