মাহবুবা চৌধুরী
শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে মালিক ও শ্রমিকের মধ্যকার ন্যায় ও নীতিগত সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও শ্রমিকদের প্রতি আর্থিক ও মানবিক অবিচার প্রতিরোধ, আট কর্মঘন্টা নির্ধারণ, শ্রমিকের শ্রমের যথাযথ মূন্যায়ন এবং শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট পরিবেশ ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা প্রতিষ্ঠার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই মে দিবস।
বিভিন্ন দেশে পহেলা মে অথবা মে মাসের প্রথম সোমবার আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয়। বাংলাদেশের মানুষও যথাযথ মর্যাদায় ও গুরুত্বের সাথে দিনটি উদযাপন করেন। এটি একটি সরকারি ছুটির দিন। এই মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের জন্য গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। এর পিছনে রয়েছে এক রক্তক্ষয়ী মর্মান্তিক ইতিহাস। উনিশ শতকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনের সহিংসতার সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনাগুলির মধ্যে একটি হলো এই হেইমার্কেট দাঙ্গা বা হেইমার্কেট অ্যাফেয়ার।
শ্রম এবং শিল্পের মধ্যে একদশকের দ্বন্দ্ব একটু একটু করে দানাবেঁধে, ৪ মে, ১৮৮৬ সালের সন্ধ্যায় শিকাগোর কেন্দ্রস্থল হেমার্কেটে সংঘটিত হয়েছিল এই মর্মান্তিক সংঘর্ষ। মৃত্যুবরণ করেছিল বেশ কিছু শ্রমিক এবং পুলিশ।
আর সেই পুলিশদের মৃত্যুকে পুঁজি করে ক্ষমতাধর মালিকপক্ষের এক প্রহসনমূলক বিচারে নিরপরাধ ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা, একদিন পূর্বে কারাভ্যন্তরে একজনের আত্মহত্যা, অন্য একজনের পনের বছরের কারাদ-ের কলঙ্কিত ইতিহাস রচিত হয়।
উনিশ শতকের গোড়া থেকে, বিশেষ করে ১৮২০ সাল থেকে ইউরোপে মানবতাবাদী আন্দোলনে ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন সরকার দাসপ্রথা নিরুৎসাহিত করে। পরে ১ জানুয়ারি ১৮৬৩ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন আনুষ্ঠানিকভাবে দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ক্রীতদাসদের মুক্তি ঘোষণায় স্বাক্ষর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদিও আইনত ক্রীতদাসপ্রথার অবসান ঘটে কিন্তু কৃতদাসতুল্য শ্রমিকের ভাগ্যের পরিবর্তন হলো না। যুক্তরাষ্ট্রে তাঁতশিল্পে বা কৃষি খামারে যে কৃতদাসরা কাজ করতেন তারাই শিল্প উন্নয়নে শ্রম দিতে শুরু করলো ১২ থেকে ১৬ ঘন্টা।
১৮৭০ সাল থেকে প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব। এ সময়ে দেশটির কারখানাগুলোতে উৎপাদন বেড়ে যায়। শ্রমের অভাব ছিল না বলে শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি বিবেচনা করতেন না মালিকপক্ষ। কাজের পরিবেশও ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। ১৯৮০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে দেশটিতে কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল বছরে গড়ে ৩৫ হাজারেরও বেশি।
অপর্যাপ্ত আলো, ধূলাবালিতে ভরা নোংরা, অরক্ষিত পরিবেশ ও বাষ্প এঞ্জিনের তাপে একটানা ১২ ঘণ্টা বা তার চেয়েও বেশি সময় কাজ করতে হতো শ্রমিকদের। সবচেয়ে ঝুঁকিতে ছিল শিশু শ্রমিকরা। কখনো কখনো তাদের ছোট্ট আঙ্গুল মেশিনে আটকে যেতো। দীর্ঘ সময় কাজ করতে গিয়ে শিশুরা শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত ছিল। মেশিনগুলো থেকে যে ধোঁয়া উদগিরণ হতো তার ফলে শ্রমিকরা শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ সহ নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়তেন।
উপরন্তু ১৮৭০ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। যারা কাজের সামান্য সুযোগ পেতেন, তাদের পারিশ্রমিক ছিল খুবই কম। কাজেই এ সময়টায় আমেরিকার শ্রমিকদের জীবন মারাত্মক হুমকিতে এসে পড়ে। দেখা দেয় মারাত্মক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।
এই অনিশ্চিত অবস্থার পরিবর্তনের জন্য শ্রমিকরা জোটবদ্ধ হতে শুরু করে। নিজের অধিকার লডাইয়ে সচেতন হতে শুরু করে। ১৮৬০ সালে প্রথম শ্রমিকরা নির্ধারিত মজুরী না কেটে দৈনিক ৮ ঘন্টা শ্রম নির্ধারনের দাবি জানায়। কিন্তু তখনো কোন শ্রমিক সংগঠন ছিল না বলে এই দাবি জোরালো হয়নি। এই সময় ‘সমাজতন্ত্র’ শ্রমজীবি মানুষের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। শ্রমিকরা বুঝতে পারে বনিক ও মালিক শ্রেণীর এই শোষণ নীতির বিরুদ্ধে তাদের সংগঠিত হত হবে। ১৮৮০-৮১ সালের দিকে শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠা করে Federation of Organi“ed Trades and Labour Unions of the United States and Canada যা ১৮৮৬ সালে নাম পরিবর্তন করে করা হয় American Federation of Labor বা AFL. এই সংঘের মাধ্যমে শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে শক্তি অর্জন করতে থাকে। ১৮৮৪ সালে সংঘটি ‘৮ ঘন্টা দৈনিক মজুরী’ নির্ধারনের প্রস্তাব পাশ করে এবং মালিক ও বনিক শ্রেণীকে এই প্রস্তাব কার্যকরের জন্য ১৮৮৬ সালের ১লা মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়।
কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও বণিক-মালিক শ্রেণীর পক্ষ থেকে কোন ধরনের সাড়া না পেয়ে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে প্রতিবাদি ও প্রস্তাব বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে শুরু করেন। এ সময় ‘এলার্ম’ নামক পত্রিকার একটি নিবন্ধ – ‘’একজন শ্রমিক ৮ ঘন্টা কাজ করুক কিংবা ১০ ঘণ্টাই করুক, সে দাসই” এই কলামটি শ্রমিকদের মনোবলকে আরও বৃদ্ধি করে দেয়। শ্রমিক সংগঠনের সাথে বিভিন্ন সমাজতন্ত্রদলও একাত্মতা জানায়। ১লা মে কে ঘিরে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের আয়োজন চলতে থাকে। এবং শিকাগো হয়ে উঠে এই প্রতিবাদ কেন্দ্রস্থল।
১লা মে এগিয়ে আসলে মালিক-বণিক শ্রেণী ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। শুধু তা-ই নয়, ১লা মে এর আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য ভিতরে ভিতরে বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে থাকে মালিকপক্ষ। কিন্তু সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ১লা মে সমগ্র যুক্ত্ররাষ্ট্রে প্রায় ৩০০,০০০ শ্রমিক তাদের কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে। শান্তিপুর্ণ বক্তৃতা, মিছিল-মিটিং, ধর্মঘট সবকিছু মিলে ১লা মে উত্তাল হয়ে উঠে। মিছিলকারীদের স্লোগান ছিল, ‘কাজের জন্য আট ঘণ্টা, বিশ্রামের জন্য আট ঘণ্টা, আমরা যা চাই তার জন্য আট ঘণ্টা’। পার্সন্স, জোয়ান মোস্ট, আগস্ট স্পীজ, লুই লিংসহ আরো অনেকেই শ্রমিকদের পথিকৃৎ হয়ে উঠেন। ধীরে ধীরে আরো শ্রমিক কাজ ফেলে আন্দোলনে যোগ দেয়। আন্দোলনকারী শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখে।
এদিকে ৩ মে ১৮৮৬, শিকাগোতে ম্যাককর্মিক রিপার ওয়ার্কসের শ্রমিকরা ধর্মঘট আহবান করেন। এই আহ্বানে প্রায় ৪০,০০০ শ্রমিক কাজ ফেলে কারখানার থেকে বেরিয়ে আসে। কারখানার বাইরে শিকাগো পুলিশের সাথে ধর্মঘটকারী শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়। সহিংসতায়, চার ধর্মঘটকারী মারা যায় এবং আরও কয়েক ডজন আহত হয়। বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকেও মারধর করা হয়।
এই ঘটনার প্রতিবাদে ৪ মে, ১৮৮৬, সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে-মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। অনেকেই শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। আগস্ট স্পিজ জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে শান্তিপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন, ঐ সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে উপস্থিত হয় এবং বক্তৃতা বন্ধ ও মিটিং ছত্রভঙ্গ করাতে উদ্যত হয়। হঠাৎ পুলিশকে লক্ষ করে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি একটি বোমা ছুড়ে দেয়। বোমা বিস্ফোরণে একজন পুলিশ নিহত হয় এবং ১১ জন আহত হয়। পুলিশবাহিনীও শ্রমিকদের ওপর গুলি ছোড়া শুরু করলে ঘটনাটি রায়টের রূপ নেয়। পরে আরো ৬ জন পুলিশ এবং ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২৭ মে, পুলিশ হত্যার দায়ে একত্রিশ জন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং আট জনকে গ্রেফতার করা হয়। এই আট জন হলেন-আলবার্ট পার্সনস, অগাস্ট স্পাইস, অস্কার নিবে, লুই লিংগ, জর্জ এঙ্গেল, অ্যাডলফ ফিশার, মাইকেল শোয়াব, স্যামুয়েলফিল্ডেন।
পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পিজ সহ ৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৮৮৬ সালের ৯ অক্টোবর বিচারের রায় তাদের মৃত্যুদ-ে দন্ডিত করা হয়।
এই রায় মেনে নিতে পারেননি শ্রমিক নেতাদের পরিবার। তারা রায়ের প্রতিবাদ করলেন, সমাবেশ করলেন, মিছিল, বক্তৃতা দিলেন। দেশ-বিদেশের সরকারের কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু তাদের প্রতিবাদ কোনো কাজে এলো না। ফাঁসির রায় অব্যাহত রইল। শ্রমিক নেতাদের দেখার জন্য তাদের পরিবারের সদস্যদের অনুমতি পর্যন্ত দেয়া হলো না। এমন এক প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হলো। লুই লিং ফাঁসির একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন, অন্য একজনের পনের বছরের কারাদন্ড হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহণের পূর্বে আগস্ট স্পিজ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে”।
তাই হলো, ২৬শে জুন, ১৮৯৩ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হৃৎপিন্ড হিসেবে পরিচিত মধ্য-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত অঙ্গরাজ্য ইলিনয়ের গভর্নর অভিযুক্ত আট জনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং রায়টের হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন। যদিও অজ্ঞাত সেই বোমা বিস্ফোরণকারীর পরিচয় কখনোই প্রকাশ পায়নি।
হে মার্কেটের ঘটনা, বিচার এবং মৃত্যুদ-ের পর, আগস্ট স্পাইস, অ্যাডলফ ফিশার, জর্জ এঙ্গেল, লুই লিংগ, এবং অ্যালবার্ট পার্সনকে জার্মান ওয়াল্ডহেইম কবরস্থানে (পরে ফরেস্ট হোম সিমেট্রির সাথে একত্রিত করা হয়েছিল) সমাহিত করা হয়েছিল। এবং এই শহিদদের স্বরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। এটি ছিল একটি ভাস্কর্য এবং ভাস্কর্যটি শিকাগোর শহরতলী ইলিনয়ের ফরেস্ট পার্কের ফরেস্ট হোম সিমেট্রিতে স্থাপন করা হয়।
হে মার্কেট শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভের গোড়ায় শিলালিপি লেখা হলো আগস্ট স্পীজের বক্তব্য “The day will come when our silence will be more powerful than the voices you are throttling today. ”
শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের “দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার” দাবি অফিসিয়াল স্বীকৃতি পায়। শ্রমিক নেতাদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে মে দিবসকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী “মে দিবস” বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস” পালন করা হচ্ছে। জাতিসংঘও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আই.ত্রল.ও প্রতিষ্ঠা করেন এতে করে শ্রমিকের অধিকার সমূহ স্বীকৃতি লাভ করে।
পৃথিবীর প্রতিটি খেটে খাওয়া মানুষের কাছে পহেলা মে দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে। শ্রমিকের পুঁজি হলো শ্রম। শ্রম হল এমন একটি পণ্য বা পরিষেবা যা শ্রমিকদের দ্বারা সরবরাহ করা হয়, সাধারণত দাবিকারী সংস্থাগুলি দ্বারা প্রদত্ত মজুরির বিনিময়ে। যেহেতু এই শ্রমিকরা একটি সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক বা রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ হিসাবে বিদ্যমান, তাই শ্রম অর্থনীতি অবশ্যই সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য দায়ী হবে। অর্থনীতিতে চার ধরণের শ্রম হল দক্ষ, অদক্ষ, আধা-দক্ষ এবং পেশাদার। একসাথে, এই চার ধরণের শ্রম সক্রিয় শ্রমশক্তি তৈরি করে। আর এই শ্রমশক্তি একটি দেশের উন্নয়নকে প্রতিনিধিত্ব করে।
মে দিবসের প্রেক্ষাপটে একজন শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবি হল, তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। কিন্তু আমাদের দেশের শ্রমিকরা কি সন্তুষ্ট আছে? হচ্ছে কি তাদের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা, তাদের শ্রম বিনিময় করে?
এখনো বাংলাদেশের শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে, কাঙ্ক্ষিত শ্রমমজুরির চেয়ে কম মজুরিতে আট ঘন্টার চেয়ে অধিক সময় শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন।
২০১৩ সনের ২৪ এপ্রিলে সাভারে রানা প্লাজার শ্রমিকদের ওপর স্মরণকালের ভয়াবহ ভবন ধস, ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের গার্মেন্ট কারখানায় আগুন শতাধিক নিরীহ শ্রমিকের করুণ মৃত্যু কি এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে? এর আগে ২০১০ সালে হামিম গামেন্টসসহ তিনটি গার্মেন্টসে অনেক শ্রমিকের প্রাণ চলে যায়। এ সবের অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে শুধুমাত্র মালিক শ্রেণির গাফিলতির কারণে। এভাবে গার্মেন্টসহ অন্যান্য ফ্যাক্টরিগুলোতে প্রতি বছর কোন না কোন দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে।
যদি সরকারিভাবে প্রতিটি দুর্ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সঠিক তদন্ত করে সুষ্ঠু বিচার করা হতো তাহলে এতো দুর্ঘটনা ঘটতো না। এটা এক ধরনের ঠান্ডা মাথায় খুন বলা যায়। এই হত্যার সাথে জড়িয়ে আছে ইন্স্যুরেন্স ক্লেইম, স্টক লট ক্লিয়ার করা, ইনসেন্টিভ আদায় করা, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের লিমিটের
বাইরের মাল গায়েব করে দেয়াসহ অন্যান্য অপরাধচক্র ।
যেখানে শ্রমিক আন্দোলন হয়েছিল ৮ ঘন্টা কর্ম দিবসের জন্য যেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টগুলোতে এখনও ১২ ঘন্টা কাজ করানো হচ্ছে। অন্যান্য কারখানাগুলোতেও একই দৃশ্য। চট্টগ্রাম শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে প্রতি বছর ঘটে চলেছে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু। নিরাপত্তা আইন আছে, নেই বাস্তবায়ন তাই দিন দিন বাড়ছে মৃত্যু হার। তাছাড়া আছে বেতন বকেয়া রাখায় পাঁয়তারা। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রাখছে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে, এ-ও একধরনের প্রহসন ছাড়া কিছুই না।
শিশু শ্রমে দৃষ্টি নিবন্ধ করলে দেখ যায়, আমাদের সংবিধানে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তথাপি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে শিশুরা কাজ করে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এসব শিশুরা বিদ্যালয়ের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং শারীরিক-মানসিকভাবে বেড়ে উঠাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । মায়া মমতাহীন প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে এ সব নির্বোধ শিশুরা এক সময় অপরাধ জগতের সাথেও জড়িয়ে পড়ছে অথবা অপরাধ জগৎ ওদের টেনে নিচ্ছে।
