শাওয়াল খান
পুরাতন হয় নতুন পুনরায়। প্রতিনিয়ত এই নতুনের দেখা মেলে বিশ্বের দেশে দেশে বিরাজমান মহাফেজখানায়। একজন নতুন মানুষের কাছে অনেক পুরানো বিষয়ও একেবারেই নতুন। শুধু তাই নয় অনেক বয়োবৃদ্ধের কাছেও পুরাতন হয় নতুন পুনরায়, বিষয় বৈচিত্র এবং সময়ের ব্যবধানের কারণে। এমন সব নতুনের ধারক বাহক মহাফেজখানা। তাই মহাফেজখানা হতে হবে অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং উন্নত। সার্বিক বিবেচনায় দেশের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের খতিয়ান অর্থাৎ সব সময়ের দর্পণ, যেখানে হাত বাড়ালেই মানুষ সময়ের অবয়ব খুঁজে পাবে, পাবে সময়ের দর্শন, সব সময়। তাই পৃথিবীর দেশে দেশে মহাফেজখানা গড়ে তোলার আয়োজন। মহাফেজখানার গুরুত্ব বিবেচনায় জাতিসংঘের উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য।
মহাফেজখানা আর্কাইভস হিসেবে বহুল পরিচিত। গ্রিক শব্দ ‘অৎপযবরড়হ’ —থেকে আর্কাইভ শব্দের উৎপত্তি। আর্কিয়ন শব্দের অর্থ হচ্ছে অফিস বা দফতর। এর আবার মূল শব্দ হচ্ছে আর্কি(অৎপযব) অর্থাৎ ক্ষমতা, উৎস, শুরু, সার্বভৌমত্ব, সংরক্ষণ, ম্যাজিস্ট্রেসি, অফিস, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। একটি দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য চর্চা এবং জাতি গঠনে আর্কাইভসের ভূমিকা অনেক তাৎপর্যবহ, অথচ পৃথিবীর বহুদেশের অনেক নাগরিক নাগরিক জীবনে আর্কাইভসের গুরুত্ব এবং কার্যকারিতা নিয়ে সচেতন নয়। তাই আর্কাইভসের ব্যবহার, কার্যকারিতা এবং গুরুত্ব বিবেচনায় বিশ্বজুড়ে নাগরিক সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস পালনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তথ্যনির্ভর ঐতিহাসিক জ্ঞান চর্চার লক্ষ্যে আর্কাইভসের বিকাশ ও সমৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে দিবসটি পালনের একটি ঐতিহাসিক পটভূমি আছে।
বিশ্ব আর্কিভিস্ট মহল বিশ্বজুড়ে আর্কাইভস বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এর কার্যক্রম স¤প্রসারণ করার প্রয়োজন উপলব্ধি করে আসছিল অনেক দিন আগে থেকেই। এই উপলব্ধি থেকেই আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবসের ধারণা এবং চিন্তার উদ্ভব। যেই দিনটিতে সারা বিশ্ব আর্কাইভস নিয়ে ভাববে, আর্কাইভসের সম্ভাবনাকে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে উদ্যত হবে। এমন পরিস্থিতে ২০০৪ সালে যখন ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক আর্কাইভস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তখন সেখানে উপস্থিত সারা বিশ্বের দুই হাজার প্রতিনিধি একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে যে, আন্তর্জাতিক আর্কাইভস কাউন্সিল একটি আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস নির্ধারণ করার জন্য জাতিপুঞ্জকে অনুরোধ জানাবে। কারণ তখন আর্কাইভস সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আর্কাইভসের গুরুত্ব সম্পর্কিত ধারণা বৃদ্ধির জন্যে কোন কোন দেশ জাতীয়পর্যায়ে একটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
২০০৫ সালে প্যারিসে ইউনেস্কো ৩৩তম সাধারণ সভায় ২৭ অক্টোবরকে বিশ্ব অডিওভিজ্যুয়াল হেরিটেজ (অঁফরড়ারংঁধষ ঐবৎরঃধমব) দিবস হিসেবে জাহির করে। দিবসটি সচেতন নাগরিক সমাজে অডিওভিজ্যুয়াল আর্কাইভস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি কার্যকর সুযোগ এনে দেয়। এর ফলে অডিওভিজ্যুয়াল আর্কাইভস সংরক্ষণের সুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু একমাত্র অডিওভিজ্যুয়াল আর্কাইভস সংরক্ষণই অতীত স্মৃতি / তথ্যভান্ডার ধরে রাখা বা জিয়িয়ে রাখার শেষ কথা নয়।
