ফাহমিনা নূর
প্রথমে ভেবেছিলাম মরে গেছি। তারপর দেখি এই পৃথিবীর আলো-বাতাস আর কিছু বিরক্তিকর মানুষের উপস্থিতি টের পাচ্ছি। তারা মনে হয় আরও ফিট ত্রিশ বা চল্লিশ ফিট নিচে আছে। আমার এই বেঁচে থাকার সংবাদটি না আনন্দের, না দুঃখের তবু এ মুহূর্তে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর। মানুষগুলোকে সেটা জানানো দরকার। ডান কাঁধ থেকে প্রায় কোমর পর্যন্ত নাড়াতে পারছি না। যেখানে পড়েছি সে জায়গাটা কিছুটা জলকাদাময়, পাথুরে মাটিতে পড়লে এখন আর এত ভাবনার সুযোগ পেতাম না। আমি চিৎকার করে ডাকি, ‘হে..এ…ল্প!’ কিন্তু বুকের বাষ্প সব বেরিয়ে গেলেও আওয়াজ তেমন হলো না। একটা অসাড় অনুভূতিকে অতিক্রম করে মনের মধ্যে বিষধর সাপটি ফিরে এলো। আমরা দু’জন-ই প্রায় একই সময় ছাব্বিশ ফিট উপর থেকে পতিত হয়েছি। এত উপর থেকে পড়লে সাপদের কী অবস্থা হয়? তারা বাঁচে? বেঁচে থাকলে ওটা এখন আমার আশে পাশেই আছে।
নিঃসাড়, অক্ষম, জখমি মানুষকে সাপ ছোবল দেয় না বোধ করি, যখন জীবিত ছিলাম মানে সক্ষম ছিলাম তখনও তার তেমন নিয়ত হয়তো ছিলো না। কিন্তু সজাগ ছিলো মনের সাপ, অজানা শত্রুকে মোকাবেলা করার জন্য মেনুফ্যাকচার্ড সাপ।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। চোখ খুলতে গিয়ে দেখি আলো সহ্য হচ্ছে না। আবার চোখ বন্ধ করে ফেললে কান সজাগ হলো। প্রায় আমার মুখের ওপর মুখ নামিয়ে কেউ কথা বলছে। পাহাড়ি মদের গন্ধ মেশানো শ্বাস আমার মুখে এসে পড়ছে, উৎকট গন্ধ তন্দ্রা ভাবটা কাটিয়ে দিলে বিবমিষার উদ্রেক হলো। খানিক নড়তে গিয়ে মনে পড়লো দুর্ঘটনার কথা, মনে পড়লো আমারতো নড়তে পারার কথা নয়। পিঠের নিচে বাঁশের কঞ্চির বাঁধন টের পেলাম। লোকটি পাহাড়ি ভাষায় কথা বলছে কিন্তু চাকমা বা মার্মা ভাষায় নয়, চাকমা ভাষা আমি কিছুটা বুঝতে পারি। সম্ভবত খিয়াং ভাষায় সে কিছু বলছে, কথা বুঝতে পারছি না কিন্তু মানুষের নজরে আছি এ তথ্য আমায় বাঁচার সম্ভাবনা দেখালো। ধরে নিচ্ছি খিয়াং, কারণ রোয়াংছড়ির গহীনে খিয়াং সম্প্রদায়ের বাস ব’লে জানি। আমার দূর্ঘটনাস্থল অর্থাৎ থা-পেদেলা গিরিখাদ রোয়াংছড়ি উপজেলার অধীনে। চোখ আগেই খুলেছিলাম। তাই দেখে লোকটার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, মানে আমার জ্ঞান ফিরে আসাটা এক অচেনা পাহাড়ি মানবের জন্যও আনন্দের! আহা বেঁচে থাকা সত্যিই বুঝি খুব আনন্দঘন ঘটনা! লোকটা কিছুটা সরে গিয়ে পাশে কারো সাথে কথা বলতে থাকলে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি টের পাই। ঘাড় নাড়াতে পারছি না আড় চোখে দেখার চেষ্টা করি, দ্বিতীয়জন এগিয়ে আসে। কাছে আসতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। ওটা একটা ছোকরা, বয়স বছর ষোলো বা সতেরো বা তারচেয়ে কিছু বেশি। আমার বিস্ময়ের কারণ তার পরনে আমার ডেনিম জিন্স, উরুতে কালচে লাল কালি দিয়ে লেখা ‘ঐধৎফ জধরহ’। এতক্ষণে টের পেলাম আমি দিগম্বর, মজনু-মাওলা-হুজুর ব’নে গিয়েছি। অনভ্যস্ত আমি সংকুচিত হয়ে যাই। প্রথম ব্যক্তি সম্ভবত সেটা টের পেয়েছে। সে মাচার নিচ থেকে বস্তার মত একটা পুরনো জীর্ণ কাঁথা বের করে আমার কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেকে দেয়। বুকের উপর চিকন দড়ি দিয়ে আমার উর্ধ্বাংশ নিচের বাঁশের কঞ্চির সাথে বাঁধা। আমি বাঁ হাত নাড়তে পারছি। কিছুটা ধাতস্ত হয়ে খাঁটি বাংলায় জানতে চাইলাম আমার মোবাইল ফোনের খোঁজ। কোনো উত্তর নেই, ইশারায় ও নিজ ভাষা সহযোগে পাল্টা জানতে চাইলো কিছু খেতে চাই কি না। সাথে সাথে টের পেলাম শুধু ক্ষুধার্তই নই আমি ভীষণ দুর্বলও বোধ করছি। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তে দ্বিতীয়জন একটা বাটিতে কিছু তরল নিয়ে এগিয়ে এলো। আঠালো তরলটি খাওয়ার সময় আমি কোনো স্বাদ টের পাচ্ছিলাম না, চারপাশের অচেনা গন্ধে ততক্ষণে আমার নাক অভ্যস্ত হয়ে উঠলে খাওয়ার সময় নতুন করে কোনো গন্ধ ভোগায়নি। খাওয়ার পর মনে হলো শরীরের ক্লান্তি ফিরে এসেছে কিন্তু ঐ আংশিক জলীয় আঠালো খাবারটিতে কী আবেশ ছিলো কে জানে, মিনিট বিশেক পর আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম ভাঙলো একটা ক্ষীণ কিন্তু অদ্ভুত আওয়াজে। ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে মনে হলো, ঘর বলতে মাচা ও সামান্য খোলা অংশ ঘিরে ছনের বেড়া আর ছাউনি। সে বেড়ার গায়ে একটা খুলি আর আর কোনো গাছের গোটা দিয়ে বানানো মালা ঝুলছিলো, সেটা গতকালই দেখেছিলাম। এ বাটির মালিক কি তাহলে কোনো তান্ত্রিক? ভাবছিলাম কাল, বেশিদূর ভাবতে পারি নি, চিন্তাগুলো অচিরেই ছিঁড়ে গিয়ে নতুন চিন্তার জন্ম দিচ্ছে। আমি কীভাবে এখানে এলাম, আমার সঙ্গীরা যাদের সাথে ট্রেকিংয়ে বেরিয়েছিলাম তারা কোথায়! আমাকে খোঁজে নি? হাসান ভাই, হাসান ভাইয়ের কথা মনে হতেই, মাথার ভেতর সাপটা ফিরে এলো। কী অবস্থা তার? মরে গেছে না কি আমারই মত কোনো তান্ত্রিকের ঘরে গোঙাচ্ছে? গতকাল আঠালো খাবারের কিছুটা আমার দাড়িতে পড়ে একটা ছোট জট সৃষ্টি করেছে। ওখানেই এখন এক পিঁপড়ে দম্পতি ঢুকছে আর বেরুচ্ছে, শীতের খাদ্য সঞ্চয় করছে নাকি ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় বানাবার ধান্ধা! আমাকে কামড়ে দেবার আগেই আমি আঙুল দিয়ে চটকে দু’জনকেই সহমরণ দান করলাম।
যমদূতের দায়িত্ব পালন করতে না করতেই আমার ডান পায়ের গোড়ালিতে ভীষণভাবে কামড়ে দিলো অন্য এক পিঁপড়ে, একটি নয় একাধিক কামড়, একজন নয় একাধিক যোদ্ধা। দারুণ সংগঠিত তো! টেলিপ্যাথি জানে না কি! মৃত্যর আগে সেই দম্পতি অথবা সম্মুখ যোদ্ধারা আক্রমণের সংকেত পাঠিয়ে দিয়েছে ব্যাক আপ টিমকে? তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমার বাঁ হাত ছুঁতে চায় ডান পায়ের গোড়ালি আর ডান পায়ের গোড়ালি চায় বাম হাতের আশ্রয়। তাতেই ঘটে বিপত্তি, শরীরময় ঝিমিয়ে থাকা যন্ত্রণাগুলো ত্রাহী চিৎকার করে জেগে ওঠে, সারেঙ্গী বাজিয়ে তীব্রতর হয়, খামচে ধরে আমার হৃদপি-। তান্ত্রিক ভ্রাতাগণ কোথায়! আমি কি জ্ঞান হারাচ্ছি! মরে যাচ্ছি? তার আগে বিস্ফোরিত চোখে দেখি সদ্য জন্ম নেয়া ভোরের আলোকে পেছনে ফেলে দরজায় দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি। এ কি কোনো ত্রাণকর্তা? দেবদূত? না কি কোনো শয়তান! পিঁপড়া সমাজের পাঠানো এক কিলার মেশিন? কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। আমাকে মৃত্যু দাও হে খোদা, এ যন্ত্রণা সহ্য হবার নয়।
আমার জ্ঞান ফিরেছে একটা সামরিক হাসপাতালে, ওখানে সাময়িক চিকিৎসা দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকায়। একটা অর্থপেডিক সার্জারি হয়েছে এখন ফিজিওথেরাপি চলছে। হুইল চেয়ারে জীবন চালাচ্ছি, ওয়াকার দিয়ে মাঝে মাঝে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাঁটার চেষ্টাও করছি। একদিন মেরুদ-ে সেটে দেয়া স্ক্রু সহযোগেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো ব’লে ডাক্তারের আশ্বাস। আমি শাহবাজ হোসেন, বয়স তেত্রিশ, একজন চৌকস মার্চেন্ডাইজার, একটা কর্পোরেট হাউসের কান্ট্রি ম্যানেজার আপাতত ছুটিতে আছি। হাসানুল আজীজ ওরফে হাসান ভাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বড় ভাই, কর্মক্ষেত্রে আমার কলিগ। আমার অনুপস্থিতিতে তিনিই এখন অফিস সামলাচ্ছেন। বয়সে আমার সিনিয়র হলেও কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছেন আমার পরে। বলতে নেই, লোভনীয় এই চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছিলেন অনেকটাই আমার সুপারিশে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে তুখোড় ছাত্র হাসান ভাই ছিলেন তারকা ধরনের মানুষ। ভক্ত পরিবেষ্টিত থাকতে ভালোবাসতেন, ভালো তার্কিক ছিলেন এবং বাংলাদেশ টেনিস ফেডারেশনের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও ছিলেন বটে। আমাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করেন মানে একসময় করতেন। কর্ম জগতের হিসেব অবশ্য আলাদা, সুহার কারণে আমার দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হবার তাড়া ছিলো। তাই অনার্স পরীক্ষা দিয়ে আমি মরিয়া হয়ে চাকরিটা শুরু করি। এ কর্মজগৎ আমাকে জীবনের ভা-ার খুলে দিয়েছিলো, সবচেয়ে বেশি দিয়েছিলো আত্মবিশ্বাস। দ্রুত আমার পদোন্নতি হয়। তিনবছরের সংসার জীবনের ইতি টেনে সুহা যেদিন আমাকে ছেড়ে চলে যায় সেদিনই প্রথমবারের মত আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে। এরপরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ক্রমশ নিম্নগামী এবং অনাস্থার। যে হাসান ভাইকে আমি এত আহ্লাদ করে একই অফিসে এনে বসিয়েছি তিনিই কি না হয়ে উঠতে চাইলেন আমার অপ্রতিরোধ্য প্রতিদ্বন্দ্বী!
সেনাসদস্যদের যে দলটি আমাকে উদ্ধার করেছিলো তাদের কাছেই জানতে পারি খিয়াং ভাতৃদ্বয়ের কথা। তারা আসলেই দুই ভাই তবে তান্ত্রিক নয়, সাধারণ বনজীবি মানুষ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কোনো সংগঠনের সাথে তাদের সংযোগ নাই। আমাকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের মতো কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিলো না বলেই অনুমিত। তবে সেনাবাহিনীকে তারা যথার্থই ভয় পায়। তাই তাদের আগমনের খবর পেয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। যে ঘর থেকে আমাকে উদ্ধার করা হলো সেটিও তাদের অস্থায়ী ডেরা, এটি খিয়াং পাড়া থেকে বেশ দূরে নির্জন একাকী অবস্থানে দাঁড়িয়ে। বনের ভেতর শিকারে বা বনজ জিনিস আহরণে গেলে তারা ওখানেই বিশ্রামে নিয়ে থাকে। আমার টোটকা চিকিৎসা তারাই করেছিলো। উদ্ধারকর্মীরা দুর্ঘটনাস্থলে আমাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই তারা এই ডেরায় নিয়ে এসেছিলো। আমার সেলফোনটি অবশ্য সেখানেই খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে পড়ে গিয়েছিলাম, তবে আস্ত ছিলো না। সম্ভবত দুর্ঘটনার সময় আমার পকেট থেকে পড়ে গিয়ে পাথরে বাড়ি খায়। ব্যাকপ্যাকটি পাওয়া যায় আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিলো যে মাচাটিতে তার নিচে। টাকা পয়সা আর টুকটাক যা জিনিস ছিলো তা ঠিকঠাকই ছিলো শুধু আমার প্যান্টালুনটা ঐ ছোকরার বিশেষ পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো।
হাসান ভাই পাহাড় ভালোবাসেন, আমিও। এই না হলে যৌথতা! টানা তিনদিনের ছুটির সাথে একদিন বাগিয়ে নিয়ে সেবার দু’জন ছুটে যাই বান্দরবন। লক্ষ্য থা-পেদেলা গিরিখাদ। আমাদের দু’জনেরই পাহাড়ি ট্রেইলে অভিযানের পূর্বাভিজ্ঞতা আছে। এবার মনে হয় আমরা একটু রিল্যাক্সড মুডেই ছিলাম। কারণ আমাদের তাড়া ছিলো না, একসাথে একাধিক স্পট কাভার করার চাপ ছিলো না। হালকা চালে গল্প করতে করতে এগিয়ে যাই। আমাদের লোকাল গাইড প্রবল তঞ্চঙ্গা বারবার কথা বলতে বারণ করছিলো, সতর্ক করছিলো সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে।বিপদসঙ্কুল পথ, পথে চ্যালেঞ্জ আছে, চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে পথে মন দেই। বিপদ পেরিয়ে আবার গল্প করি। দলের বাকি পাঁচজনকে তেমন একটা চিনি না, সেদিনই পরিচয়। আমরা পিছিয়ে পড়ছিলাম। প্রথমে সামান্য, পরে
অনেকখানি। গাইড এবং পাঁচ সহযাত্রীর সাথে দূরত্ব ক্রমশঃ বাড়ছিলো। আমরা গল্প করছিলাম চলতি পথের ট্রেইল নিয়ে, বেয়ার গ্রিলসকে নিয়ে। আমাদের গল্পের বিষয় বদলে যাচ্ছিলো। চলচ্চিত্র, রাজনীতি,দর্শন এসবের ফাঁকে গল্পে অফিস ঢুকে গেলো। গতমাসে বোর্ড মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে চট্টগ্রামে একটা ব্রাঞ্চ খোলা হবে। মালিকপক্ষ চাচ্ছে আমি তার দায়িত্ব নিই, চাচ্ছে মানে একরকম সিদ্ধান্তই জানিয়েছে। আমার উপর আস্থার কথা বলা হচ্ছে কিন্ত এটা তার প্রতিদান! পাঁচ বছর কোম্পানিকে শ্রম দিয়েছি, কান্ট্রি অফিসকে দাঁড় করিয়েছি। এখন তার সুফল অন্যের হাতে তুলে দিয়ে আমাকে যেতে হবে নির্বাসনে, নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে! আর আমার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত কে হবেন সে তো জানা আছে সবার। এসব কর্পোরেট কূটচাল আমার অজানা নয়। বিষয়তো এমন নয় যে আমার চেয়ে কম্পিটেন্ট কাউকে খুঁজে পেয়েছে। বিষয় হলো আমাকে যে বেতনটা দিতে হচ্ছে তাতে কোম্পানির খুব আনন্দ হচ্ছে না। কান্ট্রি অফিস দাঁড়িয়ে গেছে মোটামুটি চালু লোকের হাতে পড়লে সিস্টেমই তাকে চালিয়ে নিতে পারবে। আর আমার হাতে থাকে দু’টো অপশান এই বেতনটা এখন আরামে উপভোগ না করে রক্ত পানি করে নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে অথবা চাকরিটা ছাড়তে হবে। দু’টোতেই কোম্পানি লাভের দিকে থাকে। বোর্ডের সাথে এ লড়াইয়ে আমি জিততে পারতাম যদি হাসান ভাইয়ের ভোটটা আমার দিকে থাকতো। কিন্তু উনিতো এখন কান্ট্রি ম্যানেজার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এ নিয়ে তিনি বেশ এক্সাইটেড। এ মুহূর্তে বয়ান দিচ্ছেন, ” বুঝলা শাহীন (আমার ডাকনাম), তুমি যখন চট্টগ্রাম চলে আসবা অফিস নিয়া, আমরা তখন ঘন ঘন ট্র্যাকিংয়ে বাইরাবো।” বলেই ঠা ঠা করে হাসছেন। তখনই আমি সাপের হিসহিসানিটা টের পেলাম। হাসান ভাই এক হাতে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য উপর থেকে নেমে আসা বড় গাছের ঝুরি ধরে আছেন। আমরা তখন একটা খাড়া পিচ্ছিল পথ পেরুচ্ছিলাম। আমি আঁতকে উঠে ‘সাআআপ’ বলে চিৎকার করে উঠলে হাসান ভাই আচমকাই ভারসাম্য হারিয়ে পিছলে গেলেন। পিছলে গেলেন কিন্তু পড়ে যান নি, গাছের ঝুরিটা হাত থেকে ফসকে গেলে পড়তে গিয়েও তিনি পাহাড়ের খাঁড়া পিচ্ছিল গা থেকে বেরিয়ে আসা একটা ত্রিকোণ পাথুরে মাথা ধরে ফেললেন। হাসান ভাই ঝুলে আছেন, নিচে গভীর খাদ। আমার হৃদপি- তখন লাফাচ্ছে, ঐ অবস্থাতেই আমি খানিক ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দেই। কিন্তু হাসান ভাই আমার হাত না ধরে পায়ের গোড়ালি ধরতে চাইলেন। আমি ভারসাম্য রাখতে পারিনি। এর সবই এত দ্রুত ঘটে গেলো যে মুহুর্তগুলোর ডিটেইলস ভাবতে বসলে একেকবার একেকরকম হয়ে যাচ্ছে। হাসান ভাই এরপর কী করেছেন তা কেউ দেখেনি। উনি নিজেকে ট্রেইলে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি জানতেন আমি ঠিক কোন জায়গায় পড়ে গিয়েছিলাম। তবু আমাকে খুঁজে পেতে দুইদিন লেগে গেলো। হাসান ভাই অবশ্য বলেছেন তিনি নিজেই ভুল ট্র্যাকে ঢুকে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। টিমের সদস্যদের খুঁজে না পেয়ে একাই লোকালয়ে যখন ফিরেছেন তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গাইড বলছে আমাদের দেরি দেখে সে ফেরত এসে কাউকে পায়নি। যা’হোক এ যাত্রায় আমরা দু’জনই বেঁচে গেছি তিনি অক্ষত আর আমি ভয়াবহ ক্ষত নিয়ে বাড়ি ফিরেছি।
সময় কেটে যাচ্ছে। হাঁটতে পারছি, তবে একটানা বেশিক্ষণ হাঁটাতো দূর, বসে থাকতেও পারি না। বন্ধুরা আসে, কলিগরা আগে নিয়মিত ফোনে খবর নিতো, আজকাল আমিই ফোন করি। ছুটি প্রায় শেষ হয়ে আসছে, ভাবছি এক্সটেনশানের আবেদন না করে জয়েন করে ফেলবো। চট্টগ্রামে শাখা উদ্বোধনের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিলো তা স্থগিত করা হয়েছে। খবরটি হাসান ভাই-ই দিয়েছিলেন, একটা অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিয়েছিলো খবরটা। আমি রহিমকে বলি আমার অফিস স্যুট লন্ড্রি করে রাখতে। রহিম আমার বাসায় কাজ করে, বাজার, রান্না থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের কাজই সে করে। প্রতিদিন প্রয়োজন হতো না বলে ড্রাইভার বেশ অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলো তাকেও জানিয়ে রাখলাম সামনের মাস হতে নিয়মিত আসতে হবে সকালের অফিস টাইম মেনটেন করে। মোটামুটি একটা প্রস্তুতির মানসিকতা নিয়ে আমি মেইল চেক করতে বসি। প্রথমেই হেড অফিস থেকে আসা মেইলটা পড়ি, দীর্ঘ মেইল। দু’দিন আগেই এসেছে, আমারই চেক করা হয়নি। মেইলের শুরুতে অনেকটা জুড়ে কোম্পানির সাথে আমার সুন্দর সম্পর্ক এবং কন্ট্রিবিউশানের দীর্ঘ বয়ান। প্রতিষ্ঠান যে আমার প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ এবং সংবেদনশীল তা বলা হলো নানাভাবে। আসল কথাটি বলা হলো শেষাংশে। আমার স্বাস্থ্য এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনায় উক্ত প্রতিষ্ঠান মনে করে যে কান্ট্রি অফিস পরিচালনা আমার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। অতএব কোম্পানি আমাকে কান্ট্রি ম্যানেজারের পদ হতে অব্যাহতি দিয়ে গোল্ডেন হ্যান্ড শেকের প্রস্তাবনা দিচ্ছে। আমি চাইলে কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে সংযুক্ত থেকে কোম্পানিকে সম্মানিত করতে পারি।
মোদ্দা কথা, আমার চাকরি গেছে। আমি চুপ করে বসে থাকি, নিজেকে বোকা বোকা লাগে। মেইলটা আরেকবার পড়ি। আমার চোখ জ্বালা করতে থাকে। আমি ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলে রোয়াংছরির দুর্গম এলাকায় একটা ঝোপের ভেতর থেকে বিষাক্ত সাপটাকে বেরিয়ে এসে ফণা তুলতে দেখি।
ফাহমিনা নূর, গল্পকার