ফজলুর রহমান : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মতে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দাবদাহে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ১২৫ মিলিয়ন। ২০০৩ সালে ইউরোপে তীব্র দাবদাহের কারণে ৭০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলো। ২০১০ সালে রাশিয়াতে ৫৬ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ ছিল দাবদাহ। প্রতি বছর মেক্সিকো এবং ইন্দোনেশিয়াতে অতিরিক্ত তাপের সাথে সম্পর্কিত নানা জটিলতায় বহু মানুষ মারা যান।
আর এই দাবদাহ নিয়ে ভবিষ্যতেও কোন কোনো আশার বাণী শোনাতে পাচ্ছেন না বিজ্ঞানীরা। বরং বলা হচ্ছে, বিশ্বের কিছু অঞ্চলে দাবদাহের তীব্রতা এত বাড়বে যে, এসব অঞ্চল মানুষের বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে উঠবে।
প্রতি বছরই গরমে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। এসব মৃত্যুর বেশিরভাগই ঘটে গরম-জনিত হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের কারণে। বেশিরভাগ সময় শরীরের তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করতে গিয়েই এসব ঘটে থাকে। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের শরীরও গরম হয়ে যায়। এর ফলে রক্তনালীগুলো খুলে যায়। এর ফলে রক্ত চাপ কমে যায় যে কারণে সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা হৃদপিন্ডে জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এসব কারণে মৃদু কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে যার মধ্যে রয়েছে ত্বকে ফুসকুড়ি পড়া, চুলকানি এবং পা ফুলে যাওয়া যা রক্তনালী উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে হয়ে থাকে। এছাড়াও প্রচুর ঘাম হওয়ার কারণে শরীরে তরল পদার্থ ও লবণের পরিমাণ কমে যায়, গুরুতর ক্ষেত্রে দেহে এ-দুটো জিনিসের মধ্যে যে ভারসাম্য আছে তাতেও পরিবর্তন ঘটে।
মানুষের শরীর আভ্যন্তরীণ তাপ ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখার জন্য কাজ করে। আশপাশে পরিবেশ যদি গরম হয়ে ওঠে তাহলে মানুষ তার শরীর থেকে সেটি দুর করার জন্য কাজ করে। ইউরোপের ফেডারেশন অফ রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ ড্যাভরন মুখামাদিয়েভ বলছেন, “আমাদের শরীরের উপরে যদি তাপ বেশিক্ষণ থাকে তাহলে তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।” তিনি বলছেন, সেক্ষেত্রে হৃদযন্ত্র শরীরের উপরিভাগ ও ত্বকে বেশি রক্ত পাঠাতে থাকে। সে কারণে বেশি গরম লাগলে অনেক মানুষের চেহারা লাল দেখায়।
তবে এই তাপদাপ সহ্য করাটাই যেন ভবিষ্যতের নিয়তি। সর্বশেষ জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের একটি যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে দাবদাহের ঘটনা বাড়ছেই। আর এ কারণে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বের কিছু অঞ্চলে দাবদাহের তীব্রতা এত বাড়বে যে, এসব অঞ্চল মানুষের বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে উঠবে। সংস্থা দুটি বলছে, মানুষ কত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে, তার একটি মানসিক ও সামাজিক সীমা আছে। আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল, হর্ন অব আফ্রিকার দেশগুলো, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় দাবদাহ এতটা বাড়বে যে, মানুষের পক্ষে তা সহ্য করা কঠিন হয়ে যাবে। এতে মানুষের বড় ধরনের ভোগান্তি ও প্রাণহানি ঘটবে। সংস্থা দুটির প্রতিবেদনে আরও সতর্ক করা হয়েছে, প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দাবদাহের কারণে বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। আগামী দিনগুলোয় প্রাকৃতিক এসব বিপর্যয় আরও ভয়াবহ, ঘনঘন ও তীব্রতর হবে। ভবিষ্যতে দাবদাহ-সম্পর্কিত মানবিক জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ারই পূর্বাভাস দিচ্ছে এসব বিপর্যয়।
এ প্রতিবদেন নিয়ে রেডক্রসের মহাপরিচালক জগান চাপাগাইন বলেছেন, ‘আমরা এটা নিয়ে কোনো নাটকীয়তা করতে চাই না। কিন্তু তথ্য-উপাত্তে এটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এটা আমাদের একটা অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করছে।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে বয়োবৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী, খেলোয়াড় এবং যারা বাইরে কায়িক পরিশ্রমের পেশার সাথে জড়িত তারা সবচাইতে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বয়োবৃদ্ধ, শিশু এবং গর্ভবতী নারী ঝুঁকিতে থাকেন কারণ তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীর থাকে। যারা বাইরে কায়িক পরিশ্রম করেন যেমন কৃষক অথবা রিকশাওয়ালা, তারা ঝুঁকিতে থাকেন কারণ তারা সূর্যের নিচে বেশি সময় কাটান। গরমে শারীরিক শ্রম শরীরকে আরও গরম হয়ে ওঠে। বাইরে যারা কায়িক পরিশ্রম করেন তাদের সাথে সাথে খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রেও এটি বেশি ঘটে। বাইরের তাপের সাথে শরীর যখন আর সামঞ্জস্য রাখতে পারে না তখন এটি ঘটে। দেখা যাচ্ছে যে, তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪২ পর্যন্ত গেলে, সেই সাথে যদি আর্দ্রতা বেশি থাকে তখন এমন সম্ভাবনা বেশি থাকে।
এর থেকে মুক্তির জন্য কিছু টিপস্ বাতলে দিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। এরমধ্যে রয়েছে বাইরে কাজ কমিয়ে আনতে হবে। বিশেষ করে বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সূর্য থেকে দুরে থাকতে হবে। ঘর ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করতে হবে। পর্দা ব্যবহার করে গরম ঢুকতে বাধা দিতে হবে। জানালার বাইরে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয় এমন বস্তু দিয়ে রাখতে হবে। প্রচুর পানি খেতে হবে। নিয়মিত গোসল করতে হবে এবং বারবার মুখ ও শরীরে পানির ঝাপটা দিতে হবে। যথেষ্ট বিশ্রাম নিতে হবে।
ঢিলেঢালা এবং বাতাস পরিবহনকারী পোশাক পরতে হবে। বাইরে সানগøাস ব্যবহার করতে হবে। তীব্র দাবদাহ চলাকালীন দিনে তিন ঘণ্টার বেশি বাইরে কাটানো যাবে না। এই সময়ের মধ্যেও ঘনঘন ছায়ায় চলে যেতে হবে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় বর্জন করতে হবে।
ফজলুর রহমান, উপ-পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)