এখন সময়:সন্ধ্যা ৭:১৩- আজ: শনিবার-১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:সন্ধ্যা ৭:১৩- আজ: শনিবার
১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

দুপুর রঙের বৃষ্টি (পর্ব-১৩)

রাজ কুমার শেখ

বৃষ্টি পড়লেই নাজের মন খারাপ হয়ে যায়। সে কোথাও বের হতে পারে না। ভাবনার জাল বুনে চলে সারাক্ষণ। সব হাবিজাবি কথা। পুরোনো রেকর্ড এর মতো। পিন আটকে গেলে তা একই জায়গায় বাজতে থাকে। আজ নোরিন ফুপু ঘরে নেই। ইরানি পাড়াতে গেছে। অবশ্য কখন ফিরবে তা বলে যাননি।  নাজ আজ নিজ হাতে চা করে খেল। অনেক দিন পর ও চা করলো। মিনা থাকলে বেশ জমিয়ে আড্ডা হতো। সেদিন ও থাকেনি। রমির সঙ্গে চলে গেছিল। নাজের মনটা আজ ভালো নেই। ওর মায়ের কোনো খোঁজই সে জোগাড় করতে পারেনি। বেশ চিন্তাতে আছে ও। খোলা জানালা দিয়ে ও তাকিয়ে আছে। আম পাতাতে বৃষ্টি পড়ছে। কেমন একটা শব্দ হচ্ছে। যেন বৃষ্টি নাচছে। আজ ও বাড়ি থেকে বের হতে পারবে না। বৃষ্টি হলেই ওর মনটা কেমন করে ওঠে যেন। বুকের মধ্যে কেমন এক শিরশিরানি ভাব। ওর ভরাট বুকের বাঁধন ছিঁড়ে যেতে চায়। কাউকে যেন ও খুঁজে চলে। সে কে ও জানে না। তবে কেউ যেন ওর জন্য অপেক্ষা করে আছে। পথের কোনো বাঁকে হয়তো ওর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে।

সে গেলেই ওর হাত ধরে কোনো সবুজ খেতি জমির মধ্যে দিয়ে ওকে নিয়ে যাবে। ওর রক্তিম গালে তার হাতের পরশ দেবে। একেই বলে ভালো বাসা? সে রমিকে বন্ধুর মতোই দেখে। কিন্তু আদৌও অন্য রকম মনে হয়না। মনের বন্ধ ঘরটাতে অন্য কেউ এসে ঠোকা দেয়। নাজ আজকাল এমনটা অনুভব করে। তার এমন হয় কেন? কিন্তু ওর মন তো পড়ে আছে তার মায়ের জন্য। এ শহরটা আর ভালো লাগেনা। কেমন মরা মরা সব। সিরাজ-উদ্দৌলার মৃত্যুর পরই সব যেন হারিয়ে গেল। কেউ আর এ শহর আর সাধারণ মানুষের কথা ভাবেননি। সাধারণ মানুষ কাজ হারালো। কাশিমবাজারের বন্দর কেমন থম মেরে গেল। বিরাট জনপদ হারিয়ে গেল। অথচ পরবর্তী নবাব গণ সে ভাবে আর উন্নতি করতে পারেনি। সব লুটপাট হয়ছে সম্পদ। ব্রিটিশরা ভোগ করেছে।  মুর্শিদাবাদের জৌলুশে একটু একটু করে ধুলো জমতে জমতে তা পাহাড় হয়েছে। মরচে পড়ে গিয়েছে সবখানে। ১৭৫৭ পলাশীর যুদ্ধই মুর্শিদাবাদের ধ্বংসের কারণ। এখন সাধারণ মানুষ অনেক কষ্টে দিনযাপন করে। তেমন কোনো কাজ নেই। সাধারণ মানুষ এখান থেকে অন্যতরে চলে যায়। কেমন সব বদলে গেল। সারা শহর জুড়ে হাহাকার। সিরাজদৌলার মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু সাধারণ মানুষ জেগে উঠলে হয়তো অন্য রকম ঘটতো। সিরাজ দৌলা বেঁচে থাকতেন। কিন্তু মির্জাফরের বিরুদ্ধে কেউ রুখে দাঁড়াতে পারেনি। সিরাজদৌলার ভালোবাসার হীরাঝিল দখল করে নেয়। দখল হয়ে যায় তাঁর মসনদ। বাংলার ইতিহাস বদলে যায়।

আজ কেমন এক ভাবনায় পেয়েছে নাজকে। সেও সিরাজের পরাজয় মেনে নিতে পারে না। তপ্ত মাটিতে তাঁর রক্ত ঘাম মিশে আছে। আজও যেন মনে হয় সে ফিরবে। বাংলার ছোট নবাব। নাজ তাঁকে বরণ করে নেবে। কিন্তু হায় সেই মহান মানুষটি শুয়ে আছে খোশবাগের মাটিতে। কি নিষ্ঠুর পরিণতি!

নাজের মন খারাপ হয়ে যায়। বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি এখন তার বুকেও। আজ মনে হয় বৃষ্টি ছাড়বে না।  ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে।  আজ তার মন জুড়ে বৃষ্টি। এ বৃষ্টিতে আজ ও ভিজে যাবে। এমন সময় বৃষ্টিতে ভেজা একটা ঘুঘু ডেকে উঠলো ঘুগ যুগ করে। দূরে কে যেন সারেঙ্গী বাজাচ্ছে। তার করুন সুর বাতাসে মিশে আছে। কে যে বাজাচ্ছেন? কে জানে! এ শহরের রহস্য কেউই জানে না। এখনো রাতে গা ঝিম ঝিম করে। মন শিউরে ওঠে। এখনো কি কোনো নবাব রাতে ঘোড়া করে ছুটে যায়? তার যাওয়ার শব্দ কানে ভেসে আসে। খোশবাগে লুৎফার কান্না শোনা যায়। মীরজাফরের কবরে কারা যেন পাথর মারে।

কত কী-ই ওর কানে আসে। অবশ্য নাজ ও সব মানতে চায়না। সময় বদলেছে। কিন্তু মানুষের অবস্থা কি বদলেছে? বহু মানুষ বেকার। এখানে তেমন কোনো কাজ নেই। অন্যতর চলে যাচ্ছে। এ শহর এখন মরা গাঙ।

আজ বৃষ্টি মনে হয় ছাড়বে না। নোরিন ফুপু সকালে যে কোথায় গেলেন? ওকে বলেও যায়নি।  নাজ বিছানা ছেড়ে ওঠে। তারপর একটা লম্বা হাই তোলে। কেমন এক ঝিমুনি ভাব। শরীর অবশ লাগছে। কলেজের নোটস গুলো একবার দেখবো বলে উঠে গেল টেবিলের কাছে। বই খাতা নাড়াচাড়া করে। কিন্তু ওর মন বসলো না। ও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর কি মনে করে নোরিন ফুপুর শোবার ঘরে চলে আসে। বেশ সব গুছিয়ে রাখা সব। ওর এ ঘরে তেমন আসা হয় না। একটা পুরনো দিনের খাট। বেশ নকশা করা। এ খাট অবশ্য সচরাচর চোখে পড়ে না। নবাবী ছোঁয়া। নাজ এর আগেও দেখেছে। কিন্তু তার মনে এ নিয়ে কোনো রেখাপাত করেনি। কিন্তু আজ যেন নতুন করে আবিষ্কার করলো। সত্যি তো এ খাট পেলেন কোথায়? ওর মনে এখন অনেক প্রশ্ন। ও কি মনে করে খাটের তলটাকে ঝুঁকে দেখে। হঠাৎ ওর চোখে পড়ে একটা বাক্স। পুরনো দিনের। ও টেনে বের করে। তালা নেই। এমনি আলগা রাখা। ও একটানে খুলে ফেলে। কেমন একটা গন্ধ বের হয়। বহু দিন ধরে বন্ধ থাকলে যেমন গন্ধ হয়। নাজ দেখছে কিছু পুরনো শাড়ি। দেখলেই বোঝা যায় যে শাড়ি গুলো অনেক দামী।  ঝলমল করছে আলো পেয়ে। এ শাড়ি কার? বেশ অনেকগুলো শাড়ি। ও সব বের করতে থাকে। দেখছে বেশ কয়েক খানা চিঠি। কিন্তু উর্দুতে লেখা। কিন্তু ও তো  উর্দু  পড়তে পারে না। নাজ চিঠি গুলো নেয়। শাড়িগুলো রেখে দেয়। ও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে। ও চিঠিগুলো লুকিয়ে রাখে। মিনা এগুলো পড়তে পারবে কিনা দেখতে হবে। অন্য কাউকে দিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। এগুলো এত যতœ করে রেখেছেন নোরিন ফুপু। কিন্তু শাড়িগুলো কার? বেশ রহস্য মনে হচ্ছে। নাজ কেমন ঘামতে থাকে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আজ কলেজ থাকলে ভালো হতো। মিনাকে সঙ্গে করে ও চলে যেত কোনো উর্দুভাষীর কাছে। এই চিঠিতেই এমন কিছু আছে যা ওর মায়ের সম্বন্ধে জানা যাবে হয়তো। ও ঘর বাহির করছে। ওর মন বসছে না কোথাও। আজ ওর খিদেও নেই। কেমন এক ঘোরের মধ্যে আছে। কোথায় একটা  ছাতার ডাকছে। ও মনে হয় বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। শালিকগুলো বাড়ির বারান্দায় বসে ঝগড়া করছে। ওরা বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। ডানায় বৃষ্টি লেগে। মেঘের গুড় গুড় শব্দ। আবার হয়তো বৃষ্টি নামবে। নোরিন ফুপুও তো আসছেন না। আজ কোথায় গেলেন? বলেও তো যাননি। ও কি খোঁজ করবে? কোথাও গেলে তো বলে যান। এত দেরি করেন না। বৃষ্টিতে কি আটকে গেছেন? ছাতারটা এখনো ডাকছে। আম বাগানে আছে কোথাও বসে ও। ওরা ওর সঙ্গী। রোজ ভোরে ওদের চেঁচামেচিতে ঘুম টুটে যায়। খোলা জানালা নাজ বন্ধ করে রাখে। যাতে ওদের চেঁচামেচির শব্দ শুনতে না পায়। আম বাগানে ওদের অবাধ বিচরণ। রাত চোরা পাখির ডাক শোনা যায়। বুকুর বুকুর করে ডাকে। কি পাখি কে জানে। বুকটা কেমন করে যেন ওঠে। ও মাঝে মাঝে ভয় পায়। আসলে বাড়ি লাগোয়া গভীর আম বাগান। এখানে তেমন কেউ আসে না। একমাত্র আমের সময় লোকজন থাকে। আম পাড়ে। আম বেচে। তখন কিছু লোকের যাতায়াত থাকে। অন্য সময় কেউ আসে না। মাঝে মাঝে ও জানালা বন্ধ করে শুয়ে থাকে। গা টা কেমন শিরশির করে ওঠে। ভারি রাতে এক ঝাঁক পেঁচা ডেকে উড়ে পালায়। তাদের ঝটপট ডানার শব্দ শোনা যায়। কেমন এক ভুতুড়ে পরিবেশ। ও ছোট থেকেই এ সব দেখে আসছে। ওকে ছোটবেলায় কাসিম মৌলভী আরবি তালিম দিতেন। সে মানুষটিকে আর দেখা যায় না। সাদা লেবাস পরতেন। সুখময় দাড়ি। গা দিয়ে আতরের খুশবু বের হতো। গোটা সকালটা কেমন এক সুগন্ধিতে ভরে যেত। নাজের গোটা গায়ে সে খুশবু লেপ্টে থাকতো সারাদিন। মকতবখানাতে তিনি পড়াতেন। ভীষণ ভালো মানুষ। অনেক দিন পর আবার তাঁর কথা মনে পড়ে গেল। এই বৃষ্টি বাদলার দিনে কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব আসে। কিন্তু ওর চোখে ঘুম আসছে না। চিঠিগুলোর কথা ভাবছে ও। কে কাকে লিখেছিলেন? কেনই বা লুকানো এগুলো। এ শাড়ি কে পরতেন? আবার ওর মাথায় ভাবনা চেপে বসছে। কালই সকালে বহরমপুর থেকে বাস ধরে মিনার কাছে চলে যাবে ও। ওর তর সইছে না। কেমন উতলা উতলা দেখাচ্ছে। ও আবার ভেতর ভেতর ঘেমে উঠে।  ছটফট করতে থাকে ও। বিছানায় গিয়ে নিজেকে আলগা করে দেয়। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দুচোখ এক হয়না। সুন্দরী নাজের একি দশা! মুখে কে যেন কালি মাখিয়ে দিয়ে গেছে। কাসিম মৌলভীকে পেলে আজই চিঠিটার মানে জেনে নিত ও। কিন্তু মানুষটার কোনো খোঁজ ও জানে না। সেই কবে দেখেছে ও। একবার মকতবখানাতে গিয়ে খোঁজ করলে হয়। কিন্তু এখন যাবে কি করে ও? বাইরে আবার বৃষ্টি পড়ছে। ও বেশ বিরক্ত হয়। আজকে তার কোনো কাজই হবে না। চুপ করে খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে উদাস দৃষ্টিতে। বৃষ্টির ছাট ঘরে চলে আসছে। ওর সে দিকে খেয়াল নেই।  আম বাগানে কেমন একটা অন্ধকার নেমেছে। দিনের আলো বোঝা যাচ্ছে না। ওর মনেও মেঘ। বৃষ্টির ফোঁটা এসে ভিজিয়ে দেয়। ওর কোনো দিকে খেয়াল নেই। কেমন এক ঘোরে পড়ে থাকে। ওর ভরাট বুক ওঠানামা করছে। বুকের আঁচল সরে গিয়ে ওর সুন্দর বক্ষস্থল দেখা যাচ্ছে। আজ বৃষ্টি ওকে আদর দিয়ে যাবে। যে আদরে তার মন শান্ত হবে।

 

রাজ কুমার শেখ, গল্পকার, পশ্চিমবঙ্গ

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে