মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্
ব্রিজের মোড়ে যাত্রীর চাপ আকস্মিক বেড়ে যায়।’চায়না ব্রিজ’ নামে যার শুরু। চীনারা এটি বানিয়ে দিয়েছিল। আগে ট্রেনে কিংবা বাসে গেলে ব্রহ্মপুত্র ক্রস করতে হতো ফেরিতে,কিংবা নৌকোয়। লম্বা সময়টার দাফন কাফন হতো। বর্ষায় আবার ব্রহ্মপুত্রের বিশাল পানির স্রোতের বিপরীতে চলা। শ্যালোনৌকো, ছোট লঞ্চ এখন কল্পনায় পর্যবসিত।
সেটা ছিল আশির দশকে।
এখনকার প্রজন্মের সামনে কেবল উদাহরণ। ময়মনসিংহ তখনও জেলা সদর। নদের ওপর নান্দনিক একটা ব্রিজের কারণে দূরত্ব কমে যাওয়ার মতো উপকারটা হয়েছিল উত্তর বনাম দক্ষিণের। স্বাধীনতার স্মারক স্থাপনা,ম্যুরালের কারণে জায়গাটা আরও নান্দনিক হয়ে উঠেছে।
কিন্তু লোকজন কালক্রমে সংক্ষেপে চায়না ব্রিজ না বলে ‘বিরিজ’ বলতে শুরু করেছে।
চায়না ব্রিজ খুবই কম প্রচার পেয়েছে।
সারাদিনে পরিশ্রান্ত উত্তর ময়মনসিংহের ঘরফেরতা যাত্রীদের অনেকেই বগলে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরাট বিরাট খামের ভেতর বহুবিধ রিপোর্ট জাপটে ধরে সিএনজি,অটো,মাহেন্দ্র,কিংবা বাসের প্রত্যাশায় উৎকন্ঠায় থাকে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ রোগীদের অল্প আয়ের মানুষ এম্বুলেন্স, মাইক্রো,প্রাইভেট কার ভাড়া নিতে ব্যর্থ। তাই অটো,মাহেন্দ্র,সিএনজি এগুলোই ওদের কাছে প্রাইভেট কার।
ব্রিজের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে বাহনগুলো ছাড়ে। একসময় ব্রিজের ওপর সোডিয়াম বাতি ছিল। পরে নিয়ন বাতি,এলইডি এসেছে। গিজগিজানো ভীড় দুপাশেই।পরবর্তীতে এটা জ্যামের উদাহরণ হতে পেরেছে। ঢাকা থেকে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টায় চলে এসেছেন,কিন্তু ব্রিজের জ্যামে পাকা দু’ঘন্টা। ঈদ-পুজা পরবে তো বিশ্ব বিখ্যাত জ্যামের তালিকায়।
গল্পের ছেলেটার নাম ফানুস।অনেকেই তার দৈনিক সহযাত্রী।
তাদেরকে আরও অনেকটা পথে পা বাড়াতে হবে,এবং বাড়ি পৌঁছুতে হবে। ড্রাইভারগুলো যাত্রী সাধারণের মনস্তাত্ত্বিক দিকটা বেশি করে আমলে নিয়ে ভাড়া ইচ্ছেমাফিক চায়। কেউ মনে করেন, এটা যৌক্তিক, কারো কাছে এটাকে বাড়াবাড়ি মনে হয়।
আর তাতেই বচসা,অপ্রীতিকর মনের বিষক্রিয়া,ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।
অনুষ্ঠান প্রবণ বাঙালির বুধবার,বৃহস্পতিবার,শুক্রবার,শনিবার সপ্তাহের তিন চতুর্থাংশই বরাদ্দ। বেড়ানো, বিয়েশাদি যেন শেষ হতেই চায় না। জ্যামও ‘বিরিজ’ কে ছাড়ে না।
ফানুস প্রতিদিন শহরে দৌড়ায়। একটা ছোটো চামড়ার ব্যাগে বিভিন্ন মাপের স্ক্রু,সুপার গ্লু,তারকাটা,ওয়াল ক্লিপ, স্ক্রু-ডাইভার,ক্রস মার্তুল,তার,স্কচটেপ সহ আনুষঙ্গিক সামগ্রীতে ঠাসা।
সকালে বের হয়। মাইল দুয়েক হাঁটা,তারপর অটো,তারপর বাসে ময়মনসিংহ ‘বিরিজ’।
সারাদিন এ’বাসা ও’বাসায় খুঁটখাঁট কাজ। ইলেকট্রনিক, ইলেক্ট্রিক সমস্যার সমাধান তার কাছে। তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে যে যা-ই দেয়। ঢোলা শার্টের দুটো ঢাউস পকেটে ভরে। সারাদিনের পাওয়াটা লুফে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে অশেষ তৃপ্তি।
অসুস্থ মা’র সামনে ঢেলে দেয় অনেক টাকা। অকাতরে মাছ-তরকারি,সংসারের দৈনন্দিন উপকরণ,মায়ের ঔষধ,প্যারালাইজড দাদার ঔষধ,চার বছরের বাবা হারা ভাতিজির চকোলেট। বন্ধুর বিপদ আপদ। প্রতিবেশির বৈষয়িক ঝামেলা।
শেষ পর্যন্ত হাত সাফাই হয়ে যায়। নিজের শার্টের বোতাম লাগানো আর হয় না। জূতোর ওপরের আস্তর হয়ে যায় বিবর্ণ। জুতো কালি করার তাগাদা দিয়ে রবিলাল বলে, দেন ছাব, কালি কইরা দেই।একদম কালার উইঠা গেছে।
থাক,আরেকদিন।
কী যে কন ছাব। টেকা লাগবনা। আরেকদিন দিয়েন। দেন তো। কালি কইরা দিলে ম্যালা ইস্মাট লাগব।
দাদীর দেয়া নাম— ফানুস।
স্কুলের গণ্ডি টপকিয়ে ফানুস হতে পারেনি।
একরোখা,ব্রেনে কাজ করেনা,স্কুলের নিয়ম কানুন ভাল্লাগেনা,ইত্যাদি অপবয়ান তার কপালে জুটেছে। ক্লাস ছেড়ে খালি টো,টো।সারাদিন পুরনো মোবাইল,ঘড়ি সংগ্রহ করে। ওগুলো ভাঙে। পার্টস খুলে এলোমেলো করার নেশা। ফাহিম স্যার অবশ্য বলেছিলেন,ফানুস একটা এক্সট্রা অর্ডিনারী ছেলে।
মায়ের আপসোস, ছেলেডা আমার মানুষ হৈল না।
মাদ্রাসায় চেষ্টা চলেছে। কালেকশন নিয়ে তার যৌক্তিক প্রতিবাদ টেকেনি। মাদ্রাসার আঙ্গিনা ছাড়তে হয়েছে। বিশেষ করে বড় ওস্তাদের আপত্তিকর অত্যাচারে মরে যাওয়া ছোট্ট মইনুলের হলুদ,হিম হয়ে আসা মুখটার ছবি একদম ভালো লাগেনি ফানুসের কাছে। এভাবে মানুষ মানুষকে মেরে ফেলতে পারে!
এখন ফানুস প্রতিদিন সকালে বের হয়ে রাতে ফেরে বাড়িতে।
অনেকে বলেছে,মিঁয়াহ,একটা বাইক কিন্যা ফালাও। তোমার তো এখন ট্যাহার অভাব নাই।
কী যে কন,মায়ের অষুধের ট্যাহাই ত সাপ্তায় সাত-আট হাজার,কারেণ্ট বিল,গ্যাসের সিলিন্ডার,অয়াইফাই,হাট-বাজার-।
ফানুসের কথার মাজেজা কেউ বোঝে। কেউ বোঝেনা। কেউ বোঝার চেষ্টাও করেনা।
রাতের বিরিজে পিঠার গন্ধ,ফলের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধ, রেক্টির গন্ধ,তৃতীয় লিঙ্গের মেকাপের গন্ধ,সব কিছুর মধ্যে গাঁজাপোড়ার গন্ধ এখন নৈমিত্তিক বিষয়।
সব কিছুই স্তিমিত হয়ে এসেছে।
বাস দু’একটা অল্প সময় নিয়ে দাঁড়ায়। ঢাকার বাসগুলো অনেক সময় এখানেই স্টপ। নেত্রকোনা,হালুয়াহাট, শেরপুরের ট্রিপ ছেড়ে দেয় ওরা। ঢাকা থেকে আসা যাত্রীরা বিরক্তি নিয়ে নেমে পড়ে। এম্বুলেন্সের কুঁই কুঁই শব্দ বুকের ভেতরে ঘাই মারে। কে জানে,কার অন্তিম বাড়ি ফেরার শব্দ! অথবা কারও পরিবারের নবজাতকের সুকোমল শরীর নিয়ে অনাগত সম্ভাবনাটি বাড়ি ফিরছে। আবার তার বিপরীতটাও হতে পারে। কোনো হাসপাতালে বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার অভিমুখে তার যাত্রা। সফলতা,ব্যার্থতা নিয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। তবুও বাঁচতে চায় নশ্বর পৃথিবীর খরখরে মাটিতে। যে বিজ্ঞান মানেনা, সে ও বাঁচার ইচ্ছায় ডাক্তারের কাছে যায়। বিধর্মীদের তৈরি ঔষধ কেনে,সেবন করে,সিজার অপারেশন করিয়ে বাচ্চা ডেলিভারী নেয়।
ফানুসকে এক সিএনজিঅলা ডেকে বসিয়ে চিৎকার করছে–
আসেন গাছতলা, কাশিগঞ্জ। তাড়াতাড়ি উডেন। যামুগা। রাইত অইছে।
ফানুসকে বসিয়ে রেখে সে নতুন যাত্রির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।
তের-চৌদ্দ বছরের টিঙটিঙে কিশোর। হয়তো তারও এমনই ধারার একটি জীবন। সিএনজি চালক হওয়ার পেছনে কোনো মর্মান্তিক ইতিকথা আছে।
দেড় ঘন্টা শেষ। ছেলেটা ফিরে এসেছে। সাথে পাঁচ জন লোক।
ভাইছাপ,আপনে যুদি রাগ না করুইন অন্য গাড়ি দিয়া যান। আমি পাঁচজন পায়া ফালাইছি। হেরা একলগে যাইব।
দেড় ঘন্টা পরে এ-ই কাহিনি! ফাইজলামি পাইছো ! ঘাপটি মাইরা বইসা রইছি। এতক্ষণে এ-ই কতা?
আমার ইকটুক উপকার অয় ভাইছাপ। আপ্নের পাও দুইডা ধরি।
লোকগুলো বললো,ভাইজান,আমরা জরুরি রুগী দেকতে যাইতাছি। রুগীর জবাব বন্দ। আমাগর দাদা। শেষ দেহাডা দেকতে যাইতাছি।
ফানুস নিজেকে বেশ আটকে রাখে। নেমে যায়। সংযত হয়ে নিজেকে গর্বিত গর্বিত লাগে।
রোগীর জবাব বন্ধ। সত্যিই তো। ওদের আকাঙ্ক্ষার প্রায়োরিটি দেয়া দরকার।
মানুষগুলোর যদি একটু উপকার হয়, হোকনা।
নেমে আসতেই ঢাকা ফেরত খালি বাসটাও সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে গেল। ভালো একটা সিটে ও বসলো। জানালা দিয়ে নীচে সুমাইয়ার মায়ের চিতই পিঠা,সর্ষে বাটা কিনে নিলো। আয়েস করে সর্ষে বাটা দিয়ে চিতই খায় ফানুস। জানালার ওপাশে বিদায়ী বিরিজ। পাশ দিয়ে টুকটাক গাড়ির দৌড় উপভোগ করে। তখনও কতিপয় অপেক্ষা করছে যদি শেষ বেলার যাত্রী মেলে,তাহলে বিছানায় পড়া কাবুল ভায়ের জন্য সোয়েটার, কিস্তিটা দিতে পারে।
বাস ছেড়ে দিয়েছে।
সিএনজিতে রেখে আসা সেই পাঁচজন এ’বাসেও উঠে এসেছে। দেখে মনটা তেতে উঠলো ফানুসের।
কী ব্যাফার! আপনেরা বাসে ক্যান? ইমার্জেন্সি বইল্লা সিট ছাইড়া দিয়া আসলাম।
সিএনজির ছেলেটা পেছন থেকে চিৎকার করছে—
ভাইজান,আমারে মাইরেন না। আপনাগো জইন্য একজন প্যাসেঞ্জার ছাইড়া দিছিলাম।
এক পর্যায়ে তার মুখে শ্রাব্য,অশ্রাব্য ভাষার অপপ্রয়োগ চলছে।
ফানুসের মনে হলো,
না এর একটা জবাবদিহি চাই-ই, চাই।
পরক্ষণে মনে হলো, গ্যাঞ্জাম বাড়ালে সবারই ক্ষতির কারণ হবে। রাতের গ্যাঞ্জাম ভালো না। উল্টাপাল্টা ঘটনা ঘটতে পারে। আর পুলিশ বাবাজিকে সেলাম। আন্দাজে কই থাইক্কা কই লইয়া যায়।
বাস পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ওপর ব্রিজে উঠে এসেছে ততক্ষণে।
দুপাশে শীর্ণায়মান নদের বুকে শীতল স্পর্শময় উপুড় হয়ে থাকা আকাশটা ঢুলতে শুরু করেছে।
নেমে গেছে ফানুস।
বাসের কন্টাক্টর তেঁতে উঠে জিগ্যেস করে,
আপনের আবার কী অইল?
নাহ। বাসে যামুনা।
এবার কন্ট্রাক্টরের তেঁতো ঝাল মিটানো বকাঝকা —
কানা নাকি!আগে দেইক্ষা উঠেন নাই?
জবাব দেয়ার সময় নেই ফানুসের।
সে ও-ই সিএনজিঅলা কিশোরটার কাছে গিয়ে হাঁক দেয়—
কীরে যাইতি না!
ক্যামনে যামু? দেখছেন তো ঘটনাডা কী করলো। হালারা খাইস্টা।
ঠিক আছে,যাও রিজার্ভ যামু।
কিশোর তাকে জাপটে ধরে। বিরাট উপকার করলেন বড়ভাই।
তার গায়ের গন্ধটা একটু ক্যামন যেন।
সন্ধ্যার ঘুমসিতে বেশ ক’বছর আগের সেই মৃত ছোট ভাই রুবেলের গায়ের গন্ধ পাচ্ছিল ফানুস।
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, গল্পকার, নেত্রকোনা