এখন সময়:রাত ১০:৪৩- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ১০:৪৩- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

ঈশাণ তো এমনই

সৈয়দ মনজুর কবির

পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে সবুজ উঁচু বাঁধের পাশ ঘেষে। বাঁধের ওপাশে আরো অনেক বিস্তৃত সবুজ প্রান্তর পেরিয়ে নর্থ সী’র বিশাল গর্জন। বহুদূরে স্থাপত্যকলায় তৈরী লাইটহাউস প্রকৃতির সৌন্দর্যকে দিয়েছে আরো বাড়িয়ে। ঈশাণ যে পথে হাঁটছে তার ডানদিকে প্রশস্থ হাইওয়ে চলে গেছে সোজা কিয়েল শহরের দিকে। অভ্যাস হয়ে  গেছে বিকেলে কিছু সময়ের জন্য হলেও এখানে আসা চাই-ই-চাই। আজও হাঁটছে। পিছনে গাড়ির ব্রেকের শব্দ হতেই ফিরে চাইলো। একটা বড়সড় সাদা মাইক্রো এসে থেমেছে। অবাকই হলো, গাড়িটি আমাকে দেখেই থেমেছে?

অপেক্ষা করতে থাকল। সাদা মাইক্রোর দরজা খুলে অসম্ভব সুন্দরী একটা মেয়ের পিছনে হুড়মুড় করে আরেকজন মোটাসোটা ভদ্রলোক নেমে এলেন। ভদ্রলোকের হাতে মুভি ক্যামেরা। মেয়েটি এক নির্মল হাসি নিয়ে ঈশাণের সামনে এসে ইংরেজিতে বললো, এক্সকিউজ মি, মে আই নো হুইচ কান্ট্রি ইউ আর কামিং ফ্রম?

ঈশাণ স্তব্ধ। মনে বিশ্বের বিস্ময়। এই ঊনত্রিশ বছরের জীবনে তেমন কোনো মেয়েই ওকে আকৃষ্ট করেনি। এইমাত্র এই মেয়েটি সমস্ত অনুভূতিকে ওলটপালট করে দিচ্ছে। পলকহীন চোখে মেয়েটিকে দেখছে তো দেখছেই। হালকা নীল শাড়িতে যেন জলজ্যান্ত নীলপরী!

মেয়েটির দ্বিতীয় বারের প্রশ্নে ঈশাণ ঘোর কেটে বাস্তবে ফিরে আসে। লজ্জায় সাদামুখ মুহূর্তেই লাল হয়ে যায়। মেয়েটির চোখে এই রঙ বদলানো এড়ালো না। হেসে বলল স্যার, আই এম ওয়েটিং ফর ইউর রিপ্লাই।

ওহ ইয়েস, সরি, আই এম এক্সট্রিমলি সরি। আই এম ফ্রম বাংলাদেশ।

মেয়েটির প্রাণ খোলা হাসির ঝলক বয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে।

হাসি ঈশাণের মনকে আরো আপ্লুত করে। হালকা রিনরিনি বাতাস বইছে হৃদয়জুড়ে। মেয়েটি প্রায় চিৎকার দিয়ে বললো মামুন ভাই, আমি ঠিক বলেছিলাম কি না বলেন? ইনি বাংলাদেশি না হয়ে যায়ই না। পিছনে ক্যামেরাম্যানের দিকে মুখ ফেরায়।

মামুন ভাইও গদগদ হয়ে বেশ হাসি হাসি মুখে বলল, এ কারণেই তো তুমি শ্রাবণ টিভির বেস্ট রিপোর্টার আর আমি এখনো ক্যামেরাম্যান।

ঈশাণ তো অবাক, এ আবার কি হচ্ছে! আপনরাও বাংলাদেশি?

হ্যাঁ আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। প্রবাসীদের জীবন-যাপনের ওপরে একটা সচিত্র প্রতিবেদন করছি। যদি কোনো আপত্তি না থাকে, আমরা কি আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে পারি?

ঈশাণের ঘোর এখনো পুরোপুরি কাটে নি। ঘোরের মধ্যেই উত্তর ওর, হ্যাঁ হ্যাঁ। কেন নয়! অবশ্যই নিতে পারেন। আসলে নিজেই চাচ্ছে এই মায়াবিনী মেয়েটির সাথে আরও কিছুটা সময় কাটাতে। মেয়েটা আনন্দে আপ্লুত, ভাইয়া অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমার প্রস্তুতি নেই।

ঈশাণের হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকুনি দেখে মামুন ভাইকে বললো, মামুন ভাই জলদি ব্যবস্থা করেন। ক্যামেরাম্যান মামুন চটপট একটি বাটন মাইক্রোফোন ঈশাণের শার্টের কালারের নিচে লুকিয়ে আটকে দিলো। আর একটি মেয়েটির দিকে দিতে দিতে বলল, এই নাও তোমারটা।

ঈশাণের দিকে ফিরে মেয়েটি প্রশ্ন করে, ভাইয়া কোথায় বসা যায়?

ঈশাণের সলজ্জ উত্তর, আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে পারি। এত সুন্দর বিকেল!

দ্যাটস্ গুড আপনি আমার মনের কথাটাই বললেন। আমারও ঠিক একই ইচ্ছা করছিলো। চলুন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি। মামুন ভাই, আপনি বরং আমাদের হাঁটা ছবিটিই ধারন করুন। যখন ওকে বলবেন, তখন আমরা কথা বলা শুরু করব।

দুজনে  পাশাপাশি ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে। ঈশাণের বিশ্বাসই হচ্ছে না, ওর জীবনে এসব ঘটনা ঘটছে। মেয়েটির মায়াবী হাসিমাখা মুখ থেকে চোখ ফেরাতেই পারছে না। ওভাবেই দুজনে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। ওদিকে মামুন ভাই নির্দিষ্ট দূরত্বে চলে গিয়ে বললেন, ওকে।

মেয়েটি বলতে শুরু করল, সুধী আজ আমরা এসেছি সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে সুদূর জার্মানির এই অসম্ভব সুন্দর কিয়েল শহরের একদম উত্তরের নর্থ সির উপকূলে একটা ছোট্ট গ্রামে। এই সুন্দর মনোরম পরিবেশে আমরা পেয়েছি আমাদের এক প্রবাসী বন্ধুকে। এখন সেই বন্ধুর সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাবো।

আমি কণা। এসেছি আপনারা যারা প্রবাসে জীবন-যাপন করেন, সেই আপনাদের জীবনযাত্রা কেমন জানতে। আপনি আপনার নামটা বলুন।

ঈশাণ এইমাত্র নাম জানা মেয়েটির দিকে তাকিয়েই বলল, আমার নাম ঈশাণ আহমেদ হক।

আপনি এখানে কত বছর হলো এসেছেন এবং কি কাজ করছেন?

আমি বছরখানেক হলো এখানে এসেছি আর আমি ডকইয়ার্ডে কাজ করি।

ডকইয়ার্ডে আপনার কাজের ধরণ?

মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এখানে এসেছি আর এন্ড এ শিপিং কোম্পানীতে ভেহিকেল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করতে।

কিছু যদি মনে না করেন, আপনার আয় সম্বন্ধে একটা ধারণা দেবেন?

এই ধরুন বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ প্রতি মাসে।

দেশে আপনার কে কে আছেন?

আমার বাবা। খুব ছোটবেলায় আমার মা মারা যান। বাবাই আমার মা-বাবা দুটোই, এই প্রথম ঈশাণকে একটু অন্যমনস্ক মনে হলো। ব্যাপারটা কণার  চোখ এড়ালো না।

সঙ্গে সঙ্গে বলল, সরি ভাইয়া, আপনার প্রয়াত মাকে মনে করিয়ে আপনাকে কষ্ট দিলাম।

না, না ঠিক আছে, ঠিক আছে।

আমরা এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি।

এভাবে মিনিট পাঁচেক আরও কিছু বিষয়ে কথাবার্তার পর কণা বলল ভাইয়া, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে আপনার মূল্যবান সময় দেবার জন্য।

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ বলে ঈশাণ।

মামুন ভাই প্যাক আপ।

প্যাক আপ শব্দটা শুনতেই ঈশাণের বুক ধুকধুক করে উঠলো। এখনই কি কণা  বিদায় নিতে যাচ্ছে? শঙ্কিত মনে কণার  দিকে কেবলই তাকিয়ে রইলো।

ভাইয়া আমরা কালকে রাত দেড়টার প্লেনে দেশে ফিরে যাচ্ছি। কিয়েল শহরেই এক হোটেলে উঠেছি। আপাতত, এদিকে একটু ঘুরাঘুরি করে চলে যাব। আপনাকে দিয়েই সাক্ষাৎকার নেয়ার পর্বটি শেষ। কোটা পূর্ণ হয়ে গেছে। কাল সারাদিন আমাদের ছুটি।

কাল কী আমরা আরেকবার দেখা করতে পারি?

আসলে হয়েছে কি আমাদের টিভি প্যানেলের কিছু জার্মান সদস্য আছে। ওদেরকে সময় দিতে হবে একটু, সরাসরি না বলতে পারলো না কণা ।

ঈশাণ শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই কণা বিদায় নিয়ে চলে  গেলো।

২.

পরদিন দুপুর একটা। উপকূল থেকে চার কি.মি. দূরে সবচেয়ে দামি রেস্তোরাঁ। কণা দলবল নিয়ে হাজির। রেস্তোরাঁর এক কোনে দশবারো জনের এক গ্রুপ আনন্দে হই হুল্লোড়ে মত্ত। খাবারের অর্ডার ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। এক এক করে ওয়েটাররা খাবার নিয়ে পরিবেশন করতে আসছে। কণা  হঠাৎ থমকে যায় একজন ওয়েটারকে দেখে। লাফিয়ে চেয়ার থেকে উঠে যায়।

ঈশাণ ভাইয়া না?

সামনে দাঁড়ানো ওয়েটার মূর্তিমান পাথর হয়ে যায়। ঈশাণের বুকে লজ্জার জলোচ্ছ্বাস নেমে আসে দ্রুত, অতি দ্রুতই। কাঁপাকাঁপা হাতে খাবারগুলো টেবিলে সাজাতে গিয়ে দেখে কণা  হেঁটে রিসিপশন ডেস্কের দিকে যাচ্ছে। চেয়ারে বসা মামুন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জায় আরও কুঁকড়ে যায়। ওনার চোখেও বিস্ময়ের ছাপ। একটু সময় নিয়ে খাবারগুলো টেবিলে নামিয়েই ধীর পায়ে রিসিপশনের দিকে এগোয় ঈশাণ। ডেস্কের কাছাকাছি যেতেই দেখে কণা  ফিরে আসছে। সাদামুখ লাল হয়ে গেছে। চোখ ছলছল, এই বুঝি জল গড়িয়ে পড়বে। কণা  কাছে আসতেই ঈশাণ কিছু বলতে যাচ্ছিল।

ঠিক সেই সময় কণা  বলে উঠলো, ঈশাণ সাহেব আপনি এমনটা না করলেও পারতেন! আমি ছোটবেলা থেকেই প্রতারকদের দেখতে পারি না। দুঃখিত, আপনার সাক্ষাৎকার আমাদের চ্যানেলে প্রচার করা হবে না। আর আমি লজ্জিত আপনার সাথে আমার ক্ষণিকের পরিচয় হয়েছিলো বলে। আমার কষ্ট একটু বাড়িয়ে দিলেন, প্লেনে ওঠার আগে আমাকে আরও একটি সাক্ষাৎকার নিতে হবে। আমি কখনো আমার কাজ অপূর্ণ রাখি না।

ঈশাণ ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু কণা একহাত তুলে ওকে থামিয়ে দেয়, থাক ঈশাণ সাহেব, আমি যা জানার এইমাত্র রিসেপসন থেকে সব জেনে এসেছি। আপনি বছর খানেক হলো এই রেস্তোরাঁয় ওয়েটার হিসেবে আছেন। এই সত্য কথাটা বললেই পারতেন। মিথ্যে ইঞ্জিনিয়ার সেজে কি লাভ হলো? আপনি আমার সাথে আর একটি কথাও বলার চেষ্টা করবেন না, দ্রুত হেঁটে আবার দলের সাথে যোগ দেয় কণা।

ঈশাণ মাথা নিচু করে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে রিসেপশনে বসা জার্মান মেয়েটিকে কিছু একটা বলে রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে যায়।

 

৩.

পাঁচদিন পরের ঘটনা। ঢাকার মোহাম্মদপুরে আসাদ ভিলার ড্রইংরুমে ঈশাণ বসে আছে বাবার সামনে। মাথা নিচু। চোখের জল গাল বেয়ে ফোটায় ফোটায় মেঝেতে পড়ছে।

বাবা আসাদুল হকের আবেগমাখা গলা, বাবা আমার জীবনে যা কিছু ছিল এবং আছে সবই তো তোর জন্য। তোর মা মারা যাবার পর সেই ছ-বছর বয়স থেকে তোকে বুকে আগলে রেখে এখনো বেঁচে আছি। তোর মায়ের সাথে আমার অসম্ভব ভালোবাসার মৃত্যু ঘটাইনি পুনরায় বিয়ে করে। সেই ভালোবাসাই তোর মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছি। আমি তো কেবল তোর বাবাই না, তোর সবচেয়ে কাছের বন্ধুও। এমন একটা কথাও নাই যা তুই আমাকে বলিসনি। কিন্তু এই কটি বছর কি যে হয়ে গেল। তোর কিসের অভিমান? স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ পর্যন্ত কখনো দ্বিতীয়  হোসনি। বুয়েটে মেকানিক্যাল  ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে নিজের ইচ্ছাতেই ভর্তি হলি। আমি কিছুই বলিনি। তোর নতুন নতুন সৃষ্টিতে খুব শখ। অথচ শেষ পরীক্ষায় তৃতীয় হয়ে তোর কি যে হলো দুই বছর ঘরে বসেই কাটালি কিছুই করলি না। আমি তো কিছুই বলিনি তোকে। গত বছর হঠাৎ করে বললি বিদেশ যাবি। ভালো চাকরি পেয়েছিস জার্মানির এক শিপিং কোম্পানিতে। তখনো আমি নিষেধ করিনি। তোর যাতে ভালো হয় সেজন্য আমি আমার সাধ্যমত সব করেছি, কোনো বাধা দেইনি। বিদেশে যাওয়ার পর তোর কাজ সম্পর্কে আমি কিছুই জিজ্ঞেস করিনি।

 

শুধু তোর ভালোমন্দ জানার চেষ্টা করেছি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তুই প্রথম হতে পারিস নি বলে নিজের প্রতি তীব্র অভিমান। তুই হঠাৎ করে যে চলে আসলি, আমি খুব খুশি হয়েছি বাবা। আর জানতেও চাইব না কি কারণ!

না বাবা না, ঈশাণ কান্নায় ভেঙে পড়লো। তুমি ঠিকই ধরেছ। তৃতীয় স্থান আমি মেনে নিতে পারি নি। কেবলই মনে হচ্ছিল আমি আমার বাবাকে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটা দিতে পারি নি। অনেকটা সময় বসে থাকার পর বুঝতে পারলাম, আমি যা করছিলাম তাতে নিজেকেই আরও বেশি অপমান করা হচ্ছে। ভাবলাম তোমার থেকে দূরে চলে যাই। জীবনটাকে আবার নতুন করে শুরু করি। যা ভেবেছিলাম তা হয়নি বাবা। আমি জার্মানির ঐ কোম্পানিতে জয়েন করার পনের দিনের মধ্যেই ওদের অর্থনৈতিক বিশাল ধ্বস নামে। সে কারণে আমাদের সকল ইমপ্লোয়িকে চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়। সাথে দেয় তিন মাসের বেতন। আর বলে তোমরা দেশেও ফিরে যেতে পারো, আবার বছর খানেক অপেক্ষাও করতে পারো। কোম্পানি অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠলে তোমরা সকলেই তোমাদের পূর্বের পদ ফিরে পেতে পার। সেখানে থাকার ভিসা জটিলতা ওরাই সমাধান করে দেবে। করেও দিয়েছিলো বাবা। আমি দেশে ফিরে যেতে চাচ্ছিলাম না বলে তোমাকে জানাই নি। আর সমুদ্রের ধারের সেই পরিবেশটা আমাকে এতোটাই আকৃষ্ট করেছিলো যে ভাবলাম বছরখানেক ওখানে থেকেই যাই। আমি যে কাজের জন্য ওখানে গিয়েছিলাম অন্য কোথাও সেরকম কাজের কোনো পদ খালি ছিলো না বলে আমি একটা রেস্তোরাঁয় অডজব নিয়েছিলাম।

তুই অডজব নিয়েছিলি! আমাকে তো বলতেও পারতিস। আমার যত টাকা সে সবই তো তোর। আমি পাঠিয়ে দিতাম। আমার কাছে খুলে বললি না কেন বাবা?

বাবা সেখানেই তো আমার সংশয়। ভেবেছিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর টাকার জন্য তোমাকে কোনোদিন বলব না। আমার ভুল হয়ে গেছে বাবা, আমি নিজেও বুঝতে পারছি আমার ফিরে এসে নিজেই কিছু করা উচিত ছিলো।

বাবার চোখেও জল, দ্যাখ বাবা তুই ফিরে এসেছিস,  আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দ আজ। আমার যা আছে তা দিয়ে তোর কোনো স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে পারিস কি না। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি তুই অবশ্যই এখানেও প্রথম হবি।

ঈশাণ আগের মতোই বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।

 

৪.

দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেলো! কত হবে? চার চার বছর না! ক্রিসেন্ট  লেকের মাঝ বরাবর বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসে ভাবলো ঈশাণ। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র! লজ্জার পাথর বুকে চেপে অমানুষিক পরিশ্রম! শেষমেষ সফলতার শীর্ষে আরোহন। হ্যাঁ অনেক অনেক মেধার চর্চা আর সুপরিকল্পিত খাঁটাখাটুনীর পর অবশেষে ঈশাণ তৈরী করেছে গাড়ির ফুয়েলের এর ছোট্ট পরিবেশ বান্ধব ডিভাইস। যন্ত্রটি একাধারে চলাচলে খরচ কমাবে আবার বায়ুতে কার্বন নিঃসরনও কমাবে শতকরা পয়ষট্টি ভাগ। গত সপ্তাহেই হলো ডিভাইসটির প্রকাশ আর এরই মধ্যে সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে পারি দিয়েছে। দেশের কত মিডিয়া উঠে পরে  লেগেছে ওর সাক্ষাৎকারের জন্য। সাক্ষাৎকার দিতে আর সবাইকে না করলেও একটি চ্যানেলকে না বলতে পারে নি ঈশাণ। সত্যিকারে বলতে কি চ্যানেল মানে একজনকে। ফোনে কথা হয়েছে আজ সকালেই। কথা শুনেই বুঝেছে তিনি ঈশাণকে চিনতে পারে নি। চিনবেই বা কেমন করে  সে  তো এখন নাম লিখে আ. হক। সেই চার বছর আগে কতটুকুই বা সময়ের জন্য দেখা হয়েছিল! কিন্তু ঈশাণ একশ বছর পরও ওকে চিনতে পারবে। হৃদয়ে আজও মেয়েটির ছবি আঁকা,  মেয়েটি মানে কণার।

সাক্ষাৎকারের সময় ঠিক বিকেল পাঁচটা। স্থান ক্রিসেন্ট লেক।

ঈশাণের যে কি হলো প্রায় এক ঘন্টা আগেই এখানে এসে হাজির। রাস্তার ধার ঘেষে বসে অনেক কিছুই ভাবছে। এমনও সময় বেশ হুড়োহুড়ি পরে যায় তার কিছু দূরেই। বেশ কয়েকটা গাড়ি এসে থেমেছে। নামে পাঁচ ছয় জন ছেলে আর দুজন মেয়ে। একজনকে দেখে ঈশাণ  চমকে ওঠে।

আরে ওইতো কণা! সেই লাবণ্যময়ী, হালকা হলুদ শাড়ি আর ফিরোজা রঙের লংস্লিভ ব্ল¬াউজে লাগছে যেন একটা পরী! কিন্তু এতো আগে! ঈশাণের দৃষ্টি পাথর হয়ে আটকে যায় কণার মুখের উপর।

কণা হাঁটছে অন্য মেয়েটির সাথে। দুজনার হাসি কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙকেও ছাপিয়ে দুলছে যেন চারিদিকে। হঠাৎ সেই হাসি থেমে যায়। কণা  দাঁড়িয়ে গেছে। দৃষ্টি ঈশাণের দিকে। এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড…..। নিঃস্তব্ধতা ভাঙে কণার  চিৎকারে। আরে.. ঈশাণ  ভাই না! ঈশাণ ভাই-ই-তো?

এক দৌড়ে ঈশাণের একেবারে সামনে এসে  ছোট্ট শিশুর মতো ধপ্পাস করে বসে পরে। চোখে মুখে বিস্ময়!

ঈশাণের একটু খটকা লাগে, ওর তো এমন করার কথা না। কারণ, আমিতো ওর কাছে সেই প্রতারক হয়েই আছি! সযতনে মনের খটকা আড়াল করে, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। আমি ঈশাণ। আপনেই বোধহয় সেই কণা ? অনেক দিন পর দেখা। কেমন আছেন?

আপনি এমন কেনো ঈশাণ ভাই? চোখ জলে ভরে ফেলে কণা।

ঈশাণের মনের খটকা আরো জোড়ালো রূপ নিতে চলেছে, কি হলো আপনার! আপনি কাঁদছেন কেনো?

কিছুক্ষণ নীরবতা। কণার গাল  বেয়ে ফোটা ফোটা জল পরছে ক্রিসেন্ট লেকের লাল কংক্রিটে।

আমাকে ক্ষমা করে দেবেন ঈশাণ ভাই। আপনি কখনোই প্রতারণা করেন নি। আমি দেশে ফিরে ঐ শিপিং  কেম্পানীতে খোঁজ নিয়ে জেনেছি প্রকৃত সত্যটি। ওরা আপনার ঠিকানা দিতে পারলো না, তাই আপনার সাথে যোগাযোগও হলো না। আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি দেশে থাকলে দেখতে পেতেন আমি আপনার সাক্ষাৎকার প্রচার করেছি অন্যরকম ভাবে। আর সমস্ত স্মৃতি রেখে দিয়েছি অন্তরে আজও। বলুন, বলুন আমাকে ক্ষমা করেছেন। বলুন…

মনের ওপর  চেপে বসা কোটি কোটি টন লজ্জার পাথরটা হঠাৎ নিমিষেই উড়ে যায় ঈশাণের। চোখ বেয়ে  যেনো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে আনন্দের অশ্রু। প্রাণপণ দিয়ে ঠেকাতে চাইলো কিন্তু পারলো না।

কি আশ্চর্য! কণা আপনি এমন করে বলছেন কেনো? আপনার কোনো দোষ নেই। ওই দিনের ওই মুহূর্তের পারিপার্শিকতাই কথা বলেছে। ওতে আপনার বিন্দু মাত্র দোষ ছিলো না।

ঈশাণ দাঁড়িয়ে যায়। আর কণাকেও দাঁড়াতে হাত জোড় করে অনুরোধ করতে থাকে, আপনি প্লিজ উঠুন। প্লি¬জ উঠুন।

কণা দৃষ্টি এক বিন্দু না সরিয়েই দাঁড়ায়, আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন? প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে দুহাতে বাচ্চা মেয়ের মতই মুখ ঘষে ঘষে অশ্রুজল মুছতে থাকে।

এদিকে কণার চ্যানেলের অন্যান্যরাও এসে ওদের ঘিরে ফেলেছে। এদেরই মধ্যে একজন সেই ক্যামেরাম্যান মামুন ভাই। মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে হাত বাড়িয়ে দ্যায় হ্যালো, ঈশাণ ভাই। কেমন আছেন? আপনি পারেনও বটে। সেই যে কোথায় হারিয়ে গেলেন। দিনের পর দিন কণার মুখে কত যে আপনার নাম শুনেছি। তা এখানে? হাঁটতে আসেন বুঝি? ভাই, আজ কিন্তু আপনার বাড়ির ঠিকানা না নিয়ে ছাড়ছি না হাহ্ হাহ্ হা।

মামুন ভাইয়ের হাসিতে হঠাৎ গুমোট পরিবেশটা হালকা হতে শুরু করে। সেই হাসি ঈশাণের মাঝেও ছড়ালো।

এই তো, প্রায়ই এখানে আসি। ঢাকায় এখানকার চেয়ে সুন্দর খোলামেলা জায়গা আর নেই। থাকি ওই দিকে, মোহাম্মদপুরে। অবশ্যই ঠিকানা বলবো, লিখে নিন- বাড়ি নং: ২৮,  রোড নং: ১৮এ/২,  মোহাম্মদপুর।

কণা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু একটি বারের জন্যও দৃষ্টি ঈশাণের ওপর থেকে সরায় নি।

ঈশাণ  ভাই, আপনি কিন্তু এখন কোথাও যাবেন না। আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। আসলে একটু পরেই একজনের সাক্ষাৎকার নিতে হবে আমাকে। জায়গাটা তিনিই পছন্দ করেছেন। তিনি আমাদের দেশের গর্ব। এক সপ্তাহ হয়ে গেলো, এখনো পর্যন্ত সরাসরি কোনো সাক্ষাৎকারই দেন নি। আজ সকালেই শুধু আমাকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন। এটা আমাদের চ্যানেলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্র্ণ। ভাইয়া এই আর কিছু সময় একটু অপেক্ষা করুন। প্লি¬জ, প্লি¬জ।

ঈশাণ পাথর হয়ে যায়। বোধহয় এই পাথর হওয়াটা জন্মগত রোগ হয়ে গেছে। মুখে কিছুই বলতে পারলো না।

কণা আনন্দে এক প্রকার লাফাতে লাফাতেই ইউনিটের অন্য সদস্যদের নিয়ে একটু দূরে সরে যায়। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা সাড়ে আর হালকা মেকাপও নিয়ে নেয়। এতো কিছুর মাঝেও ঈশাণের দিকে তাকিয়ে মন ভুলানো হাসি ঠিকই দিয়েই যাচ্ছে।

পাঁচটা পাঁচ বেজে গেছে। কণাদের কাক্সিক্ষত মানুষটির দেখা নাই। কণাকে কিছুটা অস্থির মনে হচ্ছে। এদিক ওদিক পায়চারী করতে করতে এক সময় ঈশাণের একেবারে পাশ ঘেষে বসে পরে। মুখে হাসি কিন্তু কন্ঠে অনুযোগের সুর, কি হলো বলুন তো আ. হক সাহেব তো এখনো এলেন না। বিজ্ঞানী মানুষেরা কি এমনই হয়? মত টত বদলালেন না তো আবার!

না, আমারতো মনে হয় এমন কাজ উনি করবেন না। যদি মত নাই থাকতো তবে উনি রাজিই হতেন না।

আপনি এমন জোর দিয়ে বলছেন কিভাবে!

না, মানে – মানে….  ঈশাণ  লজ্জায় আবারো স্থির হয়ে যায়।

কণাই আবার কথা বলে, এক কাজ করি ওনাকে ফোন দেই। তাহলেই জানা যাবে কি ঘটলো। একমাত্র আমার কাছেই ওনার ফোন নাম্বার আছে। দেখি আপনার কথা ঠিক হয় কি না। কণা আ. হক সাহেবকে কল দেয়।

রিং হচ্ছে, চমৎকার একটা রিং টোন ভেসে এলো রবীন্দ্র সংগীত, আমি কান পেতে রই – ও আমার আপন হৃদয়, গহনও দ্বারে বারে বারে কান পেতে রই…

সুর আর কথার মূর্ছনায় কণা আবেগী জগতে চলে যায়। ও গানের ওই তিনটি খন্ড শুনতে থাকে একাগ্রতায়।

ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হয় না। আবার কল দেয়। ওই একই টিউন বেজে ওঠে। কণা পূরো টিউনটি শোনে কিন্তু ঠিক আগের মতো একাগ্রচিত্তে না। কারণ ও লক্ষ করেছে ওই সময় ঈশাণের ফোনে কল এসেছে। রিং বেজেই যাচ্ছে। পাথরের মতো ফোন হাতে বসে আছে। মনে হচ্ছে ফোন রিসিভ করতে ভুলেই গেছে। কণার মাঝে একটা কষ্ট কষ্ট ভাব আসছে। আবার আনন্দও লাগছে এই ভেবে যে সাক্ষাৎকারটা এখন নেহায়েত যদি নাই হয় তবে এক্ষুনি ঈশাণকে  নিয়ে উদ্যানের ভিতরে হাঁটতে চলে যাবে। এইবারই শেষ বলে ঈশাণের দিকে তাকিয়ে থেকেই তৃতীয় বার কল দেয়।

আর তক্ষণই ঈশাণের ফোনটা বেজে ওঠে। কণার ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে আসে। নিজের ফোন কানে  দেয়,  সেই মধুর গান। হঠাৎ লাইন কেটে দেয় আর একই সাথে ঈশাণের ফোনের রিংটিও  থেমে যায়। ব্যাপারটা অদ্ভুত! কণা পুনরায় কল দেয়। ঈশাণের ফোন বেজে উঠে আর কল কেটে দিতেই সঙ্গে সঙ্গেই ঈশাণের ফোন রিং বন্ধ হয়ে যায়।

কণার মনের মাঝে কি যেন উথাল পাথাল করছে। আবার কল দেয়, আর হঠাৎ কেটে  দেয়। আবার কল দেয়, আর হঠাৎ কল কেটে দেয়। ঈশাণ তো নিঃশব্দ পাথর। ওর হাতের ফোন বেজে উঠছে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বেজে উঠছে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এদিকে মামুন ভাই কাছে দাঁড়িয়ে পলকহীন চেয়ে দেখছেন। সেই দ্বিতীয় মেয়েটিও এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।

কণার মাঝে কিসের ঘোর জট পাকিয়ে গেছে। কল দেয়ার আর কাটার কাজটা ব্যস্ততার সাথে করেই যাচ্ছে। তবুও মনের জটটা খুলতে পারছে না। চোখে বিস্ময়, আনন্দ। অন্তর গলে অশ্রু বাধাহীন গড়িয়ে পড়ছে। হৃদয় থেকে উথলে পড়া ঢেউয়ে যেন সব- সব কিছু ভাসিয়ে দিচ্ছে।

ঈশাণের পাথর স্বভাব ভেঙে যায় কণার চোখের ভাষায়। ধীরে, খুবই ধীরে কাঁপা হাতে কণার  ব্যস্ত হাত দুটো গভীর ভালোবাসায় চেপে ধরে।

 

 

 

সৈয়দ মনজুর কবির, গল্পকার

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে