বাবুল সিদ্দিক:
ওমর খইয়াম ছিলেন কবি, গণিতবেত্তা,দার্শনিক বিজ্ঞানী ও জ্যোর্তিবিদ। ইরানের নিশাপুরে জন্মগ্রহন করেন। যুবা বয়সে তিনি সমরখন্দ চলে আসেন এবং সেখানে শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
ওমর খইয়ামের শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে অধুনা আফগানিস্তানের বলখ্ শহরে। তার বাবা ছিলেন তাবু তৈরীর কারিগর ও মৃৎ- শিল্পী। বিখ্যাত দার্শনিক মোহাম্মদ মুনসুরীর কাছে শিক্ষা গ্রহন করেন।দিক্ষা নিয়েছিলেন ধর্মীয় শাস্ত্র দর্শন ও গনিতে। পারদর্শী হয়ে চলে আসেন খোরাসানের সবচেয়ে বিখ্যাত ঈমাম মোয়াফফেক নিশাপুরির কাছে। ঈমাম ওমরকে খুব পছন্দ করতেন। ঈমাম মোয়াফফেক এমন শিষ্য পেয়ে মেলে দিয়েছিলেন নিজের জ্ঞান সমুদ্র। খৈয়াম হয়ে গেলেন তার সবচেয়ে প্রিয় শিশ্য। এই ঈমামের কাছেই তার শিক্ষাজীবন সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল।
দিনের বেলায় বীজগণিত ও জ্যামিতি পড়ানো, সন্ধ্যায় সুলতান মালিক শাহ্ এর দরবারে পরামর্শ প্রদান। বহু দূর থেকে আসা ছাত্রদের মাঝে জ্ঞান বিতরণ এবং রাতে জ্যোর্তিবিজ্ঞান চর্চা পাশাপাশি জালালি পঞ্জিকা সংশোধন। এই ছিল তার সারা দিনের কাজ। শেষের কাজটি ছিল প্রচন্ড পরিশ্রমের। এমনও হয়েছে কাজ করতে করতে কর্মস্থলেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। তার ত্যাগ এ পরিশ্রম ছিল অবর্ননীয় ।
ইসফাহান শহরে ওমরের দিনগুলি ভালই কাটছিল। কিন্তু আততায়ীর হাতে সেরজুক সুলতান মালিক শাহ্ এর মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রী প্রকাশ্যে সুলতান মালিক শাহ্ এর মৃত্যুর জন্য ওমরকে দায়ী করতে থাকেন। সুলতানের স্ত্রী সন্দেহ ছিল খৈয়াম এই হত্যার পিছনে গোপন চর হিসাবে কাজ করেছেন। এমন বেগতিক অবস্থায় ওমর খইয়াম সবকিছু ছেড়ে হজ্জ করতে চলে যান মক্কা মদিনায়। দীর্ঘ সময় ছিলেন সেখানে।
একসময় তাকে নিশিপুরে ফেরার অনুমতি দেওয়া হয়। নিশাপুরেই ওমর খৈয়াম গনিত,জ্যোর্তিবিদ্যা,ও চিকিৎসা বিষয়ক তার বিখ্যাত রচনাগুলো সমাপ্ত করেন। এরপর বুখারায় নিজেকে মধ্যযুগের একজন প্রধান গণিতবিদ ও জ্যোতিবিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার বীজগণিতের ‘ঞৎবধঃরংব ড়হ ফবসড়হংঃৎধঃরড়হ ড়ভ ঢ়ৎড়নষবস ড়ভ অষমধনৎধ ‘ গ্রন্থে তিনি ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধানের একটি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। এই পদ্ধতিতে একটি পরিবিত্তকে বৃত্তের ছেদক বানিয়ে ত্রিঘাত সমীকরনের সমাধান করা হয়। বীজগণিতের ত্রিঘাত সমিকরনের সমাধান তিনিই প্রথম করেন।
জীবনের একটা সময় ওমর খৈয়ামের খ্যাতি ছিল গনিতবিদ ও জ্যোর্তিবিদ হিসাবে। ইসলামি সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সোনালী যুগে তথা এখন থেকে প্রায় একহাজার বছর আগে বীজগনিতের যে সব উপপাদ্য এবং জ্যোর্তিবিদ্যার তত্ত্ব ওমর খৈয়াম দিয়ে গেছেন সেগুলো এখনও গনিতবিদ্যা ও মহাকাশ গবেষণা বা জ্যোর্তিবিদের গবেষণায় যথাযথ সূত্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি দ্বি-পদী রাশিমালার বিস্তার করেন। ওমর খৈয়ামের আর একটি বড় অবদান হলো, ইউক্লিডের সমান্তরাল স্বীকার্যের সমালোচনা যা পরবর্তী সময় অ-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির সূচনা করেছিল। নিশাপুরে তিনি তিন দশক ধরে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেন। ইসলামি বর্ষপঞ্জি সংস্কারেও তার অবদান রয়েছে।
বিশ্বে বহুমুখি প্রতিভার দৃষ্টান্ত দিতে বলা হলে গণিত, জ্যোর্তিবিদ্যা, বিজ্ঞান, বিশ্বসাহিত্যে কিংবা ইতিহাসে যাদের নাম উপেক্ষা করা কঠিন ওমর খৈয়াম তাদের মধ্যে অন্যতম।
পারস্য বা ইরানের বাইরে ওমরের একটি বড় পরিচয় কবি হিসাবে। এর কারণ অনেকেই তার কবিতা বা রুবাই – এর অনুবাদ এবং তা প্রচারের কাজ কারণে। ইংরেজি ভাষাভাষী দেশগুলিতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশী দেখা যায়। ইংরেজ মনীষী টমাস হাইড প্রথম অপারস্য ব্যক্তিত্ব যিনি প্রথম ওমরের কাজ সম্পর্কে গবেষণা করেন।তবে খৈয়ামকে সবচেয়ে বেশী জনপ্রিয় করেন এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড। তিনি খৈয়ামের ছোট ছোট কবিতা বা রুবাই অনুবাদ করে তা ‘ রুবায়াতে ওমর খৈয়াম ‘নামে প্রকাশ করেন।
বাংলা সাহিত্যে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেন কাজী নজরুল ইসলাম সহ অনেকেই। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদকৃত ‘রুবাইয়াৎ- ই- ওমর খৈয়াম ‘গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এর ভূমিকা লিখেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ভূমিকায় সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছিলেন, ‘খৈয়াম কাজী নজরুল ইসলামকে প্রচ-ভাবে আকর্ষিত করেছিলেন।’ নজরুল নিজেও বহু জায়গায় তা লিখেছেন। নজরুল বহু রাত জেগে সমাপ্ত করেছিলেন ‘ রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খইয়াম’। মার্কিন কবি জেমস্ রাসেল লোয়েল ওমরের রুবাইয়াৎ কে অবহিত করেছিলেন “চিন্তা উদ্দীপক পারস্য উপসাগরের মুক্তা” বলে। রুবাইয়াৎ এর নজরুলের অনুবাদও অত্যন্ত চমৎকার। ভাষাভঙ্গী, প্রাঞ্জলতা ও অনুবাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল ব্যাপক। নজরুল অনেক শব্দ, ভাবধারা পরিবর্তন করেন নি ভাষা সৌন্দর্যের জন্য। এজন্য নজরুলের রুবাইয়াৎ অনুবাদই সবচেয়ে জনপ্রিয়। অন্যান্য অনুবাদকের চেয়ে নজরুলের অনুবাদ অনুভুতির পরশে, যথাযথ শব্দের পরিপাট্যে সমুজ্জ্বল।
ফার্সি কাব্য জগতে ওমর খৈয়াম এক বিশেষ চিন্তাধারা ও বিশ্ব দৃষ্টির পথিকৃৎ। তিনি এমন সব চিন্তাবিদ ও নিরব কবিদের মনের কথা বলেছেন, যারা সেসব বিষয়ে কথা বলতে চেয়েও প্রতিকুল পরিস্থিতির কারণে তা চেপে গেছেন। তাই মধ্যযুগের বিখ্যাত মুসলমান মনীষী জামাকসারি ওমর খৈয়ামকে বর্ণনা করেছেন “বিশ্ব দার্শনিক” হিসাবে।
১১৩১ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর ওমর খৈয়াম ইরানের নিশাপুরে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বৎসর।
ওমর খৈয়ামের কতিপয় রুবাই (পঙতিমালা) এর মর্মার্থ :
# এই মুহুর্তের জন্য খুশি হও। এই মুহুর্তটিই তোমার
জীবন।
## আমি যখন বর্তমান সম্পর্কে জানতে চাই অথবা
ভবিষ্যত সম্পর্কে তখন আমি অতীতের দিতে ফিরে
তাকাই।
## তিনটি জিনিষের মূল্য তিন শ্রেনির মানুষ বুঝতে
পারে। যৌবনের মূল্য বুঝে বৃদ্ধ, স্বাস্থ্যের গুরত্ব বোঝে
অসুস্থ ও সম্পদের প্রয়জনীয়তা বুঝে অভাবী।
## পৃথিবী ছাড়িয়ে দূরতম আকাশের উপর আমি স্বর্গ ও
নরক খোঁজার চেষ্টা করি। তারপর আমি একটি
গম্ভির কন্ঠ শুনি ‘স্বর্গ ও নরক তোমার ভেতরই
আছে।’
## অনেক দু:খে যখন তুমি পথ চলতে পার না,আর তুমি কাঁদতে পার না, তখন বৃস্টির পরে ঝকঝকে সবুজ পাতাগুলো নিয়ে ভাবো। দিনের আলো যখন তোমাকে ক্লান্ত করবে, তুমি আশা করো দুনিয়া জুড়ে চূড়ান্ত একটি রাত, একটি ছোট্ট শিশুর জেগে থাকা নিয়ে ভাবো।
## একটি জলের ফোঁটা সমুদ্রের সাথে মিশে গেলো, পৃথিবীতে তোমার আসা ও ছেড়ে যাওয়া কেমন ? একটি মাছি উড়ে এলো আবার অদৃশ্য হয়ে গেলো।
## গোলাপ ফোটে একবার, মরে যায় চিরকালের জন্য।
## হৃদয়ে যখন প্রেমের গোলাপের চারা রোপন করলে,
তোমার জীবন বৃথা যায় নি।
## পৃথিবীতে আমি পানির মত এসেছি, চলে যাব
বাতাসের মত।
## প্রতিদিন ভোরে যেমন একটি দিন জন্ম নেয়, তেমনি
একটি দিন কমে যায়।
## দুই ধরনের চোখ রয়েছে, দেহের চোখ ও আত্মার
চোখ। দেহের চোখ মাঝে মাঝে ভুল করতে পারে
কিন্তু আত্মার চোখ সবসময় স্মরন করে।
## সত্য ও মিথ্যার মাঝে দূরত্ব হলো একটি চুলের
পরিমান।
## আস্তিনের ধুলো ঝাড়ো যতœ নিয়ে, একদিন এই
ধুলোই ছিল সুন্দর একটি মুখ।
## মন্দির যদি মানুষের ভেতরই থাকে, তাহলে
পুজারীরা বাইরে মাথা ঝাঁকায় কেন ?
## চিন্তাশীল আত্ম থেকে একাকীত্ব অবসর নেয়।
## যদি শান্তি ও নির্মলাতায় পৌঁছতে চাও তাহলে পুরো
পৃথিবীর বেদনা ঝেড়ে ফেলো।
## গোপনীয়তা অমানুষেদের কাছ থেকে দূরে রাখা
উচিত ও রহস্য বোকাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা
উচিৎ।
## যে ফুল প্রস্ফুটিত হলো, এক সময় তাকে মরতেই হবে
প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতব আলী ওমর খইয়ামের কবিতার ভাবানুবাদ করেছিলেন এভাবে : –
“ রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে,
প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে,
কিন্তু বইখানা থাকবে অনন্ত যৌবনা,
– যদি তেমন বই হয়।”
বাবুল সিদ্দিক, প্রাবন্ধিক, নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক