আ.ম.ম.মামুন:
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক। বাংলাকাব্যাকাশে তখন রবীন্দ্রনাথ প্রখর রবির মতোই দেদীপ্যমান। তাঁর উজ্জ্বল কাব্যচ্ছটায় অন্যরা ম্লান, নিষ্প্রভ। ঠিক তখন বাংলাকাব্যাকাশে অত্যুজ্জ্বল ধুমকেতুর মতো উদয় হলেন একুশ বাইশ বছরের এক যুবক।
বাংলা কবিতায় রবীন্দ্র সম্মোহন থেকে বেরিয়ে আসাটা যখন অনেকটা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল ছিলো, তখন বাংলা কবিতায় দ্রোহ ও বিপ্লবের দামামা বাজিয়ে, নিশান উড়িয়ে, হৈ হৈ করে কাব্যমঞ্চে হাজির হলেন সেই যুবক। নাম কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলা কবিতায় চির বিদ্রোহের নাম কাজী নজরুল ইসলাম।
জন্ম: ২৫ মে ১৯৯৯, চুরুলিয়া গ্রাম, বর্ধমান জেলা,পশ্চিম বঙ্গ।
বাবা: ফকির আহমদ,মা: জাহিদা খাতুন
১৯০৮: বাবার মৃত্যু। নিদারুণ দারিদ্র্যের অন্ধকারে নিপতিত হয় পরিবার। পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন বালক নজরুল। কৈশোরেই শুরু হোলো জীবন সংগ্রাম ঘানিটানা।
প্রথমে মসজিদের মুয়াজ্জিন। সাথে মক্তবের শিক্ষক। বাড়ির পার্শ্ববর্তী মাজারের খাদেম। এখানেই তার নিবিড় পরিচয় ঘটে ইসলামের মৌলিক আচার অনুষ্ঠানের সাথে। নজরুলের সাহিত্যে ইসলামি ঐতিহ্যের যে বিস্ময়কর প্রকাশ আমরা লক্ষ্য করি, তার হাতেখড়ি এখানেই বলা যায়।
তারপর ভ্রাম্যমাণ লেটোগানের যাত্রাদলে যোগদান। ওখানে নানা যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করতে গিয়ে হাতেখড়ি হয় হিন্দু পুরাণের সাথে।
এবং তারই অননুকরণীয় প্রয়োগ আমরা নজরুলসাহিত্যে দেখতে পাই।
১৯১০: লেটোগান ছেড়ে ছাত্রজীবনে পদার্পণ।
রাণীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুল
মাথরুন ইংরেজি স্কুল। ক্লাস সিক্সের পর পুনর্বার যোগদান কবিদলে। তারপর রেলওয়ে গার্ডেনের খানসামা। রুটির দোকানে চাকরি। ওখানে তার কাব্যপ্রতিভার পরিচয় পান দারোগা রফিজউল্লাহ।
১৯১৪: দারোগা রফিজুল্লাহ তাঁকে নিয়ে আসেন ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুরে। ভর্তি করান ৭ম শ্রেণিতে।
১৯১৫ : পুনরায় ফিরে যান রাণীগঞ্জ স্কুল।
১৯১৭:মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রিটেস্ট না দিয়েই সেনাবাহিনীতে যোগদান। ৪৯ বাঙ্গালী রেজিমেন্টে প্রশিক্ষণ দিয়ে চলে যান করাচি।
১৯২০:ওখানে এক পাঞ্জাবি মৌলবির কাছে ফার্সি শিখেন। এই শেখা যে কী পরিমাণ কাজ দিয়েছিলো সেটা টের পাওয়া যায় নজরুলের ওমর খৈয়াম, হাফিজ ও কাব্যে আমপারা অনুবাদে। কিছু গল্প, প্রবন্ধও লেখেন করাচিতে। যুদ্ধশেষে পল্টন ভেঙে গেলে সেনাবাহিনী ছেড়ে কোলকাতা ফিরে এসে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।
১৯২১: শান্তি নিকেতনে গিয়ে রবি ঠাকুরের সাথে দেখা করেন। একই বছর লেখক ও প্রকাশক বন্ধু আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লা আসেন। কুমিল্লা ঠাকুর পাড়ায় বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে উঠেন। ওখানে পরিচয় হয় আশালতা দেবীর (প্রমীলা) সাথে। তারপর যান আলী আকবরের গ্রামের বাড়ি মুরাদনগরের দৌলতপুরে। পরিচয় ও প্রণয় হয় বন্ধুর ভাগ্নি সৈয়দা খাতুন নার্গিসের (নার্গিস নজরুলের দেয়া নাম) সাথে। তারপর আকস্মিক বিয়ে। আক্দ হয়ে যাবার পর কাবিননামায় কিছু শর্তসহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে কবির সাথে মতদ্বৈততা দেখা দিলে নজরুল বিয়ের আসর ত্যাগ করে কুমিল্লা শহরে প্রমীলাদের বাড়িতে উঠেন। তারপর আরও কয়েকবার কুমিল্লা আসেন। আন্দোলন মিছিল করেন। গ্রেফতারও হন।
১৯২১: এ বছরের ডিসেম্বর মাসের কোনো এক রাতে তিনি লিখে উঠেন বাংলা কাব্যের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিস্ফোরক কবিতা ‘বিদ্রোহী’।
১৯২২: ধুমকেতু প্রকাশ। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশের দায়ে পত্রিকা বাজেয়াপ্ত। কবি গ্রেফতার হন
১৯২৩: জানুয়ারি মাসে বিচারে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড হয় কবির। একই বছর ডিসেম্বরে মুক্তি পান। সে বছর রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করেন।
১৯২৪: ২৫ এপ্রিল শুক্রবার, বাদ জুমা নানা ঘটনাদুর্ঘটনা আর নাটকীয়তার মধ্যে নজরুল প্রমীলার বিয়ে। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অসহযোগিতা। প্রমীলার বয়স তখনো আঠারো পূর্ণ না হওয়ায় ‘সিভিল ম্যারেজ’ সম্ভব ছিলো না তাই ‘আহলে কেতাব’ মতে বিবাহ হয় যাতে বর-কনে স্ব স্ব ধর্মমত বজায় রাখতে পারেন। বিয়েতে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অসহযোগিতা ছিলো। গোলযোগের আশঙ্কায় বিয়ের তারিখ প্রকাশ করেননি নজরুল, ফলে তাঁর কোনো বন্ধুও বিয়েতে আসতে পারেননি।
১৯২৫: এইচএমভি কোম্পানি থেকে তার প্রথম গানের রেকর্ড বের হয়।
১৯২৭: শিখা গোষ্ঠীর আমন্ত্রণে তাদের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় আগমন। এখানে পরিচয় হয় বুদ্ধদেব বসু, উমা মৈত্র, রানু বোস, অজিত দত্ত, ফজিলাতুম্নেসা প্রমুখের সাথে।
১৯২৯: কোলকাতা এলবার্ট হলে কবিকে সংবর্ধনা প্রদান। সভাপতি: আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সংবর্ধনাপত্র পাঠ: ব্যারিস্টার এস.ওয়াজেদ আলী। শুভেচ্ছা বক্তব্য: নেতাজী শুভাষচন্দ্র বসু।
প্রতিভাষণে নজরুল যা বলেন তা অভিভাষণ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে। কিছু নমুনা: “বন্ধুগণ, আপনারা আজ যে বাঁশী হাতে তুলে দিলেন,আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আজ আমার সকল তনু-মন-প্রাণ বীণার মত বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটি কথাই ধ্বনিত হয়ে উঠছে- “আমি ধন্য হলুম,” “আমি ধন্য হলুম।”
১৯২৯: চট্টগ্রাম আগমন। বন্ধু হাবিবুল্লাহ বাহার ও বোন শামসুন্নাহারের আতিথ্যগ্রহণ। এরপর আরও দুবার তিনি চট্টগ্রাম আসেন। একবার বন্ধু কবি দিদারুল আলমের ফতেয়াবাদের আলম বাড়িতে আসেন। রাউজান সাহিত্যসভায়ও যোগদেন।
১৯৩১:দার্জিলিং সফর করে রবি ঠাকুরের সাথে দেখা করেন।
১৯৩১-১৯৪১: এই এক দশক কবি কবিতা ছেড়ে গান, চলচ্চিত্র ও নাটক মঞ্চায়নে ঝুঁকে পড়েন।
১৯৩৪: নজরুল চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হয়ে ‘ধ্রুব’ সিনেমায় অভিনয় (নারদ চরিত্রে) ও সংগীত পরিচালনা করেন। এছাড়া তিনি গ্রহেরফের, বিদ্যাপতি, গোরা, নন্দিনী, পাতালপুরীসহ প্রায় অর্ধশত চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হন কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ কিংবা সংগীতায়োজনে।
