মহি মুহাম্মদ
কোকিলের কি সময় অসময় নেই? ডাকতেই হবে তাকে। বিরক্তিকর কেন? তার কানেই কেন এত জ¦ালা বর্ষণ করে? কুউ-কুউ-কুউ। মাথা থেকে যেন রক্তের ভেতরে তরঙ্গ তোলে। অদ্ভুতভাবে এই ডাকটা অবিরাম চলতেই থাকে। সবার যদি সময় বলে একটা কথা থাকে, তবে কোকিলের নেই কেন? এ প্রশ্নটা তার মাথায় যতই ধাক্কা মারুক তাতে কোকিলের কিছুই যায় আসে না। কোকিলের ডাক কোকিল ডাকবে। সে ডেকে ডেকে খুন হয়ে যাবে। হয়ে যাক খুন!
কোকিল ডাকলে কার কি সমস্যাÑ এই প্রশ্নও জাগতে পারে। একবাক্যে আমরা সবাই বলতে পারি কোকিল ডাকলে কার কি? কিন্তু কারো না কারো সমস্যা হতেও তো পারে! আর যদি সমস্যা হয়েই যায় তখন এর প্রতিকার কি করে সম্ভব, তাই ভেবে ভেবে কোকিলা তিক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠে। কোকিলার এই উৎকণ্ঠায় আর কেউ নাক গলায় না। কারণ কোকিলা যে কোকিলের কারণে ঘরে দুদ- স্থির থাকতে পারে না, সে খবর তেমন কেউ জানে না।
যদি কেউ কোকিলাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতো তবে বুঝতে পারত যে, কোকিলের ডাক কোকিলার শরীরে ও মনে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে মনে মনে কোকিলকেই সে দোষে। যদি কোকিল অমন অসময়ে না ডাকতো তবে এ জগতে কোকিলার অবস্থান অন্যরকমই হতো। কারণ কোকিলের ডাক শুনে কোকিলার প্রাণ আঁইঢাই করে। মন উচাটন করে। সাহস বেড়ে যায়। রক্তের ভেতর অদ্ভুত সব কা- চলতে থাকে। সেই চঞ্চল ¯্রােতকে সে কিছুতেই বাগ মানাতে পারে না। আর বাগ না মানাতে পেরে সেদিন শূন্য ভিটায় অমন দুপুরবেলা এসে হাজির হয়েছিল। কেউ কি তাকে অগোচরে ডেকে এনেছিল? নাকি নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল? তার পর্যালোচনা এখন আর প্রয়োজন নেই। তবে এ ঘটনা আরো কিছুদিন পরের।
মুখডোবা যতই নিচু গ্রাম হোক না কেন, এখানে যেমন শাপলা শালুক মেলে তেমনি এ গ্রামে গাছের কোনো কমতি নেই। এই এত্তো বড় বড় গাছ। উঁচু উঁচু ঝাপটানো। মাথা পেছনে কাত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে গাছ দেখতে হয়। এইসব উঁচু গাছের ডালে কালো পক্ষিগুলো বসে বসে ডাকে। ইশ, কোকিলা যদি পারতো সব গাছগুলো কেটে ফেলে দিতে! তখন পক্ষিগুলো বসে ডাকাডাকি করতে পারতো না। কুৎসিত পাখি কু-কু কু। এটা কোনো ডাক হলো? অশুভ! এমনটাই ভাবে কোকিলা।
কোকিলের কুহু রব যখন জ¦ালাতন ধরায় তখন মনে হয় কানের ফুটো তুলা দিয়ে বন্ধ করে রাখে। আরো তো অনেক পাখি ডাকে, কই সে সব তো সমস্যার কারণ হয়ে দেখা দেয় না! তবে কোকিলের ডাক এমন করে তার অন্তরাত্মার ভেতরে ক্রিয়া করে কেন সে নিয়ে তার মাথায় তুমুল চিন্তা চলতে থাকে। যদি কোনোক্রমে কোকিলের খাদ্য সে দিতে পারত তবে বিষ মিশিয়ে এ পাখিটাকে হত্যা করতে দ্বিধা করত না। মনের ভেতর এখন সব সময় তার একই সুর বাজে। ‘আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেল গো মরার কোকিলে/ আমায় উদাসী বানাইলো গো মরার কোকিলে…।’ গানের সুরে হৃদয় কিছুটা নিবৃত্ত হলেও তার উচাটন ভাবটা কিছুতেই কাটে না। বাহিরপানে কে যেন ডাকেÑবলে সে বাইরে উঁকিঝুকি দিতে থাকে। কোকিলটা কোথায় বসে ডাকে, তার অবস্থান বের করাও যেন তার দায়িত্বের মধ্যে পরে। অযথা সে কোকিলকে খুঁজেই মরে। কিন্তু প-শ্রম। কোকিলের দেখা সে পায় না। আর তার মনের ইচ্ছে মনেই মরে। তাতে কোকিল মরে না।
তবে অনেক কষ্টের বিনিময়ে এই কয়দিনে সে পাখিটার ছুরত দেখতে পেয়েছে। পাখিটার ছুরত দেখে যার পর নাই সে মনে দুঃখ পেয়েছে। দুঃখ পাওয়ার কারণ কোকিলের গায়ের রঙ তার শরীরের রঙের কাছাকাছি। তার মানে এই দাঁড়াল যে, কোকিলের গায়ের রংটাই নামের প্রধান কারণ? যদিও যে তার নাম রেখেছে তাকে আর খুঁজে আনা সম্ভব নয়! কারণ মৃত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো মাধ্যম আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। নচেৎ সে এক্ষুনি তার দাদিজানের কাছে প্রশ্ন রাখত, এই বিশ্রি পক্ষিটার নামের সঙ্গে তার নামের মিল এল কি করে? সেটা কি একমাত্র রঙের কারণেই? তার শরীরে রঙ কালো কিন্তু তাতেও তো ব্যাটা ছেলেদের কোনো সমস্যা হয়নি। তাকে তারা কিছুতেই নিস্তার দেয়নি।
দাদির নামকরণের পেছনে শরীরের রঙ ছাড়া আর কি কারণ ছিল আজ তা ভেবে পায় না কোকিলা। এখন কোকিলা বলে কেউ ডেকে উঠলেই সে কালো কুচকুচে একটা পক্ষিছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। মাঝে মধ্যে তার চোখে কাকের অবয়বও ভেসে ওঠে। তখন তার মস্তিষ্কের কোটরে কুহু কুহু রব ও কা-কা বিশ্রি ডাকের এক ধুন্দুমার প্রতিযোগিতা চলে। সে দুয়ের মল্লযুদ্ধে তার চেতনায় এক ধরনের ধ্বস নামে। তার ভেতরে হতাশার ইন্দ্রজাল তাকে বেশুমার কাবু করে ফেলে। আর এই ভাবনাগুলোই তাকে প্রথম ফিরোজ চৌধুরীর অঙ্কশায়িনী হতে বাধ্য করে। আর কোকিল যতো ডাকে, তত তার পরিম-ল বৃদ্ধি পেতে থাকে। তার এই সর্বনাশের পেছনে কোকিলই একমাত্র দোষী, সে নিজে নিজেই কোকিলকে দোষী সাব্যস্ত করে। এ ভাবনায় তাই সে নিজের কোনো অপরাধ খুঁজে পায় না। নচেৎ যে অপকর্মটি হয়ে গেছে তার জন্য মনের ভেতর এত ঝড় ঝাপটা কেন? আর এসব কাজের জন্য সে ভেবে দেখেছে প্রতিবারেই বিবেকের ঘরে তুমুল আলোড়ন খেলে যায়।
যখন তার দেহ থেকে কিশোরীকাল উধাও হয়ে যৌবন লাগতে শুরু করেছিল তখনও তার নানিবুড়ি আরেকটি কথা বলেছিল। কথাটা আজো তার স্মরণে এসে নানিবুড়ির মুখখানি ভাসিয়ে তোলে। নানি বলতেন, ‘আলো শোন মাগি, নারী নষ্ট ঘাটে আর পুরুষ নষ্ট বাজারে।’
নানির সম্বোধনে মাগি শব্দের ব্যবহারটা কতো সহজে মানিয়ে যেত। কিন্তু শব্দটা প্রায় তাকে কেমন বিচলিত আর লজ্জার মধ্যে টেনে নিয়ে যেত। তখন পাড়ার উঠতি মেয়েদের কাছে যেসব গল্পগুলো শুনতো সে সব গল্পে এর অবস্থান খুব দৃঢ় ছিল। তাই যখনই নানির মুখে কিংবা বয়স্ক মহিলারা এমন সম্বোধনে ডাকতো তখনই কোকিলার ভেতর একটা সর্বনাশা খেলা জমে উঠতে চাইতো। তার নানি তার এমন চুপচাপ ভাবনার চেহারা দেখে আরো রঙ্গ করে বলতো, ‘কিরে নাতনি দিহি ডাঙ্গর হইয়া যাইতেছে। একখান নাত জামাই না হইলে আর চলে না।’
সে মুখ ঝামটা দিয়ে বলতো, ‘যাও তো নানি, তুমার আগ বাড়াইন্যা কথা হুনি না।’
নানি আরো রঙ্গ করে বলতো, ‘তয় কি হুনতে চাও?’
‘কিছুই হুনুম না। তুমি খালি রস করো।’
‘আহালো, তুই দেহি রসের কথায় মন খারাপ করোস।’
‘করবো না?’
‘ওই দেহ তো মাগির কা-!’
কোকিলার খুব রাগ হতো নানির কথায়। কি অনায়াসে তিনি গাল দিয়ে সম্বোধন করে কথা বলতেন। আসলে এই মুখডোবা গ্রামের বয়স্ক নারীরা এমনি এমনি কম বয়েসী ছুরিদের ‘মাগি’ সম্বোধন করে কথা বলে। অথচ তারা এই শব্দের গভীর মর্মার্থ কখনই ভেবে দেখেনি। মাগি শব্দের অর্থ তারা স্ত্রীলিঙ্গের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছে। এই সম্বোধনে তাকে যখন নানি ডাকতো তখন সে নানির প্রতি একধরনের ক্রোধ অনুভব করতো। কিন্তু দাদি যখন শরীর বেড়ে ওঠার সময় নানা বিষয়ে জ্ঞান বিতরণ করতে শুরু করলেন তখন সে দাদির প্রতি এক ধরনের অন্ধ আকর্ষণবোধ করতে শুরু করল। কি এক মুগ্ধতায় সারাক্ষণ দাদির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করত। দাদি হয়তো এটাকে ভুল ব্যাখ্যা করে আদরে গদ গদভাব প্রদর্শন করে বলতেন অন্যকে, ‘দেহ কোকিলা আমার ন্যাওটা হইছে।’
কিন্তু কোকিলা যখন বুঝতে পারল কেন সে দাদির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, তখন সে মনে মনে এক নিষিদ্ধ সুখে অস্থির হয়ে উঠল। যৌবনের সুখের অলিগলি নিয়ে সম বয়েসীদের সঙ্গে আলাপে মেতে উঠল। শুধু কি তাই, সে সঙ্গে সে পুরুষের সম্পর্কিত আলোচনায় মনোনিবেশ করেছে। কোন পুরুষের কি দোষ, কাকে দেখতে কেমন লাগে, কে তাকে কি টিপ্পনি কেটেছে। কে পথে যেতে যেতে কাপড় ধরে টান দিয়েছেÑ এসব তার আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।
কোকিল না মরুক, তবে কোকিলা যে অবশ্যই মরবে, তা সে জানে। এই কথাটি অনেকেই বোঝে কিংবা বোঝাতে চায় কোকিলাকে কিন্তু কারো কথায় কান দেয় না সে। তার নিজের মতোই কাজ করতে থাকে। এই বয়সেই সে বুঝতে শিখেছে পৃথিবীটা কঠিন জায়গা। এখানে রীতিমতো লড়াই আর বুদ্ধির খেলা দিয়ে টিকে থাকতে হবে। আর না জেনেই অজানা সেই গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায় কোকিলা। তখনও একটি কোকিল বড় একটি পুরনো মেহগনি গাছের মগডালে বসে কুউ- কুউ-কুউ রবে নিস্তব্ধ এলাকা তোলপাড় করে তোলে। পাড়াপড়শি যারা কোকিলার সর্বনাশের জন্য কোকিলকে দায়ী করে, তারা বলে, ‘অমন ভরদুপুরে কোকিলার কি দরকার ছিল নাইতে যাওয়ার? সবকিছুরই একটা টাইম আছে তাই না? হে গো সময় অইছে হেরা কাম কইরা দিছে। এহন তুই কোকিলা কি করবি?’
কোকিলা গরিব, দুখি। ওর করার কিচ্ছু নেই। কিন্তু ওর কি কোনো চিন্তাও নেই!। ভাবে অনেকেই। কারণ পড়শিরা খাবার দিয়ে প্রতিদিন সহযোগিতা করতে না পারুক অন্তত মুফত দু একটা উপায় তারা বলতেই পারে। হাজার হোক, তারা পড়শি বলে কথা! কিন্তু লোকে বলে, ‘মেয়া কালা অইলে কি হইব, ঢখ চেহারা তো কম না! যৌবনে বলে কক্কুরীও শোভা পায়। আর ও তো মেয়া মানুষ! ও নষ্ট হইবো না তো, কেডা হইবো?’
তবে ভিন্ন কথাও বলে কেউ কেউ, ‘আরে নারে বু, ও কাম হয় নাই! ওরে ধরছে আলগা দোষে। দেহ না কেমনে চোখ ঘোরায়। মাথা আউলা ঝাউলা করে।’ যেহেতু কোকিলা, মিঞা বাড়ির কামলা ঝি, তাই মিঞা বাড়ির দায় ওর অসুখে বিসুখের খোঁজ-খবর নেওয়া।
কেউ কেউ বলে, ‘ক্যান খাইল্লা ভিডায় আইছিলি অবেলায়? নাইলে তো এ কাম অয় না।’
আবার আরেকজন বলে, ‘ধ্যুৎ কি যে কও হাবলুর মা, যৈবনে বেবাক হমান। পড়শীদের হেন কথার তোড় বাড়তেই থাকে। আর ওদিকে রাতের অন্ধকারে যে ছায়ামানব ভীত চেহারায় কোকিলার নিকট ত্রাণ পৌঁছে দেয় আর কাঁকুতি মিনতি করে যেন কিছুতেই তাদের কথা বাইরের কেউ না জানে। এসব খবর বাইরে গেলে তারা ছেলে মানুষ কিছুই হবে না। বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথাও আশ্রয় নেবে। কিন্তু সেতো মেয়ে মানুষ কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বিপদটা তারই বেশি। তাই কোকিলা যেন কিছুতেই কারো কাছে মুখ না খোলে। এই সতর্কবাণীর সাথে সাথে নানা রকম অর্থ সম্পদের যাতায়াত দেখতে পায় তাই সে নিজের কথা কাউকে বলবে না বলেই স্থির করে। কিন্তু সময় এখন এমন যে ঝামেলাকে সে যতই এড়িয়ে চলতে চায়, ঝামেলা কিন্তু তার পিছু ছাড়ে না। কোকিলার এসব ভাবতে ভাবতে জীবনটাকে কিভাবে ঝামলামুক্ত করা যায় সে কথাই ভাবে। মুখ খুলে সে কারো কিছুই করতে পারবে না। তার উপরে বিচার এমনও হতে পারে তাকে এই মুখডোবা থেকে বিতাড়িত করা হলো। তার তো আর যাওয়ার জায়গা নেই। কিন্তু সবকিছুই কি শাস্তি ছাড়া শেষ হয়ে যাবে। কোকিলাদের ভাগ্যকে যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কোনো বিচার হবে না? এটা তো কোনো কঠিন কিছু না। আবারও কঠিনও। তাদের কথার শোনার কেউ নেই। বিচার চাওয়ার মতো ক্ষমতা নেই। চোখের জল ছাড়া তেমন কোনো সম্পত্তি নেই। তারপরেও একটা সংগুপ্ত আশা জিইয়ে রাখে কোকিলা, সে একদিন দেখে নেবে। শুধু সময়ের ফেরে পরে মনটা যেন পরিবর্তন না হয়ে যায়, বলে নিজেকে প্রবোধ দেয় সে।
না কোকিলা মুখ খোলে না। শুধু হিসাব করে, ‘এইডা কি অইল?’ তার কি বেশি খারাপ লাগছে! ‘কই নাতো!’ তাদের কি জীবন? এ জীবন তো তাদের দয়া করে বাঁচিেেয় রেখেছে বলে। কত মানুষই তো মরে যাচ্ছে। সে তো দিব্যি বেঁচে আছে। থাকবেই তো। সে তো প্রভাবশালী মিঞা বাড়ির ঝি চাকরানি। না খারাপের কি আছে! খালি মাথাটা ঘোরে। জোঁক শুধু রক্তই খায়, উপকার করে না। তবে এরা তো তার উপকার করছে। না হয় সে তো কোন ভাগারে এতদিন মরে পচে গলে শেষ হয়ে যেত। মিঞারা ঠাঁই দিয়েছে, এটাই তো অনেক বড় উপকার। আর ভেতরে যে কাজটি হচ্ছে, সেটা তো কেউ জানে না। না জানার জিনিস না জানাই ভালো। এ পৃথিবীতে জীবন ধারণ করা যেমন সহজ, তেমন কঠিন। যতদিন ঝামেলা এড়িয়ে থাকা যায়, ততই মঙ্গল।
কোকিলার হাবভাব গ্রামের কেউই বোঝে না। তবে সে যে একটা ডেঞ্জারাস মেয়ে Ñ এ খবর চারপাশে ছড়াতে সময় নেয় না। তবে তরুণদের মধ্যে একটু বেসামাল হওয়ার ইচ্ছে জাগে তারা প্রায় কোকিলাকে প্রলোভনের মিহিজালে তুলে আনতে চায়। কিন্তু কোকিলা ততদিনে বুঝে গেছে পুরুষ মানুষকে কীভাবে ভাড়াতে হয়। তার আর অন্যকোনো কৌশল জানা না থাকায় সে এখন যতটুকু পারে ঢলাঢলি করে তবে কিছুতেই নিজেকে বিকিয়ে দেয় না। গ্রামের যুবক কুল যতো রসের গল্পই করুক না কেন তারা জানে কোকিলা তাদের সঙ্গে যতই ঠাট্টা মশকরা করুক না কেন, সে কিছুতেই কাউকে ধরা দেয় না। কোকিলা এখন পুরুষ পোষে। সে পুরুষ বোঝেও। কোকিলার ইচ্ছে ছিল কুকুর পোষার। কিন্তু তার খাবারের আর আশ্রয়ের দৃঢ়তা না থাকায় সে কুকুর পুষতে পারেনি। তবে সে পুরুষগুলোকে দিয়ে এ বিশেষ প্রাণীর উপকারটুকু লাভ করার ইচ্ছে পোষণ করে। এ কথা একদিন ফিরোজ মিঞার কানে তুলেছিল। সেদিন ফিরোজ মিঞা থম মেরে কি যেন ভেবেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তোর কি কোনো সমস্যা হইতাছে। এমুন আজব ভাবনা ভাবছ ক্যান?’
ফিরোজ মিঞা রাতের অন্ধকারে যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন কোকিলার কাছে একটি লোমশ কুকুরের অবয়ব ভেসে উঠেছিল। দিনের বেলা এই মিঞা সাহেবের দেখা মেলা ভার। থাকে রাশ গম্ভীর। শত কাজের ব্যস্ত মানুষ।পার্টির নামে যা করে বেড়ায় তাই নাকি বাহবার যোগ্য। তো কি করে বেড়ায় সে, বিচার-আচার? কে, কাকে কি বলেছে? এই নিয়ে মাথা ফাটানোর দরকার পড়লেও মিয়াসাহেবকে যেতে হয়। আবার নতুন করে সুর উঠেছে, মিয়াসাহেব বাছতে শুরু করেছেন কে পার্টিকে ভোট দেবে না দেবে। আবার কেউ আছে কোনো পার্টিতেই ভীড়তে চায় না। তাদের জন্য মিয়া সাহেবের কঠিন শাস্তি রয়েছে। এই সময়ে তাদের ওপরে নরক যন্ত্রণা নেমে আসে। কেমন সে যন্ত্রণা বলে শেষ করা যাবে না। ঘরবাড়ি ভেঙে তছনছ করে দেওয়া, প্রয়োজনবোধে জ¦ালিয়ে দেওয়ারও হুকুম আছে বলে জানিয়েছে মিয়াসাহেব। মিয়াসাহেব যখন এসব কাজে ব্যস্ত তখন রাতে সপ্তাহে দু একবার কোকিলার ডাক পড়ে। আর দিনের বেলা ফিরোজ মিঞার বাপ তোফেল মিঞা। তাকে গোসল করিয়ে দেওয়া, খাওয়া দাওয়া করানো, গায়ে তেল মেখে দেওয়া সবই করাতে হয় কোকিলাকে। কিন্তু বুড়ো হাবড়াটাও কম যায় না। বুড়ো ভারীও কম নয়। কোকিলার হাঁপ ধরে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। বুড়োর পরে যুক্ত হয়েছে বুড়োর ছেলে। যখন গা সওয়া হয়ে গেছে সব তখনই আরেকজন এসে যুক্ত হলো Ñ রনি।
রনি ফিরোজ মিঞার ছেলে। এই ছেলেটি যুক্ত হওয়ার পরেই কোকিলা কেমন পাল্টাাতে থাকে। তার ভেতরে একটা ঘরের স্বপ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। বিষয়টা আরো উস্কে দিয়েছে জরিনা। জরিনা ওদের সঙ্গেই কাজ করতো মিঞা বাড়িতে। এখন সংসার করছে। রাখাল ছেলেটার সঙ্গে ভাব করে গঞ্জে পালিয়েছে। ছেলেটা রিকশা চালায়। আর জরিনা বাসা বাড়িতে কাজ করে। বেশ সুখেই আছে। জরিনা একদিন এসে বলে গেছে। এরপরেই কোকিলার মনেও এমন আশার সঞ্চার হতে থাকে। তারও একটা ঘর হবে। হোক পুরুষটা অকর্মা। দরকার হলে সে খাটবে। খেটে এনে স্বামীকে খাওয়াবে। তারপরেও তার একজন পুরুষ লাগবে। রনিকে তার পছন্দ হয়েছে। রনির সঙ্গে ভেগে যেতে পারলে তার জীবনের গল্প অন্যরকম হতো। কিন্তু রনি লেখাপড়া না করলেও ওর বাপের টাকার গরম আছে। টাকা দিয়ে ওর বাপ সব কাজ করতে পারে। করুক তাতে ক্ষতি নেই। কোকিলার শুধু রনিকে দরকার। রনি যদি অন্য কাউকে ঠিক করে দেয় তাতেও আপত্তি নেই। দরকার হলে সে রনির আলগা মেয়েলোক হয়ে থাকবে। মাসে ছমাসে একবার আসবে তার কাছে রনি। তারপরেও তো নিজের মতো করে থাকতে পারা। এসব নিয়ে বেশ ভাবে কোকিলা।
কোকিলার কালো শরীরে বাঁধভাঙা যৌবনের গল্প যতই ছড়াতে থাকে ততই বাতাসে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সে গুজব শুধু রঙ ছড়ায়, সেখানে কোনো সার নেই। তার চেহারার মায়া রঙের কারণে বিফল হয় না। মধু থাকলে যে ফুলই হোক না কেন ভ্রমর আসবেই-কথাটা বলেছিল তার দাদি। ‘আলো সোয়াগী, তোমার গতরে বান ডাকছে তারে বানবে কিডা?’
তবে কোনো এক হাস্যরসকালে কোকিলা তার শত্রু কোকিলের প্রতি যে প্রতিহিংসা ব্যক্ত করে তা শুনে ছেলেরা অবাক হয়। কেউ কোকিলার নিবিড় পরিচর্যা উপভোগ করার জন্য দ্এুকটা কোকিল মারার জন্য পাঁয়তারা করে। কিন্তু তাতে উঁচু মগডালে বসে থাকা কোকিলের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। কারণ যখন কোকিলের ডাক অবিশ্রান্ত ভাবে কোকিলার কর্ণকুহর ভরিয়ে তোলে তখন কোকিল হন্তারক কাউকেই কাছে পাওয়া যায় না।
তবে কোকিলার কালো শরীরের ভেতরে যাই থাকুক না কেন সে নিজেকে নিয়ে জুয়া খেলার সাহস সঞ্চয় করেছে। আর তাই যে করেই হোক সে এ গ্রামে টিকে আছে। কিন্তু এ টিকে থাকার পেছনে যে কাজটি করে যাচ্ছে, যেদিন তার গোমর ফাঁস হয়ে যাবে সেদিন কেউ আর তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। তাই তাকে এ পরিকল্পনাটি মাথায় রাখতে হচ্ছে। রনি আর তার বন্ধুদের সে চটাবে না। কারণ ওরাই তার এ গ্রামের রক্ষা কবচ। রনিকে সে একদিন বলেই ফেলেছিল, তার মনের সংগুপ্ত ইচ্ছেটা। সব শুনে রনি বলল, ‘ঠিক আছে ”েষ্টা করুম।’
কিন্তু সে চেষ্টা অপচেষ্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল। রনি আর ওর বন্ধুদের শুধু শরীরই দরকার হয়। শরীর ঠান্ডা হলে কোকিলার খবর ওরা পুছে না। ওরা কোকিলাকে শহরের গল্প বলে। ওখানে গেলে সে নির্দ্বিধায় শরীর বেচতে পারবে বলে লোভ দেখায়। এখানে গ্রামের পরিবেশ ভালো না। জানাজানি হলে ওর বিচার হবে। আর সে সালিশে নিশ্চয়ই তার মাটিতে পুঁতে কঙ্কর মারার ফতোয়া দেবে মৌলবী তাহের। কিন্তু কোকিলার অজানার পথে পা রাখতে সাহস হয় না। এখানে যে অস্ত্র সে তোফেল আর ফিরোজ আর রনিকে কেন্দ্র করে রচনা করেছে, তা যেন তাকে রক্ষা করতে পারবে বলে সে বিশ্বাস করেছে। তাই অজানা-অচেনা জায়গায় যেতে সাহস পায় না। ছেলেগুলো তাকে ফুঁসলায়। ওর একটা নতুন বাড়ি হবে। একটা বাড়ির নতুন মালিকানা পাবে, আরো কতো কি? কিন্তু কোকিলার জন্মভিটা ছাড়তে মন চায় না। কেউ নেই বলে যে আশায় সে এ মাটিতে পড়ে আছে সে মাটিকে ছেড়ে বাস্তচ্যুত হতে চায় না। কিন্তু মনে হচ্ছে তাতে ঘোর বিপদকাল সত্যিই ঘনিয়ে আসবে। কারণ ওদের কথাতেই মৌলবী তাহের হয়তো কোকিলার বিচার করতে বসে যাবে। এই গ্রামে বসে ওদের কেশাঘ্র স্পর্শ করার পর্যন্ত কোনো ক্ষমতা বিধি তাকে দেয়নি। তাই ওদের বিচার নির্দ্বিধায় মেনে না নিলে অস্তিত্ব সংকটের চরম মুহূর্তকালটি যে সন্নিকটে তা সে বুঝতে পারছে।
কোকিলাকে তাই খুব তাড়াতাড়ি মুখডোবা গ্রামের মায়া ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু কোকিলা এভাবে গ্রামের মায়া ত্যাগ করতে চায় না। ওদের সঙ্গে পেরে উঠবে না তাই। আর যদি ওদের মাধ্যমে নতুন একটা বাঁচার স্বপ্ন পেয়েই যায়, তাহলে মন্দ কী! কিন্তু ওকে যারা এই পথে ঠেলে দিচ্ছে তাদের একটা শাস্তি তো হতেই হয়। মাথার ভেতর একটা কূটচালের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তবে কিছুতেই সে তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। রাত গভীর হলে গ্রাম ছাড়ার সময় হয়। কোকিলা বের হয়ে আসে।
দুই.
ঘুটঘুটে রাত। দুজন ছায়া মূর্তি এগেিয় আসে। তবে তাদের সঙ্গে কেনো নারী নেই। দুজনেই একটা মুখ বাঁধা বস্তা কাঁধে নিয়ে এগুতে থাকে। সমানেই নদী। গন্তব্য ওদের ওদিকেই। এই সময় একজন ছায়া মূর্তি অপরজনকে ডেকে বলে।
‘মনে হয় বস্তার মইদ্যে লড়তাছে!’
‘ফাইজলামি করোছ?’
‘আরে না! সত্যই। টের পাইলাম তো।’
‘জোরে পা চালা। ওই তো আইয়া পড়ছি।’
এগিয়ে চলে ওরা। নদীর কাছে এসে ওরা এদিক ওদিক তাকায়। এ সময় কাদের কথার শব্দ আসে! এত রাতে এখানে কারা! চমকে ওঠে ওরা। হঠাৎ ওরা ভয় পেয়ে যায়। কাঁধের বস্তা ধপাস করে ফেলে। ঝেড়ে দৌড় দেওয়ার আগেই শুনতে পায়, কেরে ওখানে? এই ধর, ধর! পেছনে শক্ত বুটের শব্দ ধেয়ে আসতে থাকে।
মহি মুহাম্মদ, শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক