আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী : আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে কতো ঘটনা যা গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর, হৃদয়স্পর্শী। কতো হৃদয়বান মানুষ, স্থান জড়িয়ে আছে এই ইতিহাসের সাথে তার কতটুকুই বা আমরা জানি বা জানার চেষ্টা করি। তেমনি একটি বাড়ি যা মুক্তিযুদ্ধ চট্টগ্রামের এক অমোচনীয় নাম। বাড়ির মালিক যিনি মুক্তিযুদ্ধের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। নাম এনায়েত মাওলা।বাড়ির ঠিকানাটি তিনি তাঁর লেখা ” মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ছবি “চট্টগ্রামের কাকলী ” গ্রন্থে এইভাবে দিয়েছেন”আমার বাড়ি নাসিরাবাদে,ও আর নিজাম রোডের কাছাকাছি সিডিএ এভিনিউ এর পাশে। বাড়ির নাম “কাকলী ” বর্তমানে যেটি গঈঅ হিসেবে পরিচিত। আশেপাশে বাড়িঘর তেমন একটা গড়ে ওঠেনি। বড়ো রাস্তার কাজ ও শেষ হয়নি। সবে ইট বিছিয়ে বানানো হয়েছে।গোটা এলাকায় তখন মোটমাট পাঁচ কি ছয়টি বাড়ি।আটষট্টি সালের শেষ দিকে বাড়ির কাজ শেষ করে সপরিবারে এখানে চলে এসেছিলাম। চারদিক পুরোপুরি খোলা। বাড়ির কাজের জন্য আছে দুজন লোক- শহীদুল্লাহ আর মোখলেস। আরো একজন ছিল নাম তাহের। বাড়ির দোতলাটি ভাড়া দিয়েছিলাম একজন ব্যাংক ম্যানেজার এর কাছে। সেসময় তিনি ছিলেননা, সপরিবারে গিয়েছিলেনপাকিস্তানে। তার অনুপস্থিতিতে চৌকিদার হিসেবে থাকতো তার ব্যাংকের পিয়ন।নাম অলি। এই ছাড়া আমি আমার স্ত্রী, আমার ছোট দুটি ছেলেমেয়ে। সারাবাড়িতে মানুষ বলতে এই।” এই হলো এনায়েত মাওলার “কাকলী” যা পরবর্তীতে ইতিহাসের অংশ।
এনায়েত মাওলা অবাঙালি মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরী করতেন। রাজনৈতিক সচেতন তবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা নৌ কমান্ডো এসোসিয়েশন এর মহাসচিব অনিল বরণ রায় এর ভাষ্যমতে “মাওলা সাহেব একজন নামি শুটার ছিলেন। তার লাইসেন্স করা অস্ত্র ছিল। যার কারণে ১৯৭১ সালের ৯ থেকে ১৮ মার্চ অবধি তিনি এলাকার যুবকদের অস্ত্র চালনা ট্রেনিং দিয়েছিলেন। অনেক মহিলাও সেই ট্রেনিং নিয়েছিলেন যার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জহুর আহমদ চৌধুরীর স্ত্রী নুরুন্নাহার জহুর এর নাম উল্লেখযোগ্য। খবরের কাগজে তার ছবিও ছাপা হয়। বন্দরে নৌ অপারেশন এর যোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ছিল এই কাকলী। আর সেবক আবু তাহের ছিল সবার তত্ত্বাবধানকারি। ফারুকী আজমের নেতৃত্বে সেপ্টেম্বর অক্টোবর এর নৌ অপারেশন এ আমি ছিলাম। মনে পড়ে নুপ্রল হক বীর প্রতীক (চান্দগাও) আমির হোসেন বীর প্রতীক (নোয়াখালী) এস এম মাওলা বীর প্রতীক (রাজশাহী) এর কথা। কাকলী নৌ কমান্ডো ছাড়াও বি এল এফ সহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ছিল”।
যুবক ও মহিলাদের ট্রেনিং চলতো কুমিরায়। মহিলাদের তদারকি করতেন মাওলা সাহেবের স্ত্রী, ডা রবিউল হোসেন এর স্ত্রী ও আজিজুল হক।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অল্প কিছুদিন পর “কাকলী” একটি পুরো ক্যাম্পে পরিণত হয়েছিল। এনায়েত মাওলার কথায়” কাকলীর খরচ চালানো আমার জন্য বোঝা হয়ে গেল। বাঁধা বেতনের চাকরি করি। চলার মতো সামর্থ্য ও দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছিল।পরিবার পরের বাড়িতে থাকলেও হাতখরচের কিছু টাকা স্ত্রীর হাতে দিতেই হবে। এই অবস্থায় “কাকলী ” র জন্য হাজার পাচেক টাকা জোগাড় করা খুব সহজ কাজ ছিল না। ছেলেদের দলের অপারেশন এর জন্য ও মাঝেমধ্যে কিছু খরচপাতি দিতে হতো আর সেরকম কিছু হলে খরচ আরো বেড়ে যেত। “মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এর ট্রাস্টি ও সাহিত্য প্রকাশ এর স্বত্বাধিকারী মফিদুল হক এনায়েত মাওলা লিখিত কাকলী নিয়ে একটি বই ১৯৯৩ এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করেন। এই প্রসঙ্গে আলাপচারিতা তিনি বলেন “এনায়েত মাওলার বাড়ি কাকলী ইতিহাসের সাহসী ঠিকানা যা আমরা সংরক্ষণ করতে পারিনি।”
চট্টগ্রাম বন্দরের নৌ অপারেশন এ কাকলী এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জুলাইয়ের প্রথম দিকের এক সন্ধ্যায় দুজন লোক কাকলীতে উপস্থিত। এনায়েত মাওলার কথায়” এদের একজনের নাম আফসার উদ্দিন মোহাম্মদ আলী অন্যজনের নাম সম্ভবত সিদ্দিকুর রহমান। দুজনই ইঞ্জিনিয়ার। তবে বয়স বেশি নয়। ওই দুই তপ্রণ ইঞ্জিনিয়ার জানালেন যে নিকট ভবিষ্যতে জেটি এলাকায় একটি বড় ধরনের অপারেশন হবে। জেটি এলাকার একটি বড় ম্যাপের দরকার। যদি তৈরি অবস্থায় পাওয়া না যায় তাইলে আমাদের পাড়ার আজিজুর রহমান সাহেবকে দিয়ে একটি ম্যাপ এঁকে দেয়া যায় কিনা। গল্প গুজব শেষে তারা চলে গেল। তখন বেশ রাত। পরের দিন আফসার আর সিদ্দিক এসে বললো আগামীকাল রাতের মধ্যেই তারা তাদের ম্যাপ পেয়ে যাবে। রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালেই তারা সেটা নিয়ে চলে যাবে। তবে যাবার জন্য গাড়িটা লাগবে। কারণ ম্যাপ নিয়ে বাসে গেলে চেকিং এর সময় ধরা পরার ভয় আছে। আমি রাজি হলাম। আগস্ট মাস এসে গেলো। অনেকদিন পর একটা বড় অপারেশন হবে শুনে খুশিতে মনটা ভরে উঠলো।শুনলাম এমন একটা বড় অপারেশন যা নিয়ে দেশবিদেশে সাড়া পড়ে যাবে। ইচ্ছেমতো লুকিয়ে যেতে পারবেনা পাকিস্তানিরা,… যা হবে জেটিতে।”।
পাকিস্তান নৌ বাহিনীর গাজী সাবমেরিনের বাঙালি প্রাক্তন অফিসার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী নৌ কমান্ডোদের দলনেতা। অস্ত্র মাইন। ১৫ তারিখ তারা সফল অপারেশন করেছিল। ডুবিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানিদের জাহাজ, যাদের উল্লেখযোগ্য অংশ কাকলী তে থেকেছিল।সেপ্টেম্বর এর মাঝামাঝি নৌ কমান্ডোদের আরো একটি দল কাকলী তে অবস্থান নেয়। সেই অপারেশন আগেরটির মতো সফল হয়নি।কয়েকজন ধরা পড়ে যায়। পাকিস্তান বাহিনী কাকলী’র খবর পেয়ে বাড়ি ঘেরাও করে। ধরে নিয়ে যায় অনেককে।
অল্পকথায় কাকলী নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না।
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। কিন্ত কাকলী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাহসী ঠিকানা হয়ে থাকলো। এবার ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয়ের পর কাকলী বাড়ির মালিক মাওলা সাহেবের একটি তথ্যঃ” বসায় ফিরে আসতেই বেগম সাহেব বললেন কে একজন লোক এসে আমাকে খুঁজছিলো। আমাকে না পেয়ে একটি চিঠি লিখে গেছে আর বলে গেছে যে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যেন তাদের সাথে যোগাযোগ করি।
দেখলাম ইব্রাহিম নামে কে একজন আমার কাছে ইংরেজিতে লিখেছে জেনারেলকে নিয়ে মণি ভাই এসেছিল কিন্ত আমি না থাকায় দেখা হলো না। আমি যেন আনোয়ার সাহেবকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের সাথে যোগাযোগ করি।…. জেনারেল এর নামটা পরে শুনেছিলাম..তিনি জেনারেল উবান। ফজলুল হক মণির সাথে রাঙামাটি হয়ে এই জেনারেল সাহেব ভেতরে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শিখ।”(মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ছবি “চট্টগ্রামের কাকলী”)
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা আড়ম্বরে পালন করেছি।কিন্ত এই স্বাধীনতা অর্জনে অনেক মানুষ অনেক স্মৃতিময় স্থান আজ লোকান্তরিত / বিলীন।ইতিহাসের স্বার্থে এগুলো আমাদের তুলে আনতে হবে, তুলে আনতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধে তৃণমূল মানুষের অবদান।
আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী : গবেষক, শিশুসাহিত্যিক,
আহ্বায়ক মুক্তিযুদ্ধ একাডেমি ট্রাস্ট চট্টগ্রাম