রাজকুমার শেখ :
গতকাল বৃষ্টিতে ভিজে নাজের ঠান্ডা লেগেছে। আজ ওর কলেজ যেতে ইচ্ছে করছে না। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল। আম বাগানে রোজ সকালে গলা ফাটিয়ে মৌটুসীটা ডাকে। ঠিক ওর জানালার কাছের আম গাছটার কাছে বসে। ওর ডাকে নাজের রোজ ঘুম ভেঙে যায়। নাজ ওকে মনে মনে বলে, তুই একটা কি রে? আমার ঘুম ভাঙিয়ে দিস। যা অন্য কোথা। আমাকে ঘুমোতে দে।
ও আরও জোরে ডাকে। ওর চিকন গলার বেশ জোর। নাজ আর রাগ করতে পারে না। বরং ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে খুব ইচ্ছে করে। এমন সময় নোরিন ফুপু ঘরে আসে।
নাজ, কি হল তোর? কলেজ যাবি না?
যাবো ফুপু।
ওঠ বেলা হল।
হুম।
চা দেবো?
দাও।
নোরিন ফুপু চলে যায়। নাজ ওঠে পড়ে। কলতলে গিয়ে ফেস হয়ে আসে। নিজেকে আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। চোখ দুটো ফোলা ফোলা। বৃষ্টিতে ভিজলেই এমন হয় ওর। গতকাল ওর বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক হয়নি। মিনাও ভিজেছে। ও হয়তো কলেজই আসতে পারবে না। মিনা কলেজ না এলে ওর ভালো লাগেনা। হাবুদার চায়ের দোকানে গিয়ে বসে চা খাওয়া। গল্প। কবিতা। বেশ সময়টা কেটে যায়। হাবুদার সঙ্গে ওর বেশ ভাব হয়ে গেছে। মানুষটি বেশ প্রাণ খোলা। ঠিক পাকা ব্যবসাদার না। আপন মন ভোলা দিল খোলা মানুষ। নাজ ওর কবিতা শুনতে শুনতে কেমন অন্য জগতে হারিয়ে যায়। বৃষ্টি এলেই এখন মন করে হাবুর কাছে যেতে। এ সব আবার রমি পছন্দ
করে না। না এবার যেতে হবে। কলতলাতে যত রাজ্যের শুকনো পাতা জমে। এখন এ সব পরিষ্কার করার জন্য ওর হাতে সময় নেই। নাজ তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আসে। খোলা বারান্দা দিয়ে আসতেই ওর চোখ পড়ে ফুপুমার রুমে। ওর ফুপু একটা পুরোনো দিনের জং ধরা বাস্ক থেকে কি সব বের করছে। নাজ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে। জরি দেওয়া শাড়ি। শাড়ি গুলো দেখেই বোঝা যায় খুব দামি। তার ভেতর থেকে একটা ঘুংঘুর বেরিয়ে এলো। তার শব্দ শোনা গেল। ওর ফুপু এ সব পেলেন কোথা থেকে? নাজ বেশ অবাক হয়। ও ঠিক বুঝতে পারে না। এ গুলো কি কেউ রাখতে দিয়েছে? অনেক দামি দামি জিনিস রাখা আছে। নাজ আর দাঁড়ায় না। ও ওর রুমে চলে আসে। বই গুলো গুছিয়ে নেয়। এমন সময় ওর ফুপু আসেন ওর রুমে। নাজ হাতের বই গুলো রেখে জিগ্যেস করে, ফুপু, তোমার ওই বাস্ক থেকে ও সব কি বের করছিলে? এর আগে তো কখনো দেখিনি।
এ কথা শুনে ওর ফুপু একটু থম মেরে যান। তারপরে একটু সময় নিয়ে বলেন, ও গুলো একজন আমাকে রাখতে দিয়েছে। তাই দেখছিলাম ও গুলো ঠিকঠাক আছে কি না।
নাজ এ কথার কোনো মাথামু-ু বুঝতে পারে না। নাজ আর কিছু জিগ্যেস করে না। সকালের চাটা আমেজ করে চুমুক দেয় ও। মৌটুসীটা এখনো ডাকছে। ওর যেন বিরাম নেই। নাজ ওকে হাত বাড়িয়ে ডাকে। ওর হাত বাড়ানো দেখে ফুরুৎ করে পালিয়ে গেল।
মিনা অনেক আগে কলেজে এসেছে। আজ ওদের তেমন ক্লাস নেই। নাজ আসছে না দেখে ও হাবুর চায়ের দোকানে যাবে কি না ভাবছে। আজ আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি নামতে পারে। কলেজ ফাঁকা। কলেজের করিডোরে দু একটা শালিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। গাছের পাতা গুলো গাঢ় সবুজ।সতেজ। মিনা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। এমন সময় হঠাৎ ওর পাশে এসে বসে ওর সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে রহিম। খুব কম কথা বলে। মেয়ে দেখলে সরে যায়। আজ ও কি মনে করে? মিনা বেশ অবাক হয়। রহিমের চেহারাটাতে রাত জাগরণের ছাপ। সে যেন খুব ক্লান্ত। মিনা ওকে জিজ্ঞেস করে, কি হল রহিম? কিছু বলবে?
রহিম ওর দিকে চায়। একটু সময় নেয়। তারপরে বলে, মিনু, আমাকে একটু সাহায্য করবে?
কেন কি হয়েছে?
তুমি আগে করবে কি বলোনা?
আগে বলবে তো।
আমি খুব সমস্যাতে আছি। মা হয়তো আর বাঁচতে না। অপারেশন করতে অনেক টাকা লাগবে। আমি কোথায় পাবো। খুব কষ্ট করে পড়াটা চালায়। তার অপর মা। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।
রহিমের চোখে জল। মিনা কি বলবে ও ভেবে পায়না। মিনা ওকে সান্তনা দেয়।
রহিম, তুমি চিন্তা করো না।
আকাশে মেঘটা বেশ ঘন হয়ে আসছে। রহিমের জানি ও কি করতে পারে। নাজ এলে একটা কিছু ভাবা যাবে।
রহিম, চলো হাবুদার দোকান।
কলেজ এর গেটের সামনে আসতেই নাজের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ওর সঙ্গে রহিমকে দেখে নাজ বলে, রহিম এর কি হল?
চল হাবুদার দোকান। সব বলছি।
হাবুদার দোকান ফাঁকাই ছিল। এ সময় কেউ আসে না। ওদের আসতে দেখে হাবুদা আলতো করে হাসে। মিনা রহিমের জন্য খাবার বলে। নাজকে সব বলে মিনা। নাজ সব শুনে বলে, আমার কিছু জমানো টাকা আছে। ওটা দিয়ে মায়ের কাজ হবে।
রহিম যেন হাতে চাঁদ পায়। এক সময় রহিম ওঠে পড়ে। ওর মায়ের কাছে চলে যায়।
ওরা বসে থাকে। হাবুদা আজ একটু অন্য মনস্ক। নাজ বলে, চল একটু নদীর পাড় গিয়ে বসি। আজ কিছু ভালো লাগছে না। ওরা হাবুর চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে আসে। জেলখানার পাশ দিয়ে ওরা হাঁটতে থাকে। রাস্তাতে লোকজন কম। নাগকেশর ফুলের গন্ধতে গোটা পৃথিবী যেন ভরে গেছে। নাজ বুকভরে বাতাস নেয়। ওর মন যেন ভরে গেল। ওর বেশ ভালো লাগছে। মনটা এবার উড়তে চায়ছে। মিনা ওকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, নাজ, রহিম, কেমন ছেলে?
হঠাৎ!
না এমনি বলছি।
এমনি এমনি কি কোনো কথা হয়? বল খুলে সবটা।
আরে বাবা তেমন কিছু না। ওকে দেখে আমার খুব মায়া লাগে। বেচারা খুব কষ্ট করে পড়াটা চালায়। ওর বাপ বেঁচে নেই। আজ ও থাকতে পারেনি বলে এসেছে। ও সহজে হাত পাতা ছেলে নয়। বেচারা।
নারে সত্যি ও ভালো। ওকে তুই জীবন সঙ্গী করতে পারিস।
ভেবে দেখবো নাজ।
অত ভাবার কি আছে? রহিম ভালো ছেলে।
তুই বলছিস?
হুম।
বাবারে এক কথাতে মত দিতে হবে?
দিতে হবে। কেন তোর বুঝি আপত্তি আছে?
না। তবে ভেবে দেখি। বাড়ির লোকজন আছে। তাদের মতামত নিতে হবে না। একেবারে আমাকে তুই বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিচ্ছিস।
তুই খুব ভাবিস।
না ভাবলে হবে। দুনিয়া বদলে গেছেরে। মানুষ বদলে যাচ্ছে।
বদলে যাক। তুই ঠিক থাকলে সব ঠিক আছে।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে ভাগীরথীর কাছে। শান্ত নদী বয়ে চলেছে। কোনো হেলদল নেই। কত কত যুগ ধরে বয়ছে। কত কিছুর সাক্ষী। এই নদীর কাছে এলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। শীতল জলের নীরব হাত ছানি। নাজ মুগ্ধ হয়ে নদী দেখছে। আদর করতে ওর খুব মন করে। যেন বুকে জড়িয়ে ধরে ওকে ঘরে নিয়ে যেতে চায় ও। গোটা ঘরে নদী। মনে নদী। ভালো বাসাতে নদী। নদীর সঙ্গে যেন তার ঘর। যে ঘরে কেউ থাকবে না। নদীর ডাকে সে জেগে উঠবে। তাকে ডেকে নিয়ে যাবে বালুচরে। নদী তাকে গান শোনাবে। আদর দেবে। নাজের কেমন এক ভালো লাগাই ওর মনটা নেচে ওঠে। অনেক দিন পর আজ তার উড়ে যেতে মন করছে। ও গুন গুন করে গান ধরে। মিনা কেমন বোকার মতো ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ও ঠিক এই নাজকে চিনতে পারছে না। ও হা হয়ে গেছে। ও থাকতে না পেরে নাজকে এক ধাক্কা দেয়।
এই তোর কি হয়রে মাঝে মাঝে?
নাজ বেশ চমকে যায়।
কই কি হবে?
না কি মনে মনে বিড়বিড় করছিস?
আমি?
হুম মহারানি।
ওরে বাবা, তেমন কিছু না। তুই না।
কি?
পাগলিনী।
আমি না তুই?
আচ্ছা বাবা, আমি। হার মানলাম তোর কাছে।
চল কোথাও গিয়ে বসি।
ওরা নদীর পাড় ঘেঁষে এসে বসে। পাল তোলা নৌকা ভেসে যাচ্ছে। ওপারে বন। সবুজ সবুজ গন্ধ। জলজ গন্ধ। মাছের গায়ের গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নাজ বুক ভরে সে গন্ধ নেয়। আজ আর সূর্যের দেখা মিলবে না। মিনা ফিরলে তবেই ওর ফেরা হবে। কলেজ আজ না এলেও ভালো হতো। আজ শুধু শুধু আসা। ও অবশ্য মিনার জন্য এসেছে। মিনাকে একদিন না দেখলে ওর কিছু ভালো লাগে না। বাড়িতেও ওর ভালো লাগে না। ছুটির দিন গুলো কাটতে চায় না। রমিরও দেখা নেই। আজকাল ও কোথায় থাকে কে জানে।
ওরা যখন উঠলো তখন বেলা শেষের পাখিরা বাসায় ফিরছে। তাদের ডাকডাকি শোনা যাচ্ছে। নাজ মিনার কাছে বিদায় নিয়ে ও চলে যায়। মিনা রহিমের কথাটা আবার ভাবতে থাকে। ওর কথা ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হয়। আজ ও যেন কেমন এলোমেলো। মিনার সব কেমন হয়ে যায়। বেলা শেষ হয়ে আসছে একটু একটু করে।
রাজ কুমার শেখ, কথাসাহিত্যিক, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