রহিম উদ্দিন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ নোবেল জয়ের মাধ্যমে বাংলা কবিতা ১৯১৩ সালে বিশ্ব কবিতার মর্যাদা লাভ করে। ফলে, বাংলা সাহিত্য ও বাংলা কবিতা হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক সাহিত্যের অংশ। আর এর পেছনে রয়েছে আধুনিক বাংলা কবিতা। সমসাময়িক কবিদের মধ্যে দালান জাহান পুরোপুরি কবিতার মানুষ। আধুনিক ও উত্তরাধুনিক কবিতার মিশেলে কবিতা লিখতে সিদ্ধ হস্ত এ কবি প্রায় পরিচিত শব্দ দিয়ে তৈরি করি অপরিচিত কবিতায় জাল। যা, পাঠকের কাছে হয়ে উঠে দূর্ভেদ্য অথচ উপভোগ্য। কবিতা শৈলী মূলত এখানেই, সহজ স্বাভাবিক, পাঠক বুঝতে পারবে আবার পারবে না। তার কবিতা নিজের স্বীকারোক্তি। সমসাময়িক বিষয়ে যেখানে অন্যরা নিরব, সেখানে তিনি নির্দ্বিধায় লিখেছেন, “ঘর জ্বলে না বুক জ্বলেরে / এই জ্বলা কি হবে শেষ /কোথায় পোড়ে হিন্দু বাড়ি /পোড়ে আমার বাংলাদেশ। ” একটা স্বাধীন দেশের ভেতরে বাইরে অগণিত প্রতিবন্ধকতা থাকে, আর কোথাও কোনো এক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করলে তা যেমন ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না, তেমনি তা পুরোদেশকে করে জর্জরিত। তাই ব্যঙ্গ করে ” ক্ষুদিরাম ” কবিতায় বলতে চেয়েছেন, “তিনি জিজ্ঞেস করলেন / তুমি কাকে পড়ো…/ আমি বললাম কাক আর দুর্ভিক্ষকে। ” সত্যিই কী দুর্ভিক্ষকে পড়া যায়? হ্যাঁ, পড়া যায়, কবি ত সে, যে দুর্ভিক্ষ পড়তে জানে আর পড়তে জানে সমাজের কালো কাকদের চরিত্র। কবির পড়া দুর্ভিক্ষ আর কালো কাক আমাদেরই সমাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যা আমরা দেখি না, কবি দেখে। কবির এ বাস্তবতার মোহে পাঠক হারিয়ে যায়, যেখানে গেলে মানুষ হয়ে যায় ভাবুক। কখনো কখনো কবিতায় তিনি ছড়িয়ে দেয় উষ্ণতা, চিরসবুজের উত্তাপ। তিনি যখন লিখেন, “সবুজ পাতার রেডিওথেরাপি নিয়ে / বসে থাকে গিরগিটি/ ট্যাক্সির হুড ধরে মফস্বলে যায় / বোতাম ছাড়া দুঃখগুলো।” তখন আমাদের আর বুঝতে বাকি রইলো না, আমাদের উপর মহল আর নিচের মহলের শ্রেণি বৈষম্য ও সুযোগ সুবিধার ব্যবধান। কিংবা কারো কারো বেঁচে থাকে নিরাশার প্রদীপ হাতে। কিংবা কবি যখন লিখে, ” এ শহর শান্তির শহর / এ শহর সুখের শহর /ফরচুনা’র ডানা দেখতে জেগে আছে/ বহু বছর বহু বছর। “অপ্রিয় হলেও সত্যিই, তখন আমাদের কাছেও মনে হয়, এ শহর শান্তির শহর, ফরচুনা’র ডানা দেখতে জেগে আছে বহু বছর। যে প্রতীক্ষা ঘরে ঘরে, প্রাণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে বহুকাল আগ থেকে।
দালান জাহান আমার কাছে নিত্যপাঠ্য একজন কবি। কেননা, তাকে পড়তে হয়, পড়তে হয় এবং অনুধাবন করতে হয়; অন্যথায় পাঠ কখনোই সুসম্পন্ন হয় না। কবিতার অলিগলিতে তিনি জীবনকে মানুষের জন্য রচনা করে ঠিক এইভাবে;
এক.
“যে শহরে তুমি নেই
সে শহর বিছিয়ে রাখে
দুশ্চিন্তার মতো অনাত্মীয় জাল…”
দুই.
“আগে আধুনিকা বলতে বুঝতাম
মেহেরুন্নেসার বুক ভরা বকুল বাগান
এখন দেখি বাট ভাঙা উদোম সিগারেট
হালের ছেঁড়া ছিন্ন জামার নিচে
খোলে রাখা উর্বশী’র উলঙ্গ বোতাম।
কবিতার শৈলী এবং কাঠামো বিবেচনায় দালান জাহানের কবিতার স্বতন্ত্র একটি বৈশিষ্ট্য ও ধারা দেখতে পাই। পরিমিত ছন্দবোধ, উপমা ও অলংকরণ তার কবিতাকে করে তুলে গতিময় ও লাবণ্য। পাঠককে আকৃষ্ট করেই ন্যাপথেলিনের মতে উবে যায় অনায়াসে। ইথারে হাটে পাঠকের অন্তরাত্মা সঙ্গী করে। তাই তিনি কবিতায় বলে-
এক.
“আমার একলা রাত
একা একা একলা রাত
আমি ছিটকে পড়ি মহাশূন্যে
পৃথিবী জড়িয়ে রাখে হাত
একলা রাত
আমার একা একা একলা রাত।”
দুই.
“শ্মশানঘাট পেরিয়ে নদীর ঘাটে যাই
নদীতে ভাসে মানুষ পোড়া ছাই।
……………………………………….
আজও পাথর ভাঙা মাছেরা দেয় বাঁচার সাঁতার
অরণ্যের শেষ বিবৃতি পৃথিবী এক হাসপাতাল। ”
তিন.
“তোরে না দেখতে-দেখতে
আমার হয়েছে অন্য অসুখ
সব আয়োজন পেছনে ফেলে
বসে থাকি পোড়া পাখির মতো
লোকে যারে কথায় বলে
তুষের তলে জাঁক দেওয়া বুক।
সত্যিই এখন আমাদের হয়েছে অন্য অসুখ। যা সারাতে না পারলেই একদিন গৌরব ও শৌর্যবীর্য মুছে যাবে। তবে এ অসুখ আমরা এড়িয়ে গেলেও কবি পারে না। কবি বারংবার এ অসুখের অভিশাপ হতে মুক্ত হতে চাই। সে উন্মাদনা থেকেই লিখেছেন, “আমি বরফ তাপে উদ্ভাবন করি হৃদয়শুমারি/ তার দুঃখ আমার ভালোবাসার সমান।” অর্থাৎ, চাইলেই ভালোবাসা দিয়ে সবকিছুই জয় করা যায়, তার জন্য কেবল হৃদয়শুমারি নামক আত্মোপলব্ধির প্রয়োজন। এ আত্মোপলব্ধি একান্তই বিবেকের এবং একান্ত। আর এ বোধ যখন জন্ম লয় তখন মানুষ ফিরে যায় তার মালিকের সান্নিধ্যে। কবি তার এ বোধের জায়গায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, “মানুষ মরে যায় বস্তুত মৃত্যুর বহু আগে/পড়ে থাকে লাশ!/দীর্ঘশ্বাস! /পথভর্তি শোক! হাহাকার কারবারি! /বড়ো দেরিতে পৌছায় পৌরসভার গাড়ি।” যদিও ভাবের দুর্ভেদ্যতার কারণে দালান জাহানের কবিতাকে সহজে কেউ কেউ আত্মস্থ করতে অক্ষম, তথাপি এ কথা মানতেই হয় যে, তার কবিতার পরতে পরতে রয়েছে উপভোগের নানা শ্বৈল্পিক উপাদান।
রহিম উদ্দিন, কবি ও প্রাবন্ধিক