এখন সময়:রাত ৮:১৪- আজ: শনিবার-১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ৮:১৪- আজ: শনিবার
১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

চন্দন আনোয়ারের গল্পে মুক্তিযোদ্ধাত্তর বাস্তবতা

স্বপ্না সুরাইয়া :

চন্দন আনোয়ারের গল্পে মুক্তিযুদ্ধে গণজাগরণ ও বৈপ্লবিক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের চিত্র, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির উত্থান ও মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশার চিত্র ফুটে উঠেছে অসাধারণ শিল্প নির্মাণ-দক্ষতায়। লেখকের জিজ্ঞাসু চোখ, তীক্ষ্মবিচারবোধ ও ভাষার শক্তির দ্বারা তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পগুলো হয়ে উঠেছে অনবদ্য। তাঁর গল্পে স্বাধীনতার সপক্ষীদের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা এবং বিপক্ষীয়দের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। চন্দন আনোয়ারের গল্পে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কোনো চিত্র নেই, কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী মানুষের জীবন সংগ্রাম, বহুমাত্রিক সংকট ও সমস্যা, যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া, দেশ গড়ার এবং নতুন সমাজকাঠামোর জন্য নবতর যুদ্ধের চিত্র আছে। এ জাতীয় গল্প সম্পর্কে তাঁর নিজের মন্তব্য :

আমি লিখতে চেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি, ত্যাগ ও প্রত্যাশার বিপরীতে আমাদের অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রকৃত বাস্তবতা কী? হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতা তুলে ধরতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক হিসেবে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহ এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের মতো বিরাট একটি ঘটনা, এত বড় এবং ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে দেশটির জন্ম হয়েছে,

anderkilla.com

সেই দেশের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে আমার যে প্রত্যাশা ও স্বপ্ন সেই জায়গাটি মারাত্মকভাবে ক্ষত-বিক্ষত, জরা-জীর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আমার প্রত্যাশার জায়গাটিকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি। [সাক্ষাৎকার]

এ পর্যন্ত প্রকাশিত চন্দন আনোয়ারের গল্পগ্রন্থ ৬টি: ১. প্রথম পাপ দ্বিতীয় জীবন; ২. অসংখ্য চিৎকার;  ৩. পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর; ৪. ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ ; ৫. ইচ্ছামৃত্যুর ইশতেহার;  ৬. আঁধার ও রাজগোখরা। এছাড়া ৩০টি নির্বাচিত গল্প নিয়ে কলকাতার বিখ্যাত প্রকাশনী একুশ শতক থেকে ‘নির্বাচিত ৩০’ এবং ৫০টি নির্বাচিত গল্প নিয়ে ঢাকার  বিশ্বসাহিত্য ভবন থেকে ‘বিশেষ ৫০’ শিরোনামে দু’টি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ‘অসংখ্য চিৎকার’, ‘পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কন্ঠস্বর’, ‘কবি ও পাবলিক’, ‘পালিয়ে বেড়ায় বিজয়’, ‘একটি পুকর মরে যাচ্ছে’, ‘ইঁদুর নিধন প্রকল্প’ প্রভৃতি গল্পের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাস্তবতা।

‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্পটিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিকোণ থেকে। এ গল্পে দেখা যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তরুণ প্রজন্ম সংগঠিত ও সোচ্চার হচ্ছে, প্রমাণ জোগাড় করছে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি নিয়ে ঢাকায় শাহবাগ চত্ত্বরে জোরালোভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তাদের সুতীব্র আন্দোলনের মুখে যুদ্ধাপরাধী আইন পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় সরকার। তার পূর্বেই ২০১১ সালে চন্দন আনোয়ার তাঁর লেখনীর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ হতে ডাক দিয়েছিল ‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্পে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন;

ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমি কিছু করতে পারছি না, কিন্তু প্রতিবাদ তো জানিয়ে রাখতে পারি। কে জানে, কোনো একদিন হয়তো আমার কাক্সিক্ষত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। হয়তো আমি তখন পৃথিবীতে নাও থাকতে পারি। ২০১১ সালে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি নিয়ে ‘অসংখ্য চিৎকার’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম। গল্পটি প্রথমে ভোরের কাগজে, পরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েটি পত্রিকায় ও সংকলিত বইয়ে বেরিয়েছে। এই গল্পে আমি দেখিয়েছি, তৃণমূল থেকে অর্থাৎ সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি জোরালোভাবে না উঠে আসলে সংসদমুখি ক্ষমতাপ্রিয় রাজনৈতিক দলের সরকারেরা কিছুতেই যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে না। বাস্তবে দেখেছি কি, যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হলো। ঠিক তখনি তরুণ সমাজ রাস্তায় নেমে এলো, তাদের অসংখ্য কণ্ঠের চিৎকারে প্রকম্পিত হলো দেশ। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করতে বাধ্য হলো সরকার। আপনাকে বলবো কি, শাহবাগের অসংখ্য কণ্ঠের চিৎকার রাজশাহীতে আমার বুকে এসেছে বেজেছে, আর আমি এইভাবে ভেতরে ভেতরে উল্লসিত হয়েছি যে, আমি ঠিক এমন একটি জাগরণই চেয়েছিলাম। আমার ‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্পটির কথা বার বার মনে হচ্ছিল। (সাক্ষাৎকার)

মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় পাকহানাদার বাহিনী অসংখ্য বাঙালি নারীদের নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা করে ডোবা-নালায় পুঁতে রেখেছিল। কিন্তু যুদ্ধে বিজয় লাভর পর স্বাধীনতা বিরোধীরা দেশপ্রেমের মুখোশ পরে সুবিধা নিতে থাকে। যে সব ঘাতকেরা মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করেছে তারাই আবার দেশের স্বাধীনতাকে গিলে খেতে নাগরিকত্ব নিয়ে রাজনীতিতে নেমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং বিভিন্ন কৌশলে তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। সেই সব ভ-, প্রতারক সমাজসেবীর মুখোশ উন্মোচন করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি ‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্পের বিষয়। গ্রামের স্কুলমাস্টারের মেয়ে কলেজ পড়–য়া নাসরিন তার সহপাঠীদের নিয়ে সাহস ও দৃঢ়তার সাথে মুখোমুখি হয়েছে এক স্থানীয় প্রভাবশালী যুদ্ধাপরাধীর।

গল্পপাঠে দেখা যায়, শহর থেকে আগত কিছু তরুণ গহরডাঙা গ্রামে এসে বুড়ো বটগাছের ছায়ায় নামল। তারা একত্রিত হয়ে হাত ধরাধরি করে দাঁড়াল পরিত্যক্ত ডোবাটার পাড়ে, যেখানে যুদ্ধাপরাধী জমির খাঁর পাপের প্রমাণ লুকিয়ে আছে। বিস্তৃতির গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ডোবাসদৃশ বধ্যভূমি আবিষ্কার করে সাতটি লাল নিশানা দ্বারা স্থানটিকে চিহ্নিত করে তারা। সাতটি লাল নিাশানাকে প্রতীক করে গল্পকার হয়তো সাত কোটি বাঙালিকে বুঝিয়েছে, যারা চিহ্নিত করতে চেয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতককে।

নতুন এক বিস্ময় আর অদ্ভুত আতঙ্ক তৈরি হয় গ্রামের মানুষের মনে। ছেটি-বড় সবাই নিশানাগুলোর ওড়া দেখতে আসে। লাল নিশানা আবার যুদ্ধের ডাক দিচ্ছে কিনা এমনি জিজ্ঞাসা মানুষের মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। নানা রকম গুঞ্জনও দেখা দেয়। উত্তাল বাতাসে পতাকাগুলো উড়তে দেখে স্বাধীনতাবিরোধী জমির খাঁ আতঙ্কিত হয়। স্বাধীনতার পর দেশপ্রেমের মুখোশ পরে স্বাধীনতার শত্রু জমির খাঁ দু’বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান। খুব দাপুটে মানুষ। এতদিনে তার কুকর্ম চাপা থাকলেও নতুন প্রজন্মের ঐক্যবদ্ধ নতুন নিশানা উড়ানোর মধ্য দিয়ে পুরানো ইতিহাস আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। জমির খাঁ বুঝতে পারে এই নিশানার মাধ্যমে তার মুখোশ উন্মোচন হবে। কেননা তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রধান প্রধান যুদ্ধপরাধীর বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য তরুণ সমাজের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি উঠেছিল। আগামী মৃত্যু ভাবনায় বিচলিত, ভীত সন্ত্রস্ত জমির খাঁ রাতের দ্বিপ্রহরে সুলায়মান মাস্টারের বাড়িতে তার মেয়ে নাসরিনের কাছে করুণা প্রার্থনা করে, ‘তুমি আমার মেয়ের মতোন। এই গ্রামের মেয়ে। এতবড় সর্বনাশ তুমি করো না, মা।’ সুলাইমান মাস্টার অবাক হয়ে লক্ষ করে;

আকাশের চাঁদটা এক খ- মেঘের ভারে যেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে, নাসরিন সামনে আসতেই ঠিক তেমনিভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে জমির খাঁর মেদবহুল শরীর। গহরডাঙার বিশাল সূর্যের মতো মানুষটিতে যেন গ্রহণ লেগেছে। ভয়ানক কাঁপুনি দিয়ে কাঁপছে। নাসরিন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। জমির খাঁ মাথা নিচু করে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি হিসেবে খানসেনাদের সাথে আঁতাত করে জমির খাঁ বাঙালিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছিল। তার তা-বলীলার সাক্ষ্য বহন করে আছে গহরডাঙা গ্রামের মস্ত একটা পুকুর। সেটা ঊনচল্লিশ বছরে ভরাট হয়ে ডোবায় পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পাকবাহিনীর সহযোগী হয়ে জমির খাঁ ডোবায় ফেলে মাটি চাপা দিয়েছে অসংখ্য তাজা প্রাণ, অসংখ্য ধর্ষিতা নারীর মরণচিৎকার। তখন ডোবাটাকে বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছিল জমির খাঁ। সত্য চাপা দেওয়ার প্রয়াসে ডোবাটাকে গুপ্তধনের মতো লুকিয়ে রেখেছিল। স্বাধীনতার বহুবছর পর স্তব্ধ চেতনার বীজ জেগে উঠলে জমির খাঁ নদীর পাড় ভাঙার মতো ভেঙে পড়ে। ফাঁসির দড়ি তাড়া করছে জমির খাঁকে।

চন্দন আনোয়ার গল্পের মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরোধী চিহ্নিত করার জন্য, সকলকে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করার জন্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। গল্পে নাসরিন আপামর জনতার প্রতিনিধি। সে মানুষের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার প্রতিটি স্বরতন্ত্রে বেজে উঠেছে প্রতিবাদী সুর। তার ঘৃণামাখা কণ্ঠে জমির খাঁর উদ্দেশ্যে এক সর্বজনীন প্রশ্ন: ‘পশুদের ক্ষুধার খোরাক জুগিয়ে কয়টাকা পেয়েছিলেন? আপনার মা-মেয়েকে ওদের কাছে পাঠাননি কেন?’

জমির খাঁ গোঙানির আওয়াজ তুলে সেখান থেকে চলে গেল। বিচারের পূর্বেই যেন মৃত্যু তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পুরনো পাপের ছবি তার চোখের সামনে ছায়ার মতো ভাসছে। অসংখ্য ধর্ষিত নারীর চিৎকার তাকে অস্থির করে তুলে। আসন্ন বিচারের ভয়ে আতঙ্কিত জমির খাঁর শেষ পরিণতি গল্পের সমাপ্তিতে অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতায় গল্পকার ফুটিয়ে  তুলেছেন।

জমির খাঁ ভয়ানক একা হয়ে পড়েছে। অহর্নিশি ফাঁসির দড়িতে ঝুলন্ত একটি লাশের ছায়া চোখে ভাসে। নিজেকেই প্রশ্ন করে-লাশটি কার?  ভুল করে দুপুর রাতে ডোবাটার নিকটে ছুটে যায়। সেখানে যেন একটা বেওয়ারিশ লাশ পড়ে আছে। জানাজা হয়নি। কবর হয়নি। লাশটাকে ঘিরে এক ঝাঁক শকুনের উল্লাস। শকুনের শরীরের কদর্য কালিমায়, বক্র ঠোঁটে, কুটিল চোখে, তীক্ষè নখের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন করছে লাশটাকে। নিজের শরীরে লাশের গন্ধ। অসংখ্য লাশ ডোবাটার  ভেতর থেকে উঠে আসছে। তাড়া করছে কাউকে। ভয় পেল জমির খাঁ। প্রাণভয়ে দৌড় দিল। এবার অসংখ্য যুবতী চিৎকার করতে করতে ডোবাটা থেকে উঠে আসতে লাগল। ওদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে লাল নিশান। যুবতীদের চেহারা বীভৎস। কারো স্তন নেই, কারো স্তন থ্যাতলানো, কারো চোখ বেরিয়ে ঝুলে পড়েছে, কারো বুকে-পিঠে নখ-দাঁতের নকশা কাটা, কারো আবার যৌনাঙ্গ ফেটে রক্ত বেরুচ্ছে!

‘অসংখ্য চিৎকার’ গল্পটিতে চন্দন আনোয়ার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চেতনার স্বরূপ দেখিয়েছেন। অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করলে চিরকালই স্বাধীনতা বিরোধীদের নির্যাতনের শিকার হতে হবে। বাস্তববাদী লেখক তাঁর শাণিত কলমের মাধ্যমে গণ-আন্দোলনের ডাক দিয়ে যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে এবং বাঙালি জাতিসত্তাকে কলঙ্কমুক্ত করে মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে ফুটিয়ে তুলেছে।

চন্দন আনোয়ারের ‘পালিয়ে বেড়ায় বিজয়’ গল্পে মহান মুক্তিযুদ্ধ পঙ্গু হয়ে যাওয়া রহম আলির করুণ কাহিনি নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষে স্বাধীনতা বিরোধী দালালেরা দেশপ্রেমের মুখোশ পরে রাজনৈতিক অনুকূল্য পেয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে আমু- গ্রাস করে ফেলে যুদ্ধাপরাধী ঘাতকেরা।  বিপরীতে, মুক্তিযোদ্ধারা হারিয়ে যায় হতাশা অতল গহ্বরে। চন্দন আনোয়ার গল্পটিতে মূলত পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক উত্থান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক দুর্দশা সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ নস্যাৎ করার চিত্র ফুটিয়ে তুলেন। শওকত আলীর ‘পুনর্বার বেয়নেট’ গল্পে পাকিস্তানী হানপাদার বাহিনীল বর্বরতা চোখের সামনে পরিবারের লোকজনকে নৃশংসভাবে নিহত হতে দেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল।  চন্দন আনোয়ারের ‘পালিয়ে বেড়ায় বিজয়’ গল্পটিতে মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি যুদ্ধের সময় তার গ্রামের ছানা মিয়া রাজাকারকে হিন্দুবাড়ি লুট করতে দেখে স্থির থাকতে না পেরে মুক্তিবাহিনীতে নাম লিখেয়েছিল। পাক হানাদার বাহিনির পথ রুদ্ধ করতে ব্রিজ উপড়ে ফেলবার জন্য রহম আলি তার মুক্তিবাহিনি নিয়ে বেনাপোল গিয়েছিল। অন্ধকারে কিছু বুঝে উঠবার আগেই গুলি এসে হাঁটুতে লাগে। সেই থেকে রহম আলির এক পায়ের শক্তি হারিয়ে পঙ্গু। অভাব-অনটন, জীবিকার তাগিদে তেত্রিশ বছর ধরে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ডিম বিক্রি করে। স্ত্রী জরিনা আলসারের রোগী। বড় ছেলে ঢাকা গার্মেন্টসে কাজ করে আর ছোট ছেলে গ্রামে ভ্যান চালায়। স্বাধীন দেশে মহান মুক্তিযোদ্ধা রহম আলিকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘ল্যাংড়া রইম্মা’। রহম আলি দেশকে স্বাধীন করবার জন্য মুক্ত করবার জন্য পা হারিয়েছে। তার পায়ের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা দেশ স্বাধীনের অংশ পরেই চলে যায় স্বাধীনতা বিরোধীদের দখলে। রহম আলি কিছুতেই এটা মেনে নিতে পারে না। আত্মযন্ত্রণায় ছটফট করে।

এখন বুক ফুলিয়ে ওর সামনে দিয়ে বেশি বেশি করে হাঁটে ছানা মিয়া। মাঝে মাঝে পঙ্গু ঠ্যাঙের দিকে কেমন তাচ্ছিল্যের চোখে তাকায়। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে মুচকি মুচকি হাসে। কোনোদিন যাবার সময় ডিমের ডালার কাছ ঘেঁষে পানের পিক ফেলে যায়। পিকের ছিটেফোঁটা এসে পড়ে রহম আলির চোখে-মুখে। তখন রহম আলির ইচ্ছে হয় থুতু ছিটাতে। সে পারে না। কেননা রাষ্ট্রের ক্ষমতার হিস্যা আছে এখন ওদের। ওদের দলের লোক মন্ত্রী-এমপি। গাড়িতে পতাকা উড়ে পত্পত্ করে; যে পতাকা কেনা হয়েছে রহম আলির পঙ্গু ঠ্যাঙের বিনিময়ে। ওদের দলের বড় বড় ডিসি এসপির অভাব নেই।

স্বাধীনতা বিরোধী ছানা মিয়ার রাজনৈতিক শক্তির কাছে মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি অসহায়। ক্ষমতার খেলায় সুযোগ সন্ধানী ছানা মিয়া সময়ের বিবর্তনে হয়ে উঠেছে দেশ প্রেমিক নেতা। যে কিনা যুদ্ধের সময় হিন্দু বাড়ি লুট করে বিত্তশালী। সমস্ত ক্ষমতা মান-সম্মানের ভোগ দখল নিয়ে আছে ছানা মিয়ারা।  যেদিন রহম আলির সাথে ছানা মিয়ার দেখা হয়, সেদিন চরম অস্থিরতায় রাত কাটে, ঘুম হয় না। তখন রহম আলির মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর মতো কেউ  দ্বিতীয়বার  মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলে এবার প্রথমেই ছানা মিয়ার বুক গুলি ঢুকিয়ে দিতো। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা রহম আলির আক্ষেপ ক্রোধ মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিশ্চিতভাবে। এখানে চন্দন আনোয়ার দেখিয়েছেন যে, যে স্বাধীনতার জন্য রহম আলি যুদ্ধ করেছিল সেই কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা আসেনি। হাসান আজিজুুল হকের ‘ফেরা’ গল্পে কিংবা সেলিনা হোসেনের ‘ভিটেমাটি’ গল্পে স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থান এবং তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায়ত্বের কথা মনে পড়ে। তেমনি ‘পালিয়ে বেড়ায় বিজয়’ গল্পে যুদ্ধপরাধী ছানা মিয়ার দাপটে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি অসহায়। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধা রহম আলির খবর কেউ রাখেনি। তীব্র অভাব অনটন ছানা মিয়ার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, পরিবারসহ মানবেতর জীবন-যাপনের চিত্র আমাদের সচেতন বিবেককে নিষ্ঠুরভাবে আক্রমণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধে রহম আলির স্যাক্রিফাইসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দল ও যুদ্ধপরাধীদের সমন্বয়ে গঠিত সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের আসল স্বরূপ লুকিয়ে কৌশলে রহম আলির মতো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা আয়োজন করে। এই সংবর্ধনার আড়ালে যে সরকারের তথা স্বাধীনতা বিরোধীদের গোপন উদ্দেশ্য ও স্বার্থ লুকিয়ে আছে, এবং প্রকারান্তরে এই সংবর্ধনা মুক্তিযুদ্ধ ও রহম আলিকে বরং অপমান ও তাচ্ছিল্যই করার ষড়যন্ত্র, রহম আলি বুঝতে পারে। এছাড়া, লোভ-প্রাপ্তির জন্য রহম আলি যুদ্ধে যায়নি, দেশ স্বাধীন করতে, ছানা মিয়াদের হাত থেকে মুক্তি পেতে যুদ্ধে গিয়েছিল। আত্মযন্ত্রণায় ভূগতে থাকা রহম আলী স্বাধীনতা বিরোধীতাদের এই সংবর্ধনাকে মনে প্রাণে ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে রোজ আসে রহম আলির কাছে। কেউ বিদ্যুতের দাবি করে, কেউ ন্যাশনাল ক্লাবের অনুদান, এমনকি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরল হুদা তার মেম্বার পরিষদ নিয়ে রাস্তা সংস্কারের জন্য গম বরাদ্দের কথা বলে রহম আলিকে, যেন মন্ত্রীকে অনুরোধ করে ব্যবস্থ্ াকরে।

ধান্ধাবাজ, সুবিধাবাজ, কৃত্রিম দেশপ্রেমিকের বিরাট আয়োজিত সংবর্ধনার মঞ্চ উপস্থিত হওয়ার যোগ্য কোন পোশাকে রহম আলির ছিল না, তাদের মুখোশ ঢাকতে থানার ওসি নিজের টাকায় দামি বিদেশি পায়জামা-পাঞ্জাবি, চামড়ার জুতা কিনে পাঠায়। রহম আলি প্রত্যাখ্যান করে এবং ঘৃণায়-ক্রোধে কনস্টেবলকে ধমক দিয়ে ওঠে। কাপড়ের প্যাকেট তার পায়ের কাছে ফেলে ভয়ে পালিয়ে যায়। এখানে লেখক সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধার আত্মমর্যাদা বোধকে উচ্চতায় অধিষ্ঠিত রেখেছেন। রহম আলি দারিদ্র অসহায় মানবেতর জীবনযাপন করলেও আত্মমর্যাদাকে বিসর্জন দিতে রাজি নয়। মুক্তিযোদ্ধা বিরোধী সরকারের অনুগত কনস্টেবল রহম আলির হৃদয়ের বিশালতা পরিমাপ করতে পারে না, তাই ওসিকে রিপোর্ট করে কনেস্টেবল, ‘প্যাকেট পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে ফিট হবার উপক্রম’। এদিকে রহম আলি অব্যক্ত বেদনায় ঘৃণায় ক্ষোভে দাঁত খিচিয়ে, হিসহিস করতে করতে কাপড়ের প্যাকেট লাথি মেরে ফেলে দিয়ে আসে বাড়ির পেছনের ডোবায়।

রহম আলি যুদ্ধ করেছিল দেশকে ভালোবেসে কোন ক্ষমতা, পদ পদবি বা অর্থপ্রাপ্তির জন্য নয়, দেশ স্বাধীন হলে, মুক্ত হলে ছানা মিয়ার মতো ভ-রা ক্ষমতা দাপটে অন্যের সম্পদ লূটে নিতে পারবে না এবং ন্যায্য অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হবে না, এই সামান্য আশাই ছিল মুক্তিযোদ্ধা রহম আলির। কিন্তু এই সামান্য আশাও দূরাশায় পরিণত হয়। এই ক্ষোভে রহম আলির ভেতরে বোবা কান্না চলছে। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল স্মৃতি তেত্রিশ বছর ধরে রহম আলিকে দগ্ধ করছে। কিন্তু বিশেষ একটা স্মৃতি স্মরণে রহম আলি বছরের নির্দিষ্ট একটা রাতে হাউমাউ করে কাঁদে। কী কারণে তার এই কান্না তার স্ত্রী জানতে চেয়েছিল রহম আলি যা বলেছিলÑ

জরিনা টানা তিন মাস নির্ভয়ে ঘুমাতে পারেনি। ঘুমোলেই চোখে ভেসে আসত বাঁশের ডগায় বিদ্ধ এক উলঙ্গ যুবতীর মৃতবৎ ছবি। তখনই সে লাফিয়ে উঠে বিছানায় বসে রাত কাটাত। এই যুবতী রহম আলির গুলিবিদ্ধ পায়ে ছেক দিয়েছিল রাতভর জেগে। এ খবর ফাঁস হলে সেখানকার এক রাজাকার যুবতীকে তুলে দিয়েছিল খানসেনাদের হাতে। ওরা রাতভর ব্যবহার করে যুবতীর নিথর দেহ ফিরিয়ে দেয় ঐ রাজাকারের কাছে। তখনও প্রাণ ছিল। অর্ধমৃত যুবতীর যোনিপথে বাঁশ ঢুকিয়ে রাস্তার তে-মাথায় তিনদিন তিনরাত রেখেছিল। রহম আলি আরো দুই সহযোদ্ধা গিয়ে গভীর রাতে দাফন করেছিল যুবতীকে। সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমার রাত।

মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি এদেশের পঙ্গু স্বাধীনতার সংবর্ধনা নিয়ে আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে রাজি নয়, তাই পালিয়ে মুক্তি পেতে চায়। দেশকে ভালোবেসে যুদ্ধে গিয়েছিল, কোনো কিছু প্রাপ্তির আশায় নয়,  একটি স্বাধীন দেশের আশায়, যে দেশে সবাই এক হয়ে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে বসবাস করবে। কিন্তু স্বাধীনতার এতটা বছরেও রহম আলি বুক ফুলিয়ে স্বাধীন ভাবে চলতে পারেনি, মুক্ত বাতাশে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারেনি।

আত্মবেদনায়-ক্ষোভে-দুঃখে রহম আলির মনে খেদ হয়, গুলিটা পায়ে না লেগে চোখে লাগলে ভালো হতো, তাহলে স্বপ্নের স্বাধীন দেশের এই স্বরূপ দেখতে হতো না, স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের আধিপত্য দেখতে হতো না। আত্মঅবমাননার তীব্র দহনে জ্বলতে হতো না। লাখো শহিদের রক্তের লালে রঞ্জিত পতাকা স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে পতপত করে উড়তে দেখে ঘৃণায় ক্রোধে নিজের চোখ নিজেই উপড়ে ফেলতে চায় রহম আলি। অভাবে অনটনে বিপর্যস্ত রহম আলি কোনোদিন কারো কাছে হাত পেতে কিছু গ্রহণ করেনি। তার স্ত্রী যখন দু-চালা টিনের ঘর দুধের গরু ও নগদ দশ হাজার টাকা চাইতে বলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে, তখন সে ক্রোধে গর্জে ওঠে। আত্মমযর্যাদা সম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি তাই বউকে বলেÑ

১. আমারে হাত পেতে ভিক্ষা লইবার কইলি? আমি কি জনমজুরি খাটছিনি? অ্যা! কথা কইস না কেরে? আমি কি জনমজুরি খাটছিনি? তুই না মুক্তিযোদ্ধা রহম আলির বউ। তুই এতো নীচ! এতো লোভ ভিত্রে তোর! ছি জরিনা! ছি! রহম  আলি এলোপাতাড়িভাবে থুথু ছিটাতে লাগল জরিনার স্বপ্নকাতর চোখে-মুখে।

২. -দাউ দে! বুক ফাঁড়–ম! দাউ দে! আমি মুক্তিযুদ্ধ করছি, এই মিথ্যা অহংকার বুক ফাঁইড়া বাইর করুম। আর কত পালাইয়া বেড়াইয়াম। পঁচাত্তর সালের পরে হেই যে পালাইয়া বেড়াইতাছি, আর কত…। বলে জরিনাকে জড়িয়ে ধরে কামড়ে আছড়ে জড়িয়ে হু হু করে কেঁদে ওঠে রহম আলি।

গৌরবগাঁথা মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির যে আকাক্সক্ষা ছিল পঁচাত্তর পরবর্তী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর থেকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির দাপটে তা পালাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধের সব গৌরব খুইয়ে দেশ প্রবেশ করে ভীষণ হতাশা ও দুঃস্বপ্নের ভেতরে। মুক্তিযোদ্ধাদের আড়াল করে, অস্বীকৃতি জানিয়ে, অসম্মান করে, তালিকা ওলট-পালট করে নিরাপত্তাহীনতার ফাঁদে ফেলে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সুফল রাজাকারেরা নিজেদের ঘরে তোলে। ‘পালিয়ে বেড়ায় বিজয়’ গল্পেও তেত্রিশ বছর ধরে রহম আলি মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সংবর্ধনার নামে রাজাকার ছানা মিয়া তাকে কিনতে চায়। কিন্তু এ বিজয়ের শক্তির মূলে আছে লাখো মানুষের জীবন ও রক্ত। তাই মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি এ বিজয়ের গৌরবের ভাগ ছানা মিয়ার মতো রাজাকারদের কিছুতেই দেবে না। সে মনে করে সংবর্ধনা নেওয়ার পরিবর্তে পালিয়ে যাওয়া শ্রেষ্ঠ। তাই মুক্তিযোদ্ধের গৌরব বুকে ধারণ করে সংবর্ধনার আগে রাতের অন্ধকারের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে স্ত্রী জরিনাকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যায়।

কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর রাত। কৃষ্ণকায় অন্ধকার চারদিক। বিলের মাঝখান দিয়ে আলপথ ধরে আগে হাঁটছে জরিনা। পেছনে হাঁটছে রহমালি। জরিনা এক হাতে কাপড়ের গাঁটরি, অন্য হাত রহম আলির এক হাতে।

অন্ধকারে কেউ কাউকে দেখছে না।

দারিদ্র্যলাঞ্ছিত জীবনে সুখের প্রলোভনকে প্রত্যাখ্যান করেছে মুক্তিযোদ্ধা রহম আলি। এই প্রত্যাখ্যানের ভেতর দিয়ে রহম আলী যেমন যুদ্ধাপরাধীর শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার অবস্থান শক্তিশালী করেছে। একইভাবে, একজন মুক্তিযোদ্ধার পালিয়ে বেড়ানোর মধ্যে দিয়ে প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ পালিয়ে বেড়ায়, স্বাধীনতা পালিয়ে পাড়ায়।

‘ইঁদুর নিধন প্রকল্প’ গল্পটির বিষয় যুদ্ধপরাধীদের বিচারকেন্দ্রিক। গল্পের প্রধান চরিত্র আব্দুর রহিম। তার ঘরে ইঁদুরের উপদ্রব মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থান ও দৌরাত্ম্য। গল্পকার চন্দন আনোয়ার ইঁদুরকে প্রতীক করে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারদের স্বরূপ তুল ধরছে। যারা সুযোগ পেলেই দেশটাকে দখল ও লুট কতে চায়। আর আব্দুর রহিমের বসত ঠিকানাকে দেশের প্রতীক করা হয়েছে। আব্দুর রহিম দীর্ঘ খাটুনির ফলে দোচালা টিনের ঘর নির্মাণ করতে পেরেছিল। কিন্তু তার সুখের স্বাধীন ঘরে স্বস্তিতে থাকতে পারে না ইঁদুরের উৎপাতে। আব্দুর রহিম ইঁদুরের উৎপাতের অতিষ্ঠ হয়ে দাঁত মুখ খিচিয়ে ইঁদুর তাড়নোর জন্য বড় সাইজের একটা ইঁদুর পিছনে দৌড় দেয়। হঠাৎ করে ঝাঁকে ঝাঁকে ইঁদুর এসে তাকে ঘিরে ফেলে এবং তাকে কামড়ে ধরে। পরে ইঁদুরগুলো গর্বের সাথে তদের রাজ্যে ফিরে যায়।

আবদুর রহিমের নিজের ভুলের কারণে, নিজের উদারতার সুযোগে তার বসতবাড়িতে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলে ইঁদুরবাহিনী। ক্রমেই বংশবিস্তার ঘটিয়ে ইঁদুর বাহিনী এমনি শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, তারাই দখল করে নেয় আবদুর রহিমের ঘরবাড়ি। ইঁদুর বাহিনীর উত্থান, বংশবৃদ্ধি ও ক্ষমতায়নের প্রতীকে গল্পকার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে উত্থান ও ক্ষমতায়নের বাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। ।

আব্দুর রহিমে তুমুল আফসোস। কী ভুলটাই না করেছে জীবনে! কেনো দয়া দেখাতে গেল? কেনো তন্ন তন্ন করে খোঁজে একটা একটা করে খতম করেনি? এই কয় বছরে ওরা নিজেদের এতো পরিমাণ বংশবিস্তার ঘটিয়েছে, যে কোনো মুহূর্তে তার বাড়ি দখল নিতে পারে! এই ভয় এখন মনে। এই ঘর, এই মাটির দাবি ওরা ছাড়েনি! আব্দুর রহিমের রাজত্বে ওরা শক্ত প্রতিপক্ষ।

সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যুদ্ধপরাধীরা একটি বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সমগ্র দেশটিতে তারা তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও তারা অপ্রতিরোধ্য ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের নেতার এক ডাকেই সাড়া দিয়ে শত্রুকে দমন করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই জন্য প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা নাজেহাল, যেটা চন্দন আনোয়ার আব্দুর রহিমের মধ্য দিয়ে পাঠককে স্পষ্ট করেন। আব্দুর রহিম কিছুতেই ইঁদুরবাহিনীর কাছে পরাজয় মেনে নেবে না, ভয়ানক আক্রোশে চিৎকার করে ওঠেÑ‘না কিছুতেই না! কিছুতেই না! এই বাড়ির এক ইঞ্চি জায়গাও ছাড়বে না সে। একটা ধানও বেহাত হতে দিবে না। দরকার হলে যুদ্ধ হবে। ফের যুদ্ধ।’

ইঁদুরের ফাঁদে পড়ে আব্দুর রহিম আত্ম-যন্ত্রণায় জর্জরিত। তার সমস্ত ভাবনাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে ইঁদুর। ইঁদুরকে মারতে না পারার অক্ষমতার কারণে তার স্ত্রীও নানা কটূকথা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, সাপের মতো শরীর কাঁপিয়ে ফোঁসফোঁস করে। কিন্তু নির্বিকার আব্দুর রহিম ইঁদুরের ভাবনায় নিমগ্ন থাকে। তার মগজ ইঁদুরে ছিঁড়েকুড়ে ফেলছে।

মুক্তিযুদ্ধে সময় কাঁচা তরকারি নিয়ে শহরে গিয়েছিল আবদুর রহিমের বাবা,কিন্তু আর ফেরেনি।  স্বামীর খোঁজে  জমির মৃধার সঙ্গে শহরে গিয়েছিল তার মা,  সেও ফেরেনি। মায়ের স্মৃতি তার মনে এলেই স্বাধীনতা বিরোধী জমির মৃধার ছবি আবদুর রহিমের চোখে ভাসেÑ‘

কারা যেন দ্রৌপদীর শাড়ির মতো আব্দুর রহিমের মা-র শাড়ি ধরে টানছে আটত্রিশ বছরে। সে প্রায়শ মায়ের সেই লাল পেড়ে শাড়ির আঁচল দেখতে পায়! মাকে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। সে ভাবে, মা ইচ্ছে করলে দেখা দিতে পারে। নিজেই দেখা দিচ্ছে না। কেনো দিচ্ছে না? তখুনিই বিভ্রমে বেদিশা হয়ে গোঙায়ে ওঠে, মা-মাগো! তুমি কইগো মা? চোখ বুঁজে সে। হাত বাড়ায় সামনে ছুঁতে! আব্দুর রহিম ছুঁতে পারে না। আরো দূরে চলে যায়ভ যেন মা লজ্জা পাচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে আব্দুর রহিমের চোখে ভেসে ওঠে আশ্চর্য এক চিত্রকল্প, তার সামনে দাঁড়িয়ে শিকার খাওয়া বিড়ালের মতো জিভ্ দিয়ে মুখ চাটে জমির মৃধা। এই মৃধার সাথেই আব্দুর রহিমের মা গিয়েছিলো শহরে-তার স্বামীর তালাশে।

আব্দুর রহিমের এই আত্মজিজ্ঞাসা পাঠককেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকারো ক্ষমতার বদৌলতে তাদের অপকর্মকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছে। স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার জমির মৃধা নানা কৌশলে শুধু সামাজিক ভাবেই নয়, রাজনৈতিক ভাবেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে টানা তিনবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতার অধিকারী জমির মৃধা। তাই আব্দুর রহিমের মনের ভেতরে জমে থাকা প্রশ্নগুলো করতে সাহস পায় না। শুধু তার মনেই ঘুরপাক খায়। তার মা’র কী পরিণতি হয়েছিল? কোথায় হারিয়ে গেল? কারা মেরে ফেলেছে? জানজা হয়েছে কিনা, কিংবা হিন্দু ভেবে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে কিনা আব্দুর রহিম অনুমান করে সব প্রশ্নের উত্তর জমির মৃধাই জানে। সেই সাথে আর একটি জিজ্ঞাসা আব্দুর রহিমকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তার মায়ের র্কথা মনে এলেই শিকার খাওয়া বিড়ালের মতো জমির মৃধা জিভে চাটে কেন? পাপ নাকি বাপকেও ছাড়ে না, আব্দুর রহিমের মেয়ে সাবিনার উপরেও জমির মৃধার লালসা জেগে ওঠে। সাবিনার সংলাপে আব্দুর রহিম স্পষ্টই বুঝতে পারে, তার বাবা মায়ের হত্যাকারী জমির মৃধা। আব্দুর রহিমের মেয়ে সাবিনা উঠানে লুটিয়ে কান্না জুড়ে এই বলে যে, চেয়ারম্যান তাকে যেতে বলেছে। এবং বলেছে, সাবিনা খাতুন দাদির মতো দেখতে, দাদির মতো বুক-সিনা।

আব্দুর রহিমের এতদিনের জমে থাকা সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হওয়ায় জমির মৃধার সাথে হিসাব নিকাশ মেটাতে মনে মনে শক্তি সঞ্চার করে। বাবা-মার হত্যার ও মেয়েকে অপমানের প্রতিশোধ নিজ হাতে তুলে নেয়, কারণ আব্দুর রহিম আটত্রিশ বছর ধরে অপেক্ষা করেছে, বাবা-মায়ের হত্যার বিচার পায়নি।  গল্পে চন্দন আনোয়ার যুদ্ধাপরাধীর হত্যার চিত্রটি সরাসরি দেখাননি। কিন্তু আবদুর রহিম মুখোমুখি দাঁড়ালে জমির মৃধা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, উদভ্রান্ত হয়ে নেংটি ইঁদুরের মতো পালানোর চেষ্টা করে; এবং শেষে আব্দুর রহিমের খুক খুক একচোট হাসির যে বর্ণনা দিয়েছেÑ বোঝা যায়, আব্দুর রহিম যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কাজটি নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, ক্ষমতার রাজনীতিতে জমির মৃধারা চিরকালই নিজেদের নিরাপদ রাখবে। সন্ধ্যার অন্ধকার ধেয়ে আসছে। মৃধা চেয়ারম্যান যেন ভূতের মতো অন্ধকারে বিলীন হতে হতে নাই হয়ে যাচ্ছে। ক্ষীণ হতে হতে নেংটি ইঁদুরের মতোই দেখাচ্ছে তাকে। উদ্ভ্রান্ত হয়ে পালাবার জন্যে গর্ত খুঁজছে সে! এমন করে এলোপাথাড়িভাবে দৌড়াচ্ছে যে, দেয়ালের সাথে দড়াম দড়াম করে হোঁচট খাচ্ছে। জখম ইঁদুরের মতো আব্দুর রহিমকে কামড়াতে এসে নিজেই খাবি খেয়ে উল্টে পড়ছে। আব্দুর রহিম খুক খুক করে একচোট হেসে নিল। আটত্রিশ বছর পরে আসল ইঁদুরটাকে বাগে পেয়েছে।

গল্পটিতে চন্দন আনোয়ার রাজাকার জমির মৃধার বিচারের মধ্যদিয়ে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী এবং তৃণমূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দাবিকে জোরালোভাবে উপস্থাপন করেছেন।

 

স্বপ্না সুরাইয়া, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক

 

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে