এখন সময়:রাত ১০:৩২- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ১০:৩২- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

ঐতিহ্যের উদ্ভাবন : ‘অন্তর্জলী যাত্রা’

ড. সালাহউদ্দীন আইয়ুব : … তবে মুস্কিল ইহা যে যখনই আমি কথা বলি তখনই পাঁচজনে বলিয়া থাকে আমি মস্করা করিতেছি। সেদিন ভবানী চৌধুরী [স্টেইটসম্যান-এর সাংবাদিক] আমাকে দোষারোপ করিলেন।..জানি না সুনীলও হয়ত আমারে উল্টা বুঝিল, কেননা, সে..পত্রপ্রাপ্তি স্বীকার করে নাই।.. তোমার মিনিবুকের জন্য আমি আমার একটি রচনা বাছিয়াছিযাহার গল্পটা একটি কথা!..বলিতে পারা যায় চিন্তা। ..তবে গরীবদের জন্যে লেখা নয়, উচ্চবর্ণের গরীবদের জন্যে লিখিত। … লেখা আমি দুর্বোধ্য করিনাএত সরল যে তাহা দুর্বোধ্য হইয়া যায়। তবে আমি বৈদিক, অন্তত ব্রাহ্মণ্য, সরলতা ভালবাসি।

সন্দীপন চ্যাটার্জীকে লেখা কমলকুমারের পত্র, ১৩ই এপ্রিল, ১৯৭০

‘মস্করা করিতেছি’: কমলকুমারের নিজের মুখেই জানা গেল যে, খালাসীটোলায় বা অন্যত্র তিনি যে সব কথা বলতেন (যেমন শরৎ-এর ‘অভাগীর স্বর্গে’র মত অতি-সাধারণ গল্পকে বিশাল বাংলা সাহিত্যের প্রতিভূ ঘোষণা, বা অতিরিক্ত বঙ্কিম-প্রীতি ও শরৎ-ভক্তির প্রভাবে তাঁর রহফবভবহংরনষব রবীন্দ্রবিদ্বেষী মন্তব্য), সে সব প্রতিক্রিয়াশীল উক্তিকে কেউই নিছক মস্করা বা টিটকারি ছাড়া আর কিছু মনে করে নি। তবে, টিটকারি বা মস্করা মনে করলেও, কমলকুমারের শিষ্য ও বন্ধু-বান্ধবেরা যে তা উপভোগ করেছেন অন্তত দুই দশক যাবৎ, এবং সে ধরনের টিটকারি, মস্করা, তামাসা যে কমল-তিরোধানের পরবর্তী সময়কার বাংলা লেখালেখির একটা বৃহৎ অংশের “চরিত্র” (ফবভরহরহম ঃৎধরঃ) হয়ে উঠেছে সাধু বাংলায় প্রবন্ধ রচনা, আঞ্চলিক ভাষায় বা বিমিশ্র বুলিতে কবিতা, ব্লগ, ফেইসবুকিং ইত্যাদিএবং এ সব মস্করা, টিটকারির জড়, উৎস, আদি ভগীরথ যে শ্রীকমলকুমার, এই ফ্যাক্টটা কেউ তলিয়ে দেখেছেন বলে মনে হয় না। ইয়ার্কি-টিটকারির উৎপত্তি কমলকুমারে, তার ওয়ার্কশপটা তিনিই খুলেছিলেন। অ্যালকোহলিক, নি:সন্তান, হাঁপানির ব্যাধিতে চিররুগ্ন কমলকুমারই শিখিয়েছেন যে, বিশ^খ্যাত সত্যজিৎ রায়কে, মতিলাল পাদরী গল্পে বর্ণিত, ‘ঢ্যাঙা’ ইউক্যালিপটাস বলে মস্করা করা যায়; বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথকে ‘বেম্ম’, ‘দাড়িবাবু’, ‘পীরবাবা’ বলে গালি দিলে তাতে অষ্টাদশপুরাণ-শাসিত দেশের বাসিন্দারা মজাই পাবে, আপত্তি করবে না। শঙ্খ ঘোষ, আনিসুজ্জামান বা শিবনারায়ণ মনে করেন নি যে বাংলা লেখালেখির ধারায় কমলকুমারের কোনো প্রভাব আছে বা ছিল বা তৈরি হওয়া সম্ভব, কিন্তু প্রভাব মানে কি শুধু মেঘনাদবধ পড়ে মহাশশ্মান লেখা? কমলকুমার থেকে ফরহাদ মজহার এবং ফরহাদ মজহার থেকে এ-সময়ের লেখালেখির একটা অংশের ভঙ্গির মধ্যে কমলকুমারের সুনিশ্চিত ছায়া লক্ষ করা যায়। বিষয় বা সারবস্তু নয়, লেখার ভঙ্গির মধ্যে কমলকুমারীয় ঢং-এর ডিএনএ বিদ্যমান। এই ঢং-এর মূল জিনিশ হলো যাকে কমলকুমার বলেছেন ‘মস্করা করিতেছি’। বস্তুত ফরহাদ মজহারের এবাদতনামা-র ভঙ্গি, অ্যাটিচ্যুড, বিভিন্ন পংক্তির মধ্যে ঠাট্টা-মস্করা ইত্যাদি স্পষ্টত কমল-প্রভাবিত। তাঁর ‘ভাবান্দোলন’ বইতে কমল-এর দীপ্ত উপস্থিতি। মাধবায় নমঃ বা জয় রামকৃষ্ণ লিখে পরমুহূর্তে ‘নস্যাইতাছে’, ‘বিস্তারিয়াছে’ ‘উজরিব’, ‘প্রত্যক্ষিলাম’ বসিয়ে দেয়ার মস্করা, টিটকারি থেকেই ‘এবাদতনামা’র মস্করা উদ্ভূত হয়েছে; আবার ফরহাদ মজহার-বাহিত কমল-প্রভাব ছাড়া কবিতার বইয়ের নাম ‘আকাশে কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি’ হতে পারত কি? ফরহাদ মজহারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ভাবান্দোলন’-এর কোনো কোনো অংশ, সংক্রামক কমল-মস্করার প্রভাবে, বিমিশ্র বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে এবং সেই বিমিশ্র বাংলার মডেলে আকৃষ্ট হয়ে অনেকে সাধু ভাষাতেই লেখা শুরু করেছেন প্রবন্ধ-নিবন্ধ। সাধু ক্রিয়াপদ বা ভাষার সঙ্গে মস্করার সম্পর্ক ছিল না (সাধু বাংলায় রচিত ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’কে কেউ মস্করা মনে করে না), কিন্তু শ্রীকমলকুমার ‘নস্যাইতাছে’ ‘লক্ষ্যিয়াছি’ ‘চীৎকারিয়াছে’ ইত্যাদি লিখে সাধু ভাষাকে টিটকারির বস্তুতে পরিণত করেছেন। ফলে এখন যদি সাধু ক্রিয়াপদযুক্ত বাক্যযোগে গোটা প্রবন্ধই লিখে ফেলা হয়, তাহলে সেই ভাষাকে ‘মস্করা’ ছাড়ানাটকের মধ্যে ‘ঢাকাইয়া’ সংলাপের মতোআর কিছু মনে করা সম্ভব না। একইভাবে ইদানীং কেউ কেউ বইপত্রে ব্যবহৃত ভাষা বাদ দিয়ে, ‘মস্করা’র ইফেক্ট তৈরির সচেতন ইচ্ছায়, বিমিশ্র আঞ্চলিক ভাষাতে সাহিত্যচর্চা করে থাকেনযার সাম্প্রতিক উদাহরণ মাহবুব লীলেনের লেখা অভাজনের মহাভারত (শুদ্ধস্বর ২০১৫)। কাজেই বর্তমান সময়ে সাধু বাঙ্গালা ও বিমিশ্র আঞ্চলিক ভাষায় রচিত যে-সব ‘মস্করা’ধর্মী লেখালেখির নমুনা দেখা যায় (প্রধানত ইন্টারনেটে), তার শিকড় অনুসন্ধান করতে হলে পৌঁছুতে হবে কমলকুমার-এর লেখাপত্রে। তবে খোঁজার সময় মনে রাখা চাই যে, কমল-প্রভাবের জন্যে কমল-সাহিত্য পড়ার দরকার নেই এবং যারা ‘মস্করা’য় আসক্ত হয়ে পড়েছে তাদের সবাই কমল পড়েছে এমন মনে করার দরকার নেই, কারণ যে প্রভাবের কথা বলছি তা হলো ঢং, ভঙ্গিগত প্রভাবটিটকারি, ইয়ার্কি, মস্করার ভঙ্গির অনুকরণ: ‘নস্যাইতাছে’, ‘ঠিকরাইতাছে’ ‘বিস্তারিয়াছে’, ‘প্রত্যক্ষিয়াছে’ এবং এগুলোর সূত্রে, এ সব মস্করার পরিণতি, ‘কালিদাসের লগে মেগ দেখতেছি’ বা ‘দোরা কাউয়া পেয়ারা গাছে কা কা করে’, বা ‘জরিনার লগে..’।

এই পরিণতি কমলকুমারের অভিপ্রেত ছিল কিনা, সে প্রসঙ্গ অবান্তর; আসল কথা হচ্ছে, বাংলা লেখালেখিতে তিনিই ঠাট্টা, মস্করা, টিটকারির এই বেগবান ধারার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন: ‘এবাদতনামা’ থেকে ‘দোরা কাউয়া’ বা আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত ‘অভাজনের মহাভারত’ পর্যন্ত যার ধারাবাহিক বিকাশ চোখে না পড়ে পারে না। কাজেই শঙ্খ-সুনীল-সন্দীপন বা আনিসুজ্জামান যা কল্পনা করতে পারেন নি (এবং আহমদ ছফাও যা ভাবতে পারতেন না) লেখালেখিতে ঠিক তাই ঘটেছে: সাহিত্যের অগস্ত্যযাত্রা সম্পন্ন হওয়ার পর বর্তমানে, মস্করা টিটকারি ইন্টারনেটের এই সময়টায়, কমলকুমার মজুমদারের চেয়ে বেশি প্রভাব সঞ্চারকারী দ্বিতীয় কোনো নাম মিলবে না। ভঙ্গিগত এই প্রভাবের জন্যে, আগেই বলেছি, কমলকুমারের লেখার সঙ্গে পরিচয় থাকার প্রয়োজন নেই; কিন্তু যে ঢং বা ভঙ্গির কথা বললাম, তার ডিএনএ পরীক্ষা করলেই ধরা পড়বে তার অদৃশ্য, আদিতম, সূত্র শ্রীকমল মজুমদার। বহু হাত ঘুরে এসেছে বলে প্রভাবের পলেস্তারায় নানা আঞ্চলিক বৈচিত্র্য যুক্ত হয়েছে, হঠাৎ চেনা যায় না, কিন্তু গত তিরিশ বছরের লেখালেখির কালানুক্রম সম্পর্কে যাঁর স্পষ্ট ধারণা আছে, তিনি এ কথার সত্যতা অনুধাবন করতে পারবেন। কাজেই কমলকুমারের অদৃশ্য উপস্থিতি ও  বাস্তব প্রভাব বিষয়েসে প্রভাব সাহিত্যচর্চায় যত বিধ্বংসীই হোক না কেনসংশয়ের কোনো সুযোগ নেই। অন্যদের কাছ থেকে শেখা এই ঠাট্টা-মস্করার প্রভাবেই অনেক তরুণ ইদানীং সত্যিকার রোমান্টিক সংবেদনের অসংকুচিত নির্ভীক প্রকাশের চেষ্টা ত্যাগ করে, রোমান্টিক বিষয়াদি নিয়ে বরং টিটকারি করে চলেছে বিমিশ্র আঞ্চলিক ভাষায়। অর্থাৎ সাহিত্যের চর্চা-অনুশীলনের আগেই এদের অবিশ^াস জন্মে গেছে নিজেদের ক্ষমতায়, ফলে হাত পাকাচ্ছে ঠাট্টা-মস্করা, ইয়ার্কিতে, নষ্ট করছে অন্যদের, আর অনুকরণ করছে তাদেরই যারা নিজেরা লেখক হতে পারে নি। সাহিত্যবৃত্তি সমূলে ধ্বংস করার সহজতম পথ ইয়ার্কি, মস্করা; ওতে আসক্তি ধরলে আর তা ছাড়া যায় না, বারাণসীর নিকটস্থ গাজীপুরের আফিমের চেয়েও তা মারাত্মক।

তবে কমলকুমারের ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ সিরিয়াস সাহিত্যকর্ম, মস্করা নেই; এ উপন্যাসেরই একটা দিক নিয়ে এই  লেখা।

এক

অন্তর্জলী যাত্রা (১৯৬২) ইতিহাস নয়, উপন্যাস; তাই, উপন্যাস বিধায়, অন্তর্জলীতে ‘ঐতিহ্য’ বর্ণিত হয় না, ‘উদ্ভাবিত’ হয়। ‘ইনভেনটিং ট্রাডিশন’ বলে যে-কথাটি একালের তাত্ত্বিক আলোচনায় অবিরাম প্রতিধ্বনিত, ঐতিহ্য-উদ্ভাবনের সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এ উপন্যাসটি পাঠ করা যেতে পারে। মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১) রচিত হবার পর থেকে পুরাণের পুনর্জন্ম, পুনর্ব্যাখ্যা, পুনর্বোধনএসব ধারণার সঙ্গে আমরা কম বেশি-পরিচিত; কিন্তু ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ উপন্যাসে ‘সতী’ নামক একটি প্রাচীন, পপুলার, পৌরাণিক ধারণার যে-রূপায়ণ (ৎবঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ) লক্ষ করা যায়, তাকে শুধুমাত্র ঐহিহ্যের পুনর্মূল্যায়ন বা পুরাণের পুনর্বোধন বলা যায় না। সাহিত্যের ইতিহাসে ঐতিহ্যের পুনমূর্ল্যায়ন সুপরিচিত নৈমিত্তিক ঘটনা, কিন্তু শিল্পসাহিত্যে ‘ঐতিহ্যের উদ্ভাবন’ একান্তভাবেই আধুনিকতাবাদী উদ্যম। রূপায়ণ এক কথা, উদ্ভাবন আরেক। যা ছিল না, থাকে নাবা থাকলেও সেভাবে থাকে না বা থাকতে পারত নাতা নতুন পন্থায় বানিয়ে নিয়ে পরিবেশন করার নাম ‘ইনভেনশন’, উদ্ভাবন। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় সতীর ট্রাডিশন বা ঐতিহ্য এইভাবে উদ্ভাবিত হয়েছে।

কিভাবে সম্পন্ন হয় এই উদ্ভাবন? ঢাকার শাঁখারিবাজারে নির্মিত দুর্গাপ্রতিমা গ্রাম থেকে আনা কৃষ্ণবর্ণ, অ-দগ্ধ, মসৃণ মৃত্তিকায় রচিত। সেই দুর্গাপ্রতিমার শিল্পীহেনরি গ্লাসির বইটির (১৯৯৭) কারণে জগতবিখ্যাতহরিপদ পাল। দুর্গা-বিগ্রহ রচনায় হরিপদ পালের প্রধান নির্ভর এই বাংলার আর্দ্র, অশ্রুসিক্ত, মাতৃ¯েœহের মত আঠালো মাটি; আর অন্তর্জলীতে ‘সতী’ যশোবতীর উদ্ভাবন-কর্মে কমলকুমারের প্রধান অবলম্বন উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ বাংলা। হরিপদ পালের দুর্গাপ্রতিমায় ‘মাটি’ হলো প্রধান উপকরণ; কমলকুমারের সতী-আখ্যানের প্রধান অবলম্বন ‘বাক্য’। হরিপদের দুর্গা ও কমলকুমারের সতী ‘প্রাকৃতিক’ কিছু নয়, দুটোই উদ্ভাবিত; হরিপদের দুর্গা পশ্চিম বাংলায় মেলে না (হেনরি গ্লাসি ১৯৯৭), অষ্টাদশ পুরাণেও তা অনুপস্থিত; কমলকুমারের সতী যশোবতী যে রাজস্থানের রূপ কানোয়ার বা বাস্তব কোনো চরিত্র নয়, সে কথা বলাই বাহুল্য।

 

দুই

‘অন্তর্জলী যাত্রা’ গঙ্গাতীরে সীতারাম-যশোবতীর বিবাহ ও মৃত্যুর কাহিনি। সীতারাম চাটুজ্জে রাঢ়ার বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, গঙ্গাতীরে আসন্ন মৃত্যুর জন্যে প্রতীক্ষমান; যশোবতী বালিকা মাত্র, মাতৃহীনরাঢ়ার আরেক ব্রাহ্মণ লক্ষ্মীনারায়ণের কন্যা। বিবাহলগ্নের একটা বিশেষ মুহূর্তে, মাল্যবিনিময়ের সময়, বালিকা যশোবতীকে দিতে-যাওয়া বৃদ্ধ সীতারামের মালাটি ছাগলে খেয়ে ফেললেও, গঙ্গাতীরস্থ শ্মশানঘাটে ফুলসজ্জা পর্বের আগেইবৃদ্ধ ও বালিকার মধ্যে পতি-পত্মীর মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলত, পতিপ্রাণা যশোবতী, তার ‘কর্ত্তা’র সঙ্গে অর্থাৎ অশীতিপর বৃদ্ধ সীতারামের সঙ্গেসহমরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কেউ হয়ত বলবেন, সহমরণের আয়োজন বা সিদ্ধান্ত হলেও, বুড়ার সঙ্গে যশোবতীর সহমরণ তো উপন্যাসে ঘটে না। এ ধারণাটি ভুল। এই উপন্যাসে যশোবতীর সহমরণ, আমার বিবেচনায়, ঘটেছে একবার নয়, দুইবার। প্রথমবার উপন্যাসের মাঝামাঝিতে (অন্তর্জলী যাত্রা [২০০২] ২০১১: ৩৬-৩৮), দ্বিতীয়বার উপন্যাসের শেষে এক পূর্ণিমার রাতে, চাঁদ যখন লাল, দোলায়মান ফুলসজ্জায় যখন ‘গোলাপশীতল পোম্পাইয়ের আতিশয্য’। শিল্পগত বিচারে দ্বিতীয় সহমরণের তুলনায় প্রথম সহমরণ অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণভাবে উত্থাপিত:

চতুর্দ্দোলার আসনে যজ্ঞবাট করা হইয়াছে, চারিভিতে ছোঁড়া কদলীবৃক্ষ লাল সুতা দিয়া গ-ীবদ্ধ, উপরে মালাকার মেঢ় ঝুলাইতে ব্যস্ত…। দিকে দিকে হরিধ্বনি, কাঁসর ঘণ্টা ঢাক বাজিতেছে, পক্ষীরা ভয়ার্ত্ত পলায়মান, গাছে গাছে ‘চালকা’ কাপড়ের নিশান উড়িতেছে। …পুণ্য লোভী স্ত্রীলোকেরা স্থানচ্যুত হইবার আশংকায় পার্শ্ব পরিবর্তন পর্যন্ত করিতেছেন না। … ব্রাহ্মণেরা শশব্যস্তে পাঁজী পাঠ করিতেছেন, অন্যান্যেরা পরামর্শে নিশ্চল, সহসা নস্য লইয়া পুনর্ব্বার শাস্ত্রীয় বুদ্ধিযুক্ত। যশোবতী একভাবে বসিয়াছেন, বর্গভীমা মন্দিরে ইষ্টকে প্রতিমা উল্লিখিত ভঙ্গিতে; অভিজাত গৃহের রমণীরা তাঁহাকে সাজাইতে ব্যস্ত…। স্বর্ণভৃঙ্গার হইতে তাঁহাকে উম্মল-পানি দেওয়া হইতেছে, তিনি সহাস্যবদনে তাহা পান করিতেছেন এবং তাঁহার চক্ষু আরক্ত। হায় মোহিনী মায়া! গোলাপের সহচরী, ফলে গোলাপের ম্লান তাঁহাকে পাইয়াছিল। নিকটে বন্ধ-চিত্র জাঁতি দিয়া একজনা গুবাক কাটিতেছেন। …এয়োস্ত্রীগণ চুল দিয়া পথ মার্জনা করিলেন, জল সিঞ্চিত হইল।

(অন্তর্জলী যাত্রা [১৯৬২] ২০১১ : ৩৭-৩৮)

বাক্যের পর বাক্য গেঁথে চিতাসজ্জার এই দীর্ঘ, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুপুঙ্খসমেত, নিখুঁত দৃশ্যটি নির্মিত হবার পর চতুর্দ্দোলায় “লক্ষ্মীমূর্তি”র মত সতী যশোবতীর সহমরণ সম্পন্ন হয় এভাবে:

অধুনা যশোবতী চতুর্দ্দোলায়, তিনি যেন লক্ষ্মীমূর্তি, একহস্তে প্রস্ফুটিত পদ্ম, কখনও বা দেখিলেন পঞ্চ পল্লব, অন্য হাতে বরাভয়। যশোবতী ইদানীং সাক্ষাৎ চম্পক ঈশ্বরী। তাঁহাকে নামান হইল। হাজার হাজার স্ত্রী শরীর তাঁহার পায়ের কাছে কাছে গড়াইয়া পড়িতেছে। কাহারও মস্তকে তাঁহার পা পড়িয়া পিছলাইতেছে; কোন কোন রমণী অজ্ঞান হইতেছেন। ..চতুর্দ্দোলা হইতে নামিবার পরে অনেকেই তাঁহার স্মৃতি সংগ্রহের জন্য কেশ আকর্ষণ করিতে তৎপর…., একটি একটি চুল গেল, অনেক কিছুই গেল, ক্রমে বীভৎস রূপ ধারণ করিলেন। তিনি দৌড়াইয়া চিতায় উঠিলেন…অগ্নি সংযোগ করা হইল, শাঁখা কড়ি স্বর্ণালংকার উড়িল। লেলিহান শিখায় গৃহাভিমুখী সুখপক্ষীর দল ছত্রাকার, কোনোটি বা বিমোহিত হইয়া চিতার মধ্যে নিশ্চিহ্ন।

…চিতা হইতে দেখিলেনপার্থিব মায়াবন্ধনে অধীর হইয়া একটি লোক লাঠির উপরে মুখ ন্যস্ত করিয়া আছে….                                                                                                     (অন্তর্জলী যাত্রা [১৯৬২] ২০১১ : ৩৮)

এই সহমরণে যশোবতীর শারীরিক মৃত্যু ঘটেনি, কারণ এটি যশোবতীর ‘মানস চক্ষে’ সংঘটিত ‘সতীদাহ অনুষ্ঠান’ (পৃ. ৩৬); কিন্তু চিত্রকর কমলকুমারের বলিষ্ঠ তুলিকায় দুই পৃষ্ঠা ব্যাপী যে ধরনের শব্দে বাক্যে পৌরাণিক অনুষঙ্গবহুলতায় এই সহমরণ অনুষ্ঠিত, যে লজিক ও পারম্পর্য অনুসৃত এবং তাতে যে আনুপূর্ব সংগতি, তাকে মানসচক্ষে দৃষ্ট ঘটনা (ারংরড়হ) বা ‘যশোবতীর ভ্রম দর্শন’ (রষষঁংরড়হ) মনে করা কঠিন। কমলকুমার রেভারেন্ড লালবিহারী  দে-র লেখা ‘গোবিন্দ সামন্ত’ বইটি পড়ে দেখতে বলেছেন সহমরণের বাস্তব ও বিশদ বিবরণ জানার জন্যে। আমি পড়েছি। যশোবতীর এই সহমরণের সঙ্গে ‘গোবিন্দ সামন্তে’র প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ তুলনা করলে মনে হবে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র এই সহমরণই বাস্তব, এবং লালবিহারীটা বানানো। এর পরেও কি বলবেন, ও ছিল যশোবতীর স্বপ্ন বিভ্রম মাত্র, সহমরণ নয়? আমরা কি ফ্রয়েড পড়িনি? স্বপ্ন কখনো এত সুশৃঙ্খল হয়, এমন লজিক্যাল? কমলকুমার একে ‘স্বপ্ন’ বলেছেন বটে, কিন্তু তাঁর বাক্য তার বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। তাঁর বাক্যবিগ্রহ এই সহমরণকেই করে তুলেছে বাস্তব।

কেন এই পয়েন্ট-এ জোর দিচ্ছি, তা বলি। এ-উপন্যাস পড়ার সময় মনে রাখতে হবে যে, প্রচলিত অর্থে যাকে ‘বাস্তব’ ধরা হয়, তা এখানে বাস্তব নয়, ‘মায়া’; আবার আধুনিক বিদ্যার ক্যাটেগরিতে যা ‘মায়া’ বা ইল্যুশন হিশেবে চিহ্নিত উনিশ শতকের ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দুধর্মালম্বী বা ব্রাহ্ম আধুনিকেরা যাকে বলতেন ‘অনৈসর্গিক’ (ঁহহধঃঁৎধষ)তা এখানে, অন্তর্জলী যাত্রায়, “বাস্তব” (ৎবধষ) রূপে উপস্থাপিত। কমলকুমারের অভিপ্রায় কি, তা বুঝতে হবে। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র বিরাট আয়োজনের পশ্চাতে কমলকুমারের মূল লক্ষ্য হল ‘বাস্তব’কে মায়া এবং মায়াকে ‘বাস্তব’-এ রূপান্তরিত করা। আমাদের বোধের ক্যাটেগরিগুলো ক্রমশ বদলাতে থাকে এ উপন্যাসে; ফলে উপন্যাসের মাঝামাঝিতে এসে পূর্বোক্ত সহমরণের দৃশ্যের সানুপুঙক্ষ বর্ণনার অভিঘাতে আমরা বুঝতে বাধ্য হই যে, ‘বাক্য’ই এই আখ্যানে বাস্তবের স্রষ্টা, তার নিয়ন্তা, তার উদ্ভাবক। এটিই ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র (‘শ্যামনৌকা’রও) একমাত্র মেটাফিজিক্স। বাক্যের বাইরে আলাদা কোনো বাস্তবে এর বিশ্বাস নেই। কাজেই প্রথম সহমরণটি কিছুবা কম সত্য, দ্বিতীয়টিযেখানে যশোবতীর শারীরিক মৃত্যু হয়বেশি সত্য, এরকম  বিচার অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক। বাক্যে নির্মিত ‘বাস্তবে’র অনুধাবন বা মূল্যায়নে হিসাবী মানুষের বৈষয়িক বুদ্ধিজাত শ্রেণী-বিভাজন চলে না। ফরাশি তত্ত্বের গ্রন্থাদিতে এ-সব কথা এত বেশি এসেছে যে তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নাই। বাক্যই, অর্থাৎ ভাষাই, বাস্তবের উদ্ভাবক ও নির্মাতা, এ কথাটা বোঝা গেলেই যথেষ্ট।

 

তিন

যশোবতীর দ্বিতীয় সহমরণে এ উপন্যাসের সমাপ্তি। শেষতম এই দৃশ্যে যেখানে চ-ালের হস্তে ‘নিঃসঙ্গ চন্দ্রালোকে মধ্যরাত’ খেলা করে, এবং শ্মশানের ‘নরমু-’ নিয়ে চ-াল যাকে বলে তার ‘ঘরণী’ছোটার সময় ‘কনে বউ’ (অর্থাৎ যশোবতী) পড়ে যায়, এবং তখন ‘নির্ম্মাল্যবৎ’ যশোবতীর ‘মায়া বহির্ভূতা’ মনে অকস্মাৎ ‘তপোবন-বিরোধী বিকার’ উপস্থিত হয়, এবং অনতিবিলম্বে চ-াল পশুর মত হাতে ভর দিয়া, হামাগুড়ি দিয়া স্থির। [যশোবতী] উন্মাদহাস্যে কহিলেন “না”…তাঁহার একটি হাত নরকপালের কাছে যেখানে কহ্লার, যেখানে জলজ লজ্জাবতী, তাহার উপর অদ্ভুতভাবে আন্দোলিত হইল, লজ্জাবতী লতা ব্রীড়াবনত হয়।

চ-াল তাহার একটি হাত ধরিয়াছে…. (অন্তর্জলী যাত্রা [১৯৬২] ২০১১: ৭৪)

চ-াল বৈজু এর আগে, মধ্যনিশীথে, যশোবতীকে স্পর্শ করেছিল; শুধু স্পর্শ নয়, বিবস্ত্র অকস্মাৎ চ-ালের উপস্থিতিতে বিমূঢ়যশোবতীকে কোলে তুলে কাব্যও করেছিল অনেক। কিন্তু শেষ দৃশ্যের এই স্পর্শ তা থেকে ভিন্ন। যশোবতী এখন ‘বেপথুমনা’, অর্থাৎ কামাসক্ত এবং সতী-মাহাত্ম্য ভুলে সে এখন ‘তপোবন-বিরোধী বিকারে’ আক্রান্ত, আচ্ছন্ন। আগের মত বৈজুকে ‘চ-াল’ বলে ধমক না দিয়ে, প্রত্যাখ্যান না করে, যশোবতী এখন তাকে উন্মাদহাস্যে আমন্ত্রণ জানায়। তারপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। তারপর ‘সহসা কিসের শব্দ’ হয়: বায়ু স্থির, পাখীরা উড়িয়া গেল, ধরিত্রীর বক্ষে কে যেন হাঁটু ডলিতেছে। ত্রিলোক এক হইয়াছে। ওপস্বিনী বিশাল সমতল শ্মশান দাম্ভিকভাবে আসিতেছে, মহাব্যোমে স্ফুলিঙ্গ উদ্ধত। (অন্তর্জলী যাত্রা [১৯৬২] ২০১১ : ৭৪)

‘বিগলিত লৌহের মত জলপর্ব্বতে’র আকৃতিতে কোটাল বান এগিয়ে আসছে দেখে বৈজু “কোটাল কোটাল” বলে উঠে যেতে উদ্যত হলো, কিন্তু কামজ¦রে আক্রান্ত “কনে বউ তাহার হাত বজ্রজোরে ধরিলেন।” যশোবতী ‘মহাআবেগে মুষ্ঠিতে দুর্ব্বাদল’ ধরে আছে, তার কপালে খেলছে ‘খদ্যোৎ বিদ্যুৎ’, এবং তার ‘নিঃশ্বাসে অজগর ঠিকরাইতাছে’। ‘বুড়ো [সীতারাম] তোমার বর’যশোবতীকে মনে করিয়ে দেয় উদ্বিগ্ন বৈজু; যার জবাবে যশোবতী যে এখন ‘ইন্দ্রিয়াসক্ত’ তো বটেই, ‘বেপথুমনা’ তো বটেই, উপরন্তু ‘তমোগুণের’ আধিক্য হেতু ‘দেহাভিমানিনী’ভীষণ ক্রোধ আর অতীব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, “মরুক”।

অবিলম্বে ‘অপেক্ষমাণ বৃদ্ধ স্বামীর’ দিকে ছুটে আসে যশোবতী; বানের স্রোতে ভেসে যাবার মুহূর্তে মুমূর্ষু অর্ধচেতন বৃদ্ধের মনে হয় ‘তার সঙ্গে কে যেন বিশ্বাসঘাতকতা করিতে আসিতেছে।’ সেই অনুমান ভিত্তিহীন নয় কেননা বিশ্বাসঘাতক বৈজু, তার আগের রাতে, বৃদ্ধের সঙ্গে ‘কনে বউ’র নিশ্চিত সহমৃত্যু বানচাল করার প্রতিজ্ঞায়, বৃদ্ধকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় ছুঁড়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল (কিন্তু যশোবতীর আকস্মিক হস্তক্ষেপে তা ব্যর্থ হয়)।

কোটালের বানে আক্রান্ত বৃদ্ধের ‘দুর্দ্দশা’ দেখে বৃদ্ধের বালিকা বধূ যশোবতীর ‘কর্তব্যবুদ্ধি’ ফিরে আসে; ‘তাঁহার হাত তখনও চ-াল ধরিয়া আছে’। তখন বৈজুর হাতে একটি কামড় দেয় যশোবতী; ‘কামড় দিতেই বৈজুনাথ হাত ছাড়াইয়া লইল’। এখানে মুশকিল হলো, কে কার হাত ধরে আছে নিশ্চিত হওয়া যায় না,  কারণ যশোবতীও যদি বৈজুর হাত না ধরে থাকে, তাহলে বৈজু হাত ছাড়াতে যাবে কেন?:

গুপ্তঘাতকের হস্তে বৃদ্ধ সীতারাম আহত। জল আলোড়নে বৃদ্ধদেহ চক্র দিয়া উঠিল…. যশোবতী জলে নামিয়া পড়িলেন। একটি বৃষকাষ্ঠ ধরিলেন, ক্রমাগত “কর্ত্তা কর্ত্তা” চীৎকারে হাত ছাড়িয়া গেল।  বান… সহসা তাঁহাকে লইয়া গেল।…

একবার বৃদ্ধকে দেখিলেন।

(‘অন্তর্জলী যাত্রা’ [১৯৬২] ২০১১ : ৭৫)

যশোবতী কোনোমতে একটি প্রতিমার কাঠামো ধরে, তারপর, বৃদ্ধকে দেখে, ঐ কাঠামোটি ছেড়ে দেয়। ‘পতিপ্রাণা’ যশোবতী “কর্ত্তা কর্ত্তা” বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলের সমুদ্রে:

ক্রন্দন করিতে করিতে সন্তরণের বৃথা চেষ্টা করিলেন, ‘দু’একবার “কর্ত্তা” ডাক শোনা গেল। ইহার পর শুধুমাত্র রক্তিম জলোচ্ছ্বাস। কেননা চাঁদ এখন লাল।

(‘অন্তর্জলী যাত্রা’ [১৯৬২] ২০১১ : ৭৫)

জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে যশোবতীর এই মৃত্যু তার দ্বিতীয় সহমরণ। প্রথম সহমরণটি ছিল ‘সতী’র সহমরণ, দ্বিতীয়টি যা মূলত এক ‘বেপথুমনা’ ব্রাহ্মণকন্যার আত্মহত্যা অপরাধীর। প্রথমটি শাস্ত্র-নির্দেশিত এবং তা যশোবতীর নিজের ও সকল ব্রাহ্মণের লক্ষ্মীনারায়ণের, কৃষ্ণপ্রাণের, অনন্তহরির একান্ত অভিপ্রেত, কাজেই তা সত্য; দ্বিতীয়টি বৈজুর দেহজ সংশ্রবে কলুষিত, অপরাধী ‘দেহাভিমানিনী’ কামাসক্তা রমণীর আত্মহত্যা। প্রথমটি বৈদিক, কাজেই সত্য; দ্বিতীয়টি বাস্তব, কাজেই মিথ্যা। ‘লস অফ ইনোসেন্সের’ পরযা পৃথিবীর সকল গল্পের আদিতম মোটিফ আত্মরক্ষার্থে ‘অপরাধী’ যশোবতীর যে আত্মহত্যা, তা সহমরণ হলেও, তা পূর্বেকার ‘পতিপ্রাণা’ সতীনারীর  সহমরণ নয়: ‘মায়া’র সংক্রামে তা ঐহিক, প্রাকটিক্যাল, অবৈদিক। ‘কোথাও এখনও মায়া রহিয়া গেল’উপন্যাসের শেষতম বাক্যযথেষ্ট কাব্যিক শোনালেও ‘মায়া’ এখানে কাব্য নয়। ‘মায়া’-র অর্থ বেদ-বিচ্যুত বাস্তব। অর্থাৎ অবাস্তব। অর্থাৎ মিথ্যা।

 

চার

হায় আমরা দুর্গার সহিত সম্পর্ক হারাইয়াছি! আমাদের জীবন সুন্দর হইয়াছে, যে-জীবনকে আমি কদাকার বলি.. শালা ব্রাহ্মরা যাহা চাহিয়াছিল তাহাই ফলিবে। আমাদের শুচিবায়ুগ্রস্ত মানসিকতা আর রহিল না…

সুব্রত চক্রবর্তীকে চিঠি, কমলকুমার মজুমদার, ৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় বর্তমানের বিপরীতে অতীতের, অনিত্য সংসার তথা মায়ার বিপরীতে নিত্যসত্যের, বিদ্যমানের বিপরীতে চিরন্তনতার উপস্থাপনায় সম্পাদিত হয় হিন্দু ঐতিহ্য-পুরাণের নবতর উদ্ভাবন। কোনো কোনো সমালোচক (যেমন রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০০৫) এই আখ্যানে সম্ভবত যশোবতীর পরিণামের জন্যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির অবক্ষয়, এমনকি ট্রাজেডি, লক্ষ করেন। আমি করি না। কোথায় অবক্ষয়? কার ট্রাজেডি? এ উপন্যাস সতীদাহ-নিরোধ আইন (১৮২৯) পরবর্তী ব্রাহ্মণ-শাসিত হিন্দু বাঙালি সমাজের পটভূমিকায় রচিত, যে-সমাজবিশেষত তার নিয়ন্ত্রক ব্রাহ্মণেরাপলাশিতে (১৭৫৭) ইংরেজ ষড়যন্ত্রের সফলতায় দারুণ উল্লসিত ছিল, কিন্তু এখন, ১৮২৯ সনে, সেই ইংরেজ-কর্তৃক সতীদাহের মতো হিন্দুসমাজের একটি প্রাচীন ইনস্টিটিউশন আক্রান্ত হওয়ায় দারুণ বিচলিত, এবং ভারতের নানাস্থানে সতীদাহ চালু রেখে ইংরেজি প্রভুত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, এমনকি প্রতিরোধে, সোচ্চার। এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কি অবক্ষয়? ব্রাহ্মণ এ উপন্যাসে ব্রাহ্মণের মত আচরণ করছে বলে তাকে অবক্ষয় বলব? মনুষ্য মনুষ্যের মত আচরণ করবে, কিন্তু ব্রাহ্মণ করবে ব্রাহ্মণের মতো: এর কোনো ব্যতিক্রম কি এ-উপন্যাসে ঘটেছে কোথাও? ব্রাহ্মণই যে ব্রহ্ম সে কথা বুৎপত্তির দিক থেকে যেমন সত্য, তেমনি রঘুনন্দনী তত্ত্ব ও অষ্টাদশ পুরাণের সেটিই মূল কথা। এই জগৎ-চরাচর, স্বর্গ-মর্ত্য, আকাশ-অন্তরীক্ষ, যশোবতীর মত ‘তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা’ রমণীকূল সবই সীতারাম চাটুজ্জের মত ব্রাহ্মণের সেবার নিমিত্ত সৃষ্টি হয়েছেব্রহ্মতত্ত্বের মূলসূত্রও এটাই। এ উপন্যাসে অনন্তহরি, কৃষ্ণপ্রাণ, গীতা পাঠরত ব্রাহ্মণ (যার ‘গীতা কণ্ঠস্থ’), কিংবা লক্ষ্মীনারায়ণ কি কোথাও ব্রাহ্মণ-রচিত ও ব্রাহ্মণের হিতার্থে প্রণীত শাস্ত্র লংঘন করেছেন? ব্রাহ্মণ অনন্তহরির ‘বেলাতটের অঙ্ক’ কি মিথ্যা হয়েছে? মৃত্যু, অর্থাৎ ‘অমৃতে যাত্রা’র সময়, সীতারাম চাটুজ্জে কি ‘দোসর’ নিয়ে যান নি? ব্রাহ্মণের ভবিষ্যতবাণীর কি নড়চড় হয়েছে? হয় নি। যশোবতীর সহমরণের সময় চাঁদ কি ‘লাল’ ছিল না? অবশ্যই ছিল।

পতিব্রতা হিন্দু রমণীর সহমরণকে ‘ট্রাজেডি’ বলার আধুনিক প্রবৃত্তিটিকে আদ্যন্ত আক্রমণ ও তাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করার অভিপ্রায়ে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ রচিত। মৃত্যুর মানে কি মৃত্যু? মৃত্যুর অর্থ তো ‘অমৃতে যাত্রা’, যা বইয়ের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়, ‘গীতা ব্যাখ্যার গোঙানি’তে, আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়। সহমরণ কি মরণ? যশোবতীর প্রথম সহমরণের বর্ণনা (পৃ. ৩৭-৩৮) কি মরণের আয়োজন না চিতাবাসরে ‘মিলন অভিলাষিণী’ বধূর বিবাহসজ্জার উদ্যোগ?

চিতার অনলে ‘সতী’ যে পোড়ে না, বরং পাতিব্রত্যের অন্তঃস্থ, নিজেরই দেহ থেকে নির্গত, শিখায় ‘সতী’ দগ্ধীভূতঅর্থাৎ তার পতির সঙ্গে একাত্মহয়, তার এখনো গ্রাফিক বিবরণ পশ্চিমা গবেষকদের সাম্প্রতিক মাঠকর্মের ভিত্তিতে সংগৃহীত বিভিন্ন রাজস্থানী রমণীর সাক্ষ্যে লক্ষ করা যাবে (জন স্ট্রাটন হ’লি) ১৯৯৪ : ৭৯-৯০)। কাজেই কমলকুমারের কাছে এসব গল্প নয়, ফ্যাক্ট; যেমন এ উপন্যাসেই আছে যে, ‘গঙ্গাশিবের জটা বহিয়া যাহা নামিয়াছে, যাহাতে কোনো গল্প নাই’ ([২০০২] ২০১১: ৩৪)।

নি:সন্তান, অ্যালকোহলিক, হাঁপানিতে আক্রান্ত কমলকুমারের ব্যক্তিগত জীবন, খালাসিটোলার বিষাক্ত বাংলা মদ গলাধঃকরণের পর ‘কুলি’ ও দীর্ঘ আড্ডা, আর ঘরে ফিরে  ‘ছোটবেলা থেকে স্বল্পবাক’ স্ত্রী দয়াময়ীর সঙ্গে চিল্লাচিল্লি (দয়াময়ী মজুমদার ২০১২ : ৩১, ৩৩; ৪৪-৪৫; ৪৭; ৫৬-৫৭) কিংবা দয়াময়ীকে ‘আতঙ্কিত’ করে মরা কুত্তার মুখে চুমা (২০১২ : ৪৮)  এসব ব্যক্তিগত খুঁটিনাটিতে খেই হারালে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’র মূল বক্তব্য মিস্ হবার আশংকা। সেই বক্তব্য, যা উপরের তিনটি অনুচ্ছেদে এইমাত্র আলোচিত হল যা মূলত কমল-মানসের সারকথা যদি যথেষ্ট বিপজ্জনক মনে হয়, তাহলেই উপন্যাসটির রচনাগত অভিপ্রায় সার্থক। আধুনিক কালের (অর্থাৎ উনিশ শতকের) ব্রাহ্ম ভাবাদর্শের পরিবর্তে সনাতন ব্রাহ্মণ্য আইডিওলজির পুনর্নিমাণ চেষ্টায়যাকে ‘ঐতিহ্যের উদ্ভাবন’ বলে আসছি শিল্পী কমলকুমারের সফলতা এখানে যে পুরো সতীকাহিনির মূল বক্তব্য, তার তাবৎ অনুষঙ্গ, ডিটেল ও বিপজ্জনকতা সমেত, আগাগোড়া অপরিবর্তিত  থেকে যায়।

সহমরণের মাহাত্ম্যকথাকে ‘বিপজ্জনক’ বলছি, কিন্তু তা কার কাছে? নবনীতার কাছে না হয় বিপজ্জনক (নবনীতা দেব সেন ১৩৮৪ : ২৫০-২৭৪), কিন্তু সবার কাছে কি তা বিপজ্জনক? কারো কারো কাছে কি তা উদ্দীপক হতে পারে না, উৎসাহ-বর্ধক? “বিপজ্জনক” বিশেষণটা তাই আপেক্ষিক। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় ব্রাহ্মণ-রচিত সনাতন হিন্দুধর্মের যে অথেনটিক আফিম পরিবেশিত হয়েছে এবং যে কলানৈপুণ্যে তা উপস্থাপিত, যেরকম সূক্ষ্ম তুলিকায় তার ক্রমিক উদ্ভাসন ও পরিচর্যা, তার বশীকরণ শক্তি ও কনভার্শনের ক্ষমতা অগ্রাহ্য করা যাবে না। (শিকাগো ২০১৪)

উৎসনির্দেশ

কমলকুমার মুজমদার ([২০০২] ২০১১)। উপন্যাস সমগ্র। কলিকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স।

রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় (২০০৫)। কমলকুমার, কলকাতা : পিছুটানের ইতিহাস। কলিকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স।

দয়াময়ী মজুমদার ([২০১০] ২০১২)। আমার স্বামী কমলকুমার। কৃষ্ণনগর, নদীয়া : আদম।

অনিরুদ্ধ লাহিড়ী (২০০৮)। কমলকুমার ও কলকাতা কিস্সা।  কলিকাতা : তালপাতা।

প্রশান্ত মাজী ও গৌতম ম-ল, সম্পা. (২০১২). কমলকুমার মজুমদারের চিঠি। কৃষ্ণনগর, নদীয়া: আদম।

নবনীতা দেব সেন (১৩৮৪)। “পিঞ্জুরে বসিয়া পাঠক : এবং অথবা সিদ্ধ তান্ত্রিকের শব্দ সাধনা”, চতুরঙ্গ মাঘ-চৈত্র (৩৯) : ২৫০-২৭৪

John Stratton Hawley, ed. (1994). Sati, the Blessing and the Curse: The Burning of Wives in India. Oxford: Oxford University Press.

Henry Glassie (1997). Art and Life in Bangladesh. Bloomington and Indianapolis: Indiana University Press.

 

ড. সালাহউদ্দীন আইয়ুব

সাহিত্য সমালোচক, গবেষক ও শিকাগো স্টেট ইউনির্ভাসিটির, (ইউএসএ) ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের অধ্যাপক

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে