মুশফিক হোসাইন
কাঠবিড়ালি রোডেনশিয়া বর্গের ব্কিউরিড গোত্রের ছোট ও মাঝারি আকারে স্তন্যপায়ী প্রাণী। পৃথিবীর সব জায়গায় এদের দেখা মেলে। এদের সামনের পা দুটো খাটো পেছনের দুটি বড়। তাই এরা সহজে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে পারে। কাঠবিড়ালির কথা লিখতে গিয়ে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কথা মনে পড়ে গেল। বাস্তবে কাঠবিড়ালি দেখার আগে আমি নজরুলের বিখ্যাত ‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’ ছড়াটি পাঠ করি।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন নগরে কাঠবিড়ালির উৎপাত ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। সে সম্পর্কে বলার আগে ছড়াটির কিছু অংশ উদ্ধৃতি দেয়া যাক।
“কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?/ গুড়-মুড়ি খাও? দুধভাত খাও? বাতাবি নেবু লাউ? বেড়াল ছানা? কুকুর খাও? তাও? / ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক,/খাও একা পাও যেথায় যেটুক! বাতাবি নেবু সবগুলো/একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো! / তবে যে ভারী ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পুটুস চাও?/ ছোঁচা তুমি, তোমারি সঙ্গে আঁড়ি আমার! যাও।”
ভারি চমৎকার এ ছড়াটি বাঙালি সমাজের শিশুরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করে থাকে।
ছড়াতে কাঠবিড়ালির খাওয়ার যে বর্ণনা আছে, তাতে মনে হয় তার অখাদ্য কিছুই নয়। তবে একথা সত্য যে সেস সবভুক নয়। নজরুলের ছড়া পড়ে মনে হয় পেয়ারাই তাদের প্রিয় খাদ্য।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরের কিছু কিছু এলাকায় কাঠবিড়ালির ব্যাপক উৎপাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিষয়টি বিগত কয়েক বছর ধরে আমার নজরে আসছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক বদরুল আমিন ভূঁইয়ার সাথে এ ব্যাপারে আমার আলাপ হয়। তাঁর নেতৃত্বে বায়োডাইভার্সিটি রিসার্চ গ্রুপ অব বাংলাদেশের সাথে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ২০১৮ সালে এক সমঝোতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। তাঁরা চট্টগ্রামের সব কটি ওয়ার্ডে জীববৈচিত্র্য চিহ্নিত করার দায়িত্ব পায়। তবে তাঁর গবেষক দল শুধুমাত্র শুলকবহর ৮নং ওয়ার্ডে জরিপ চালিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে দেখা যায় শুলকবহরে ৩৭০টি বন্যপ্রাণী শনাক্ত করা হয়। তাতে কাঠবিড়ালিও ছিল। আমি ২১নং ওয়ার্ড জামালখানে বাস করি। ওয়ার্ডটি হেলদি ওয়ার্ড হিসেবে পরিচিত। এখানে বহুতল ভবন যেমন আছে তেমনি টিলা নালা ঝোপঝাড় পাহাড় ও কবরস্থানও আছে। আর বাড়ির চারপাশে যে ভবনগুলো আছে তার প্রায় সবগুলোতেই ছাদবাগান দেখা যায়। এখানে বাস করে কয়েক জোড়া কাঠবিড়াল। আমার নিজের এবং পাশের বাগানের ফল ফুল গাছের কচি ডগা কিছুই বাদ যাচ্ছে না। কাঠবিড়ালি যতটুকু খায় তার চেয়ে বেশি নষ্ট করে।
যাই হোক প্রবীণদের বিশেষ কোনো কাজ থাকে না বলে ঘরে বসে কাটাতে হয়। লেখালেখির পাশাপাশি জানালা দিয়ে প্রকৃতি (যতটুকু দেখা যায়) অবলোকন করা আমার একটি বিশেষ কাজ। আমি নিসর্গী ও প্রকৃতি পত্রিকার সম্পাদক। সেহেতু বিশেষ আকর্ষণ নিয়ে প্রকৃতি অবলোকন করা আমার অভ্যাস ও গবেষণা। পাখপাখালি কীট পতঙ্গ উদ্ভিত ও প্রাণীজগতের প্রতি তীক্ষè দৃষ্টি রাখা আমার একটি বিশেষ কাজ। সেই সূত্রে বছর কয়েক আগে নজরে এলো একজোড়া কাঠবিড়ালি। অতি রুগ্ন ও কেষ্টা শরীর দেখে ওদের খাবার ও জল সরবরাহ করি। দেখতে দেখতে ওদের সংখ্যা বেড়ে গেলে খাবার সংকট দেখা দেয়। এখন ওদের উৎপাতের শেষ নেই। পাশের এবং আমার বারান্দর ফুল ফল অর্থাৎ পেয়ারা, সফেদা, কামরাঙা, বিলেম্বু, সবজি সবকিছু খেয়ে যাচ্ছে নির্বিচারে। এমন কি এসির আউডডোর কম্প্রেসারের তার, হোস পাইপ ইত্যাদি।
আট দশ বছর আগে আমি এদের প্রথম দেখেছিলাম ডিসি পাহাড়ে, মহসিন কলেজে। এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে রাখি; তা হলো আমার বারান্দার হাঁড়িতে প্রায় পনের বছর ধরে দোয়েল পাখি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাসা করে ছানা তুলে যাচ্ছিল। প্রতি মৌসুমে তারা ৪/৫ বার ছানা তোলে। এবং প্রতিবার ৩ থেকে ৫টি করে। হঠাৎ করে ওরা গত বছর থেকে ছানা তুলছে না। বাসা ছেড়ে দিয়েছে। আমার আশে পাশের তল্লাটে ওদের দেখা মেলে না। অনুসন্ধান করে এই প্রতীয়মান হল দোয়েলের বাসায় কাঠবিড়ালি হানা দিয়ে ডিম ও ছানার ক্ষতি করেছে। এখন কাঠবিড়ালির প্রধান শত্রু চড়–ই ও কাক। তারপরও কাঠবিড়ালি অপ্রতিরোধ্য। এদের প্রতি মমতা বশত: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট জীব বিজ্ঞানী ডক্টর গাজী আসমতের সহায়তায় আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। যা পরবর্তীতে দৈনিক পূর্বদেশ ও পূর্বকোণে ছাপাও হয়েছিল।
যা-ই হোক এদের অত্যাচার সইতে না পেরে সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট দিই। এরিমধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব অধ্যাপক আলেক্স আলীম ও সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্ট দেন। চট্টগ্রাম কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের কোনো কোনো অধ্যাপক জানান যে, তাঁদের শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্ভিদ, ফুল, ফল কাঠবিড়ালি ধ্বংস করছে। একইভাবে কথাশিল্পী ও শিক্ষা দপ্তরের পরিচালক আজাদ বুলবুল, হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজের প্রভাষক হাদিজ রহমান একই তথ্য দেন। বন্ধু ও চা বিশেষজ্ঞ আমিনুর রশীদ কাদেরী এবং দৈনিক বাংলার ব্যুরো প্রধান ডেইজি মওদুদ এর কাছ থেকে কাঠবিড়ালির তথ্য পাই। উল্লেখ্যযোগ্য যে এরা সবাই চট্টগ্রাম মহানগীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
আমরা জানি জীববৈচিত্র্য যতবেশি স্বাচ্ছন্দ্য হবে মানবজীবন তত বেশি স্বাস্থ্যকর হয়। কিন্তু কোনো প্রাণীর আধিক্য হলে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ছাদ বাগানের ফুল, ফল, সবজির ক্ষতি হলে কীটপতঙ্গ, পাখি ও অন্য প্রাণীর জন্য হুমকিস্বরূপ। জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্যের জন্য এরা এমন ক্ষতিকর হয়ে আবির্ভূত হয়েছে কাঠবিড়ালির মাধ্যমে ‘এনসেফ্যান্টিস’ নামের মরণব্যাধি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ছাড়াও টুলারেমিয়া, প্লেগ, রিংওয়ার্ম রেবিস, সালমোনিস ইত্যাদি রোগ ছড়াতে পারে। যে কারণে ‘দ্য ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিস প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল’ পরামর্শ দিয়েছেন যে, কাঠবিড়ালি থেকে দূরে থাকুন, এদের মাধ্যমে প্রাণী ও মানব শরীরে রোগ বালাই ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে। অতএব কাঠবিড়ালি সংখ্যা বৃদ্ধি প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।
মুশফিক হোসাইন, কবি ও নিসর্গী