সুরেন্দ্র প্রকাশ
ভাষান্তর: জ্যোতির্ময় নন্দী
[সুরেন্দ্র প্রকাশ (সুরেন্দ্র ওবেরয় (১৯৩০-২০০২) তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের, বর্তমান পাকিস্তানের লায়ালপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ভারত বিভাজনের পর তাঁর পরিবার দিল্লিতে অভিবাসন করে। সুরেন্দ্র প্রকাশের শিক্ষা এতে ব্যাহত হয় এবং তিনি হাই স্কুল থেকে লেখাপড়া ছেড়ে দেন। দিল্লিতে তাঁর সাথে কয়েকজন কবি ও লেখকের পরিচয় হয়, এবং এতে তিনি নিজেও একজন লেখক হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত হন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে তিনি স্ক্রিপ্ট লেখকের চাকরি করেন, এবং পরে মুম্বাইয়ে চলে গিয়ে পুরোদস্তুর চিত্রনাট্য লেখক হয়ে যান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব এবং পেশাগত ব্যস্ততা সত্ত্বেও একজন লেখক হিসেবে তিনি যথেষ্ট প্রতিভা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দেন এবং ক্রমশ ‘জাদিদিয়ত’ বা আধুনিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। ১৯৬৮-তে তাঁর উপন্যাসিকা ‘দুসরে আদমি কা ড্রয়িং রুম’ (অন্য লোকের ড্রয়িং রুম) প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উর্দু সাহিত্যের নতুন ধারার লেখকদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান।
তাঁর প্রজন্মের আরো অনেক লেখকের মতো সুরেন্দ্র প্রকাশও একজন প্রগতিবাদী হিসেবেই লেখালেখি শুরু করেছিলেন, কিন্তু খুব শিগগিরই এ-ব্যাপারে তাঁর মোহভঙ্গ ঘটে। প্রগতিবাদী লেখালেখির দৃশ্যপট তাঁকে তাঁর ভাষায় ‘ভীষণ একঘেয়েমি’ আক্রান্ত করে তোলে, এবং নিজের মানসিক অস্থিরতার কারণেও তিনি কিছুটা নাড়া খেয়ে যান। প্রকাশ ভাবলেন যে, কাহিনিতে বর্তমান সময়ে বেঁচে থাকা মানুষের সত্যিকারের মানসিক অবস্থার প্রতিভাস ঘটাতে হবে, এবং লেখক প্রকৃত সত্য ও পাঠকের মাঝখানে কখনোই তাঁর কোনো পক্ষপাতকে ঠেলে ঢুকিয়ে দেবেন না। ফলত, তাঁর গল্পগুলো আসলে আত্মানুসন্ধানের প্রয়াস, যেগুলোতে লেখকের সঙ্গে পাঠকও অংশগ্রহণ করেন এবং তা থেকে শেষপর্যন্ত যে-ফলাফলই আসুক-না কেন, দুজনেই তা সমান ভাগে ভাগ করে নেন। প্রতিশ্রুত অভিজ্ঞতার সত্য প্রতিভাস তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে তিনি এ-প্রভাব সৃষ্টি করেন, যাতে সেটা তার নগ্ন বিভীষিকা, অভাবনীয় সৌন্দর্য আর আনকোরা নতুন চেহারা নিয়ে প্রকাশিত হয়। ‘বিজুকা’ (কাকতাড়ুয়া) গল্পটিতে তাঁর এই বিশিষ্ট বর্ণনাভঙ্গীটির পরিচয় পাওয়া যায়।
প্রেমচন্দের* গল্পের হরি বুড়ো হয়ে গেছে। এত বুড়ো যে, তার ভুরু এবং চোখের পাতা পর্যন্ত পেকে সাদা হয়ে গেছে, পিঠ কুঁজো হয়ে গেছে, হাতের রুক্ষ, খসখসে চামড়ায় শিরাগুলো ফুটে উঠেছে একটা জটিল নকশা নিয়ে।
ইতোমধ্যে তার দুটো ছেলে জন্মেছিল। কিন্তু তারা বেশিদিন বাঁচে নি। একজন গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে ডুবে মরেছে। অন্যজন মরেছে পুলিশের সাথে এনকাউন্টারে। পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারের বিস্তাারিত বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন নিশ্চয় নেই। যার ভেতরে শান্তি আর স্থিরতা আছে, কিন্তু বাস করে এক অশান্ত, অস্থির সময়ে, পুলিশের সঙ্গে তার এনকাউন্টার তো অনিবার্য।
হরির ছেলেরা তাদের বউ-ছেলেপিলেদের রেখে গিয়েছিলো। ছেলেপিলের মোট সংখ্যা পাঁচ– দুটো ডুবে মরা পুত্রটির, তিনটে পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে নিহত জনের। এদের সবার ভরণপোষণের ভার তখন হরির ওপর এসে পড়েছে। তার জরতি দেহে রক্তধারা আবার নতুন জীবনবেগে ছুটতে শুরু করেছে।
লাঙলে হাতের মুঠো আলগা করে হরি বুড়ো দাঁড়ালো এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর আবার তার মুঠো চেপে বসলো লাঙলে। সে তার বলদজোড়াকে হাঁক দিলো, এবং মাটির বুক চিরে লাঙল এগাতে লাগলো সামনের দিকে।
সেদিন ভোরে সূর্য তখনো উঁকি দেয় নি। আকাশে শুধু একটা গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। ন্যাংটো পাঁচটা বাচ্চা হরিদের উঠোনে কুয়োয় স্নান করছিলো। হরির বড় ছেলের বউ কুয়ো থেকে জল তুলে বাচ্চাগুলোর মাথায় ঢালছিলো পালা করে, আর তারা মনের আনন্দে জল ছিটোচ্ছিলো। ছোট ছেলের বউ বিরাট বিরাট রুটি বানিয়ে সাবধানে রাখছিলো একটা চাঙারিতে।
ঝোপড়ির ভেতরে ইতোমধ্যেই হরির কাপড়চোপড় পরা শেষ, এবং তখন সে পাগড়িটা মাথায় বেঁধে নিচ্ছিলো। সেটা সেরে সে ঘরের কুলুঙ্গিতে রাখা একটা আয়নায় নিজের চেহারাটা একবার দেখে নিলো। বলিরেখায় আকীর্ণ একটা মুখ আয়না থেকে তার দিকে তাকালো। এর পর সে পাশে রাখা হনুমানজির ছবির সামনে গিয়ে মাথা নুইয়ে, চোখ বুঁজে, হাত জোড় করে দাঁড়ালো। উঠোনে বেরিয়ে এসে সে হেঁকে বললো, “সবাই তৈরি?”
“হ্যাঁ, বাপু!” ওরা সমস্বরে জবাব দিলো। তার পুত্রবধূরা শাড়ির প্রান্ত টেনেটুনে ঠিক করে নিচ্ছিলো, ক্রমশ আরো দ্রুত চলতে শুরু করলো তাদের হাত। হরি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলো যে, কেউই এখনো পুরোপুরি তৈরি হয় নি। সে ভাবলো, আমরা মিথ্যে ছাড়া বাঁচতে পারি না। আমাদের বেঁচে থাকার জন্যে এসব মিথ্যের এতো প্রয়োজন! ভগবান আমাদেরকে এই ‘মিথ্যে’টা উপহার না দিলে আমরা তো বাঁচতেই পারতাম না! সবকিছু শুরু হয় একটা মিথ্যের মধ্যে দিয়ে। মিথ্যেটাকে সত্যি বলে চালানোর চেষ্টাটাই তো মানুষকে বছরের পর বছর বাঁচিয়ে রাখে।
হরির নাতি-নাতনি আর পুত্রবধূরা এক্ষুণি যে-মিথ্যেটা উচ্চারণ করেছে সেটাকে সত্যি বলে প্রমাণ করার কাজে লেগে পড়েছে। ততক্ষণে হরি ব্যস্ত হয়ে পড়লো ফসল কাটতে যেসব জিনিস দরকার সেগুলো গুছিয়ে নিতে। কাজটা সারা হতে হতে বাকিরা সবাই তখন, অবশ্যই, প্রস্তুত। সূর্য তখন সারা বাড়ি ঘিরে এক জাদুকরি আভা ছড়াচ্ছে। তাদের সবাইকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন উৎসবে যোগ দিতে যাচ্ছে। আজকে তারা তাদের জমির ফসল কাটবে। উৎসাহ-উদ্দীপনায় ভরপুর তারা অধীর হয়ে উঠেছিলো কখন তাদের মাঠে, মৃদুমন্দ হাওয়ায় দুলতে থাকা সবুজ, সোনালি মাঠে গিয়ে পৌঁছবে।
সময়টা আসলেই ভালো, হরি ভাবলো, লাল-সাদা ডোরাকাটা গামছাটা আরো জুত করে কাঁধে চাপিয়ে নিতে নিতে। এখন ওভারসিয়ারের চোখ রাঙানি সইতে হচ্ছে না, চাল-ডালের দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না, আংরেজের অত্যাচার আর জমিদারের লোভের শিকারও হতে হচ্ছে না।
তাদের চোখের সামনে সোনালি শস্যের ছবি ভেসে উঠে অন্তর খুশিতে ফেটে পড়লো যেন আতশবাজির মতো।
তার হাত ধরে টেনে বড় নাতিটা বললো, “চলো না, বাপু!” বাকি নাতি-নাতনিরা তার পা আঁকড়ে ধরে ঝুলতে লাগলো। নাতনিদের মধ্যে বড়টা বাড়ির দরজা বন্ধ করলো। ছোট নাতনিটা মাথায় তুলে নিলো রুটির চাঙারিটা। বীর বজরং বলীর নাম উচ্চারণ করে তারা সবাই দল বেঁধে রাস্তাায় নাামলো। পুরো গাঁ ততক্ষণে কর্মব্যস্তাতায় সরগরম। লোকজনকে দেখা যাচ্ছে ছোট-বড় দল বেঁধে ব্যস্তাসমস্তাভাবে তাদের নিজ নিজ ক্ষেতের দিকে এগিয়ে যেতে। আবার কেউ কেউ অলস পায়ে ফিরে আসছে গাঁয়ের দিকে।
আজকের দিনটা ছিলো গতকালকের দিনের চেয়ে কীভাবে যেন আলাদা। অথবা হয়তো হরিরই ওরকমটা মনে হচ্ছিলো।
সে মুখ ঘুরিয়ে তার পেছন পেছন আসতে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকালো। চাষাভুষোর ছেলেমেয়েদেরকে দেখতে আর কেমন হবে! কালো, রোগা চিমসে, মনে হয় যেন একটা জিপ গাড়ির শব্দ শুনলেও একছুট্টে দৌড়ে পালাবে। এমনকি ঋতু পরিবর্তনও যেন তাদেরকে শঙ্কিত করে তোলে। তার পুত্রবধূরাও আর পাঁচটা বিধবা কৃষকবধূর চেয়ে আলাদা রকমের কিছু নয়। তাদের শাড়ির ভাঁজের মধ্যে থেকে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকা জঘন্য উকুনের মতো তাদের মুখগুলো ঘোমটায় ঢাকা।
হরি মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁটছিলো। দূর থেকে তাকে আর তার পরিবারের সদস্যদেরকে দেখাচ্ছিলো যেন শুকনো ঘাসের মধ্যে দিয়ে গুটি গুটি চলতে থাকা নানা বিচিত্র বর্ণের পোকা।
গলিপথের শেষ বাড়িটা ছাড়িয়ে যাওয়ার পর বিশাল, উন্মুক্ত মাঠ। কাছেই পানচাক্কিটি অচল দাঁড়িয়ে। একটা নিম গাছের নিচে একটা কুকুর শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। গরুমোষগুলো ভরা পেটে তাদের ছাউনির নিচে বিশ্রাম নিচ্ছে। দূরে ফসলের ক্ষেতগুলোকে দেখা যাচ্ছে বিরাট সোনালি বিস্তাারের মতো।
হরি বুড়োর ক্ষেত এসব ক্ষেত ছাড়িয়ে তারপর খালের ওপারে। ওটা অলসভাবে গা এলিয়ে দিয়ে তার জন্যেই অপেক্ষা করছিলো। হরির জমি যেখানটায় শেষ, তারপর থেকে শুরু এক বিশাল পতিত, রৌদ্রদগ্ধ জমি, যার কোথাও তিলমাত্র সবুজের চিহ্ন নেই। অকর্ষিত, ঝুরঝুরে মাটির ওই জমিতে হাঁটতে গেলে পা দেবে যায়। মাটি সেখানে সহজেই ধুলো হয়ে যায়, ঠিক যেভাবে তার ছেলেদেরকে চিতায় পোড়ানোর সময় তাদের হাড়গুলো ছাই হয়ে গিয়েছিলো; সামান্যতম স্পর্শে যে-ছাই ছড়িয়ে পড়ছিলো বালুর মতো।
পোড়োজমিটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিলো তার জমির দিকে। হরি লক্ষ্য করলো যে, গত পঞ্চাশ বছরে জমিটা গজ দুয়েক এগিয়ে এসেছে। তার নাতিরা বড় হয়ে ওঠার আগেই তার জমিটা ওই পোড়ো জমির গর্ভে ঢুকে পড়ুক, এটা হরি চাইছিলো না। ততদিনে সেও ধুলোতে পরিণত হবে, ঠিক এরকমই কোনো পোড়ো জমির একটা অংশের মতো।
সামনের পথ মনে হচ্ছিলো অন্তহীন, কিন্তু হরি আর তার পরিবারের সদস্যদের খালি পাগুলো সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো অবিচলভাবে…
সূর্য তখন পূর্ব দিগন্ত থেকে উঁকি মারছিলো। দীর্ঘ পথ চলার কারণে তাদের পাগুলো ধুলোয় ঢেকে গিয়েছিলো। আশেপাশের জমিগুলোতে ফসল কাটতে ব্যস্ত চাষিরা একপলক কাজ থামিয়ে তাকে সম্ভাষণ জানাচ্ছিলো, “রাম-রাম!” পরক্ষণেই তারা আবার নতুন উদ্যমে কাজে লেগে পড়ছিলো; ছন্দোবদ্ধভাবে চলতে থাকা তাদের কাস্তের নিচে লুটিয়ে পড়ছিলো ফসলের সোনালি গুচ্ছগুলো।
হরিরা একে একে খাল পেরিয়ে গেলো। খালটাতে জলের কোনো চিহ্নই ছিলো না, এমনকি জলের একটু বিভ্রম সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট পরিমাণেও না। এ-খাল দিয়ে একদা যে-জলধারা প্রবাহিত হয়েছে, খালের তলার শুকনো বালিমাটিতে তা অদ্ভুত সব ছাপ সৃষ্টি করে রেখে গেছে।
সোনালি ক্ষেতটা এবার হরিদের চোখে পড়লো আর তাদের হৃদয় যেন আলোতে ভরে গেলো। ফসলটা একবার কাটা হয়ে গেলে তাদের উঠোন খড়ে এবং ঝুপড়িটা শস্যে ভরে যাবে। চারপাইয়ে বসে বসে ভাত খেতে তখন কী যে মজা লাগবে!
চলতে চলতে হঠাৎ হরি থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। থেমে গেলো তার পেছনে আসতে থাকা বাকিরাও। হরি তার ক্ষেতটার দিকে তাকালো বিভীষিকা ভরা দৃষ্টিতে। বাকিরা প্রথমে হরির দিকে তাকিয়ে আঁচ করার চেষ্টা করলো ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছে। হরি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো বজ্রাহতের মতো। হঠাৎ সে লাফ দিয়ে এগোতে এগোতে চেঁচিয়ে উঠলো, “আব্বে, কে রে —?” ঠিক তখনই তারা হাওয়ায় দুলতে থাকা ধানগাছগুলোর মাঝখানে একটা নড়াচড়া লক্ষ্য করলো। হরির পেছন পেছন ওরা সবাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। হরি আবার হাঁক দিলো, “আব্বে, কে রে? আমার ক্ষেতে ওটা কে? সাড়া দিচ্ছিস না কেন? কে আমার ফসল কাটছিস?”
ওদিক থেকে কোনো জবাব পাওয়া গেলো না। ওরা এখন ক্ষেতে প্রায় নেমেই পড়েছে এবং কাস্তে দিয়ে ফসল কাটার ঘস ঘস আওয়াজ পরিষ্কার তাদের কানে আসছে। একটু ঘাবড়ে গিয়ে ওরা আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। হাতের কাস্তেটার ডাঁটি শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে হরি হুঙ্কার দিলো, “কথা বল্, বেজন্মার বাচ্চা!”
একটা ভুতুড়ে মূর্তিকে দেখা গেলো মাঠের আরেক প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতে। মনে হলো, মূর্তিটা ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর তারপরই ওরা শুনলো, ওটা কথা বলছে। হাতের কাঁচি নাচিয়ে সে বললো, “এটা আমি, হরি কাকা — আমি, বিজুকা, কাকতাড়ুয়া!”
আতঙ্কে ওদের মুখ দিয়ে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো। ওদের চেহারা হয়ে পড়লো রক্তহীন, ফ্যাকাসে। হরির ফাটা ঠোঁট দুটো সাদা হয়ে গেলো। ওরা তখন স্তম্ভিত, বাক্যহারা। কতক্ষণ ধরে? একমুহূর্ত, এক শতাব্দী, একযুগ? কে জানে! চারপাশের সবকিছু ওদের মগজ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলো। রাগে কাঁপতে থাকা হরির ঘড়ঘড়ে কণ্ঠস্বর তাদেরকে ঝাঁকি দিয়ে ফিরিয়ে আনলো বর্তমানে।
“তুই— বিজুকা — তুই! আমিই তোকে খড়কুটো দিয়ে বানিয়েছি আমার ফসলের ওপর নজর রাখতে। আমিই তোকে এক ইংরেজ শিকারির খাকি পোশাকে সাজিয়েছি, যাকে আমার বাবা সাহায্য করেছিলো। ওই শিকারি পোশাকটা রেখে গিয়েছিলো তার কদরদানের নজির হিসেবে। আমি তোর মুখ বানিয়েছি আমাদের বাড়ি থেকে ফেলে দেয়া একটা মাটির হাঁড়ি দিয়ে। তোর মাথায়ও আমি একটা ইংলিশ টুপি পরিয়েছি। আর এখন, একটা প্রাণহীন পুতুল, তুই আমার ফসল কেটে নেয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছিস?”
বলতে বলতে হরি সামনে এগোচ্ছিলো। কাকতাড়ুয়াটি হরি যা বলছে তাতে আদৌ বিচলিত না হয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। আরো খানিকটা কাছে এসে ওরা দেখতে পেলো যে, মাঠের ফসলের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ইতোমধ্যেই কেটে ফেলা হয়েছে। আর ওখানেই হাতে কাস্তে, মুখে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো কাকতাড়ুয়াটা। ওরা ভেবে পাচ্ছিলো না, কাস্তেটা ও কোত্থেকে পেলো। এতগুলো মাস ধরে ওটা কি তাদের নজরদারির মধ্যেই ছিলো না, ওখানটায় দাঁড়িয়ে আছে শূন্য হাতে, প্রাণহীন? আর আজকের দিনটাতেই ওটা কীভাবে মানুষ হয়ে যেতে পারলো? একেবারে রক্তমাংসের মানুষ, তাদের থেকে আলাদা-কিছুই না!
ওখানে ওভাবে ওটার দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটা দেখে হরির মাথা ঘুরে উঠলো। সে সামনে লাফিয়ে গিয়ে কাকতাড়ুয়াটাকে একটা প্রচ- ধাক্কা দিলো। এতে কিন্তু ওটা একটুও টললো না। কিন্তু ধাক্কাটার বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় হরি নিজেই মাটিতে পড়ে গেলো। আর্তনাদ করে উঠে হরির সঙ্গীরা সবাই তার দিকে ছুটে গেলো। এক হাতে পিঠ চেপে ধরে সে তখন উঠে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো। ওরা তাকে উঠতে সাহায্য করলো। ভয়ার্ত চোখে কাকতাড়ুয়াটার দিকে তাকিয়ে সে বললো, “তা হলে তুই এখন আমার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গেছিস, কাকতাড়ুয়া! অথচ আমি নিজের হাতে তোকে বানিয়েছি আমার ফসল পাহারা দেয়ার জন্যে!”
মুখের সেই সার্বক্ষণিক হাসিটি ধরে রেখে কাকতাড়ুয়া বললো, “মন খারাপ করার কিছু নেই, হরি কাকা। আমি শুধু ফসলের আমার ভাগটাই নিচ্ছি– চার ভাগের এক ভাগ, ব্যস্ এটুকুই।”
“কেন নিচ্ছিস? তুই কে বেটা? ফসলের ভাগে তোর অধিকারটা আসেই-বা কোত্থেকে?”
“ফসলের ভাগে আমার অধিকার অবশ্যই আছে, হরি কাকা। কারণ আমি আছি। আমার অস্তিত্ব আছে। এবং আমিই ক্ষেতটার ওপর নজর রাখি।”
আমিই তোকে ওখানে দাঁড় করিয়েছি, তোর প্রাণ নেই এ-কথা জেনে তবেই। প্রাণহীন একটা জিনিসের কী করে কোনো অধিকার থাকতে পারে? তা ছাড়া, ওটা তুই কোত্থেকে পেলি?” কাস্তেটার দিকে আঙুল তুলে হরি জিজ্ঞেস করলো।
কাকতাড়ুয়াটা হো হো করে হেসে উঠলো, “হরি কাকা, তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছো, অথচ তবুও জোর দিয়ে বলছো আমার প্রাণ নেই!”
“কিন্তু কাস্তেটা তুই পেলি কোত্থেকে? আর প্রাণ? তোকে আমি যখন বানিয়েছিলাম, তখন তো এ-দুটোর একটাও তোর ছিলো না।”
“মানে, ওটা নিজে-নিজেই হয়েছে। যেদিন তুমি আমার কাঠামো বানানোর জন্যে বাঁশটা চিরলে, আমাকে একটা ইংরেজ শিকারির ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকটা পরালে, একটা ভাঙা হাঁড়িতে আমার চোখ, নাক, মুখ এঁকে দিলে– এমনকি সেদিনও এসবকিছুর মধ্যে জীবন টগবগ করে ফুটছিলো। যখন তুমি সবগুলো জিনিস একত্তর করে আমাকে বানালে, আমি প্রাণ পেয়ে গেলাম। ওদিকে ফসলগুলো পেকে উঠছিলো, আর আমি এখানটায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় পার করছিলাম। তখন ধীরে ধীরে একটা কাস্তে আমার ভেতরে আকার নিতে শুরু করলো। ফসল যখন পুরোপুরি পেকে কাটার জন্যে প্রস্তুত, ততদিনে কাস্তেটাও পুরো তৈরি হয়ে গেছেÑ যেটা আমার হাতে দেখতে পাচ্ছো। তবে তুমি যে-বিশ্বাস আমার ওপর রেখেছো, তা আমি ভাঙি নি। আমি ধৈর্য ধরে আজকের এই দিনটার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। এখন তোমরা যখন ফসল কাটার জন্যে প্রস্তুত, আমিও তখন আমার ভাগটা কেটে নিচ্ছি। এত দোষেরটা কী হয়েছে?”
কাকতাড়–য়াটা একটা ধীর, বিচক্ষণ ভঙ্গীতে কথা বলছিলো। কথাগুলোর নিহিতার্থ সবাই পরিষ্কার বুঝতে পারছিলো সঙ্গে সঙ্গেই।
“কিন্তু এটা তো অসম্ভব– এটা আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র। আমি যতটুকু জানি, তোর প্রাণ নেই। ভাবিস না যে এটা করে তুই পার পেয়ে যাবি, বেটা চক্রান্তকারী! আমি গ্রাম পঞ্চায়েতে যাবো। কাস্তেটা নামিয়ে রাখ্! আমি তোকে ফসলের একটা ডাঁটিও নিতে দেবো না!” হরি চিৎকার করে বললো।
কাস্তেটা ছুড়ে ফেলে দিলো কাকতাড়ুয়া, হাসিটা তখনও তার মুখে লেগেই আছে। পঞ্চায়েতের বৈঠক বসলো গোলাবাড়িতে। সেদিনকার বৈঠকে পঞ্চায়েত একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয় ইতোমধ্যেই তাদের দাবি ব্যক্ত করেছে। সরপঞ্চ্ (পঞ্চায়েত-প্রধান) এবং অন্যান্য প্রবীণরা সবাই উপস্থিত। হরি তাদের মাঝখানে বসেছিলো তার নাতি-নাতনিদেরকে সাথে নিয়ে। তার ফ্যাকাশে মুখে গভীর উদ্বেগের ছাপ। তার পুত্রবধূরাও দাঁড়িয়ে ছিলো অন্যান্য মহিলার সঙ্গে। তারা সবাই অপেক্ষা করছিলো কাকতাড়ুয়ার জন্যে।
অবশেষে তারা কাকতাড়–য়াকে দেখতে পেলো দূরে, গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে, এবং অবশ্যই মুখে লেগে আছে সেই হাসি। সবাই চোখ তুলে ওদিকে তাকালো। তার চেহারা-সুরতে এমনকিছু ছিলো যা সম্মান পাওয়ার দাবি রাখে। ওটা গোলাবাড়ির চত্বরে এসে পৌঁছানোর পর সবাই উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। অজান্তেই, তারা তাদের মাথাও নোয়ালো। হরিকে ধন্দে ফেলে দিলো দৃশ্যটা। অস্বস্তিকর এ অনুভবটাকে সে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারলো না যে, গ্রামবাসীরা তাদের বিবেককে কাকতাড়ুয়ার কাছে বিকিয়ে যেতে দিচ্ছে এবং সম্ভবত গ্রাম পঞ্চায়েতও সেটাই করেছে। নিজেকে তার কেমন অসহায়, মরিয়া মনে হলো– জলে পাগলের মতো হাত-পা আছড়াতে থাকা ডুবন্ত মানুষের মতো।
সরপঞ্চ্ রায় ঘোষণা করলো। রায় অনুযায়ী হরি যখন তার ফসলের চারভাগের একভাগ কাকতাড়ুয়াকে দিতে রাজি হলো, তার মধ্যে যেন একটা ভূমিকম্প হয়ে গেলো। তারপর সে উঠে দাঁড়িয়ে তার নাতিদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো, “শোনো। সম্ভবত এটাই হতে যাচ্ছে আমার জীবৎকালের শেষ ফসল তোলা। তোমাদেরকে আমার উপদেশ এই যে, তোমাদের ফসল পাহারা দিতে কক্ষণো কাকতাড়ুয়া বসাবে না। আগামী বছর যখন মাঠে লাঙল দিয়ে বীজ বোনা হবে, বৃষ্টির মধু পেয়ে যখন নতুন অঙ্কুর গজাবে, তখন কাকতাড়ুয়ার বদলে আমাকেই একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ক্ষেতে দাঁড় করিয়ে দিয়ো। নিষ্ফলা পতিত চড়াটার কবলে চলে গিয়ে তোমাদের জমিটার মাটি ধুলোতে পরিণত হওয়ার আগপর্যন্ত আমিই তোমাদের ফসল দেখাশোনা করবো। কখনোই আমাকে ক্ষেত থেকে সরাবে না। তোমরা কাকতাড়ুয়া বানাও নি, তার প্রমাণ হিসেবে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখবে। কাকতাড়ুয়া কিন্তু প্রাণহীন নয়, যদিও তার তেমনটাই হওয়ার কথা। সে নিজে-নিজেই তার একটা জীবন অর্জন করে নেয়। এবং অস্তিত্বের এই সত্যটা নিজেই তার হাতে গজিয়ে দেয় একটা কাস্তে। ফসলের চারভাগের একভাগে তার অধিকার সম্পর্কে অবশ্য আমার কিছু বলার নেই।”
কথাগুলো বলে হরি ক্লান্ত পায়ে হেঁটে চললো তার ক্ষেতের দিকে। তার নাতি-নাতনিরাও চললো তার পেছন পেছন, এবং তাদের পেছনে আসছিলো তার দুই পুত্রবধূ। তারও পর এলো গ্রামবাসীরা, ব্যস্ততাহীন মন্থর পায়ে, নতমস্তকে।
তারা মাঠের কাছাকাছি এসে পড়েছে, এমন সময় হরি হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। দর্শকদের কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে তার নাতি-নাতনিরা সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলার কাজে লেগে গেলো। কাকতাড়ুয়াটা তার মাথার টুপি খুলে বুকের কাছে চেপে ধরে মাথা নোয়ালো সদ্যপ্রয়াতের উদ্দেশ্যে।
*এখানে আধুনিক হিন্দি-উর্দু গদ্য সাহিত্যের জনক হিসেবে পরিচিত মুন্সি প্রেমচন্দ-এর কথা বলা হয়েছে।
ভাষান্তর: জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি ও অনুবাদক