ড. সালাহউদ্দীন আইয়ুব : তবে এটাতো ভাবা ঠিক নয় যে পাঠকমাত্রেই বুদ্ধিহীন হবে, তারা কিছু বুঝতে পারবে না। এটা করে করে গোটা জাতটা নষ্ট হয়ে গেল। দিনের পর দিন রক্ত জল করে যেটা আমি জেনেছি, যেটা আমি শিখেছি, এককথায় সেটা জেনে ফেলবে? অনেক নিষ্ঠা চাই, অনেক কষ্ট করতে হয়, তবেই হয়। আমি বল্লুম আর হয়ে গেল, তা হয় না। একজন বল্লেমার্শাল প্রুস্ত সম্বন্ধে কিছু বলুন। আমি জিজ্ঞেস করলুম, কীএক কথায় বলতে হবে? এতটুকু ধৈর্য্য নেই, কেউ কিছু পড়বেনা, চেষ্টা করবে না। কী ত্যাগ করেছে জীবনে? ত্যাগ ছাড়া কি জীবনে কিছু হয়?
দয়াময়ী মজুমদার, আমার স্বামী কমলকুমার, ২০১২: ২৯-৩০
কথার চিত্রকর কমলকুমারকে আমি, আরও অনেকের মত, ‘কবি’ বলেই জানি। চিত্রশিল্পী তো তিনি ছিলেনই, দক্ষ ক্রাফটস্ম্যানও ছিলেন (অনেক ‘নিষ্ঠা’, অনেক ‘কষ্ট’, অনেক ‘ত্যাগ’ ছাড়া কাব্যি করা যায়, আর্টিস্ট বা ক্রাফটস্ম্যান হওয়া যায় না)। কমলকুমারের লেখার ভিতর ‘আর্ট’ ও ‘ক্রাফটে’র এই দুটো দিক- যার সঙ্গে শব্দজীবী বঙ্গীয় লেখকদের নিছক শব্দচর্চার কোনো মিল নেই কমলকুমারের রচনারীতির চরিত্র, তার পৃথকত্ব, অনুধাবনের জন্যে খেয়ালে রাখা বাধ্যতামূলক। উপরন্তু বুঝতে হবে যে, কমলকুমারের রচনা বাহ্যত কবিতা নয়
বটে, কিন্তু তা কাব্যই (অর্থাৎ তার মধ্যে, ফ্লোবেয়ারের মতো, পরবর্তী প্রুস্ত-জয়েসের মতো, উৎপ্রেক্ষার “অ্যাক্শন” আছে: নিছক কথাসাহিত্য-নবীশের পক্ষে কমলকুমারের মত মৌলিক উৎপ্রেক্ষা রচনা আদৌ সম্ভব নয়)। গোলাপ সুন্দরী (১৯৮২) থেকে উৎকলিত কিছু কিছু বাক্যে চোখ বুলিয়ে পাঠক নিজেও টের পাবেন যে প্রতীকী অর্থে না, আলংকারিক অর্থেও নয়, একেবারে বৈদিক অর্থেই কমলকুমার কবি ছিলেন।
এক
কমলকুমারের মন-মানস বা চিন্তাধারা বহুলাংশে যাঁর বিপরীত, সেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একদা ‘দুষ্পাঠ্য’ কমলকুমারকে শিক্ষিত পাঠকের কাছে সহজবোধ্য না হলেও ‘সহনীয়’ করে তোলার সদিচ্ছায় কমলপাঠের দুয়েকটা টেকনিক প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি, অন্তর্জলী যাত্রা পড়ার আগে, গৌতম ঘোষের ছবিটা দেখে নিতে বলেছেন; পরামর্শ দিয়েছেন ‘গোলাপ সুন্দরী’ পড়া শেষ করে তারপর ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ধরতে।
সিনেমার সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক আছে মানি, কারণ দুটোই ‘আর্ট’ (মধুসূদনের ‘বঙ্গভাষা’ সনেট এবং ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভাস্কর্য যেমন, মাধ্যম পৃথক হলেও, আর্ট হিসেবে এক)। কিন্তু সুনীল আর্টের কথা বলছেন না; তিনি বলছেন, মার্কিন দেশের ইসকুল-টিচারদের মতো, সিনেমা দেখার কথা। সিনেমা-দর্শন এবং সাহিত্য-পাঠ কি করে এক হতে পারে তা, অদ্বিতীয় ভাবুক নীল পোস্টম্যানের মতো, আমারও বুদ্ধির অতীত। ‘গোলাপ সুন্দরী’র সঙ্গে ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ মেলানোর প্রস্তাবও, আমার মতে, কম বিভ্রান্তিজনক নয়। সুনীল লিখেছেন, ‘গোলাপ সুন্দরী’ পড়ার পর ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ ফিরে পাঠ করলে অনেক জট খুলে যায়’ (ভূমিকা, উপন্যাস সমগ্র, কমলকুমার মজুমদার [২০০২] ২০১১: ৩)। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় জট কই? আমি তো কোনো জট দেখি না। হতে পারে তা আমার পড়ার দোষ, কিন্তু অন্তর্জলীতে যা নেই তা আবিষ্কার করা নিষ্প্রয়োজন।
তবে ‘গোলাপ সুন্দরী’র প্রতি সুনীলের সহজাত পক্ষপাত আছে (হয়ত বেলাল-সন্দীপনেরও ছিল) এবং তা খুব স্বাভাবিক, যদিও পক্ষপাতের হেতু খুব সম্ভব ‘গোলাপ সুন্দরী’র বিষয়বস্তু নয়; যক্ষায় আক্রান্ত ‘বিলাস’ চরিত্র ও মনিক চ্যাটার্জ্জির সম্পর্ক হতে পারে, কিন্তু গোলাপ সুন্দরীর বিষয়বস্তু নয় । কারণ ‘গোলাপ সুন্দরী’র বিষয়বস্তু তাঁদের লেখায় আলোচিত হতে দেখি নি; তাঁরা যে-সকল বাহ্য বিষয়াদিকে এর বিষয়বস্তু মনে করেছেন, এবং তাঁদের দেখাদেখি অন্যেরা সে কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন, তার সঙ্গে ‘গোলাপ সুন্দরী’র বিষয়বস্তুর কোনো সম্পর্ক নাই, মধ্যযুগের ক্রিসেনডম ও সে-সময়কার অ্যালেগরিকাল ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ছাড়া ‘গোলাপ সুন্দরী’র বিষয়বস্তু বোধগম্য হতে পারে না [এর বিষয়বস্তু অন্য প্রবন্ধে আলোচিত হবে]।
কাজেই ‘গোলাপ সুন্দরী’র বিষয়বস্তু বা কমলকুমারের বক্তব্য নয়, বরং তাঁর উৎকট গদ্যের আড়ালে উৎকৃষ্ট কাব্যের উপস্থিতি দেখেই ‘কৃত্তিবাসী’রা কমলকুমারে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কমলকুমারের সঙ্গে কৃত্তিবাসীদের ভাব-বিশ্বাসের কোনো মিল থাকা সম্ভব নয়; তাই কৃত্তিবাসীদের কমল-ভাষ্য পড়ে কমল-সাহিত্য অনুধাবন বা তার অর্থোদ্ধারের চেষ্টা সময়ের অপচয় মাত্র। তবে, যেমন বলেছি, কমল-সাহিত্যে অন্তর্লীন ‘কাব্য’ই তাঁর প্রতি কৃত্তিবাসীদের আকর্ষণ বোধের মূল কারণ: সেই ‘কাব্য’, যা কখনো দেশ, কাল, ব্যক্তি, বিশেষ অভিরুচি বা নির্দিষ্ট ‘ভাষা’তে সীমাবদ্ধ থাকে না, যার ‘প্রাচীন’-‘আধুনিক’ ‘সাধু’-‘চলিত’ ‘নতুন’-‘পুরাতন’ ভাগ নেই। যথার্থ কাব্যে মৌলিক কল্পনাশক্তি ও গভীর অনুভবের সেই উদ্ভাসন থাকে, সেই ঝলক যা কথাসাহিত্যে কেউ আশা করে না, ‘শেষের কবিতা’র মতই তা একেবারে অপ্রত্যাশিত।
কমলকুমারের গল্প-উপন্যাসে, এমনকি প্রবন্ধে বা সাধারণ চিঠিতেও, এই অপ্রত্যাশিত কাব্য বিরাট শক্তি নিয়ে উপস্থিত। ‘কৃত্তিবাসী’দের সূত্রে এই সংগুপ্ত কাব্যের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে অন্য লেখকেরা বিশেষত দেশভাগোত্তর আধুনিক কবিরা কমলকুমারে কৌতূহলী তো হলেনই, তার পর থেকে ‘কবি’ ও ‘কথাশিল্পী’র সনাতন শ্রেণীবিভাগও অবিচলিত থাকল না। বুঝতে বাকি রইল না যে, ‘কবি’র লেবেল লাগিয়ে বসে আছেন এমন সব ব্যক্তি যাঁদের কাব্যির সঙ্গে কোলরিজ-ব্যাখ্যাত ‘কল্পনা’ ও ‘প্রতিভা’র দূরতম সম্পর্কও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কাব্য এবং কল্পনাশক্তির এই ঘোরতর দুর্ভিক্ষের ভিতর কৃত্তিবাসীরা কমলকুমারের শরণ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কৃত্তিবাসীদের কমল-ব্যাখ্যা গ্রহণের দরকার নেই, কিন্তু ‘কৃত্তিবাসে’র মধ্যস্থতা ছাড়া কমলকুমার নামটাও ঢাকা পর্যন্ত এসে পৌঁছাত কি না সন্দেহ। ‘দুষ্পাঠ্য’ কমলকুমারের যাবতীয় গল্প-উপন্যাস আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশ করেছে, এই আশ্চর্যজনক ঘটনা যে ঘটতে পারল তার তিন-চতুর্থাংশ ক্রেডিট ‘কৃত্তিবাস’ এবং কৃত্তিবাসীদের দিতে হবে। জীবনীকার বসওয়েলকে (জ. ১৭৪০) বাদ দিয়ে যেমন ডক্টর জনসন (জ. ১৭০৯) নামক কিংবদন্তী অচিন্ত্যনীয়, তেমনি কমলকুমার নামক কিংবদন্তী নির্মাণে কৃত্তিবাসীদের ভূমিকা (সুব্রত, অনিরুদ্ধ, প্রশান্ত সবার কথা মনে রেখেই বলছি) স্বীকার না করে পারা যায় না। তাতে অবশ্য কৃত্তিবাসীগণ, ডক্টর জনসনের ভক্ত জীবনীকার স্খলিতস্বভাব স্কটিশ উকিল শিষ্যটির মত, নিজেরাও উপকৃত হয়েছিলেন যথেষ্ট।
গোলাপ সুন্দরী উপন্যাসের ‘মাঝে মাঝেই ঝলসে ওঠে কবিত্বের মাধুর্য’, লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। খুব সত্য কথা। উপন্যাসের শুরুতেই হাসপাতালের সামনে রাখা গাড়ির ‘ফুটবোর্ডে’ বসে একটা ‘কালো সুঠাম ন্যাংটো’ বালকের ‘বুদ্বুদ’ তৈরির বর্ণনায় কাব্যের সেই ঝলক চমকে দেয় আমাদের। কলমকুমার কবিও, চিত্রকরও (চিত্রকর কি, কারিগর-ক্রাফটস্ম্যান কি, তা যে কখনও কিছু আঁকার চেষ্টা করে নি এবং কখনও, ঘন্টার পর ঘন্টা একস্থানে বসে, টুল-পিঁড়া-আলমিরার মত কোনো জিনিশ বানায় নি, তার পক্ষে বোঝা কঠিন)। এই কারিগর-চিত্রকর কবির লেখায় সামান্য বুদ্বুদও তাই অসামান্য কাব্যচিত্রে পরিণত হয়, ‘বুদ্বুদ’ আর বুদ্বুদ থাকে না: একটির পর একটি উঠে যাওয়া বুদ্বুদকে দিকভ্রান্ত ‘পলাতক কাঠবিড়ালী’র মত মনে হওয়ায় বালকটি আয়ত চোখ তুলে উর্ধ্বে তাকায় এবং হাসে; আবার সেই ভ্রাম্যমাণ বুদ্বুদগুলো বিলাসের চোখে প্রতিভাত হয় সবুজ শষ্যক্ষেতে ‘হেমন্তের অপরাহ্ন মন্থনকারী রাখালের বাঁশরীর শুদ্ধনিখাদে দেহ ধারণ’ করে ‘সুডৌল দ্যুতিসম্পন্ন’, চঞ্চল; উপরন্তু, সকালের সূর্যালোকে স্বেচ্ছাচারী ওসব বুদ্বুদকে তার মনে হয় যেন বা এক-একটি উজ্জ¦ল, অভিমানী, ‘বাবু’। বুদ্বুদকে আর কেউ ‘বাবু’ বলেছেন বলে মনে হয় না। কবির কল্পনার সঙ্গে চিত্রকরের ভিশন মিললে গোলাকার ‘বুদ্বুদ’ও অভিমানী বাবু হয়ে যায়।
তিনটি বাক্যের সমন্বয়ে গঠিত প্রথম এই অনুচ্ছেদটির অল্পাংশ মাত্র বিবৃত হল আমার এই ভাষ্যে: অনুচ্ছেদটির মুখ্য প্রতিপাদ্যে প্রবেশ করা এখনো বাকি। কারণ অনুচ্ছেদটি ‘বুদ্বুদে’র বর্ণনা নয় (যেরকম বর্ণনা‘বুদ্বুদে’র না হোক, কমলকুমারের মত কাব্যময় না হোক গল্প-উপন্যাসে বিস্তর মিলবে)। তিন-বাক্যের এই অনুচ্ছেদ মূলত দু’টি শব্দের ব্যাখ্যা, যা দিয়ে গোলাপ সুন্দরীর আলোচ্য অনুচ্ছেদের আরম্ভ। ‘বিলাস অন্যত্রে’এই দুটি শব্দ দিয়ে এই অনুচ্ছেদ তথা উপন্যাসের সূচনা, এবং বিলাস কি কারণে ‘যেখানে’ আছে ‘সেখানে’ নেই, আছে অন্যত্র, অন্য কোথাও, এবং সে কেন যে এখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ‘বেশ সুস্থ’ বুদ্বুদের এই সৌন্দযর্, এই দৃশ্য (যা কখনো আসন্ন সন্ধ্যায় ক্রমে নক্ষত্র পরম্পরার উদ্ভাসের মত প্রতীয়মান) দেখে ‘অন্যদিকে আপনার দৃষ্টি’ ফিরিয়ে নিয়ে যায়, এই উৎপ্রেক্ষাময় চিত্রকল্পময় অনুচ্ছেদটি তার অনুসন্ধানে উদগ্রীব। অনুসন্ধানের ধরন থেকে বোঝা উচিত, গদ্যে রচিত হলেও, ‘গোলাপ সুন্দরী’ একজন কবির রচনা এবং উনবিংশ শতাব্দীর সাধু বাংলায় লিখিত হলেও এর মধ্যে যে-চৈতন্য, যে-অনুভূতি, যে অভিজ্ঞতার অন্তর্বয়ন, তা তুলনীয় হতে পারে শুধু ‘আধুনিক কাব্যে’র সঙ্গেই (গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে নয়)।
বিলাস কোথায়? ‘বিলাস অন্যত্রে’শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেকারণ বুদ্বুদ-দর্শনে বিলাসের চিত্তলোক চঞ্চল, কেননা রৌদ্রালোকে উড়াল দেয়া ‘অবিচারৎ নীল’ বুদ্বুদসকল ‘সম্মুখে থাকিয়াও পশ্চাৎধাবন করে।’ বুদ্বুদের ‘পশ্চাৎধাবনে’ বিলাস ‘কুণ্ঠিত’, কেননা কবি না হয়েও অতীতে, ‘আত্মসচেতনতার কুজঝঠিকা’র ভিতর বিলাস যখন নি:সঙ্গ একা, তখন তার কবিতা লেখার ইচ্ছা হত। কাব্য রচনার বাসনা থাকলেও ‘কবি’ হওয়ার ইচ্ছে তার ছিল না, কারণ ‘রূপ’-কে ‘রূপান্তরিত’ করা কবির প্রাথমিক কর্তব্য হলেও, সেই রূপের ভেতর ‘ভালোবাসার শুদ্ধতার দিব্য উষ্ণতা’ সঞ্চার করার সামর্থ্যইে নির্ধারিত হয় কাব্যপ্রতিভা। বিলাসের সেই সামর্থ্য নেই, প্রতিভা নেই, যদিও সে কল্পনাক্ষম, সংবেদনশীল, ‘স্বতন্ত্র’। রূপের আত্মার ভিতর ‘দিব্য উষ্ণতা’ সঞ্চারের শক্তি না থাকলেও, বিলাস নিজের ভেতর কাব্যের সংক্রাম টের পায়; সেজন্যই রোগশয্যা থেকে উঠে বুদ্বুদের সৌন্দর্য দেখে সে বিচলিত, কেননা বুদ্বুদের সৌন্দর্য তার পশ্চাৎধাবন করে, তার মধ্যে জাগিয়ে তোলে অতীতের কাব্যচেষ্টার স্মৃতি ও আকাক্সক্ষা, অথচ বুদ্বুদের সৌন্দর্য রূপের আধারে বিন্যাস করার সামর্থ্য বা যথোচিত ‘অভিজ্ঞতা’ তার আয়ত্তে নেই। মিলিয়ে পড়ার জন্যে এবার সম্পূর্ণ অনুচ্ছেদটি তুলে দিচ্ছি:
বিলাস অন্যত্রে, কেননা সম্মুখেই নি¤েœর আকাশে, তরুণসূর্য্যবর্ণ কখনো অচিরাৎ নীল, বুদ্বুদসকল, যদৃচ্ছাবশত: ভাসিয়া বেড়াইতেছে। একটি আর একটি এইরূপে অনেক অনেকআসন্ন সন্ধ্যায়, ক্রমে নক্ষত্র পরম্পরা যেমন দেখা যায়দূর হরিত ক্ষেত্রের হেমন্তের অপরাহ্ন মন্থনকারী রাখালের বাঁশরীর শুদ্ধনিখাদে দেহ ধারণ করত সুডৌল দ্যুতিসম্পন্ন বুদ্বুদগুলি ইদানিং উঠানামা করে, এগুলি সুন্দর, উজ্জ্বল, বাবু, অভিমানী আশ্চর্য্য! এ কারণেই বিলাস, চমৎকার যাহার রূপ, যে বেশ সুস্থ, এখন অন্যদিকে আপনার দৃষ্টি ফিরাইয়াছিল কেননা এ সকল বুদ্বুদ সম্মুখে থাকিয়াও পশ্চাদ্ধাবন করে কিন্তু এ-দৃষ্টিতে তাহার কোনোরূপ অভিজ্ঞতা ছিল না, এ কথা সত্য যে, তাই মনেতে নিশ্চয় সে কুণ্ঠিত কেননা ইত:পূর্বে অজ¯্র দিনের আত্মসচেতনতার কুজঝটিকার মধ্যে সে একা বসিয়া কবিতা লিখিবার মনস্থ করে কবি হইবার নয়, যেহেতু, সম্ভবত, রূপকে রূপান্তরিত না করিয়া ভালবাসার শুদ্ধতার দিব্য উষ্ণতা ক্রমে অস্পষ্ট অহংকার পর্যন্ত, তাহার ছিল না যদিও তাহার নি:সঙ্গতা নাই শুধুমাত্র স্বতন্ত্রতা ছিল। গোলাপ সুন্দরী [১৯৮২] ২০১১:৮৩
দুই
‘গোলাপ সুন্দরী’তে ঘটনা বিশেষ নেই, চরিত্রসংখ্যাও অল্প, কাহিনিও জটিল নয়। এটি ‘বিলাস’ নামক যক্ষারোগে আক্রান্ত এক শিক্ষিত, অনুভূতিপ্রবণ, প্রণয়লিপ্সু রোমান্টিক যুবকের কাহিনি। বিলাসের অতীত জীবন বা তার পরিবার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। উপন্যাসের প্রাথমিক ঘটনাস্থল যক্ষারোগীদের চিকিৎসাকেন্দ্র। ‘উচ্চশ্রেণীর দক্ষিণ ভারতীয়’ ব্রাহ্মণ ডাক্তার রঙ্গস্বামীর যতœ ও সুচিকিৎসায় প্রথমবারের মত সেরে ওঠার পর বিলাস তার বিবাহিত দিদি ওমি ও তার বিত্তবান স্বামী মোহিতের গাড়িতে করে একটা ইংলিশ কটেজে গিয়ে ওঠে। বিলাস সুন্দর, মার্জিত, ‘রূপবান যুবক’; ওমি, মোহিত, বিলাসের কথাবার্তা, ইংরেজিয়ানা, ফ্যাশন থেকে বোঝা যায় তারা ইংরেজি শিক্ষাপ্রাপ্ত উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনুষ্য। বিলাসকে ‘মিয়ানী মৌজার ছোট বিলাতী কটেজে’ রেখে আসার পর ওমি ও মোহিতকে ‘গোলাপ সুন্দরী’তে দেখা যায় না। অবশ্য দিদি-ভগ্নিপতি যে একেবারেই অনুপস্থিত এমন নয়, কেননা কটেজে বসে বিলাস ওমিকে চিঠি লেখে; কটেজের একাকী জীবনে, ‘শূন্যতা’Ñবিলাসের বিভিন্ন মুহূর্তে বিলাস তাদের কথা ভাবে; মোহিতের বিভিন্ন ব্রান্ডের বিদেশি মদ্য ও ওমির রেখে-যাওয়া কাপড়-চোপড়ের উল্লেখ থেকে তাদের উপস্থিতি আমরা অনুভব করি (ওমি ওভাবে কাপড় রেখে না গেলে বৃষ্টিতে ভিজে বিলাসের কটেজে আগত রাধিকার, অর্থাৎ মনিক চ্যাটার্জির, মানে গোলাপ সুন্দরীর, ভীষণ অসুবিধে হত)। দিদি ওমির পোশাক-পরিহিতা গোলাপ সুন্দরী মনিক চ্যাটার্জ্জি: এই সাংকেতিক তথ্যে ‘অজাচারে’র মত ঘৃণ্য অপরাধের ভয়ানক ইঙ্গিত দিয়ে যান কমলকুমার। নৃতাত্ত্বিক লেভি-স্ত্রোস দেখিয়েছেন যে, অজাচার সারা পৃথিবীর সকল সমাজে, ব্যতিক্রমহীন ভাবে, একটি জঘন্যতম অপরাধ রূপে বিবেচিত। ‘গোলাপ সুন্দরী’র বিষয় আন্দাজ করতে হলে এসব ইঙ্গিত বিস্মৃত হওয়া যাবে না।
উপন্যাসে ভগ্নিপতি মোহিতের ভূমিকা গৌণ হলেও উপন্যাসের শুরুতে তার উপস্থিতি কৌতূহল উদ্রেক করে। মোহিত ফিরিঙ্গি সাহেবসুবার মত ফ্যাশন-দুরস্ত বাবু; ইংরেজির অনাবশ্যক উপদ্রবে তার মুখের বাংলা কথা ও উচ্চারণ প্রায়ই বিকৃত হয়ে যায়। হাসপাতালকে, এই ফেরেঙ্গ মোহিতের, মনে হয় ডা’ল জায়গা (মানে, ধ ফঁষষ ঢ়ষধপব)। তাছাড়া সে কথায় কথায় ‘অফুলি স্পোর্ট’ ‘ডিয়ার’ ‘গাড অয়লমাইটি’, ‘অদ্ভুত টেরিবল’এই জাতীয় শব্দের খৈ ফোটাতে অভ্যস্ত।
স্যানোটোরিয়ামকে তার মনে হয় ‘অ্যাডোরিং গার্লিক উইথ হামবল ফেইস’ (পৃ. ৮৯) [মানে, হাসপাতালটি ‘গোবেচারা রসুনের মত বড় ভাল’]। মোহিতের অসম্পূর্ণ ইংরেজি বাক্যে ‘আর্টিকেল’ না থাকায় তার ইংরেজিবিদ্যার দৌড় সম্পর্কে ধারণা করা যায়, তবে কথাটা (রসুনের সঙ্গে উপমা) তার নিজের নয়, ওয়েলসের যাজক কবি জর্জ হারবার্ট (১৫৯৩-১৬৩৩) থেকে আত্মসাৎকৃত, আর্টিলের অনুপস্থিতিতে যা ঈষৎ বিকৃত হয়েছে। জন ডান, এইবরাহাম কাওলি, জন ক্লিভল্যান্ড, জর্জ হারবার্টএঁদেরকে ‘মেটাফিকিকাল কবি’ বলা হয়, লেবেলটা দিয়েছিলেন ডক্টর জনসন, এবং কাওলি-সংক্রান্ত তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধে এইসব প-িতি মারানো কবিদের গুষ্ঠি উদ্ধার করেছিলেন। তবে জন ডানের কবিত্বশক্তিতে ডক্টর জনসনের সংশয় ছিল না; তবে অনুভূতিশূন্য কাওলিকেই তিনি, কবিতার মধ্যে প্রকৃত অনুভূতি প্রকাশের বদলে পা-িত্যগিরি করার জন্যে, একেবারে ধুয়ে দিয়েছিলেন। মেটাফিজিকাল কবিরা শেক্সপীয়রের ইষৎ পরবর্তী, অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর। বিংশ শতাব্দীতে এসে এই সপ্তদশ শতকী মেটাফিজিকালদের মুরিদ হয়েছিলেন স্বধর্মভ্রষ্ট টি. এস. এলিয়ট এবং তিনি, ক্যাথলিক ফেরকায় নাম লেখানোর পর, সপ্তদশ শতকের ক্যাথলিক মেটাফিজিকাল কবি জন ডানকে উর্ধতম আকাশে স্থাপন করেছিলেন শেক্সপীয়র, মিল্টন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ “প্রটেস্টান্ট” আধুনিক কবিদের নিচে নামানোর জন্যে। কমলকুমার ইউরোপের মধ্যযুগ এবং মধ্যযুগ-উত্তর এইসব এলিজাবেথীয় মেটাফিজিকালদের সম্পর্কে খুব ভালভাবে অবহিত ছিলেন। তিনি যে সার ওয়াল্টার র্যালির কথা লিখেছেন, তাঁকেও প্রতœ-মেটাফিজিক্যাল ধরা হয়। মেটাফিজিকাল কাব্য মানে কবিতা লিখতে গিয়ে পা-িত্য ফলানো, তত্ত্ববাজি। এ ধরনের মেটাফিজিকাল বা ‘প-িতি সাহিত্যে’র বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন অষ্টাদশ শতকের ‘প্রটেস্টান্ট’ সমালোচক ডক্টর সামুয়েল জনসন। ডক্টর জনসনের প্রবন্ধগুলো কমলকুমার গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন (বসওয়েলের লেখা জনসন-জীবনী তো বটেই)। শেক্সপীয়রের সমকালীন ইংলিশ কবি এডমান্ড স্পেনসারের কঠিন, রূপকান্বিত (অ্যালেগরিকাল), মহাকাব্য ‘ফেয়ারি কুইন’ (১৫৯০ খৃ.) ও তিনি বাদ দেন নি। সাহিত্য ইত্যাদি অধ্যয়নের জন্যে কমলকুমারের যে নিজস্ব পাঠক্রম বা কারিকুলাম ছিল, তার সঙ্গে (সুধীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে) তিরিশি কবিদের কোনো পরিচয়ই ছিল না, বা পরিচয় থাকলেও ওতে তিরিশিদের আগ্রহী হবার কোনো কারণ নেই। আর তিরিশিরা যা পড়ে নি, জানতে চায় নি, তার হদিস যে পরবর্তীদের থাকবেনা তা তো নিশ্চিত। তিরিশের সাহিত্য থেকে গড়ে ওঠা সাহিত্যবোধ বা ধারণা দিয়ে ‘গোলাপ সুন্দরী’ বোঝা যাবে কি?
‘গোলাপ সুন্দরী’র মোহিত, বিলাসের ফেরেঙ্গ ভগ্নিপতি, বিলাসের চোখেও একটা কৌতুকজনক চরিত্র । মোহিত, বলা বাহুল্য, ম্যাটেরিয়ালিস্টিক অর্থাৎ বস্তুমনস্ক। বস্তুমনস্ক মানে বিভিন্ন ফ্যাশনেবল বস্তু, কোট-প্যান্ট বিলাতি জিনিশ সোনার বোতাম, দিয়েই যার পরিচয় এবং সেসব বস্তু সরিয়ে নিলে মোহিত নামক মনুষ্যের সঙ্গে একটা ইট, দেয়াল বা কাঠের টুকরার কোনো পার্থক্য থাকবে না। মোহিতের ‘সৌখীন সিগারেট কেস’, ইস্ত্রি করা ‘সিয়াসেকা’ কাপড়ের কোট-প্যান্ট (তার মধ্যে ছোট্ট সুরার বোতল), ‘পোলকা ডট সার্ট’, পকেটে ‘ব্লু রুমাল’ এবং ‘বাটনহোলে সোনার চাকতিতে’ ইংরেজি হরফে লেখা ‘এম’ মনোগ্রাম ইত্যাদি দেখে বিলাসের মনে হয় ‘বঙ্গের গোলাপ’ বলতে ‘যে-আহলাদ উদাত্ত হয়ে ওঠে’, তা হয়তবা তার ভগ্নিপতিকে ধারণ করেছে (পৃ.৮৪)। এই কৌতুকজনক মোহিত চরিত্র কমলকুমারের একটি প্রিয় উপন্যাসের তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘স্বর্ণলতার (১৮৭৪) গদাধর চন্দ্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। স্বর্ণলতা (১৮৭৪) উপন্যাসে গদাধর (শশিভূষণের স্ত্রী প্রমদার ভাই) বাংলা ‘ত’ বলতে অক্ষম; ‘ত’-কে এই গদাতার মা ও বোন ছাড়া অন্য সকলে তাকে ‘গদা’ই বলে‘ট’ বলে। ‘তুমি’ না বলে ‘টুমি’, ‘তোমরা’র স্থলে ‘টোমরা’, দিদি-র বদলে ‘ডিডি’। গদাধরের দিদি প্রমদা। প্রমদা তার জামাই শশিভূষণের বাড়ি থেকে চাল-ডাল, জিনিশপত্রাদি, চুরি করে নিয়মিতভাবে তার বাপের বাড়িতে পাঠায়, এবং পাঠায় এই গদাধর-মারফত। গদাধর, বলাবাহুল্য, অপদার্থ: ফলে শশিভূষণের বাড়ি থেকে তাদের বাড়িতে বেড়াতে-আসা ছেলের সামনেই সে জিজ্ঞেস করে বসে, “ডিডি যে ডালটা পাঠায়ে দিয়েছিল, টা নেই?” (স্বর্ণলতা [১৮৭৪] ১৯৫৭: ৪৫)।
‘গোলাপ সুন্দরী’র মোহিতও, ‘স্বর্ণলতা’র গদাধর চন্দ্রের মত, “তোমরাত” বলতে গিয়ে বলে “টমিরত” : ‘টমিরত [হাসপাতালে] থাকলেই পারতে’। অন্যদিকে স্বর্ণলতা উপন্যাসের নায়িকা ‘র্স্বণলতা’র সঙ্গে গোলাপ-প্রতিম সুন্দরী মনিক চ্যাটার্জ্জির বয়সে-শিক্ষায়-চরিত্রে (রূপে নয়) বেশ পার্থক্য থাকলেও, স্বর্ণলতার সুশিক্ষিত ভাই হরিদাসের অর্থলোভী গুরুঠাকুর শশাঙ্কশেখর যাকে কটাক্ষ করেছেন ‘ইংরেজি ম্যান’ (পৃ. ১৪২) বলে সেই বসন্ত রোগাক্রান্ত, এবং উপন্যাসের শেষে শয্যাশায়ী, হেমচন্দ্রের সঙ্গে ‘গোলাপ সুন্দরী’র বিলাসের সাদৃশ্য দেখা যায়।
‘গোলাপ সুন্দরী’র গল্প গোড়া থেকে অনুসরণ করে গেলে এরকম দাঁড়ায়: যক্ষারোগে আক্রান্ত হয়ে বিলাস একটি স্যানাটোরিয়ামে ভর্তি হয় এবং ব্রাহ্মণ চিকিৎসক রঙ্গস্বামীর চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে ওঠে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সে একটি সুন্দর বিলাতি কটেজে গিয়ে উঠে এবং সেই নিরিবিলি কটেজের লাগোয়া একটি বাগানের বিশেষত একটি গোলাপের যতœ ও পরিচর্যায় সময় কাটায়। সুস্থতাবোধ সত্ত্বেও মৃত্যুচিন্তা বিলাসের মাথা থেকে যায় না, যদিও তা ভুলে থাকার জন্য যে তেজস্বী গোলাপ বাবু ও রসিক চন্দ্রমাধবের সঙ্গে আড্ডায়, কথাবার্তায়, পরন্তু গোলাপ বাগানের পরিচর্যায় অনেক সময় অতিবাহিত করে। এক অন্ধকার রাতে কটেজের পাশ্ববর্তী আদিবাসীদের গ্রামে এক সাঁওতাল রমণীরভূষণের বউর মৃত্যু হলে বিলাসের মৃত্যুচিন্তা পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে কেননা সাঁওতালদের শবযাত্রায় ‘একটানা স্বরে দেহালা ধরনে’র এই সাঁওতালী গান তার কানে আসে: ‘পরান ময়নারে এ বাসা ছেইড়ে/ কোত্থাকে যাও বারেবার’। সাঁওতালদের বামন আছে, কিন্তু সেই বামন অনুপস্থিত; ফলে বিলাসকেই, যে ব্রাহ্মণ নয়, ভূষণের বউর মুখাগ্নি ও শেষকৃত্যের সময় পি-দান-পাঁজিপাঠের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। সে সময় ‘বিজুরী রেখার আলোকে’ চিতায় শায়িত হতভাগিনীকে বিলাসের মনে হয় ‘শুধু রাজরাজেশ্বরী নহে অপূর্ব্ব সুন্দরী’ (পৃ. ৯৯)। প্রবল ঝড়-বাদল, মেঘের গর্জন, একটানা বিদ্যুচ্চমক, বর্ষণমুখর সেই দুর্যোগপূর্ণ দিবসের অবসানে তার কটেজে এসে হাজির হয় বৃষ্টিতে জবুথবু এক অপূর্ব সুন্দরী রমণী, মনিক চ্যাটার্জ্জি। তার বাগান নিয়ে কৌতুহলী এবং একই কটেজের বাসিন্দা এই মনিক চ্যাটার্জিকে বিলাস এই প্রথম নয়, আগেও দেখেছে। চন্দ্রমাধবের কাছে ‘গ্রান্ড মেয়ে’ অসামান্যা রূপসী ‘দারুণ স্কলার’ মনিকের অনেক গল্পও সে শুনেছে; একবার মনিককে সে তার ঘরে আসার জন্যে নেমতন্নও করেছিল (যদিও সে আসেনি)। এই ঝড়তুফানের ঘোর তা-বের মধ্যে মনিকের উপস্থিতি দেখে বিলাস বিস্মিত, উত্তেজনায় বিমূঢ়। বহু দিনের যতœ, প্রতীক্ষা ও পরিচর্যায় প্রস্ফূটিত বাগানের যে গোলাপটিকে বিলাস শবযাত্রার আগেই ঘরে এনে রেখেছিল, মনিককে সে তা প্রদর্শন করে অনতিবিলম্বে এবং ন¤্র, অনুচ্চকণ্ঠে মনিককে ডাকে ‘গোলাপ সুন্দরী’ বলে । ‘মাহ ভাদরে’র ভরা বাদলে সাক্ষাৎ গোলাপ সুন্দরী মনিকের রাধিকায়, অর্থাৎ বৈষ্ণব পদাবলীর অভিসারিণীতে, রূপান্তরিত হতে বিলম্ব হয় না; এবং ‘ঘোর যামিনী মেঘের ঘটা’য় ভগ্নিপতি মোহিতের রেখে-যাওয়া বিলেতি সুরা সহকারেএবং বিলাস-প্রস্তাবিত নতুনতর বাৎসায়ণ সূত্র অনুযায়ীএ দুই রাধাকৃষ্ণের মিলনও অবিলম্বে সম্পন্ন হয়। প্রভাতে নিদ্রা ভঙ্গেও পর মনিককে বিছানায় পাওয়া যায় না। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই বিলাসের মুখ ভরে ‘পুনরায় রক্ত’ নেমে আসে।
পুুনরায় স্যানাটোরিয়ামে ফিরে সেখানে ‘অনেকদিন পার’ হয়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে গোলাপ সুন্দরীর সংবাদ-সম্বলিত একটি টাইপ করা চিঠি বিলাসের কাছে আসে। ওতে মনিকের মৃত্যু-সংবাদ ছাড়াও আরেকটি, তার চেয়ে গুরুতর, সংবাদ ছিল। পৃথিবী ত্যাগ করার পূর্বে ‘গোলাপ সুন্দরী’ একটি পুত্র রেখে গেছেন। এই পুত্রটি কার, তা স্পষ্ট করে বলা হয় নি, বললে গল্পটি নষ্ট হত। আমাদেরকে, অতি নিরাসক্ত ভঙ্গিতে, দেয়া হয় শুধু মৃত্যুর মুহূর্তে ‘গোলাপ সুন্দরী’র পুত্রের খবর, এবং পুত্র বিষয়ে ‘চিঠিতে সনির্ব্বন্ধ অনুরোধের কথা’ শুনে মুমূর্ষু বিলাসযে বিলাসের সময় উত্তীর্ণ, আর ‘কয়েকটা নি:শ্বাস’ মাত্র যার সম্বলদেখতে পায় ‘গোলাপের ইতস্তত প্রমত্ততা’ নয়, ‘ওলিভকুঞ্জের ঘনঘটা করা রাত্রে’ চেট্টির বুকে জমা রক্ত নয়, বুদ্বুদের ‘চলন্ত নিদ্রা’ বা স্কাঁরোর এপিটাফও নয়। মৃত্যুর পূর্বক্ষণে প্রাপ্ত মনিকের জারজ পুত্রের সংবাদে বিলাস দেখতে পায় কেয়ামত, এক জাজ্জ্বল্যমান ‘মহাপ্রলয়’।
তিন.
গোলাপ সুন্দরী (১৯৮২) উপন্যাস না বড় গল্প, সেই তর্কে আমাদের কাজ নেই। স্বদেশী যুগের উচ্চশিক্ষিত দুজন আধুনিক নর-নারীর এই কাহিনিতে কাহিনির অতিরিক্ত, কাহিনির চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যে কাব্য সেটাই মনে রাখা বাঞ্ছনীয়। ‘কাব্য’ বলতে কাব্যই বোঝাচ্ছি, ‘কবিত্বের মাধুর্য’ (সুনীল) নয়, কাব্যিকতা নয়। ‘কবিত্ব’, ‘কাব্যিকতা’ বাংলা কথাসাহিত্যে প্রচুর; গল্প-নির্মাণের কৌশল, কিংবা টেকনিকের, মানদন্ডে কমলকুমারের চাইতে কুশলী ও অধিকতর কীর্তিমান কথাশিল্পী বাংলা সাহিত্যে বিদ্যমান। কিন্তু ‘কাব্য’ রচনার সংকল্প, এবং শব্দযোগে চিত্রকর্ম নির্মাণের ইচ্ছায়, ‘কথা-সাহিত্য’ অবলম্বনের আর কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। চিত্রকলা-সম্বলিত ‘কাব্য’ হওয়ার কারণেই কমলকুমার পড়তে সময় লাগে, লাগতে বাধ্য।
‘গোলাপ সুন্দরী’র প্রথম অনুচ্ছেদই কত কিছু ঢুকে পড়েছে, আমরা দেখেছি। প্রথম আড়াই পৃষ্ঠাই ঐ ‘বুদ্ধুদে’র নিয়ন্ত্রণে। তার মানে সেসব বিষয়কে কমলকুমার, কথার চিত্রকর, তাঁর উপন্যাসে প্রধান ব্যাপার হিশেবে দেখান বা উপস্থাপন করেন (অনেকটা জেমস জয়েসের মত), তা অন্য কথাশিল্পীর কাছে গৌণ বিষয় রূপেও বিবেচিত হবে না। চিত্তহারী গল্প নয়, বরং বিশুদ্ধ কবি ও সুদক্ষ চিত্রকরের বিরলদৃষ্ট সম্মিলনে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তুর অদৃষ্টপূর্ব রূপান্তর-সাধনকেই কমলকুমার মনে করেন “কাব্য”।
‘গোলাপ সুন্দরী’তে, সে কারণে, চরিত্রের বিকাশ নেই, মূল ঘটনা বা গল্পটিও বেশ প্রচ্ছন্ন; কাব্যের অভিঘাত, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু বা বিষয়ের ভেতর সম্বন্ধ-কল্পনার বিরামহীন ড্রামা, এবং সবকিছুর উপর দিয়ে উৎপ্রেক্ষার ঝড় বইয়ে দেয়ার দুর্মর সংকল্প, এই বইতে যেমন তেমনি অন্যত্রও, সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা পড়ি, ‘দু:সহ ঝটিতি আরবীটান’ (পৃ.৮৩); মাডগার্ডের ধূলায় ‘শিশুওষ্ঠের অজ¯্র এলেবেলে স্পন্দনে’র মত রেখাচিত্র, যা ‘গণিতের সংখ্যা’র মত নৈরাত্মক, ব্যঞ্জনাহীন এবং যা ধূলায় আঁকা ‘রেখাচিত্র’হয়ত বা ‘মানসিক অধৈর্য্য’ের প্রকাশ, অথবা বালোচিত ‘খুসীর ব্যক্তিগত অনুভবে’র দ্যোতক; যা দৃষ্টির ক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও ‘স্বকীয়তা’র অভাবে ‘আত্মিক’ হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ বালকের পিছনে যে রেখাচিত্রগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো যে কিছু হয় নি, তা ধূলার কারণে নয়, কেননা ধৈর্যশীল অভিনিবেশ ও স্বকীয় দৃষ্টির গুণে তুচ্ছ বস্তুও আর্টে উন্নীত হতে পারে। কিন্তু ধৈর্যহীনের হাতে আর্ট সম্ভবে না, কারণ তার মধ্যে ‘ক্ষুব্ধ বিরক্তি আকাশ হইয়া আছে’ দেখা যায়।
‘সাবানজলের বুদ্বুদ’, নগেনের ভাই ভূষণের বউয়ের মৃত্যু, শবযাত্রা ও শেষকৃত্য, ‘ঘোর যামিনী’তে গোলাপী অপ্সরার অনাহূত আবির্ভাব ও সেই বর্ষণমুখর রাতে মনিক-বিলাসের, আধুনিক কালে রাধা ও কৃষ্ণের, অপ্রত্যাশিত মিলন, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে বিলাসের হাতে গোলাপ সুন্দরীর মৃত্যু ও তার পুত্রের সংবাদ-সম্বলিত ‘টাইপ করা’ চিঠি এগুলোই ‘গোলাপ সুন্দরী’র ঘটনা। সে সব ঘটনা বটে, কিন্তু গোলাপ সুন্দরীতে তো তত্ত্ব আছে এবং তা থাকতে বাধ্য, কারণ কমলকুমার মজুমদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতই, তাত্ত্বিক কথাশিল্পী। গোলাপ সুন্দরীর তত্ত্ব হলো ‘বুদ্বুদ’; সেকারণেই ‘বুদ্বুদে’র বর্ণনায় অনেক বাক্য ব্যয় করেছেন কমলকুমার।
‘বুদ্বুদ’ এই বইয়ের তত্ত্ব, কারণ জীবন ও মৃত্যুর নাটক প্রতিবিম্বিত হয়েছে, প্রতীকায়িত হয়েছে, এই ‘বুদ্বুদে’র মাধ্যমে। যেমন আমরা পড়ি, হল ঘরে রুমে ‘সাবানজলের বুদ্বুদ’ একটি ‘ঝাড়ের কলমে লাগিয়া নিশ্চিহ্ন’, এবং বুদ্বুদকে নিশ্চিহ্ন হতে দেখে চেট্টি, হাসপাতালের আরেক যক্ষারোগী, ‘খাটের বাজু’ ধরে তার উত্তেজিত ‘ব্যাধি-ক্লান্ত শরীর’টি নিয়ে ‘গীতব্যঞ্জক উদাত্ত কণ্ঠস্বরের উপরেই যেন বা ঝরে’ পড়ে, এবং তা দেখে অন্য রোগীদের ‘বাণবিদ্ধ কষ্টের ধ্বনি উৎসারিত’ হবার সঙ্গে সঙ্গে ‘একটি বর্ত্তমানকাল’ তার আত্মস্বরূপে প্রকাশিত হয় ঠিক সেই মুহূর্তে। একটি “বর্ত্তমানকাল” আত্মস্বরূপে প্রকাশিত হওয়ার অর্থযেমন কমলকুমার পরের বাক্যে বলছেন‘বাস্তবতা ঝটিতি অনিত্যতা কেন্দ্র করিয়া সকলের সমক্ষে অত্যন্ত সহজরূপ পরিগ্রহ করিল’ (পৃ. ৮৭)। কাব্যের পাশাপাশি একটি তত্ত্বও ব্যক্ত হওয়ায় তুচ্ছ বুদ্বুদকে আর তুচ্ছ জ্ঞান করার উপায় নেই। বুদ্বুদের প্রতীক দিয়ে কমলকুমার বলতে চান যে, প্রত্যহের সুখ-দু:খ প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঘটনাবহুল জীবন যত আকর্ষণীয়ই হোক তা ঐ বুদ্বুদের মতই অনিত্য, ক্ষণস্থায়ী; এবং বুদ্বুদের অচিরাৎ অদৃশ্য হওয়ার ঘটনায় ‘অত্যন্ত সহজরূপে’ প্রকাশিত হয়ে পড়ল ‘অনিত্য’ বাস্তব নিয়ে চেট্টির মত চৈতন্যহীন মানুষের লম্প-ঝম্প-উত্তেজনার অসারত্ব ।
কমলকুমার ‘মানুষকে’ মনে করেন বাক্য রচনাকারী জীব; বাক্য রচনার ক্ষমতার মধ্যে তিনি দেখেন মনুষ্যপ্রজাতির ‘মনুষ্যত্বে’র, অর্থাৎ মনুষ্যরূপে তার অর্জন বা কীর্তির, অন্যতম প্রকাশ। মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, অভিজ্ঞতা, কল্পনাশক্তি সবই থাকতে পারে যেমন আছে বিলাসের; কিন্তু বাক্যে প্রকাশিত না হলে তার মূল্য কমলকুমারের কাছে সামান্য। বিলাস কবিতা লিখতে ‘মনস্থ’ করে, তার বিদ্যা বুদ্ধিমত্তা কল্পনাশক্তিও যথেষ্ট, কিন্তু বিলাস কবিতা লেখেনা। বিলাস দিনপঞ্জি লেখে, কিন্তু কল্পনার ‘বাক্যরূপ’ নির্মাণে, অর্থাৎ কাব্যসৃষ্টিতে, বিলাসের ক্ষমতা অপ্রমাণিত। রঙ্গস্বামী ডাক্তারের ওষুধের গন্ধমুক্ত কামরাটিকে তার মনে হয় ‘বিল্বদলের মত শুদ্ধ’, মোহিতের মুখে ‘স্পোর্ট’ শব্দের অনুষঙ্গে তার মনে পড়ে শূন্যতা দিয়ে ক্রীড়ামগ্ন তুষারÑঅভিমানী যৌবনশালিনী ‘ব্রাহ্মণী হংস’; রঙ্গস্বামীর সামনে সে (‘ঠেকাপূর্ণ সামগ্রী’ নিয়ে) ঠিক সাঁওতাল রমণীদের মত ‘মুখে একটি হাত’ দিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে, ‘স্যানাটোরিয়ামের সাজগোছে’র সঙ্গে সে সাদৃশ্য খুঁজে পায় রঙ্গস্বামীর ‘সরলতা’র; রঙ্গস্বামীর ‘বিশ্বাস করো’ কথাটা ‘ভোরের হাওয়ার মত বিলাসের শীর্ণ মুখে’ এসে লাগে; হাসপাতালের ‘কালহত ঘরে’ শয্যাশয়ী ‘নিরাকার রোগীদের’ গুঞ্জনে সে ‘গিরিনদী ভূমিকার পূর্ব্বেকার স্তব্ধতা’ দেখতে পায়, যে ‘স্তব্ধতায় দশাসই উৎকণ্ঠিতযৌবনার কেশরাশির আঁধার’, যে-আঁধার ‘বাঁশরীর বিচিত্র অন্তরীক্ষে’ অস্তিত্বমান; উপরের সিঁড়ি থেকে নিচে ফেলা ‘নীল কাগজের পি-’কে তার মনে হয় ‘ঘুমন্ত পক্ষীশাবকের মত চুপ’। দিদি ওমি ও ভগ্নিপতি মোহিতের সঙ্গে গাড়িতে করে কটেজে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটি হরিণ দেখে মোহিত যখন ওমিকে বলে, ‘আ: কি সুন্দর হরিণটাবন্দুকটা ওমি’, তখন বিলাসের চোখে ভেসে ওঠে ‘লিনটেলের ফুলকাটা লাল নীল’ এবং বস্তুমনস্ক, ম্যাটেরিয়ালিস্টিক, মোহিতের এক নি:শ্বাসে বলে-ফেলা ‘সুন্দর’ ‘হরিণ’ ‘বন্দুক’ কথাগুলো পুনরায় ভাবতে গিয়ে:
বিলাসের মনে হইল ছেলেবেলার জ্বর উপশমে প্রথম মাগুর মাছের তেজপাতা জীরে মরিচ বাটা ঝোলের মধ্যে যেরূপ মুখচোরা লাজুক পৃথিবীর নিমন্ত্রণটি থাকিত, এখানেও মোহিতের উক্তির মধ্যে সেই বাহু বিস্তার করা স্বাগতম স্বাগতম ধ্বনিটি ছিল।
গোলাপ সুন্দরী [১৯৮২] ২০১১:৯১-৯২
কিংবা মোহিত যখন ওমি আর বিলাসকে বলে, হাসপাতালের মত নিরুত্তাপ জায়গায় তার ‘এক মুহূর্ত্ত’ও ভাল লাগছেনা, তাকে উন্মাদ করে তুলছে এই পরিবেশ, তখন বিলাস ‘মধ্যরাতে রমণীর চোখের’ অনুরূপ ‘করিডোরের সাদা একটানা দেওয়ালে’র দিকে দৃষ্টিপাত করে, মোহিতের কথাটি শুনে সচকিত, ‘আত্মস্থ’ হয়, এবং সেই নির্জীব, নিষ্প্রাণ, নিরুত্তাপ স্থানকেই তার মনে হয় তার অস্তিত্ব ও ‘সমস্ত অতীতে’র স্মৃতিচিহ্ন বিজড়িত একমাত্র বসবাসযোগ্য ‘বাড়ি’। পরক্ষণে, ‘এরূপ আশ্বস্থ মূহূর্তে’ :
সহসা বিলাস আপনার পকেটে হস্তপ্রদানের সঙ্গেই বেপথুমান, যে কি সে অনুভব করে? অস্ফুট নিবিড় ঘোর এক খস্খস্ কাগজের শব্দ; এ রৌদ্রকর্ম্মা শব্দ তাহাকে চকিত রোমাঞ্চিত করিয়াছিল। কাংড়া কলমের ‘অভিসারিকা’ চিত্র দর্শনে মানুষের যেরূপ একা বোধ হয়, ধৈবতের গাম্ভীর্যের রাজ্যে যেরূপ একাকী বোধ করে, সেইরূপ এই ক্ষেত্রে বিলাসকে পকেটস্থ এই খস্খস্ শব্দযাহা অন্ধকারকে নাম ধরিয়া ডাকেবড় একা করিয়াছিল। গোলাপ সুন্দরী [১৯৮২) ২০১১: ৮৪
বিলাসের অনুভূতিতে খাদ নেই; সে বোঝে পকেটে-রাখা কাগজের ‘খস্খস্ শব্দ’ কিভাবে ‘অন্ধকারকে নাম ধরে ডাকে’; নশ্বরতা, সংক্ষিপ্ত জীবন ও মৃত্যুর অমোঘতা সে কম দেখেনি, বিলাস তবু কবিতা লেখেনা। এখানেই বিলাসের ট্র্যাজেডি।
চার.
আমার হৃদয় হবে রাঙাজবা দেহ বিল্বদল
মোর অশ্রু দেবো মা’র চরণে সেই তো গঙ্গাজল
কাজী নজরুল ইসলাম
বিলাসের ট্র্যাজেডি হল, তার স্বতন্ত্র কল্পনাশক্তির ক্ষমতা, বোধ-অনুভবের শক্তি, সূক্ষ্মতা সবই আছে কিন্তু তা গোলাপ-বিলাস কল্পনা-বিলাসে সীমাবদ্ধ, কিংবা মনিক চ্যাটার্জ্জির কম্পমান জঙ্খা ও ‘সুরম্য উরুযুগে’র ধ্যানে নি:শেষিত। বিলাসের ‘কল্পনা’শক্তি, লিবিডোর মত প্রাকৃতিক স্তর অতিক্রম করে, শিল্পিত নির্মাণে রূপান্তরিত হয় নি। বিলাসের দিনপঞ্জিতে গোলাপ ফোটানোর কথা আছে, কিন্তু তা প্রাকৃতিক গোলাপ, তা কাব্য হয়ে বাক্যে ফোটে না। এই ব্যর্থতার কারণে বিলাস কষ্ট পায়, সাঁওতালী গানের ‘পরান ময়না’ তাকেও দ্রবীভূত করে, তার মৃত্যুভীতিও অন্যদের চেয়ে বেশি, কিন্তু সেচন্দ্রমাধব বাবুর বিবেচনায়সত্যিকার ‘দু:খ থেকে বঞ্চিত’: সত্যিকার দু:খ কি সে জানতে পারে নি। অন্যদিকে চন্দ্রমাধবের ‘জগজ্জননী তারা’য় প্রগাঢ় বিশ্বাস এবং সেই ‘জগজ্জননী’র জন্যে চন্দ্রমাধবের “মা মা” কাতর উক্তিতে বিলাস বিহ্বল হয়, কিন্তু রামকৃষ্ণ-কথিত ‘অহৈতুক ভক্তি’ আর বিশ্বাসে আস্থা রেখে ‘শিশু’ হবার সাহস বিলাসের নেই।
বিলাসের সুযোগ ছিল ‘শিশু’ হবারযক্ষায় তার মৃত্যু আসন্ন, এবং তা প্রতিরোধের অতীতকিন্তু বিলাস ইংরেজি-পড়া শিক্ষিত আধুনিক যুবক। শিক্ষিত বলে সে, স্বদেশী যুগের অন্য আধুনিকদের মত (যেমন ‘কলিকাতার রাস্তায় রাইফেলের গুলিতে’ নিহত রুক্ষিèণীকুুমার), নিজেকে ‘সরলতা’র, ‘অহৈতুক ভক্তি’র, অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তুচ্ছ জীবন-ধারণের ‘অনর্থ কূটপদ্ধতি’ এবং মূঢ় ‘ষড়যন্ত্রে’ লিপ্ত। এই মূঢ় জীবনাসক্তি বিলাসের ট্র্যাজেডির দ্বিতীয় কারণ। বিলাসের ট্র্যাজেডির সঙ্গে অতএব যক্ষারোগ বা যক্ষারোগে মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক নেই। যক্ষাব্যাধির সঙ্গে নি:সম্পর্কিত এই ট্র্যাজেডি বিলাসের একার নয়, সকল চৈতন্যবান ব্যক্তির। শুধু ‘আধুনিক’ ব্যক্তির নয়, এটি আধুনিকতারও ট্র্যাজেডি।
(শিকাগো, ২০১৪)
উৎসনির্দেশ
কমলকুমার মজুমদার ([২০০২] ২০১১)। উপন্যাস সমগ্র। কলিকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স।
কমলকুমার মজুমদার (১৯৯০)। গল্পসমগ্র। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-সম্পাদিত। কলিকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স।
দয়াময়ী মজুমদার ([২০১০] ২০১২)। আমার স্বামী কমলকুমার। কৃষ্ণনগর, নদীয়া: আদম।
তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ([১৮৭৪] ১৯৫৭)। স্বর্ণলতা। কলিকাতা।
ঝধসঁবধষ ঔড়যহংড়হ (১৯৭৭). ঝবষবপঃবফ চড়বঃৎু ধহফ চৎড়ংব, বফরঃবফ নু ঋৎধহশ ইৎধফু ধহফ ড. ক. ডরসংধঃঃ. ইবৎশবষবু ধহফ খড়ং অহমবষবং: টহরাবৎংরঃু ড়ভ ঈধষরভড়ৎহরধ চৎবংং.
ঐবৎনবৎঃ এৎরবৎংড়হ (১৯২১). গবঃধঢ়যুংরপধষ খুৎরপং ্ চড়বসং. ঙীভড়ৎফ: ঈষধৎবফড়হ চৎবংং.
গধষপড়ষস ইৎধফনঁৎু ধহফ উধারফ চধষসবৎ (১৯৭১). গবঃধঢ়যুংরপধষ চড়বঃৎু. ইষড়ড়সরহমঃড়হ: ওহফরধহধ টহরাবৎংরঃু চৎবংং.
ঞ. ঝ. ঊষরড়ঃ (১৯৩২). “ঞযব গবঃধঢ়যুংরপধষ চড়বঃং” রহ ঝবষবপঃবফ ঊংংধুং, ১৯১৭-১৯৩২. ঘবি ণড়ৎশ: ঐধৎপড়ঁৎঃ, ইৎধপব ্ ঈড়সঢ়ধহু.
ড. সালাহউদ্দীন আইয়ুব
সাহিত্য সমালোচক, গবেষক ও শিকাগো স্টেট ইউনির্ভাসিটির, (ইউএসএ) ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের অধ্যাপক