পোশাক শিল্পের বিকাশে এই দেশে নারীর শ্রমিকের অবদান সবচেয়ে বেশি। বলা যায় এই নারীরা অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রেখেছে তাদের শ্রমে এবং ঘামে। কিন্তু এই নারীরা অধিকাংশ বস্তিবাসী এবং শিক্ষা ও সামাজিক জীবন থেকে বঞ্চিত। কেননা যতটা কায়িক শ্রম তারা দেয় এবং বিনিময়ে যা পায় তাতে জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এসব কিছুই জোগানো সম্ভব হয় না। যে নারী শ্রমিকের অবদানে দেশের জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, সেই নারী শ্রমিকের চলমান জীবনযাপন বড়ই দুর্বিষহ। বেতনের সাথে যাদের জীবনযাত্রার ব্যয় খাপ খায় না তারাই হলেন গার্মেন্টস শ্রমিক।
গার্মেন্টস কর্মীদের পরে আসে নির্মাণ কর্মীদের কথা। সেখানেও নারীপুরুষ শিশুশ্রম অনায়াসে বাজারে উঠছে কিন্তু সেখানেও রয়ে যাচ্ছে বৈষম্য। একই কাজ একই সময় ধরে করেও পুরুষের চেয়ে নারী ও শিশু কর্মীরা কম মূল্য পাচ্ছে। মালিক শ্রেণিতো ঠকাচ্ছেই।
গ্রাম অঞ্চলে কৃষি কাজেও পুরুষের পাশাপাশি নারী ও শিশু কর্মী শ্রম দিচ্ছে। সেখানেও একই বৈষম্য।
পুরুষ কর্মীদের সাথে সাথে নারীকর্মীরাও দেশ ছেড়ে বিদেশে পা বাডাচ্ছে। কিন্তু বিদেশে এইসব নারী কর্মীরা কি ধরনের পেশায় নিয়োজিত আছে, আদতেই তাদের কাজ করার সম্মানজনক পরিবেশ আছে কি না, সেই খোঁজ নিয়োগকর্তা বা সরকার কতটুকু রাখেন। যদি রেখে থাকেন, তাহলে দেশে ফেরার পর তারা কেন শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলবেন।
বিত্তবানের ঘরে যে নারী বা শিশুরা শ্রম দিচ্ছে, সেই শ্রমও কেন আইনের আওতায় পড়ে না। সেখানেও কাজের সাথে অর্থ বৈষম্যের বিভেদ রয়ে যায়। আর এ সবই হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের শ্রমবাজারে বঞ্চিত হয়ে অধিকাংশ নারী কর্মী।
বাংলাদেশের শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা কোথায়? একুশ শতকে এসে শ্রমিকরা, তার কতটুকু মর্যাদা বা অধিকার ভোগ করছে? বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ শ্রমিকের শ্রম এ দেশের সম্পদ। তাদের কারণেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে।
রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে কর্মক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টা শ্রমের নিয়ম হয়তো বা প্রতিষ্ঠা হয়েছে, কিন্তু থামেনি শ্রমিক নিপীড়ন, শ্রমিক পায়নি নিরাপদ কাজের পরিবেশ। বেতন বৃদ্ধি কিংবা বকেয়া বেতন আদায়ের জন্য প্রতিনিয়তঃ বাংলাদেশের শ্রমিকরা বিক্ষোভ,সড়ক অবরোধ করে যাচ্ছে। মালিকপক্ষ আন্দোলন ঠেকানোর জন্য আইনশৃংখলা বাহিনীকে ব্যবহার করে শ্রমিক নেতা-নেত্রীদেরকে গ্রেফতার এমন কি গুম করে দিচ্ছে। কোথাও শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি এবং তাদের বাঁচার উন্নত পরিবেশ কাক্সিক্ষত মাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে দৃষ্টান্ত নেই।
বাংলাদেশ লেবার ফোর্সের জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ মহিলা শ্রমিক। মে দিবস যায়, মে দিবস আসে। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্য আর খোলে না। বিশেষ করে নারীশ্রমিকদের।
মহান মে দিবসকে শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র হিসাবে ধরে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে। তবে দেশের উন্নতি ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত ও সার্থক হবে।
মাহবুবা চৌধুরী, কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক