তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী
সামনের অজগরের মতো রাজপথটা ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল একটার পর একটা মিছিল। মিছিলের হাজারো কণ্ঠে রাত্রির নিস্তব্দতা ভেঙে অনুরণিত হচ্ছিল, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?
লাইটপোস্টের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল বাইরের সবকিছু। লুবনা জানালার পর্দাটা সরিয়ে আনমনে দেখছিল এসব। এক সময় দেখা গেল, লুবনার চোখ থেকে ঝরে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা নদী। লুবনার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। লুবনা কি যেন বলতে চাচ্ছে উচ্চ কন্ঠে। কিন্তু কিছুই বলতে পারছে না লুবনা। লুবনা কাঁপছে উত্তেজনায়, লুবনা কাঁদছে অব্যক্ত বেদনায়। অথচ লুবনা এমনটি ছিল না। লুবনা হাসতো। লুবনা গাইতো। সবার সাথে কারণে অকারণে হেসে হেসে কথা বলতো। ওড়না উড়িয়ে চঞ্চলা হরিণীর মতো এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতো লুবনা।
একদিনের কথা। সেদিনটি ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। লুবনা বেড়াতে বের হয়েছিল। সাথে ওর ভাই সাব্বির। পাহাড়ি পথ ধরে ওরা অগ্রসর হচ্ছিল। সাব্বির আগে লুবনা পিছনে। সন্ধ্যা নামতে তখনো বেশ দেরী। কিন্তু সারাটা এলাকা তখন কুয়াশার স্বপ্ন চাদর মুড়িয়ে আসন্ন রাত্রির অপেক্ষায়।
” ভাইয়া , আমাকে বাঁচাও ” — লুবনার করুণ আর্তিতে সাব্বির পিছনে চোখ ফেরাতেই দেখে চারজন যুবক লুবনাকে ধরে রেখেছে “। “আমাকে ছাড়ুন, আমাকে ছাড়ুন” — লুবনার প্রচ- প্রতিবাদে ওরা টললো না মোটেই। “খামোশ, খারাপ হবে ” — সাব্বিরের কণ্ঠেও একই আওয়াজ। “হ্যালায় কয় কি! এতদিনে একটা পাখি মিলল, তাও আবার ছাড়ুন। কত সাধের আবদার রে ” —ওরা বললো। সাথে সাথেই সাব্বির পুনঃগর্জে উঠল প্রচ- শব্দে — “খামোশ “। মুহূর্তেই দ্রুম দ্রুম শব্দে ছুটে আসে কয়েকটা গুলি।
সাব্বিরের বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেল। সাব্বির লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়লো চর্তুদিকে। রক্তে লাল হয়ে গেল সমস্ত পথ। গঁ গঁ শব্দ বের হতে লাগল সাব্বিরের মুখ থেকে। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। একসময় বন্ধ হয়ে গেল গোঙানী। প্রাণবায়ু খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিল অনন্তের পানে।
লুবনা কাছে থেকে সব দেখল। দেখল ভাইয়ার আত্মত্যাগ, দেখল নেকড়ে অরণ্যের দানবীয় উল্লাস। ওরা ওকে সব দেখতে দিল। কিন্তু বেশি দেখা সম্ভব হলো না লুবনার। “ভাইয়া ” — একটা অস্ফূট আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে লুবনা। তারপর কিছুই জানে না লুবনা। সাতদিন লুবনা নেকড়ে অরণ্যের গুহায় ছিল। বিচ্ছিন্ন ছিল আত্নীয়-পরিজন থেকে।
সাতদিন পর সমাজধিকৃত অবাঞ্চিত লুবনা নিস্কৃতি পেল নেকড়ের ছোবল থেকে। পান্নাদের মরা গরুটির মতো অসহায় লুবনা রাস্তার একপাশে পড়ে রইল। সহৃদয় এক পথিকের কৃপায় লুবনা ঘরে এল। সেই থেকে লুবনা বাড়ির বাইরে কোথাও বেরুয় না। হাসে না, গায় না। কথা কয় না। লুবনা কি যেন হারিয়ে ফেলেছে। লুবনা কি যেন খোঁজে !
এমনিভাবে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। বহতা সময়ের স্রোতে লীন হয় একে একে লুবনার দুর্বিসহ মুহূর্ত। লুবনা যেন মৌনতার গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া এক নি¯প্রাণ পাথর। শুধু ফেব্রুয়ারি এলে লুবনা জানালার পাশে যায়। লুবনা কাঁদে। লুবনা কি যেন বলতে চায়।।
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাবন্ধিক ও গবেষক