নিজের লেখা ‘আলেয়া’ ও ‘ঝিলিমিলি’ ছাড়াও মহুয়া, রক্তকমল, সাবিত্রী, দেবীদুর্গা, মধুমালা জাহাঙ্গীরসহ প্রায় ২০টি নাটক মঞ্চস্থ করেন। এসব নাটকে প্রায় সহস্রাধিক গান সংযোজিত হয়।
১৯৩৯: কবিপতœী প্রমীলা নজরুল পক্ষাঘাত রোগগ্রস্ত হন।একই বছর রেডিওর সাথে যুক্ত হন। নাটক, কথিকা, গীতিনাট্য প্রচার করেন।
১৯৪১: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে তাৎক্ষণিকভাবে রচনা করেন ‘রবিহারা’ ও ‘সালাম অস্তরবি’ শীর্ষক দুটি কবিতা। একটি গানও লেখেন ‘ ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’।
১৯৪২: এক দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হন।
লুম্বিনী পার্ক ও রাঁচী মেন্টাল হাসপাতালে এক বছর চিকিৎসা করেও কোনো ফল হয়নি।
১৯৫৩: প্রথমে ইংল্যান্ড ও পরে জার্মানিতে চিকিৎসার্থে পাঠানো হয়। সব ডাক্তারেরই অভিমত, এ রোগ চিকিৎসার অতীত। ঐ বছরেই কবিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ভারত সরকার কবির চিকিৎসার্থে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে। ক্রমান্বয়ে অবস্থার আরও অবনতি হয়। প্রায় ৩৪ বছর এক যন্ত্রণাক্লিষ্ট নির্বাকজীবন যাপন করেন কবি।
১৯৬২: কবিপতœী প্রমীলার মৃত্যু হয়।
১৯৭২: স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ভারতসরকারের অনুমতিক্রমে কবিকে সপরিবার বাংলাদেশে আনা হয়।
১৯৭৪: কবির ছোট ছেলে অনিরুদ্ধ মারা যায়।
১৯৭৬: কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।
১৯৭৬: একই বছর ২৯ আগস্ট ঢাকা পিজি হাসপাতালে কবি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাঁকে কবর দেয়া হয়। মসজিদের পাশে কবর দেয়া প্রসঙ্গে কবির লেখা একটি গানের কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়-মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই,যেন গোরে থেকে মোয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।’
সাহিত্যকর্ম:
কাব্যগ্রন্থ: অগ্নিবীণা, দোলন চাঁপা, বিষের বাঁশী, ভাঙ্গার গান, ছায়ানট, পুবের হাওয়া, চিত্তনামা, সর্বহারা, সাম্যবাদী, ফণিমনসা, চক্রবাক, নির্ঝর, মরুভাস্কর, চক্রবাক, সন্ধ্যা, সিন্ধু-হিন্দোল, সঞ্চিতা।
সংগীত: বুলবুল, সন্ধ্যা, চন্দ্রবিন্দু, চোখের চাতক, সুরসাকী, গীতিশতদল, স্বরলিপি, গুলবাগিচা।
ছোটগল্প: ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলীমালা
উপন্যাস: মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা, বাঁধনহারা
অনুবাদ: রুবাইয়াতে হাফিজ,রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম,কাব্যে আমপারা।
নাটক:ঝিলিমিলি, মধুমালা
গীতিনাট্য:আলেয়া, বিদ্যাপতি, বিয়েবাড়ি, পুতুলের বিয়ে, শ্রীমন্ত, ঈদুল ফিতর, প্রীতি উপহার, বনের বেদে।
প্রবন্ধ: যুগবাণী, ঝিঙেফুল,রাজবন্দীর জবানবন্দি, ধুমকেতু, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্রমঙ্গল।
তথ্যসূত্র: ১.রফিকুল ইসলাম:কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও সাহিত্য, মল্লিক ব্রাদার্স,১৯৮২
২.আবদুল মান্নান সৈয়দ : নজরুল ইসলাম কবি ও কবিতা, বাংলা একাডেমী,১৯৭৭
৩.গোলাম মুরশিদ : বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল জীবনী, প্রথমা প্রকাশন, ২০১৮
আ.ম.ম.মামুন, অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক