রূপক বরন বড়ুয়া :
দীর্ঘদিন এজাজ ইউসুফী ও আমি একই এলাকায় থাকলেও দু’জনের তেমন পরিচয় ছিলো না, আলাপ ও তেমন হয়নি ‘করোনা’ মহামারীর দু’বছর আগ পর্যন্ত। তবে একথাও সত্যি যে আশির দশকে সবুজ হোটেলে সবুজ আড্ডা, সপ্রতিভ নির্ভীক এক তরুণ এজাজ ইউসুফী’কে চিনিয়ে দিচ্ছিলো তার স্বতন্ত্র সত্তায় কাব্যচর্চার জন্য, সর্বোপরি তখনকার সাহিত্যাঙ্গনে লিটলম্যাগ ‘লিরিক’-এর সফল সম্পাদনার জন্য। বলা নিষ্প্রয়োজন যে স্বাধীনতাত্তোর চট্টগ্রামে অনেক লিটলম্যাগ আত্মপ্রকাশ ও প্রচারিত হলেও কালের বিবর্তে প্রায় সবকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু গুটিকয়েক লিটলম্যাগের মাঝে লিরিক’ আজও দুই বাংলা জুড়ে দেদীপ্যমান। এর জন্য কবি ও প্রাবন্ধিক এজাজ ইউসুফী’ যেমন সম্মানিত হয়েছেন তেমনি সমানে পুরস্কৃত ও হয়েছেন দু’বাংলায়। চট্টগ্রামের প্রথিতযশা ‘দৈনিক পূর্বকোণ’ জাতীয় দৈনিকে তার সহ- সম্পাদক থেকে নিজ যোগ্যতায় ফিচার সম্পাদক হিসেবে বর্ণাঢ্য সাংবাদিক জীবন কাটিয়েছেন কর্মক্ষেত্রে ভিন্নতর, ব্যতিক্রমী চিন্তা, চেতনা ও মননে। কর্মপথচলায় ইতি টেনেছেন এইতো কিছুদিন আগে।
কবি ও প্রাবন্ধিক এজাজ ইউসুফী’ উত্তর আধুনিক মনস্ক ভাবধারায় তার সাহিত্যচর্চাকে বেগবান করতে চেয়েছেন প্রথম থেকেই। বিগত কয়েক দশক ধরে এই পোস্টমডার্নিজম বা উত্তরাধুনিক ধারণা চর্চিত হয়ে আসছে। চড়ংঃসড়ৎফবৎহরংস বা উত্তরাধুনিকবাদ হলো আধুনিকতাবাদ বিরোধী একটা দার্শনিক আন্দোলনের নাম। এই মতবাদের অনুসারীগণ মনে করেন মডার্ন বা আধুনিক যুগটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের(১৯১৪Ñ১৯১৮) এর মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি হয়। এরপর উত্তরাধুনিকতার চিন্তাভাবনার বিষয়গত আঙ্গিকগত নানা প্রশ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে (১৯১৮-১৯৩৯) এর মধ্যে প্রস্ফুটিত হতে থাকে। ধারণা করা হয় বা গাণিতিক হিসেব মতে ১৯১৮ অর্থাৎ আধুনিক যুগের পরপরই উত্তরাধুনিক যুগ শুরু। উত্তরাধুনিক চিন্তক যাঁরা সবিশেষ স্মরণীয় তাঁরা হলেনÑফ্রেডরিখ ভেলহেম নিৎসে (ভৎরবফৎরপয ডরষযবষস ঘরবঃুংপযব) (১৮৪০-১৯০০) ১৯ শতকের জার্মান দার্শনিক ধ্রুপদী ভাষাতত্ত্ববিদ। মার্টিন হাইডেগার গধৎঃরহ ঐবরফবমমবৎ (১৮৮৮-১৯৭৬) যিনি আধুনিক দর্শনের ভিত্তি সাবজেক্টিভিটি, অবজেক্টিভিটি এবং যুক্তির পারম্পর্যের ধারণাকে অস্বীকার করেন। জাঁক দেরিদা ঔধপয়ঁবং উবৎৎরফধ (১৯৩০-২০০৪) একজন ফরাসি দার্শনিক তার কর্মচিন্তা সমকালীন সাহিত্যদর্শনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। মিশেল ফুকো গরপযবষ ঋড়ঁপধঁষঃ, (১৯২৬-১৯৮৪) ফুকো ফরংপঁংংরাব ৎবমরসব সধারণার প্রবর্তন করেন। ফরাসি এই দার্শনিক সামাজিক ক্রম ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে ভাষ্য, ক্ষমতা এবং সামাজিক আচরণের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন। এই উত্তরাধুনিকবাদকে দার্শনিক তত্ত্বের আদলে রূপায়িত করেনÑজাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার, ম্যাকাইন্টাইন ও রিচার্ড রবোটি। সাহিত্যে এ ধারণাটাকে নিয়ে এসেছেন ইহাব হাসান। পশ্চিম আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতাবাদ সম্পর্ক নিয়ে প্রথম ধারণা পাওয়া যায় ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত সুপরিচিত প্রবন্ধকার সালাউদ্দিন আইয়ুব’র আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিক’ গ্রন্থ থেকে। এ প্রসঙ্গে আরো কিছু ব্যাখ্যা সম্বলিত তথ্য ও উপাত্ত পাওয়া যায়। কবি, প্রবন্ধকার এজাজ ইউসুফী’র ২০০১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘উত্তর আধুনিকতা’ নতুন অন্বয়ের পরিপ্রেক্ষিত’ ও প্রতিভাবান কবি ও প্রাবন্ধিক ‘জিল্লুর রহমান’র ২০০১ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘উত্তর আধুনিকতা’ এ সবুজ করুণ ডাঙ্গায়’ থেকে।
যা হউক সময়ের হাত ধরে এ নিয়ে মুখরিত হন পশ্চিম বঙ্গের অঞ্জন সেন, তপোধীর ভট্টাচার্য ও অমিতাভ গুপ্ত। বাংলাদেশে উত্তর আধুনিক ধারা নিয়ে প্রথম সরব হতে দেখা যায় চট্টগ্রামে সবুজ আড্ডার, পুলক পাল, জিল্লুর রহমান, মোস্তাক আহমদ ও মূল কা-ারী এজাজ ইউসুফী ও সমসাময়িক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেন’কে। মূলত ভাষাতত্ত্বের আকারবাদীরা উত্তর আধুনিকতার সূচনা করেন। রুশ দেশে আকার বাদী বুদ্ধিজীবী ‘ভিকতর স্কোলাভস্কি’ তার ‘আর্ট এজ টেকনিক’ বা কৌশলরূপে শিল্প বইটি ১৯১৭ সালে প্রকাশ করেন। একটি পৃথক স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি বলেছিলেন ‘শিল্প হলো চিত্রকল্পের মাধ্যমে চিন্তা’ এবং ‘কবিতা হলো ভাবনার প্রথম ও প্রধান উপায়’। যেখানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে এসেছিল আধুনিকতার চিন্তাভাবনা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ব্যাক্তিবাদ বা ব্যাক্তির আত্মপ্রকাশই ছিল এর কেন্দ্র বিন্দু। পরে পরে সময়ের হাত ধরে উত্তরাধুনিকতা আমাদের এক অবধারিত জীবন ব্যাখ্যার কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এ প্রসঙ্গে এমিলি ডিকেন্সন এর একটা কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করতে হয়;
Faith’ is a fine invention
For Gentlemen who see!
But Microscopes are prudent
In an Emergency!
উত্তরাধুনিকতার অভ্যুত্থানের বছরটি ছিলো ১৯৬৮সাল। এ সময়ে গোটা ইউরোপ জুড়ে বামপন্থী ছাত্র যুব-শ্রমিক-বুদ্ধিজীবীরা অ্যাস্টাবলিশমেন্ট বিরোধী ও নানা ক্ষেত্রে অটোনমির দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কিন্তুু তা ছিলো লক্ষ্যহীন, রোমান্টিক বিক্ষোভমূলক এবং তাৎক্ষণিক ফলে তা স্বাভাবিকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং ডেকে আনে ঘোর হতাশা, নেতিবাচক চিন্তা বা সিনিসিজম। এরপরও উত্তর আধুনিকতাবাদ নিয়ে চর্চা থেমে যায়নি যদিও কালপঞ্জি, বিষয়বস্তু এবং দৃষ্টিভঙ্গীর নিরন্তর সংঘর্ষ ও অসংলগ্নতায় উত্তর আধুনিকতাবাদ কেমন যেন স্পষ্ট হতে পারেনি আজো। যে কয়জন বাংলাদেশে উত্তর আধুনিকতাবাদে আবিষ্ট এবং চর্চায় রয়েছেন তাদের মধ্যে এজাজ ইউসুফী অন্যতম। বলতে গেলে তারই হাত ধরে বাংলাদেশে উত্তরআধুনিকতার যুগ ও চর্চা শুরু হয়। তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো ১. স্বপ্নাদ্য মাদুলি (কাব্যগ্রন্থ-১৯৯৬), মধুব্রত অধুনা নগরে(কাব্যগ্রন্থ-২০২২) জীবন মৃদঙ্গের তাল (কাব্যগ্রন্থ-২০২১), উত্তর আধুনিকতা: নতুন অন্বয়ের পরিপ্রেক্ষিত (প্রবন্ধ-২০০১), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বিশেষ সংখ্যা লিরিক (সম্পাদনা-২০১৬), প্রফুল্ল রায়ের উপন্যাস রামচরিত্র অবলম্বনে নাটক (রামচরিত-২০১৭), আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাক্ষাতকার ও বিবিধ (সম্পাদনা-২০১৮), গদ্যের গোলাঘর (প্রথম সংকলন-২০১৯) ও লিরিক লিটলম্যাগ সম্পাদনা করেন প্রথম ১৯৮২ সাল থেকে।
আজ আমি কীর্তিমান এ কবি ও প্রাবন্ধিকের তিনটি কাব্যগ্রন্থ ১. স্বপ্নাদ্য মাদুলি, ২. মধুব্রত অধুনা নগরে, ৩. জীবন মৃদঙ্গের তাল নিয়ে আলোচনা করার জন্য সচেষ্ট হলাম।
ভিন্ন আরকে ডোবা স্বপ্নাদ্য মাদুলি
————————-
স্বপ্নাদ্য মাদুলি কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হলেও পরিত্যক্ত বিবশ ম্যাডোনা (১৯৮২) কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। স্বপ্নাদ্য মাদুলি কাব্যগ্রন্থ সেজেছে ৫৪ টি কবিতা নিয়ে। প্রতিটা কবিতা কবির স্বপ্নে আঁকা বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। কবি তার ভাব, আবেগ আর বিষয়বস্তুর আলোকে কবিতার মর্মকথাকে অনন্য মোড়কে আবরিত করেছেন। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘যৌগপদ্য’। কবিতার শরীর খুলেছে স্বপ্নময় আবেশে ডুবা বাস্তবতার আলো- আঁধারি রূপ নিয়ে;
প্রাণে বিষ মেখে দূর গ্রামে কোলাহল বাড়ে।
মেঘবতী আকাশের স্থবির সংসারে পাখি ওড়ে
নদী পাড়ে ডিম। আজ বিদ্রোহের দিন।
জীবনের চরম বাস্তব চিত্ররূপ এখানে প্রতিভাত হয়েছে, সংগ্রামমুখর জীবনের চরাচরে সম্ভবনা আর নৈরাশ্যের আলো আঁধারির ছায়া ফলাফলে বিপ্রতীপ অবস্থায় কবি বিপ্লবের ঘ্রাণ খুঁজে চলছেন। ‘নদী পাড়ে ডিম। আজ বিদ্রোহের দিন’ নদী পাড় যেখানে সম্ভাবনাময় সেখানে আজ যেন শূন্যতার কৃষ্ণঘোর।
টালত সুন্দরী থাকে পাড়া প্রতিবেশী নাই
যৌগিক আবেশে কেন্দ্রচ্যুত হাঁড়িতে নেইকো ভাত
পাটেশ্বরী জ্বাল দেয় লক্ষীর পাতল জল
চর্যা আর পুরাণ পাশাপাশি দোল খেয়েছে কবিতার এ ছত্রে। জীবনে ক্ষুধার একটা জাগতিক রূপ প্রকট হয়েছে কাল ঘূর্ণনের চিত্রে। কবির কবিতায় উত্তর আধুনিকতার ভাবধারা আলো ফেলে গেছে চুপিসারে। তার গ্রন্থের ২য় কবিতা ‘অন্তর্গত’তে তার একটা ছাপ উদ্ভাসিত হতে দেখি:
হাসন রাজায় অভিশাপ দেয় রোজ
…. ছেয়ে গেছে মাঠ গুবরে পোকার খোঁজ
নিয়ে দেখি গান বাঁধে বসে ধলা সাঁই
আরেক জায়গায় দেখি কবি শব্দে শব্দে বুনলেন;
“প্রতœদিনের নিষ্ফলা জমি চষে
গোপনে দিয়েছি নোনতা রক্ত মেখে
… জীবনের গান গেয়ে যাবো রোদে সেঁকে।”
“ইলোরার পায়ে ডুবে আছে কালো শোক
জলজবৃত্তে বেঁধে রাত দিনগুলো
লেগে থাকে গায়ে কোন মহাজনি জোঁক
দুহাতে দু’চোখ ঢাকি কানে দিয়ে তুলো।”
অসম্ভব একটা জীবনবোধ কবিতার ছত্রে ছত্রে অনুরণিত হয়েছে। কঠিন বাস্তবতার অনুর্বর বন্ধুর পথ বেয়ে কবি জীবনের গান গেয়ে চলেছেন।
এখানে একটা কথা না বললে নয় যে, উত্তর আধুনিক চিন্তনে কবিকে মিথ, উপকথা, লোকবিশ্বাস, ধর্ম বিশ্বাস, কৃষ্ণ, হাছন, লালন ইত্যাদিকে সামনে রেখে পুনঃচর্চায় আবিষ্ট হতে দেখা যায়। বড় হও প্রতিমা শিশু’তে শেষের দু’লাইন
“কৃষকেরা ফসলের ঠোঁটে তুলে দেয়
শরীর নিঙড়ানো হিমোগ্লোবিনের কণা”
কবি এখানে কৃষকের শ্রমের কথাকে তুলে ধরেছেন অনন্য চিন্তনে। কৃষকের শ্রমের ত্যাগ তিতিক্ষার কথা নবজাতকের উপলব্ধি আর অনুভবে অনুরণিত করতে চাইছেন। এ প্রসঙ্গে কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরানী’র ‘চাষী’ কবিতার দুটো লাইন মনে পড়ে গেলো:
“সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা,
দেশ মাতারই মুক্তিকামী, দেশের সে যে আশা”
দেশপ্রেম কবির অন্তরসত্তায় জাগুরূক। যে দেশের মাটিতে তিনি জন্মেছেন, আলো হাওয়ায় জীবন বেড়ে উঠেছে তার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ। ধরণীর প্রতি যে ঋণ তার ধমনীতে রক্তের কণায় কণায় বইছে তার প্রতি গভীর উপলব্ধিজাত দৃষ্টিবোধে ‘ঋণ’ কবিতায় লিখলেন;
“ঋণভারে জর্জরিত
আমাদের সে হাজার বছর,
নৃ-তত্ত্বের অই ছেঁড়া পাতায়
খোদাই করা রক্ত-আখর।”
মানবতার বিকিকিনিতে কবির গভীর দৃষ্টি আপতিত হতে দেখি ‘বিনির্মাণ’ কবিতায় দাসত্ববোধের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেলেও কবি বলে উঠলেন ‘কলোনিয়াল শিশুটি কাঁদছে শব্দহীন’ আর ‘আমরা জন্মেছি পণ্য থেকে, মৃত্যু মানে পণ্যের বিচ্ছেদ। বিশ্বব্রহ্মা-ের সবকিছু আগুন, বাতাস, ফুল, পাখি, নারী বাজারেই ফিরি আসি’ আপন জন্মভূমি ছেড়ে সংখ্যালুঘুদের অন্যত্র যেতে দেখে কবিপ্রাণ হাহাকার করে উঠলো তাই তার ‘অভিবাসন’ কবিতায় লিখলেন:
“কালিন্দীর নিরঞ্জন কাকাবাবু ভাটির বাংলা ছেড়ে
রবীন্দ্রনাথের দেশে ভিড়িয়েছেন গোধুলির তরি”
এ কবিতার কয়েকটি লাইন বেশ কাছে টানে। হৃদয় স্পর্শ করে:
“ভিন দেশে যায়। শব বাহকের কাঁধে যায়
পাতার কঙ্কাল তবু পোড়ায় স্মৃতির চুল।
নিরঞ্জন কাকাবাবু তাঁর গ্রামটির কথা ভেবে
দিশি-যুবাদের বেড়ে দেয় জুঁইভাত।
ভাষা পায় সাম্প্রদায়িকতা, দ্বিধার তুমুল অপবাদ”
চরম সত্য কথার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এ কবিতায়। সাম্প্রদায়িক চেতনায় পুষ্ট অশুভ শক্তির উৎপাতে, নিপীড়নে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের এক করুণ চিত্র প্রতিভাত হয়েছে। মানবতাবাদী এ কবিকে তার ‘মানুষ’ কবিতায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, বিভাজনে দ্রোহী হয়ে ওঠতে দেখা যায়। কন্ঠ থেকে নিসৃত হয়েছে তেজোদ্দীপ্ত উচ্চারণ:
মানুষ মানুষ করে এই হাতে নিয়েছি বন্দুক
ভাঙবো প্রতিটি তালা লুটে নেবো স্পর্ধিত সিন্দুক।
জীবনের জলতরঙ্গে ‘জীবন মৃদঙ্গের তাল’
———————
উত্তর আধুনিকতা মনস্ক কবি এজাজ ইউসুফী’র দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘জীবন মৃদঙ্গের তাল’ বাস্তবতার জলরং মেশানো অসাধারণ কাব্যের সমাহার। আধুনিকতা ও উপনিবেশিকতার ¯্রােতে বহমান একপেশে অবসাদ, জড়তা, ক্লান্তিকর হাপর টানা, শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে উত্তরণের যেন এক হিরন্ময় হাতিয়ার খুঁজে নিলেন তার কাব্যজগতে। ‘স্বপ্নাদ্য মাদুলি’র ভেতরের শাঁসে ও মজ্জায় যে নির্যাস প্রাণময় হয়ে উঠেছে তা ধারণ করে মসিবাদি চিন্তা চেতনায় তৎপর হয়ে উঠলেন হৃদয়ের, অনুভবের আর মনের কথাকে জানান দিতে। কবিতার ক্যানভাস ভরে তুললেন অনিন্দ্য সব কথাকাব্যে। সময়কে বক্ষে ধারণ করেছেন মিথ বা পুরাণের অগ্নিচরিত্রের পাশাপাশি ধর্মীয় চিন্তাচেতনা, নগরে নাগরিকের যাপিত জীবনের সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়-আশয়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দৃষ্টিপাত, নিজভূমের পরিম-লে ভ্রমণ করতে করতে বিশ্বের ক্ষুধাতাড়িত দেশগুলোকে অবলোকন করলেন সহজাত প্রবৃত্তি নিয়ে। সেখানে শব্দগুলো শব্দবাণ হয়েছে কোথাও কোথাও আবার কৌশলী শব্দের ছন্দে, নৃত্যে কাব্যময় হয়েছে কবিতা তার নির্মাণে। দ্রোহ ও প্রকাশিত নান্দনিকতায়।
‘উত্তপ্ত বালির ছাদে হন্তারক মেঘ’ কবিতায় কবির দ্রোহ প্রকাশ পেয়েছে অন্যভাবে। চিলির বিপ্লব ক্ষেত্রে স্মৃতির আতশ পুড়িয়ে খুঁজলেন স্বাধীনতার মূল কথা ও সুর, বললেন:
“স্বাধীনতা জুঁই নয়, রক্ত চায়
ফোঁটায় ফোঁটায়,
রক্ত নয়, মজ্জায় মজ্জায়
গেঁথে দিতে চায়
অলোক সাহস।”
বলার ধরণ স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব। গভীর দর্শন এখানে ডানা মেলেছে শব্দের যূথবন্ধনে অপূর্ব কাব্যচ্ছটায়। ‘বেজন্মার স্বপ্ন’ কবিতায় দ্রোহের ঝলক দেখা যায় কবির কবিতায়;
“দুঃস্থ মানব কাঁদে নিয়োজিত সেবায় কী লাভ!”
এখানে কবি মানবতার মৃত্যু দেখেছেন হেলাফেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষের সাজানো কৃত্রিম পরিসেবাকে কেন্দ্র করে। তারপর বললেন:
“তোমাদের সুখেই কাঁদি ভয়াবহ অগ্নি-জিহ্বা নিয়ে
অভিজ্ঞ ডাক্তারজন নিরাপদ মৃত্যুর আশ্রয়,
অথচ মৃত্যুর নগ্ন-বিভীষিকা কেবলি তো দিয়ে
যাবে কি ব্যবস্থাপত্র? যত্রতত্র দৃষ্টির প্রশ্রয়?”
তারপর চরম সত্য মৃত্যুকে স্বীকার করে নিয়ে অদ্ভুত সাহসে বললেন:
আমৃত্যু তোমার কাছে যূথবদ্ধ থাকবো হে মৃত্যু
মৃত্যুর ইশারা দিয়ো আগেভাগে হবো না যে ভীতু।
কতো সহজে মৃত্যুকে মেনে নিয়ে তার কাছে সমর্পিত হয়ে ‘পরাজয়’ কবিতায় শব্দময়ে ঝলসে উঠলেন:
“ঘাতকের দল ভাঙে জাহাজের তপ্ত পাটাতন
সাম্যের অরণ্যে জাগে প্রিয় নদী ফারাক্কা-যমুনা
একাকী আড়ালে থাকে কমরেড সাহসী হয় না
সামান্য কবিরা নেয় কবিতার যৌথ আয়োজন।”
‘স্বপ্নাদ্য মাদুলি’ কবিতায় কবি জীবনবোধের চরম বাস্তবরূপ অবলোকন করেছেন অন্তরসত্তা দিয়ে। জীবনের কঠিন কাল, চড়াই-উতরাই কষ্টের আদি অনাদিকাল নিকষ আঁধার রাত আর সোনালি প্রভাতের মধ্যকার স্বরূপ সবই তিনি তুলে ধরেছেন অনন্য শব্দের মাধুকরীতে। জীবনের এই শাশ্বত রূপকে রূপায়িত করলেন রূপকথাকে প্রাণবন্ত করে:
অজানা দীঘির জলে
ভোমরা ঘুমিয়ে আছে
সেখানে পদ্মপাতায়
বিষাক্ত সর্প নাচে
কাহিনির ভাঙবো কৌটো
হায়েনার হিং¯্র থাবায়,
তরঙ্গে ভাসিয়ে বুক
স্বপ্নাদ্য মাদুলি পায়।”
দেশপ্রেম কবির কবিতায় এক অনন্যরূপে প্রতিভাত হয়েছে। নিজ শহর চট্টগ্রামের প্রাচীন আমলকে তুলে ধরেছেন ‘গাঙচিল ও প্রতœস্মৃতির কফিন’ কবিতায়:
“দেয়াংগিরির সবল বাহু চিরে
হার্মাদ-পর্তুগীজগণ ফেলে গেছে
সোনার শিকল জলদস্যুদের চোরাটানে।
তাই, এখনো পিছিয়ে যায় মধ্যরাত-
শিকল বাহায়। কর্ণফুলীর গাভীন জেলেনি
চাঁদের আলোয় শুকোতে দিয়েছে
তার ভেজা চুল।”
নিজ শহরের জনজীবন আর আবহের সাথে মিশে গিয়ে লিখলেন ‘শেখ ফরিদের চশমা’ এখানে কবির আধ্যাত্মিকতার একটা গভীর টান প্রত্যক্ষ করি। কবির রাজনৈতিক দিক ও প্রত্যক্ষ করি কবির ‘চশমা হিলের মহিউদ্দিন’ এখানে একসময়ের প্রবল পরাক্রান্ত নগরপিতার শৌর্য ও বীর্যের কথা স্পষ্ট হয়েছে কবিতায়:
“বাবা শেখ ফরিদের চশমা হিলের পাদদেশে
আস্তানা গেড়েছেন ধরিত্রীপুত্র মহিউদ্দিন,
টিনশেডের নান্দনিক ঘরে আস্তিন গুটিয়ে
তিনি জনগণমগ্ন বহুদিন
কখনো নগরপিতা, কখনো সেবক
আবার কখনো বেদনায় নীল
বিচিত্রবীর্য রাজনীতিক।”
জাতির পিতার মূত্যুতে লিখলেন কবিতা ‘বঙ্গবন্ধুর জন্য এলিজি’। এখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি এবং কবির গভীর শ্রদ্ধা এবং জাতির পিতার মৃত্যুতে শোকাবহ বার্তায় শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে দেশের ক্রান্তিকালে অবিসংবাদিত নেতার অপরিহার্যতা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে লিখলেন:
বিশুদ্ধ চুম্বনে মধুগন্ধী আয়নায় কার মুখ যেন
ডেকে বলেÑআর কোন পিতা নেই।…
শেষ দেখা হলে ভোরের আকাশ ছলছল করেÑ
অন্ধকারে মুদ্রাদোষে মহান আলবাট্রস মাথা ঠুকে দূরগামী
কোনো জাহাজের বিবেকী মাস্তুলে।
বিমূর্ত ভাস্কর্যে গড়াÑ
দিগন্ত জোড়া চশমার ফাঁকেÑ
তাঁর মুখ মনে পড়েÑআর কোনো মুজিব নেই…”
উত্তর আধুনিক আরকে মধুব্রত অধুনা নগরে
———————-
জীবন মৃদঙ্গের তাল আর তার সুরে আবিষ্ট কবি চোখ খুললেন দৃষ্টি রাখলেন আধুনিক শহরে যেখানে তার নিবাস শহুরে সব বর্ণ গন্ধ নিয়ে যে অনুষঙ্গ তাকে আবরিত করে রাখে নিত্যকার অনুপম ছন্দে রাগে বিরাগে, আনন্দ বিষাদে। তারই এক বাকচিত্র অঙ্কন করলেন পুরাণ ও পুরানের রসায়নে সমসাময়িক রাষ্ট্রচিন্তা এবং আধ্যাত্মিকতার সুন্দর চিন্তন চিত্রায়ন করেছেন প্রাজ্ঞিক ধারণায়। ‘মধুব্রত অধুনা নগরে’ কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। নিজ শহরের আশয়-বিষয় কাব্যগ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন কবি অনন্য পারঙ্গমতায়। আধুনিক ভাবাবেগ আর সৃজনের উৎসে কবির ভাবনায় এলো ব্যতিক্রমী চিন্তন কাব্যসজ্জায় রাখলেন নিজস্ব সত্তা, আধুনিক নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে সৃজনের ধারাকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন। আশির দশকে কাব্যকালের খরায় যেখানে অনেক কবির অন্তরাল হয়েছে, হারিয়ে গেছে সেখানে চট্টলার সবুজ আড্ডার পুরোধা ‘এজাজ ইউসুফী’ আধুনিকতার আঁটোসাঁটো দেয়ালে আঘাত হানতে দ্রোহী হয়ে উঠলেন। তার কলম থেকে বের হলো উত্তরাধুনিক মনস্ক কবিতার নানান মাত্রা ও দিক। নিজে একাই যেন খুলতে চাইলেন নতুনত্বের বাতায়ন। ছড়িয়ে দিতে চাইলেন উত্তর আধুনিকতার মর্মকথা ও দার্শনিক ব্যাখ্যা। নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করতেই এপার বাংলা ও ওপার বাংলার সাথে সেতুবন্ধনে সচেষ্ট হলেন। তার সম্পাদিত লিটলম্যাগ ‘লিরিক’ এদিক থেকে সৌরভ ছড়ালো এখনো ছড়াচ্ছে।
কবির চিন্তা ভাবনা এখানে একদম স্বতন্ত্র, দ্রোহী, স্বর ও উচ্চারণ বলিষ্ঠ। একপেশে আবহে কেমন যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে মরিয়া, দেহ ও মনে হাঁসফাঁসের চরম অবস্থা। কবির মনন আধুনিক ও আধুনিকতার নাগপাশ থেকে ভিন্ন এক স্তরে উত্তোরণ। তাই তিনি তার ‘কবর’ কবিতায় কত সহজে বললেন:
আধুনিক নগরীতে থেকেও আমার কেন যেন
মনে হয়, আমি বেঁচে আছি
কোন এক ধ্রুপদী সময়ে
কবির কাছে আধুনিকতা আর আধুনিক নেই তা প্রাচীন হয়ে গেছে। আধুনিক শহরে তাই পাচ্ছেন পৌরাণিক ঘ্রাণ। মনে হচ্ছে এ নগরী বিরাট এক শূন্যতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যার পরিসর অনেক বড়। অনেক কিছু আছে করবার, ভাববার। বললেন কবি আর কবির প্রণয়ীর দুই ভিন্ন সত্তা বা পরিচয় নিয়ে পৃথিবীতে যেন বেঁচে থাকা। কিন্তু মৃত্যুতে এক অভিন্ন সত্তায় লীন হয়ে যায় পরিশেষে। এসব দৃশ্য মনোজগতে ঘুরপাক খাচ্ছে বলেই লিখলেন:
“আমি মানব, তুমি মানবীÑএই আমাদের পরিচয়
আমরা বেঁচে থাকি দুটি ভিন্ন সত্তা নিয়ে,
কিন্তু মরে গিয়ে অভিন্ন হই
সাড়ে তিন হাত মাটির গভীরে।”
জন্ম-মৃত্যুর সন্নিধানে যে উপলব্ধি তার শাশ^ত এক চিত্ররূপ পরিগ্রহ হয়েছে কবির অপূর্ব আবেগ আর শব্দের বৈচিত্র্যময় প্রয়োগ ধারায়। রবি ঠাকুরকে স্মরণ করতে গিয়ে রাবিন্দ্রিক
যুগের বর্ণময় আধুনিক কালের ¯্রােতে ভেসে যেতে যেতে আকণ্ঠ ডুবে খেই হারাতে হারাতে বলে উঠলেন:
“ঠাকুর আমাকে স্পর্শ করো
আমাকে তোমার বাণীবদ্ধ করো।
উত্তরাধুনিকতার এ কালে স্বেচ্ছায় চোখান্ধ
যুধিষ্ঠির হতে চায় সে কোন জন?
আজীবন না ছোঁয়া পানি না জল।”
কবিতার এ অংশ কেমন যেন ধোঁয়াটে। উত্তরাধুনিক কবি চাইছেন আধুনিকতায় পুষ্ট হতে। শব্দের দোলাচলে সত্যনিষ্ঠতা যেমন অয়োময় তেমনি সমার্থকতায় একই অর্থে প্রাণময়। আধুনিকতার প্রাজ্ঞ সুবাস বইছে চেতনার কন্দরে। মানবতাবাদী এ কবি সতত মানুষ ও তার আশয় বিষয় নিয়ে ভেবেছেন। লেখার সহজাত প্রবৃত্তি কাব্যে শব্দসজ্জায় যে মুন্সিয়ানা, বলার ভঙ্গিমায় নিজের অবস্থান থেকে একটুও চ্যুত হননি। প্রাচীন ধ্যান-ধারণাকে চাপা পড়া রুদ্ধশ্বাস থেকে মুক্তি দেয়ার প্রবণতা তার কাব্যস্বরে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। ‘মামুলি মানুষ’ কবিতায় তাকে দ্রোহী স্বরে চিৎকার করে উঠতে দেখা যায়:
“মাটির মানুষ মামুলি মানুষ
মাটিতেই যাবি তো মিশে
ধরমের নামে পরিচিত ধামে
এতো জোশ তোর কিসে।”
কত সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন ধর্মের নামে কেন মানুষে মানুষে এতো হানাহানি এতো ভেদাভেদ? কেন এই বিশে^ অরাজকতার সৃষ্টি করে ধ্বংসের আর হিংসার পথে প্রবিষ্ট হচ্ছে নিয়ত মানুষ। খুন, গুম, ধর্ষণ, অত্যাচার অনাচারের বিরুদ্ধে লোক দেখানো, পরিহাসমূলক কর্মকা- দেখে কবি স্বাভাবিকভাবে হয়েছেন ক্ষুব্ধ। অন্তঃসারশূন্য মানবতা রক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহ কবির বিবেকী মনে জ্বালা ধরিয়েছে, দ্রোহে তাই ক্ষিপ্ত হয়ে মানববন্ধন কবিতায় বললেন:
“আমি আর তোমাদের মানব বন্ধনে দাঁড়াবো না।
এর সলুক সন্ধানে যাবেন নাÑ
কারণ এই মানববন্ধনের ঔষধি গুণ হারিয়ে গেছে বহুদিন।
এটি আজ প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে না
এটি আজ মৃত্যুর শ্লোগান হতে পারে।
কারণ, কবরখানার দরোজা এখন
আর বন্ধ হয় না-যে কেউ যখন-তখন
হতে পারে দাফন-কাফন।”
সাম্প্রদায়িকতার হিং¯্রতা দেখে তিনি সক্রোধে তেতে উঠেছেন, তাই ‘আমাকে দাহ করো’ কবিতায় সক্রোধে উচ্চারণ করলেন:
“হিন্দুকুশ পর্বতমালা থেকে নেমে আসা
আমি এক হিন্দু
আমাকে পেট্রোল বোমায় পুড়িয়ে দাহ করো
তারপর চিতাভস্ম ছড়িয়ে দাও বঙ্গোপসাগরে।”
‘মধুব্রত অধুনা নগরে’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা মৃত্যুকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। তাই মৃত্যুর করাল ছায়া শব্দময় হয়েছে অনন্য দক্ষতায়। ‘বারোয়ারী স্বপ্নগুলো’ কবিতায় মৃত্যুর চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি পুনঃজন্ম ও স্পষ্টতর হয়েছে:
“তুমি ছেড়ে গেলে উড়ে যাবে লাল ফড়িং
শ্যাওলায় ঢেকে যাবে নীলাভ রোদ্দুর,
বারোয়ারী হোমাগ্নিতে পুড়ে যাবে প্রতœভূমি
ভালোবাসা মিথ্যে নয় ; ভাবো পুনর্বার।”
কবিতা প্রতীকী। তাই এর শরীর জুড়ে থাকে জীবনবোধ, জীবনের গাঢ় তত্ত্ব আর অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মাদকতা। অতিমারী করোনার ভয়াবহতা আর এর মরণঘাতী ছোবলে লড়াই করা সাহসী প্রবল পরাক্রান্ত বীর ডাক্তারের মৃত্যুতে তিনি লিখলেন:
মানুষের চিকিৎসক ছিলো ওরা।
করোনা যুদ্ধের কারবালা ময়দানে
তমসিক কুরুক্ষেত্রের তা-বে
ঢাল তলোয়ারহীন হেরে গেলে
ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে।
‘কেবিন-বন্দী অনুভব’ কবিতায় লিখলেন:
“হঠাৎ যদি সূর্যটা ডুব দেয় পশ্চিম দিগন্তে
হাতের ক্যানোলা সহজ ব্যথায় বলে:
তুমি ডাক দিলে পৌঁছে যাবো দারুণ আহ্লাদে
অমানিশার মায়ার জগতে হারিয়ে।”
‘শাশ্বত মৃত্যু’ কবিতায় আপন ভাইয়ের মৃত্যুতে শোকাগ্রস্ত হয়ে লিখলেন:
“ওদের বলেছি মৃত্যু মানে শেষ বিদায় হয় না,
কেবল কারও শরীরটাই অপ্রকাশ্যই হয়ে যায়
যখন দেহের মধ্যে মরে গেলে-তুমি নও
আসলে এই পৃথিবীটাই নিয়েছে বিদায়।”
বক্তব্যের ভেতরে নিখুঁত পরিপূর্ণতার ছাপ আলোকমান হয়েছে। পৃথিবীর বাসের উপযোগী নই যেন আমরা বরং বলতে পারি
পৃথিবী আমাদের বাসের যোগ্যতা হারাচ্ছে ধীরে ধীরে। এরকম জোর গলায় কয়জনে বলতে পারে যে আসলে আমাদের মৃত্যুতে পৃথিবীই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেয় জাগতিক বিধানে।
তিনটে কাব্যগ্রন্থ আলোচনায় দেখা যায় যে ‘এজাজ ইউসুফী’ একজন স্বতন্ত্র সত্তার মেধাবী কবি। কবিতার প্রতি ছত্রে ছত্রে শক্তিমান এই কবির অনুভব প্রবহমান আধুনিক চিন্তা চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করলেও আধুনিকতার একপেশে বেড়াজাল ও তার নাগপাশ ছিন্ন করেÑউত্তরণের পথ খুঁজে ফিরেছেন উত্তর আধুনিকতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে। কবি অসম্ভব মানবিক, মানবতার বিপর্যস্তে কবি দ্রোহী। কবি ধর্মান্ধ নন বরং বলা যায় আধ্যাত্মবাদী। ‘স্বপ্নাদ্য মাদুলি’ কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। বইটির ২য় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ‘খড়িমাটি’ প্রকাশন থেকে। চার ফর্মার এই কাব্যগ্রন্থ পরিপাটি করে ছাপা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা স্পষ্ট। এটা সহজে এড়ানো যেত। ‘জীবন মৃদঙ্গের তাল’ কবির ২য় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। চার ফর্মার এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটা কবিতা ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন আঙ্গিকের। বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্রকাশক আলী প্রয়াস-এর ‘তৃতীয় চোখ’ প্রকাশনা থেকে।
‘মধুব্রত অধুনা নগরে’ কবির তৃতীয় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। কবির কাব্যস্বর এসে যেন ক্ষণিক থামলো আপন আবাসে, আপন সময়ে অর্থাৎ আধুনিক সময়ে। এখানেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন নিজেকে, আপন স্বজনকে। জীবন-মৃত্যুর মাঝে স্বাপ্নিক বিচরণকে প্রত্যক্ষ করলেন আপন সত্তার ভেতরে। জীবনের চরম সত্যসমূহ যেন ডুবে আছে অধুনা নগরে অর্থাৎ আধুনিক নগরে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ‘চন্দ্রবিন্দু’ প্রকাশনা থেকে। আমি তিনটি কাব্যগ্রন্থের পাঠকপ্রিয়তা আশা করছি।
রূপক বরন বড়ুয়া, কবি ও প্রাবন্ধিক