ফজলুর রহমান
মরুর দেশের একটি খবর পড়ি শুরুতে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের খবর। যেখানের দুবাইয়ে ১০ কোটির বেশি গাছ লাগানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। শহরের ৭০ কিলোমিটার জুড়ে বৃহত্তম উপকূলীয় নগর সংস্কার প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই গাছ রোপণ করা হবে।
দেশটির পক্ষ থেকে ‘দুবাই ম্যানগ্রোভ’ নামের উদ্যোগের অধীনে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এর আওতায় উপকূলে বৃহৎ একটি ম্যানগ্রোভ বন গড়ে তোলা হবে। টেকসই শহর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ইউআরবি দুবাইয়ের উপকূল সংস্কারের এই উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এত সংখ্যক গাছ লাগানোর ফলে প্রতিবছর ১২ লাখ মেট্রিক টন কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষিত হবে, যা সড়ক থেকে ২ লাখ ৬০ হাজার গ্যাসচালিত গাড়ি বন্ধের সমান!
ইউআরবির প্রতিষ্ঠাতা ও নগর পরিকল্পনাবিদ বাহারাশ বাঘেরিয়ান বলেন, ‘ম্যানগ্রোভ উপকূলীয় ক্ষয় এবং সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রকৃতির নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। প্রকল্প শুরুর জন্য প্রাথমিকভাবে ছয়টি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে।
এসব স্থানের সংস্কারের জন্য নকশা করা হচ্ছে।’
উপকূলীয় নগর সংস্কার প্রকল্পটি ২০৪০ সাল নাগাদ শেষ হবে বলে জানিয়েছে ইউআরবি। এই ম্যানগ্রোভ বনের ওপর ভিত্তি করে দুবাইয়ের উপকূলীয় এলাকার পুরো বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠবে বলে মনে করেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
দেখুন তো কারবার! মরুর দেশে ১০ কোটির বেশি গাছের সুরক্ষা গড়ে উঠছে। আর বিপরীতে এই সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা দেশে গাছ বড় অবহেলার শিকার হচ্ছে। উজাড় হচ্ছে বন।
আমরা দেখেছি, ২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে এক দিনে ২০ কোটির বেশি গাছ লাগিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল ইথিওপিয়া। যে কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। এর আগে ২০১৬ সালে এক দিনে ৫ কোটি গাছ লাগিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবী অনেক সংগঠন বিভিন্ন রেকর্ড গড়েছেন। ২০১৫ সালে ভুটানের একদল স্বেচ্ছাসেবক এক ঘণ্টায় ৪৯ হাজার ৬৭২টি গাছ লাগিয়ে বিশ্বরেকর্ড করেছে। পূর্বে এই রেকর্ড করেছিল ভারত।
এ রকম বড় আন্দোলন কিংবা উদ্যোগ আমাদের দেশেও হওয়া জরুরি। কারণ, একটি দেশের আয়তন অনুযায়ী ওই দেশের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন সেখানে আমাদের আছে অনেক কম। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে দেশের আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে বলে জানান।
এতো কম বনভূমি এবং বৃক্ষ কমে যাওয়ার অন্যতম কুফল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে সাম্প্রতিক তাপপ্রবাহকে।
আমরা জানি, তাপপ্রবাহের প্রধান কারণ দুটি; একটি হল তাপমাত্রা এবং অপরটি আর্দ্রতা। বর্তমান বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের পিছনে রয়েছে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়া। আর আর্দ্রতার কারণ হলো ভূ-পৃষ্ঠের বাষ্পীভূত এবং উদ্ভিদ থেকে প্রস্বেদিত পানি। আবার পানির এই দুই উৎসই বৃষ্টিপাতের জন্য অপরিহার্য। বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকা সত্ত্বেও বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণ হলো মেঘ সৃষ্টি না হওয়া।
সুতরাং বলা যায় ভূ-পৃষ্ঠের যে অঞ্চলে উন্মুক্ত জলাধার এবং বৃক্ষরাজি বেশি থাকবে সেখানে জলীয়বাষ্পও বেশি তৈরি হবে। ফলে তাপপ্রবাহের মাত্রাও বেশি থাকবে। কারণ বাতাসের জলীয় বাষ্পের কণাসমূহ সূর্য থেকে আগত বিকিরণ সরাসরি শোষণ করে আবার ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত বিকিরণও শোষণ করে। এতে পানির কণাসমূহ নিজে উত্তপ্ত হয় এবং তাপ ত্যাগ করে পরিবেশকেও উত্তপ্ত করে তোলে।
অন্যদিকে জলীয়বাষ্প না থাকলে সূর্য থেকে আগত বিকিরণ বাধাহীন হয়ে ভূপৃষ্ঠে প্রতিফলিত হয়ে আবার আকাশে চলে যায়। অর্থাৎ বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্প অন্যতম একটি গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে কাজ করে। আর বাতাসের আর্দ্রতার জন্য প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে প্রাণিকুল অধিক তাপমাত্রা অনুভব করে যাকে “ফিল লাইক” তাপমাত্রা বলা হয়। এই কারণে মরুভূমিতে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও আর্দ্রতা কম থাকায় “ফিল লাইক” অবস্থা থাকে না। ফলে মরুভূমিতে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও তুলনামূলকভাবে তাপদাহ কম অনুভূত হয় যেটা আমাদের এই অঞ্চলে বেশি হয়।
উদ্ভিদরাজি প্রয়োজনীয় জলীয়বাষ্প তৈরি করে বৃষ্টিপাতে সাহায্য করে। সুতরাং বনভূমি রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বনভূমি ধ্বংস করা মানে বিপর্যয় ডেকে আনা। এছাড়া যে অঞ্চলে উদ্ভিদরাজি রয়েছে সে এলাকার মাটি হয় উর্বর।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতার ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম তিনটি ক্যাটাগরিতে ১২টি দেশের তালিকায় বন্যায় প্রথম অবস্থানে বাংলাদেশ, ঝড়ে দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ প্রথমে রয়েছে ফিলিপাইন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে দশম অবস্থানে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে যে বিবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং ইতোমধ্যে পড়েছে তার মধ্যে রয়েছে বৃষ্টিপাত হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিঝড়, ভূমিকম্পসহ নানা দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার হিসাব অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট জায়গার দৈনিক যে গড় তাপমাত্রা বিরাজ করে, তা থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে এবং তা পরপর ৫ দিন চলমান থাকলে তাকে হিটওয়েভ বলে। আমাদের দেশে এই হিটওয়েভ শুরু হয় ৩৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে। কিন্তু সম্প্রতি কিছু কিছু স্থানে তা প্রায় ৪৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত চলে গেছে।
খাদ্যের উৎস, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, চিত্তবিনোদন এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। বৃক্ষ থেকে আমরা বিভিন্ন প্রকার ফল, মিষ্টি রস, ভেসজ দ্রব্য, কাঠখড়িসহ অনেক মূল্যবান সম্পদ পাই। বিভিন্ন প্রকার ফল উৎপাদনে বৃক্ষের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। ফল শারীরিক ও মানসিক পরিপূর্ণতা বিকাশ লাভে সহায়তা করে। দুনিয়ার সব রোগের ওষুধ রয়েছে উদ্ভিদের মধ্যে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকায় মানুষের এসব ওষুধের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। বৃক্ষরাজি বাতাস থেকে ঈঙ২ শোষণ এবং অক্সিজেন (ঙ২) ত্যাগের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। একটি বয়স্ক বৃক্ষ ১০ জন মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা পূরণ করে। বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডের অধিক বিষাক্ত গ্যাস শোষণ ও ১০টি এসির সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করে। শত শত টন কার্বন শোষণের মাধ্যমে বায়ুর দূষণরোধ ও তাপদাহ দুপুরে প্রস্বেদনের মাধ্যমে বাতাসে প্রায় ১০০ গ্যালন পানি নির্গত করে পরিবেশ ঠান্ডা রাখে। বৃক্ষরাজি শব্দ দূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। সর্বোপরি সবুজ বৃক্ষের মনোরম দৃশ্য ও নির্মল বাতাস সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ সব মানুষের চিত্তবিনোদনের আকর্ষণীয় উপাদান।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী জানান, সরকারের এসডিজি এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২৫) বাস্তবায়নে বন অধিদপ্তর থেকে দেশব্যাপী বনাচ্ছাদন ও বৃক্ষাচ্ছাদনের পরিমাণ ২০২৫ সালের মধ্যে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ২ ও ২৪ শতাংশে উন্নীত করা হবে। আমরাও এভাবে আশাবাদী থাকতে চাই। এমন আইন হোক, যে আইনে পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে অন্তত একটি বৃক্ষ চারা রোপণ ও পরিচর্যা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এমন মূল্যবোধ গড়ে উঠুক যে মূল্যবোধে একটি বৃক্ষনিধন দেখে হাহাকারে ভরে উঠবে অনেক মানব মন। এমন ভবিষ্যত গড়ে উঠুক যে ভবিষ্যত বৃক্ষে আচ্ছাদিত। আসুন, কাজে নেমে পড়ি। যে যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখি।
ফজলুর রহমান, উপ-পরিচালক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)