২০০৭ সালে কানাডার কিউবেক শহরে আর্কিভিস্টরা আর্কাইভস বিষয়ে সর্বজনীন ঘোষণার প্রথম খসড়া তৈরি করেন। ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস এর অঙ্গসংগঠন ‘সেকশন ফর প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন (এসপিএ)’ আন্তর্জাতিক ওয়ার্কিং গ্রুপের সহযোগিতায় বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা স¤প্রদায়সমূহের ভাষা, সংস্কৃতি এবং আর্কাইভস ঐতিহ্যের একক বৈশিষ্ট্য, স্থানিক ভিন্নতাসহ আর্কাইভসের বহুমাত্রিকতা বিবেচনা করে খসড়াটির নতুন সংস্করণ প্রস্তুত করে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস (আইসিএ)—এর বার্ষিক সাধারণ সভায় এটি গৃহীত হওয়ার আগে সদস্যদের মধ্যে এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হয়। আইসিএর চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে এটি বিশ্বব্যাপী প্রচার করা হয়। সংশ্লিষ্টদের মতে এই প্রচারাভিযানে বেশ সাড়া মেলে। বাংলাদেশের আর্কাইভস প্রেমীরাও এই অভিযানে শামিল হয়েছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই আন্তর্জাতিক আর্কাইভস কাউন্সিল ২০০৭ সালের নভেম্বরে তাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় ৯ জুনকে নির্বাচিত করে তা পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই তারিখটি নির্বাচন করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ১৯৪৮ সালের ৯ জুন ইউনেস্কোর পৃষ্ঠপোষকতায় ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস (আইসিএ) গঠিত হয়। পরবর্তীতে আইসিএ নির্বাহী বোর্ড এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাব গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী সব আর্কাইভস প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্টরা এই তারিখটি গ্রহণ করে পৃথিবীর দেশে দেশে আর্কাইভস দিবস পালন করতে শুরু করে।
সুসংগঠিত আর্কাইভস অতীত দলিল দস্তাবেজ, নথিপত্র এবং তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ইতিহাস বিকৃতি থেকে দেশকে রক্ষা করে, জাতি গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করে। শুধু তাই নয়, আর্কাইভস নাগরিক সমাজের নাগরিক অধিকার এবং জাতিগত পরিচয় নির্ণয়েরও হাতিয়ার। তার একটি সুস্পষ্ট নির্দশন আমরা দেখতে পাই ২০১৭ সালের জাতীয় আর্কাইভস দিবসের নির্ধারিত প্রতিপাদ্য ‘আর্কাইভস, নাগরিকত্ব ও আন্তঃসাংস্কৃতিকতাবাদ’ (অৎপযরাবং, ঈরঃরুবহংযরঢ় ধহফ ওহঃবৎ—ঈঁষঃঁৎধষরংস) নামক বিষয়ে। ধারণা করা হয়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বজুড়ে নানা জাতি গোষ্ঠীর বিক্ষিপ্ত অভিবাসন সমস্যা ও অসংলগ্ন এক বৈশ্বিক সংস্কৃতিকে উদ্দেশ্য করে। সেই বছর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের যে জঘন্য ঘটনা ঘটে তা ছিল ভয়াবহ এবং অকল্পনীয়। বিশ্ব ইতিপূর্বে এমন ঘটনা দেখেছে, সেই দৃষ্টান্ত বিরল। এখানে বিতাড়নের চেয়েও নিকৃষ্ট ঘটনা তা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সংকট। নাগরিকত্ব মুছে দিয়ে রোহিঙ্গাদের দেশ ছাড়া করেছে মিয়ানমারের সেনারা। সেই বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের বিরাট একটা অংশ(প্রায় এগার লাখ) সেই থেকে আজ অবধি বাংলাদেশে অবস্থান করছে। আধুনিক বিশ্বে যে সংকটের দালিলিক সমাধান হতে পারত শুধু একটি মাত্র সুসংগঠিত আধুনিক মহাফেজখানা বা আর্কাইভস। যে ইতিহাস বিশ্বের জানা আছে, শুধু সংরক্ষিত দলিল দস্তাবেজের অভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তা বিশ্বদরবারে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া অভিবাসন প্রক্রিয়া এক আন্তর্জাতিক নতুন সংকটের নাম। সারা বিশ্ব এক নিষ্ঠুর চিত্র দেখেছে, ২০১৫—২০১৬ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অভিবাসনের আশায় তৃতীয় বিশ্বের অনেক লোককে মাসের পর মাস সাগরে ভেসে বেড়াতে, অনাহারে মরতে। এই অভিবাসনের কারণেই বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর নাগরিকত্ব আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে। সা¤প্রতিক সময়ে মহাফেজখানা অতীতের চেয়ে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ উঠেছে বর্তমানের সংকট সমাধানে তা যে কোন সময়ের চেয়ে আরো স্পষ্ট হয়েছে চলমান রোহিঙ্গা সংকটকে সামনে রেখে।
২০১১ সালের ১০ নভেম্বর ইউনেস্কো আর্কাইভস বিষয়ে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই দিন ইউনেস্কোর পূর্ণাংগ সাধারণ সভায় ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অন আর্কাইভস(আইসিএ) প্রস্তাবিত ‘আর্কাইভস বিষয়ে সর্বজনীন ঘোষণা’ বা ‘ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অন আর্কাইভস’ সংক্ষেপে ‘ইউডিএ’ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে অসলোতে অনুষ্ঠিত আইসিএর বার্ষিক সাধারণ সভার পর থেকে আর্কাইভস সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় ঘোষণাটি ইউনেস্কো কর্তৃক গৃহীত হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ২০১১ সালের ১০ নভেম্বর সফলতা আসে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ে সর্বজনীন ঘোষণার আর্টিক্যাল ১৯ এর সঙ্গে সংগতি রেখে এই ঘোষণাটি প্রণীত হয়েছে। আর্টিক্যাল ১৯—এ উল্লেখ আছে, প্রত্যেকেরই তথ্য ও মতামত অন্বেষণ ও প্রচার করার অধিকার আছে। এ ছাড়াও গৃহীত ঘোষণাটি ইউনেস্কো সংবিধানের আর্টিক্যাল ১ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে উল্লেখ আছে যে সদস্যদেশগুলো জ্ঞান সংরক্ষণ, প্রসার আর প্রচার করবে। এ ঘোষণার দ্বারা ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে যে আর্কাইভস নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
ঘোষণাটি সংক্ষিপ্ত হলেও এতে একটি তথ্যবহুল বলিষ্ঠ ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। ঘোষণায় আর্কাইভসের চৌহদ্দিকে স্পষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে আর্কাইভস কি ধারণ করবে, জনগণকে কিসের সন্ধান দেবে ইত্যাদি। সেই সাথে নাগরিকের তথ্য অধিকারকে সুসংগঠিত করার কথা বলা হয়েছে। যাতে সকল নাগরিকের সহজ অধিগম্য প্রশাসন গড়ে উঠে। ঘোষণায় আর্কাইভসের অনন্য বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্য ও আবশ্যকতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে নথি সৃষ্টির বহুমাত্রিকতা, প্রশিক্ষিত আর্কিভিস্টদের ভূমিকা, সর্বোপরি আর্কাইভস ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষ, সরকারি কর্মকর্তা, নীতিনির্ধারকসহ সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের সম্পৃক্ততাকে এই ঘোষণায় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ঘোষণার ভূমিকায় উল্লেখ আছে, আর্কাইভস সিদ্ধান্ত, কাজ ও স্মৃতি ধারণ করে। এককথায় পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসকে তরতাজা রাখে নিজস্ব আঙ্গিকে। ইউনেস্কোর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ এই ঘোষণায় সমর্থন দিয়েছে।
আর্কাইভস বিষয়ে সর্বজনীন ঘোষণার লক্ষ্য হচ্ছে — আর্কাইভস ও আর্কিভিস্টদের প্রয়োজনীয়তা, তাৎপর্য ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্যতা ও সমঝোতা নিশ্চিত করা; মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনে সরকারের স্বচ্ছতা ও নিশ্চিত করতে আর্কাইভসের ভূমিকাকে প্রচার করা; আর্কাইভসের অনন্যতার কারণে এটি প্রতিষ্ঠিত আর্কিভিস্ট দ্বারা পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা; আর্কাইভসের ব্যবহার বৃদ্ধিতে উৎসাহ যোগানো এবং সরকার, নীতিনির্ধারক ও জনসাধারণকে আর্কাইভস সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে সম্পৃক্ত করা।
আমাদের সংবিধানের ২৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—’ রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য
ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন, যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।’
মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং শ্রেষ্ঠ অর্জন। আর মহাফেজখানা বা আর্কাইভসই হতে পারে আমাদের এই গর্বের ইতিহাসের চলন্ত ফোয়ারা। ইতিহাসকে নিয়ত বর্তমানে উৎসারিত করা জ্ঞানের আধার। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন দেশে আর্কাইভসের প্রচলন ছিল। তবে আধুনিক আর্কাইভসের জন্ম হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ফরাসী বিপ্লবের সময়। সর্বপ্রথম জাতীয় আর্কাইভস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে। সে দেশেই ১৭৯৬ সালে প্রাদেশিক আর্কাইভস প্রতিষ্ঠা করা হয়। আইন ও বিধি বিধান অনুসরণ করে ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় আর্কাইভস যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করে, তা পরবর্তীকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ গ্রহণ করে।
ভারতীয় উপমহাদেশে জাতীয় আর্কাইভস প্রতিষ্ঠিত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে। ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের পরেই প্রশাসনিক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং নতুন নতুন বিভাগ ও দফতর প্রতিষ্ঠিত হয়। সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক, রাজস্ব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯১ সালে কলকাতায় ‘রেকর্ড ডিপার্টমেণ্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ডিপার্টমেন্টই পরবর্তী কালে ‘ন্যাশনাল আর্কাইভস অব ইন্ডিয়া’ নামে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ‘ডাইরেক্টরেট অব আর্কাইভস এন্ড লাইব্রেরি’র অধীনে ১৯৫১ সালে করাচিতে ন্যাশনাল আর্কাইভস অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ঢাকায় ‘আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর’—এর অধীনে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস। রেওয়াজ অনুসারে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলাদেশের সকল ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন সরকারি, আধা—সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দলিলপত্র, দুষ্প্রাপ্য পুস্তক, পান্ডুলিপি, ম্যাপ ইত্যাদি সংগ্রহ, দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ ও পরিচর্যার দায়িত্ব বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসের। এক কথায়, বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস আমাদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আকর তথ্যবাহী মূল উপাদানের সংরক্ষণাগার, গোটা জাতির স্মৃতি বিজড়িত তথ্যের ভাণ্ডার, জাতির শেকড়ের সন্ধানদাতা। অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে জনস্বার্থে সৃষ্ট সব নথি আর্কাইভসে যথাযথভাবে থাকাটাই যুক্তিযুক্ত। এটা নির্ভর করছে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা দক্ষতার ওপর।
সর্বজনীন ঘোষণা বলছে, যেখানে যে নথি সৃষ্টি হবে বা হচ্ছে তা জাতীয় আর্কাইভসের আওতায় চলে আসবে। আর্কাইভস হচ্ছে সত্যকে ধারণ করার, তথ্যকে জীবন্ত রাখার এক অনবদ্য সংরক্ষণশালা, ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল, সময়ের সাক্ষী। যে দেশ যত উন্নত সে দেশের মহাফেজখানা তত আধুনিক, তত সমৃদ্ধ।
জাতীয় আর্কাইভসের উদ্দেশ্য হচ্ছে সংরক্ষিত সকল নথিপত্রের নিরাপত্তা বিধান এবং রেফারেন্স ও গবেষণা কাজে সুযোগ প্রদান এবং সরকারের সকল নথিপত্রের আইনগত সংরক্ষক হিসেবে কাজ করা। সরকারি, আধা—সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি সংস্থা ও জনসাধারণকে তথ্য সরবরাহ করা, আধুনিক ও যথাযথ নথি ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসের প্রধান বিভাগসমূহের মধ্যে রয়েছে প্রশাসন, নথি ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ, মাইক্রোফিল্মিং/রিপোগ্রাফি, স্টাফ ব্যবস্থাপনা, জনসংযোগ, প্রদর্শনী, ইলেকট্রনিক রেকর্ড সংরক্ষণ এবং ডিজিটালাইজেশন। মহাফেজখানা বা আর্কাইভস শুধু তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে নয়, দূর অতীত, নিকট অতীত, বর্তমান এবং অদূর ভবিষ্যতের জন্য জ্ঞানার্জনের একটি কার্যকর মাধ্যম।
জাতীয় আর্কাইভস কি এবং কেন এ বিষয়ে আমাদের শিশু শিক্ষার্থীদের অবহিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। নিজের ইতিহাস, অতীত, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সমাজ তথা শেকড়ের সন্ধান পেতে আর্কাইভস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ আর্কাইভস একটি দেশের ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ সকল সরকারি, আধা—সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা দলিল দস্তাবেজ, নথিপত্র, পান্ডুলিপি ও দুষ্প্রাপ্য পুস্তকের সংরক্ষণাগার। প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন দেশে ঐতিহ্য ধরে রাখা, সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও সামাজিকতা স¤প্রসারণের লক্ষ্যে আর্কাইভসের প্রচলন ছিল। আর্কাইভস শুধু ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মারকই ধারণ করে না, নানাবিধ জ্ঞান সংরক্ষণ এবং সরবরাহ করে, অভিজ্ঞদের স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে, নব্যসাক্ষর বা নবীনদের আনন্দ দেয়।
আমাদের জাতীয় আর্কাইভস আগারগাঁওয়ের ৩২, বিচারপতি এস এম মোর্শেদ সরণিতে অবস্থিত। এ প্রতিষ্ঠানটি সরকারি কর্মদিবসে সরকারি অফিস সময়সূচি অনুযায়ী খোলা থাকে এবং সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিন বন্ধ থাকে। জাতীয় আর্কাইভসে সংরক্ষিত নথিপত্র দেশের গবেষক, প্রশাসক, সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ এবং বিদেশী বৈধ গবেষকের গবেষণা কাজের জন্য উন্মুক্ত। প্রতিষ্ঠানটিতে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন স্মারক ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের দুষ্প্রাপ্য দলিলপত্র সংরক্ষিত আছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত জাতীয় আর্কাইভসে সংরক্ষণযোগ্য দলিলপত্রের সন্ধান ও সংগ্রহ কাজ চলছে। আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য অনুসারে, জাতীয় মহাফেজখানা আরো সমৃদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। এই জন্য দরকার আপোষহীন জাতীয় উদ্যোগ, যা হাজার উত্থানপতনের মধ্যেও ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখবে।
প্রাথমিক স্তরেই আমাদের শিশু শিক্ষার্থীরা জাতীয় জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, শহিদ মিনার সম্পর্কে পাঠ্যপুস্তকে পড়ার সুযোগ পায় বলেই শিশু কিশোরদের মানসপটে এসব বিষয় সজাগ থাকে অর্থাৎ এসব বিষয়ে তারা প্রাথমিক জ্ঞান রাখে। সুযোগ পেলে শিশু কিশোররা এসব প্রতিষ্ঠান দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং দেখে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করে যা তাদের শুধু তথ্য সমৃদ্ধই করে না, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা এবং সামাজিক জীবন গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব বিবেচনায় রেখে প্রাথমিক/ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে জাতীয় আর্কাইভসের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের অন্যতম দাবি। শুধু তাই নয় কালের ইতিহাস, সময়ের সুসমব্যবস্থাপনা, উন্নত সমাজ নির্মাণের বিভিন্ন পদক্ষেপ ইত্যাদি সুসংহত রাখার স্বার্থে অদূর ভবিষ্যতেও নথি সংরক্ষণ সমুজ্জ্বল রাখা এবং জাতীয় আর্কাইভস সংরক্ষণ ও স¤প্রসারণের লক্ষ্যে ইউনেস্কো ঘোষিত আর্কাইভস বিষয়ক সর্বজনীন ঘোষণা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা সময়ের দাবি। কারণ উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণের রসদ, ‘ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষ্য’ মহাফেজখানাই যত্নের সাথে রক্ষা করে, যা শিক্ষার্থীদের শেকড়ের অকৃত্রিম সন্ধানদাতা। জাতির ইতিহাস শুধু অতীতের কথা বলে না, জাতির চোখ খুলে দেয়, ভবিষ্যতের পথও দেখায়।
শাওয়াল খান, গবেষক ও প্রাবন্ধিক