মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ:
ক্লান্ত হাবিবের পা আর চলে না। দাদার আমলের সাইকেল নিয়ে রসিকজনদের মন্তব্য সে এনজয়ও করে।
সকালে ঘুম ভাঙার পরেই ওটার গায়ে তেল ডলাডলি শুরু। কালি, ময়লা থেকে ওকে রেহাই দেবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। তেল, গ্রিজ, মবিল এখন কমন জিনিস ওর জন্য।
দাদার সাইকেলটা ইতিহাস।
উপরে আকাশ।
নিচে মাটি।
মাঝের কাদামাটির পথ, ময়মনসিংহ শহরে দৌড়াতে হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন।
দৌড়ায়।
আর দৌড়ায়।
ক্রিং ক্রিং…ক্রিং ক্রিং…
প্যাডেলের মচমচানিতে পথের ধারে, ভাঁট-নিসিন্দা, আকন্দের ঝোঁপ-ঝাড়ে ঢুলু-ঢুলু কুনো ব্যাঙটার ঘুমের তালা ছুটে যায়। গ্রামের প্রান্তে বাঁশের সাঁকোটা সাক্ষী।
আশপাশের ঘরবাড়িতে পল্লিবিদ্যুতের আলো। শুধু এ-ই গ্রামের অন্ধকারটা প্রাচীন কুয়োর মতো গভীর। আলো জ্বালানোর আয়োজন হয়েছে অনেকবার। উপদলীয় কোন্দলের কারণে এখন যে যার উল্টোপথে হাঁটছে। আলো জ্বললে বাড়িতে টিভি আসবে। ঢেঁকির শব্দ থেমে যাবে। মা-চাচিরা ঘরে থেকে
বেরিয়ে পড়বে, বালিকাবধুর সংখ্যা কমে যাবে, স্কুল কলেজ, ক্লাব, নৈশ বিদ্যালয় বেড়ে যাবে— ইত্যাদি রকমের শংকা।
সাইকেলটা কয়েকবার হারিয়ে গেছে। আবার খুঁজেও পাওয়া গেছে। যতবারই হারিয়ে গেছে, ততবারই মাইকিং। ততবারই ওটা ফিরে পেয়েছে।
ভোররাত পর্যন্ত মা’ জেগে থাকেন, ছেলের ফিরতে দেরি হয়। টেবিলের ওপর ঠা-া হয়ে আসা ভাতের ওপর ডাল ঢেলে দেন মা। বাবার সাইকেলটা বেচে নতুন আরেকটা কিনতে বলেন। কারণ, কবে যে এক্সিডেন্টে না আবার শরীরটা পঙ্গু হয়।
হাবিব একাট্টা। সে বেচবে না।
এ-ই সাইকেলের প্যাডেলেই বাবার স্মৃতি। বাবার শিক্ষকতার জীবন কেটেছে। এর ওপর ধান, পাট, সরিষা, কচু, বেগুন সবাই চেপে শহরে গেছে। ছোট বোনেরা স্কুলে গেছে বাবার সাথে সামনে বসে। মাকে নানার বাড়ি থেকে আনতে গিয়ে এমনি করে তেল ডলে, ঘষে মেজে প্রস্তুতি নিতেন। বর্ষ, বন্যা, খরা, মহামারির সাক্ষী।
আজমতপুর গ্রামের রাস্তা আজকে আরসিসি ঢালাই। সাঁকোর পরিবর্তে কালভার্টের সংস্করণ। হাবিবের চলমান সময়ের দৌড়ে সেই পুরনো সাইকেল। এ-ই সাইকেল তার কাছে সহজ সরল একটা বিষয়। বিপদের বন্ধু। সাইকেলের সাথে কথা বলে। সাইকেল তার কথার জবাব দেয়। অন্ধকার রাতে একলা ভূতড়ে সড়কে, জোনাকজ্বলা রাতে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দে সাহস বাড়ে রাতে ফেরতা পথিকের।
সদরের কতিপয় অফিসার তাকে প্রচ- টানে। বিশ্বাস করে।ওর সাইকেলটাই বাড়তি আগ্রহ তৈরি করে রেখেছে। কোর্ট, থানা, এলজিইডি, পল্লি বিদ্যুৎ, ট্রেজারির বারান্দা মুখস্থ। রুমে রুমে তার সহজ সরল সংলাপ, ভাষায় মুগ্ধ সবাই।
নেতৃস্থানীয় সবাই তাকে বিশ্বাস করে।কোনো এলট,প্রজেক্ট, বরাদ্দ এলে তার পরিকল্পনা সবাই পছন্দ করে। কেবল কতিপয় অশুভ মানুষ এ-ই বিষয়টাকে পছন্দ করে না।
সবাই ভালোবাসে। কালিবাড়ি মোড়ের মনু মিয়ার নাস্তা, সালামের পান, বিষ্ণুদা’র কাঁচাগোল্লা সবাইকে এ-ই সড়কপথে যেতেই হয়।
একদিন অনেকা লোকজন এলো গ্রামে। হাবিবের সাইকেল নিয়ে কতো রসিয়ে রসিয়ে আলাপ। তারপর হাবিবের কথা রাখলো।
গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া ইলেক্ট্রিসিটি জ্বলে উঠেছে। ঘরে ঘরে সাপ্লাইয়ের পানি। রাইসকুকার, ওভেন এখন ওয়ান-টু। অথচ পুরনোরা একসময় সরকারি টিউবওয়েল বসাতে দেয়নি। খেতে সার বিষ দিতে দেয়নি।
প্রচ- বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছিল সেদিন। পূর্বাভাসেও ছিলোনা। হঠাৎ চাঁদ ঢেকে গেলো। তারপর টিপটিপানি বৃষ্টি। আবার বাড়াও শুরু হলো। বাড়তে বাড়তে ঝুমবৃষ্টি। বাংলায় কুকুর-বেড়াল বৃষ্টি বলাটা অযৌক্তিক হবেনা।
গুঞ্জরালীর বারান্দায় বসে পড়তে হলো। সাইকেল চালানোর ক্ষমতা থাকলেও বৃষ্টিতে ভিজে কাক হয়ে যাচ্ছে হাবিব। ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়ার বিষয়টা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। মশাদের উৎসব লেগেছে। দুই হাতে ঠুসঠাস চলছে। কিন্তু মশারা আজকে অপ্রতিরোধ্য। জোটবদ্ধ। জোট ভাঙার সম্ভাবনা আপাতত কম।
নারীকণ্ঠ শুনে অবাক হবারই কথা।
ভাইজান, একটু হুনবাইন?
আশপাশে চোখ বোলালো হাবিব।
গুমোট অন্ধকার, ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এই একটাই ঘর। এটির আগে পিছনে অনেকটা দূরের কয়েকটি ঘরের দরজা,শাটার বন্ধ। স্ব স্ব অবস্থান নিরাপদে রাখা আরকি। বৃষ্টিতে কাস্টমার নেই। সুতরাং নির্বিশেষে নির্বিকার সময় কাটানো। মোবাইল, তাস, লুডু এখনকার অনুষঙ্গ।
আবারো নারীকন্ঠ —
ভাইজান, ভয় নাই। আমি খারাপ মেয়ে-ছেলে না। বিপদে পড়ছি।
বিশ-বাইশ হবে, তরুণী। ভিজে ভিজে চুপসে উঠেছে।
কোথায় গেছিলেন এ-ই বিষ্টির মইদ্যে?–হাবিবের প্রশ্ন।
ভাইজান, আমারে রহমতপুরে পৌঁছায়া দিলে খুউ–উব উপকার হৈতো।
কিন্তু —।….
তরুণীর ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাতের ছোঁয়াতে হাবিব ভয় পেয়ে যায়। হাবিবের হাত চেপে ধরেছে। সাপের মতো ঠান্ডা। হাতটা কাঁপছিল ভীষণ।
আমি রানু, রহমতপুরের কফিলের মাইয়া। কিসমত গেরামে আমিনুল মাস্টারের বাড়িতে আমার বইনের বিয়া হৈছে। আইজ রাইতের মইদ্যে কিস্তির ট্যাকা না দিলে বইনের সংসারে আগুন লাগবো।
জটিলতার শেষ নেই মনে হয়।
হাবিব নিজেও বাড়িতে নির্বিবাদে ফিরতে পারছে না মুষলধারে বৃষ্টির কারণে। তৌহিদা বাড়িতে একদম একা। পাশের বাড়িতে বুড়ো এক চাচি। কতরকম সমস্যা। সমস্যা তো বলে কয়ে আসে না। সমস্যা ঘটে গেলে তার জেরবার বেশ ঘোরালো প্যাঁচালো। পথের মেয়ে। মানুষের চোখ, নাক, মুখ ভালোর ভালো। খারাপের খারাপ। রাতের সাইকেলে স্ত্রীকে বসিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেও গ্রাম, মফস্বলের জিহ্বা, চোখ এখনো যথেষ্ট টাটায়। বিব্রতকর প্রশ্ন, মন্তব্যের ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারাটাই সাধারণ হয়ে ওঠে।
ঠিক আছে, বসেন পেছনে। দেখি কতদূর কী করা যায়।
আমি পিছনে বসতে পারি না। সিজার হৈছে কয়দিন আগে।
একসাথে কষ্টও পেলো। হাসিও পেলো। হায়রে কিস্তিঅলা! তোদের মায়া-দয়া কবে আর হবে?
রানুকে সামনে বসিয়ে নিলো হাবিব। বৃষ্টিভেজা দুটো বিড়াল যেন তীব্র একটা সমূহ সংকটের সামনে। সমস্যার মোকাবেলা করতেই হবে।
একটু পরে পরে নামতে হয়ে। আবার প্যাডেল মারে হাবিব — চাকার ক্যাঁচক্যাঁচানী, ব্যাঙের ডাকে মাদকতা এনেছে। কিসমতের আমিনুল মাস্টারের বাড়িতে গিয়ে কিস্তির টাকাটা দিয়ে আবারও রহমতপুরের পথে ধরে ওরা। রাতে একটা অচেনা মানুষের সাইকেলে করে, বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে চুপসানো দুটি মানুষের জন্য সমালোচনা জোটার পরিবর্তে সহানুভূতিই জুটেছে। ওরা শুকনো কাপড়, গামছা, লুঙ্গি দিয়ে সহযোগিতা করলো। রাতে থাকার জন্য একরকম চেপেই ধরলো।
ততক্ষণে বৃষ্টিটা কমেছে। মেঘ সরে যাচ্ছে। আধমরা জোনাকির আলো নিস্পন্দ জ্বলে পড়ে আছে এখানে ওখানে।
হাবিবের প্রতি মায়া বসে গেছে সবার। রাতেই ডিম, মুরগী, মাছ, ডালের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা গেলোনা। বিদ্যুৎ নেই। মোবাইলটাও ডেড। ওদের কারো মোবাইল নিয়ে তৌহিদাকে ফোন দিয়ে বিষয়টা জানাতেই ওপাশ থেকে মনে হলো তৌহিদা ফোনটা কেটে দিচ্ছে।
একবার।
দু’বার।
কয়েকবার।
তারপরই বন্ধ।
বেচারিকে আগেই বাস্তবতা জানানোর দরকার ছিল। নিজেরই ভুল হয়েছে।
রাতে থাকার কোনো ত্রুটি ছিলো না। একরাতের সেবায় যেন আজকের হাবিব অন্যরকম ভালোবাসার আঙ্গিক অনুভব করে। রানু নিজে বিছানা গুছিয়ে, মশারি গুঁজে দিয়ে,মাথার কাছে চার্জার লাইট, পানি, গ্লাস রেখে গেছে। হাবিবের ভিজে চুপসে যাওয়া কাপড়গুলো ঘরে, বারান্দায় টানিয়ে দিয়েছে।
রাতে মোবাইলটা খোলাই রাখলো হাবিব। কোনো সংবাদ, ফোন আসতেই পারে।
নানান এলোমেলো চিন্তার ছন্দোময় দুলুনি ঠিক কখন যে চোখের পাতাকে ভারি করে দিয়েছে টেরই পায়নি।
চোখের পাতা যখন খুলেছে তখন সকাল। গতকাল যেন বৃষ্টির লেশমাত্র ছিল না।
সামনে দাঁড়ানো রানুর ছোট বোন।
রানুর কপি। তবে রানুর চাইতে একটু স্থূল।কিন্তু চেহারায় কমনীয়তা বেশ। বেগুনি কালারের ওড়নায় চেহারা আরো স্মার্ট লাগছে।
আমি শাওলি। আপু আপনের
উছিলায় আমারে বিপদ থাইককা উদ্ধার করেছে। আপনার এ-ই সাইকেলটা না থাকলে কী–যে হতো।
কী– আর হতো?
কী— না– হতো, বলেন? কিস্তির জন্য আমাদের পাড়ার জমিলা ভাবির ঘরদোর ভাইঙ্গা নিয়া গেছে। এরা খুবই ডেঞ্জারাস জিনিস।
আমাকে তোমাদের কিস্তিঅলার ফোন নাম্বারটা দিও তো। একটু বোঝনের আছে।
না, থাক। পরে আপনেও বিপদে পড়বেন।
ঘরে আলমারিতে বই।
এতগুলো বই!
সময় পাইলে পড়ি। এইটা ছুটু বেলার অভ্যাস।
ভালো।
হাবিব নিজেও বইপাগল। যা হোক আরেক পাগলের সন্ধান পাওয়া গেল।
সকালের নাস্তার সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা বেজে ওঠেছে।
কী-সর্বনাশ। চল্লিশটা মিসকল। একটা ম্যাসেজে— তুমার বৌয়েরে হাসপাতালে নিতাছি। বারান্দায় পিছলা খাইছে। পচ্চুর বেলাড যাইতাছে।–
মাথাটা চড়কির মতো ঘুরতে শুরু করেছে। কী– অন্যায়টাই না হলো তৌহিদার সাথে।
কী? কোনো খারাপ সংবাদ?– রানুর উৎকন্ঠিত প্রশ্ন।
বৌ হাসপাতালে। পিছলা খাইছে বারান্দায়। তিনমাসের —-
তাই নাকি! বলেন কী? তাহলে তো সর্বনাশ!
হাবিবের সজল চোখে রানু অন্য আরেক জলের ধারা টের পায়। শাওলিও ব্যস্ত হয়ে পড়ে —আপনে একদম চিন্তা করবেন না। আমরাও যাবো।
সাইকেলের ওপর দিয়ে গতরাতে ব্যাপক নির্যাতন গেছে। নতুন করে তেল ডলাডলির সময় নেই হাতে। প্যাডেল মারে। কিন্তু সবকিছুই যেন মরচেধরা। যেন সাইকেলটা আজ বাতে ধরা বৃদ্ধ। একদম বিট্রে করে বসে আছে।
শাওলি ভেতর থেকে একটা বাইক বের করে।
কোনো টেনশন নাই। আপাতত ওই বাইসাইকেল অফ করেন। ও-ই মালের ঠিকানা অহন মিলন ভায়ের ভাঙ্গারি।
কিন্তু আমি তো বাইক চালানো শিখি নাই।
তা—র দরকার নাই। আমি চালামু। আপনে কেবল ঠিকমতো বসেন।
সময় কম হাতে।
তৌহিদাকে উদ্ধারের জন্যই আজকে শাওলির সাথে সদর হাসপাতালে যেতে হবে।
শাওলি নিজে একটা, হাবিবের মাথায় একটা হেলমেট চাপিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়।
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক