আ.ম.ম. মামুন
প্রিয় আন্দরকিল্লা,
ক্রমশ বেড়ে উঠছো তুমি পার্কের ঘন সবুজ গাছটির মতোন। ডালপালা ছড়াচ্ছো চারদিকে। পত্রপল্লবে সুশোভিত হচ্ছো। লাল নীল শাদা হলুদ নানান রঙের পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হচ্ছে তোমার চারপাশ। এই ডিসেম্বরে বিজয়ের মাসে পঁচিশটি বসন্ত পূর্ণ হলো তোমার। পঁচিশটি বসন্ত মানে আড়াই দশক! ভাবতেই অবাক বিস্ময় মানছি। মনে হয়, এই তো সেদিন তোমার জন্ম। বর্ণিল অক্ষরে তোমার আত্মপ্রকাশ। দিন মাস বছরে তুমি রজতজয়ন্তীর কুর্সিতে আসীন। তোমাকে অভিবাদন, প্রিয় আন্দরকিল্লা।
তোমার শিরোনাম দেখে তুমি হয়তো সবিস্ময়ে চোখ কপালে তুলছো। বলছো অন্তর্জালের (ইন্টারনেট) সর্বগ্রাসী, সর্বপ্লাবী বিস্তারে যোগাযোগের এতো এতো মাধ্যম থাকতে চিঠি কেন? তাও আাবার খোলা! কী করবো বলো? বিজ্ঞানের বিস্ময়কর যুগে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসএ্যাপ, টুইটার, ইন্সটাগ্রামের দৌর্দ- প্রতাপেও এখনো আমি হলুদ খামে মোড়ানো কম্পিত হাতে লেখা অভ্যস্ত ভুল বানানের গোটা গোটা অক্ষরের চিঠিতেই মুগ্ধ। আর তুমি জানো নিশ্চয়Ñ এই চিঠিকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে কত শত গান, কবিতা, ছোটগল্প, গাঁথামালা। এই মুহূর্তে, প্রেয়সীকে লেখা কবি রফিক আজাদের চিঠিটার কিছু অংশ মনে পড়ছেÑ
‘চিঠিও দেখা-সাক্ষাতের মতোই একটি মাধ্যম বটে। দুটির চরিত্র আলাদাÑচিঠির কাজ চিঠি করে, দেখার কাজ দেখা। একথা তো সত্য, দেখা হওয়ার সময় সব কথাই বলা হয় নাÑ কিংবা টুকরো টুকরো অনেক কথারই ব্যাখ্যা হয় না। সেগুলো চিঠিতে আসতে পারেÑ কেননা, নৈকট্যের উচ্চতা থেকে দূরে থেকে, শরীরের মাদকস্পর্শ থেকে দূরে এসে সেগুলো মনে পড়ে যায়।’ সুতরাং চিঠির ভূমিকা থাকছেই। এখন বুঝতেই পারছো কেন তোমাকে লিখছি? প্রতি মাসে তো বটেই, সপ্তাহান্তেও তোমার সাথে দেখা হয়। তবু বহু কথাই অকথিত থেকে যায়, অব্যাখ্যাত রয়ে যায়। সেই না বলা কথা লেখার উপযুক্ত উপলক্ষ্য খুঁজছিলাম। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কেমন ছিলো তোমার জন্মক্ষণটি? কেমন ভাবনাচিন্তার আক্ষরিক প্রকাশ তুমি? শুনেছি খুব বেশি ভাব-চিন্তার ফসল তুমি নও। এমন নয় যে, দিনের পর দিন মিটিং করে বড়ো কোনো উৎসব আয়োজনের ফসল তুমি? তোমার স্বপ্নদ্রষ্টার নাম সিদ্দিক আহমেদ। কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক সাংবাদিক সিদ্দিক আহমেদ। অকালপ্রয়াত কিন্তু জীবন্ত এই মানুষটি একদিন চেরাগির মোড়ে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত সিগারেট হাতে গল্প করতে করতে তাঁর ভাবশিষ্য মুহম্মদ নুরুল আবসারকে বললেনÑ‘একটি পত্রিকা বের কর। এই কলেবরের, এরকম এরকম হবে এবং নাম হবে কিন্তু আন্দরকিল্লা।’ ব্যস হয়ে গেলো। স্বপ্নের বীজ বপিত হয়ে গেলো হৃদয়ের গভীরে। এবং তোমার আত্মপ্রকাশÑপত্রিকাকারে নয় ম্যাগাজিনাকারে। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরেÑবিজয়ের মাসে তোমার জন্মসংখ্যায় তুমি প্রচ্ছদে ধারণ করলে আধুুনিক বাংলা কবিতার নিঃসঙ্গ শেরপাÑশামসুর রাহমানকে। দ্বিতীয় সংখ্যায় তুমি আবির্ভূত হলে গল্পে গল্পে। জগৎ ও জীবনের সরল জটিলতার গল্প নিয়ে তুমি পাঠকের দৃষ্টি কাড়লে। অভিনিবেশ দাবি করলে। তৃতীয় সংখ্যায় তুমি তোমার অবয়ব পাল্টালে। আলপিনে আটকানো ম্যাগাজিনের সুনির্দিষ্ট বন্ধন ছেড়ে তুমি হলে প্রমুক্ত। খোলা পাতায় হাত ছড়িয়ে তুমি এবার ট্যাবলয়েড পত্রিকা। ম্যাগাজিন থেকে পত্রিকা। মাসিক আন্দরকিল্লা। সম্প্রতি তুমি আবারো নতুন মাধ্যমে তোমাকে প্রকাশিত করেছো। এবার তুমি নিজেকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে অনলাইন ভার্সনে। বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা তোমার পাঠক এক ক্লিকেই তোমাকে দেখে নেবে, পড়ে নেবে ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোনের মায়াবী স্ক্রিনে।
আন্দরকিল্লা? এ আবার কেমন ধারা নাম? একটি পত্রিকার নাম এমন হতে পারেÑকেউ কি ভেবেছে? আমি নিজেও কি ভেবেছি? না। তোমার এমন ধারা নাম দেখে চোখ কপালে তুলেছে অনেকে। পত্রিকার নাম মুখে নিলেই চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠেÑ সংবাদ, ইত্তেফাক, আজাদী কিংবা ম্যাগাজিনের প্রসঙ্গ এলে অনিবার্যভাবে আমাদের কানে ধ্বনিত হয় বিচিত্রা, নিপুণ, রোববার, সন্ধানী, চিত্রবাংলা আরও কতো নাম। তাই বলে আন্দরকিল্লা? কী মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে এ নামে? নাম কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু? যারা সাহিত্যের ছাত্র তারা জানেন নিশ্চয়Ñ সাহিত্যের নামকরণের কতোটা গুরুত্ব? ক্যাভেনডিস সাহেব তো অনেক আগে এ প্রসঙ্গে বলেছেনÑঅ নবধঁঃরভঁষ ঘধসব রং নবঃঃবৎ ঃযধহ ধ ষড়ঃ ড়ভ বিধষঃয. অন্যদিকে শেক্সপিয়র মহাশয় মানবচরিত্রের স্বভাব ব্যখ্যা করতে গিয়ে বলেছেনÑ ‘গোলাপ যে নামেই ডাকো, তার গন্ধে কোনো তারতম্য হবে না।’ তবুও আমরা নামের গুরুত্ব মানতে চাই। কানা ছেলের নাম ‘পদ্মলোচন’ দিয়ে আমাদের চলবে না। তোমার নামের রহস্য ইতোমধ্যে পাঠক জেনে গেছে। আজ বিশেষ উপলক্ষ্যের দিনে আবারো বলি।
তাহলে কেন তুমি আন্দরকিল্লা? অন্য কিছু নও? হয়তো স্বপ্নদ্রষ্টার মনে উঁকি দিয়েছেÑঐতিহাসিক কোনো ঘটনাপ্রবাহ। এই বীর চট্টলার অতীত ইতিহাসের শরণ নিলে জানা যায়Ñ এখানে এই পাহাড়ি স্থানে ছিলো এক কিল্লা। যে কিল্লায় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিলো বলে কথিত আছে। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম মোগল সা¤্রাজ্যভুক্ত হওয়ার পর শাাসনকর্তা নিযুক্ত হন শায়েস্তা খাঁর পুত্র উমেদ খাঁ। তিনি পর্তুগিজ জলদস্যুদের ঘাঁটির অন্দরে প্রবেশ করলে জায়গাটির নাম হয় আন্দরকিল্লা। এটাই তি তোমার নামকরণের উৎস? না বোধ হয়। অন্দর মানে ভেতর। মানুষের ভেতরকার অর্থাৎ অন্দরের অন্ধকার কালিমা, অজ্ঞতা দূর করে সেখানে আলো ফেলবার একটা তীব্র্র আকাক্সক্ষা এরকম নামকরণের প্রতীকী তাৎপর্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। আর চট্টগ্রামের ‘আন্দরকিল্লা’ তো নলেজ কর্নার হয়ে অন্দরে আলো ফেলছে শত শত বছর ধরে।
তবুও তোমার এমন একটি আঞ্চলিক নাম নিয়ে নাক সিটকাতে দেখেছি বহুজনকে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের বাক্য প্রয়োগে আসর মাতাতে শুনেছি। তুমি জানো নিশ্চয়ই এলাকানির্ভর নামের পত্রিকা জগতে তুমি একমাত্র নও। আরও বহু আছে। হাতের
কাছের উদাহরণটাই টানিÑ আনন্দবাজার পত্রিকা। শুনেছি এই মিডিয়া গোষ্ঠীর মালিক যারা ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর অন্যদের মতো তারাও দেশ ছেড়ে ওপার বাংলায় থিতু হয়েছেন। আদি নিবাস যশোর জেলার আনন্দবাজার এলাকায়।
তাদের বিশাল এই প্রকাশনা শিল্পের নাম তাঁদের স্মৃতিময় গ্রাম্যহাট ‘আনন্দবাজার’ এর নামেই আজকের ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা। অনেক হয়েছে। আপাতত নামের বড়াই আর না করলেও চলবে। তবে এটা ঠিক, আজ কেউ যদি ওভার টেলিফোন জানতে চায় কোথায় আছো? জবাবে আন্দরকিল্লা বললে পাল্টা প্রশ্ন আসে- কোন্ আন্দরকিল্লা? মানে মসজিদের সামনে না আন্দরকিল্লা অফিসে? চট্টগ্রামবাসীসহ বহুলোকের কাছে তুমি এমনই প্রিয় এক নাম হয়ে উঠেছো। পঁচিশ বছর পূর্তির এই শুভক্ষণে তোমাকে আবারো শুভেচ্ছা।
এবার অন্য এক প্রসঙ্গ নিয়ে বলি। যে মানুষটি গত পঁচিশটি বছর ধরে তোমাকে আগলে রেখেছে, প্রখর রোদে ছায়া হয়ে, তুমুল বৃষ্টিতে ছাতা হয়ে তাকে তুমি কতোটা জেনেছো? তার ভেতরকার ক্ষরণের কতোটুকু ধারণ করো তুমি? কতো কতো রাত বিনিদ্র জেগে, এ পাড়া ও পাড়া ছুটে, অবহেলা আর অসহযোগিতার ছায়া মাড়িয়ে তোমাকে আলোর মুখ দেখায়, যন্ত্রের যন্ত্রণা থেকে তোমাকে টেনে বের করেÑতাকে কতোটা জেনেছো?
তোমার চোখের সামনে কতো দ্রুত বদলে গেলো সব। চিরচেনা চেরাগির চেহারা পাল্টালো, একতলা দোতলা ভবনগুলো আকাশ ছুঁলো, কতো পত্রিকা বেরুলো, কাছের মানুষগুলো অচেনা হয়ে গেলো, কারণে অকারণে বদলালো; কেবল বদলালো না তোমার সম্পাদক মুহম্মদ নুরুল আবসার। মাঝেমাঝে ভেবে অবাক হই। মৃত মানুষ পঁচে যায়। জীবিত মানুষ স্বাভাবিকভাবে বদলায়। কিন্তু এই মানুষটাÑআগের মতোই রয়ে গেলো। কীভাবে পারলো? এমন নয় যে, সামর্থ ছিলো না। ছিলো। কিন্তু তার সদ্ব্যবহার নাকি দুর্ব্যবহার সে করলো না। ছলনা জানলো না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখলো না। শুধু তোমাকেই মোক্ষ ভেবে, ভালোবাসা মেনে কাটিয়ে দিলো একটা জীবন। সবাই পারে না। কেউ কেউ পারে। স্থূল সার্থকতাকে তুচ্ছজ্ঞান করতে না পারলে জীবনে এতোটা পথ একলা পাড়ি দেয়া অসম্ভব। লক্ষ্মীর আশীর্বাদ না পেয়ে কেবল সরস্বতীর হাত ধরে বিক্রিত হওয়ার কিউতে না দাঁড়িয়ে অবিক্রিত থেকে যাওয়া ব্যতিক্রম বলেই সম্ভব। তোমাকে রজতজয়ন্তীর শিখরে টেনে তোলা এই সরলসাদা কিন্তু বিস্বাসে অটল নিষ্ঠ যোদ্ধাকে সশ্রদ্ধ সালাম।
একথা সত্যÑ পত্রিকা জগতে মস্ত বড় কিছু করে ফেলবার দুর্বার বাসনা নিয়ে তুমি আবির্ভূত হওনি। তুমি সাধারণই। নবীন, সাধারণ লেখকের লেখাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছো নিয়মিত। পাশাপাশি যেসব প্রবীণ প্রাজ্ঞ লেখক ভালোবেসে বাড়িয়েছে হাতÑতাদের দিয়েছো প্রশস্ত উদার জমিন, জানিয়েছো যথাযথ সম্মান। এই পঁচিশ বছরের পথ পরিক্রমায় তুমি কি পরিতৃপ্ত? পরিপূর্ণ প্রত্যাশার পালক কি গুঁজতে পেরেছো? না, বোধহয়। আবার এটাও ঠিকÑ প্রত্যাশাকে ছোঁবার দূরন্ত বাসনা নিয়ে পূর্ণ প্রস্তুতিতে এগিয়ে যাওয়াটা বড়ো কথা। অতৃপ্তি বোধই মানুষকে নিত্য সৃষ্টিশীল রাখে। তৃপ্তিবোধ প্রায়শই অক্রিয় করে তোলে। সমস্যা-জর্জর কণ্টকময় পথ চলায় কম তো প্রত্যক্ষ করোনি। দেখেছো সুন্দরের অপমৃত্যু, প্রবলের বিক্রম, পরাক্রমের সর্বগ্রাসী দংশন, নিরীহের অশ্রুপাত, তবু বিরুদ্ধ পরিবেশে দুর্জনের ভয়ংকর বিস্তারেও তুমি টিকে আছোÑ তোমার সপ্রাণ সতেজ রঙিন অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে পঁচিশ বছর পূর্ণ করেছোÑএটাও অনেক বড়ো ঘটনা দুর্ভাগা দেশে। রজতজয়ন্তীর শুভক্ষণে প্রত্যাশা করি আমাদের শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির নানা দিক বিধৃত হবে নান্দনিকতার বহুমাত্রিক বিন্যাসে। পাঠক জানবে খেলাধূলার কথা, ফ্যাশন, রান্নাঘর, ঘরকন্নাসহ প্রতিদিনকার যাপিত জীবনের চালচিত্র। স্বদেশ ও বিদেশের না দেখা ঐতিহাসিক স্থান, পর্যটন কেন্দ্র, প্রকৃতি ও মানুষের জীবন কথা মুদ্রিত হবে তোমার পাতায়। সদ্য প্রকাশিত বই, বিশ্বসাহিত্যের খোঁজ খবর, অনুবাদের সেতুবন্ধন, শিক্ষা সম্পর্কিত নানা তথ্য ও তত্ত্বÑআরও বহু কিছু।
তোমার পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে মুদ্রিত হোক বাঙালির সৃজনশীল বিনোদনের কথা, লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ সংস্কৃতি অগ্রাধিকার পাকÑতুমি হয়ে ওঠো আমাদের কণ্ঠস্বর, আমাদের দর্পণ।
আগামীর পথচলা মসৃণ হোক। সুন্দর হোক আগামী সূর্যোদয় হোক আরও সম্ভাবনাময়। সতত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তুমি নতুন রূপে আবির্ভূত হও। রজতজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে তোমাকে জানাই হৃদয়োৎসারিত ভালোবাসা। হার্দিক অভিবাদন।
আ.ম.ম. মামুন, অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক