রাজকুমার শেখ
নাদিরা আজ অনেক ভোরে উঠেছে। আম বাগানে একটা কোকিল ডাকছে। ও যেন কি একটা হারিয়ে ফেলেছে? থামবার ফুরসত নেই যেন। নাদিরা ওর ডাক শুনেই ঘুম ভেঙে যায়। এত ভোরে ওর কি হল? নাদিরা ভাবে মনে। এমনিতেই গত রাতে দেরি করে ঘুমোতে গেছে। নানহা এসেছিলেন ওর কোঠিতে। খুব ইয়াসি মানুষ। এক সময়ের পয়সাওয়ালা লোক। মন খারাপ হলেই নাদিরার গান শুনতে আসেন। বসেন। গোলাপ আর আতরে রাত মাখামাখি হয়ে যায়। তিনি কিন্তু শরাব ছুঁয়ে দেখেন না। শুধু পান খান। জর্দা পান। গান শোনেন মন দিয়ে। তিনি অনেক গভীরে ডুবে থাকেন। রাত জেগে থাকে নাদিরার সাথে। সারেঙ্গীর শব্দতে কে যেন কেঁদে ওঠে! মাতাল হয় বাতাস। বাতাবি ফুলের গন্ধ। নাদিরা মেতে ওঠে সে গন্ধে। ওর নেশা লাগা দুচোখে আরও নেশাতুর হয়ে ওঠে রাত। মোমবাতির শিখা আর ঝাড়বাতির টুংটুং শব্দ। গান জমে ওঠে। নাদিরা এক সময় গান থামায়। নানহা ওকে কাছে ডাকে। নাদিরাকে সোহাগ করতে চায়। নাদিরা ধরা দেয়না। নানহা ওকে টেনে নেয় কাছে। নাদিরা ওঁর শক্ত বাহুর মধ্যে ছটফট করতে থাকে। ওর সামনে আসগর আলির মুখটা মনে পড়ে যায়। রাতের চোরা পাখির ডাক পাওয়া যায়। ঠুমরীর সুর বাতাসে মিশে। নাদিরা আজ অন্য মনস্ক। আসগর আলি তাকে যেন টানছে। মনে হল এখনি ওর কাছে চলে যাই। নানহাকে দূরে ঠেলে দেয়। তারপর এক সময় নানহা চলে যায়। পড়ে থাকে মচলানো গোলাপের পাপড়ি। গোলাপের গন্ধ। নিভে যাওয়া ঝাড়বাতি। গোলাপ জলের গন্ধ। ঠুমরীর সুর। কেমন সব চুপচাপ হয়ে যায়। নাদিরা আজ একটু বেশি মাতাল। রাত ঢলে পড়ে শিশির ভেজা ভোরের দিকে। চারিপাশে এত আলো। নবাবী গন্ধ। তবু যেন তার মনে শান্তি নেই। নাদিরা একটা কি যেন খুঁজছে! আসগরকে কেন তার এত বেশি করে মনে পড়ে? সেও সুখী হতে চায়। তার এই কোঠি জীবনের বাইরে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার যে উপায় নেই। তাকে জড়িয়ে আরও কয়েকটা জীবন। ও চলে গেলে তাদের কি হবে? আবার বাতাবি ফুলের গন্ধটা ভেসে আসছে। কোকিল ডাকছে। নাদিরা ভিজে চুল শুকিয়ে নেয় চিকন রোদে। না– আজ কোথাও যেতে হবে। অবশ্য একটু বেলা হলেই আসগর আলি আসবে। সারাদিন ঘুরবে ও। আজ আর কোঠিতে আসর বসাবে না। এমন সময় কাজের বুয়া চা দিয়ে গেল। এই ছাদের ওপর থেকে অনেকটা দেখা যায়। নবাবী গন্ধটা এখনো পাওয়া যায়। সিরাজ দৌলার সময় চলে যাবার পরও সেই গন্ধটা ছিল। কিন্তু সময় যতটা গড়িয়েছে, নবাবী আমলের সব একটু একটু করে ফুরিয়ে এসেছে। শক্তি। লোকবল। নবাবী জৌলুশ। সিরাজ দৌলার পর থেকেই মুর্শিদাবাদের পরবর্তী নবাবগণ সেভাবে আর বাংলার মসনদ ধরে রাখতে পারেনি। চতুর ইংরেজ পরবর্তী নবাবগণকে হাতের পুতুল করে রেখেছিল। সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছিল। বহু মানুষ কাজ হারালো। মুর্শিদাবাদ যেন একটা মরা গাঙ। এই মরাগাঙের শেষ হয়ে আসা কিছু নবাবী ঠাটবাট নিয়ে আসেন কোঠিতে। নাদিরাকে সাজতে হয়। তাদের সামনে পান খাওয়া লাল ঠোঁট দুটোকে এক করে হাসতে হয়। ঢলে পড়ে। এ খেলা তার আর ভালো লাগে না। ওর চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই বাগান বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওয়ার নেই। পাশেই ভাগীরথী বয়ে চলেছে। তার জলজ গন্ধ বাতাসে মিশে ভেসে আসছে। আজ পাগল করা বাতাস। মন যেন মনে নেই। ও পথ চেয়ে থাকে। আর একটু পরেই আসগর আসবে। তার টাঙা গাড়িতে যেখানে খুশি যাবে ও। চায়ে চুমক দেয়। মাথার রেশমঘন চুল এলোমেলো করে দেয় বাতাসে। ওর নরম ঠোঁটে চায়ের গমন ছোঁয়া। বেশ উপভোগ করে নাদিরা। তার এই সকাল একদম নিজস্ব। এখানে কোনো নবাবের আসা নিষিদ্ধ। অবশ্য যারা এখনো নিজেকে নবাব ভাবেন। নানহার মতো মানুষেরা। নাদিরার শরীর কে না ছুঁতে চায়। তাই বলে কি যাকে তাকে ও ধরা দেবে? একদমই না। নাদিরা আছে নাদিরাতেই। তার রুপের অনেক গুণগ্রাহী আছে। তাই বলে সে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে না। তার কদর আছে। তাকে জড়িয়ে ধরে গোলাপ আতরে ভরিয়ে দিতে চায়। তাই বলেÑ সে খুশবুতে ও ডুবে যায় না। রাত শেষ হলেই উবে যায় সে আতর গন্ধ। নাদিরা গোসল করে নেয়। ধুয়ে ফেলে রাতের সোহাগ। তার শরমী চোখের পাতা। সুরমা টানা চোখের কলস। শরাবি রাতের বাজনা। ওর দিলের আশপাশ। রেকাবি তে রাখা শরবতের গিলাস। সব ধুয়ে নেয় ও। কাছে তো অনেকেই আসে। তেমন করে আসে কই? যাকে সে মনের হাজারদুয়ারী দরজা খুলে ঢুকিয়ে নেবে। যে দরজা মরণে খুলবে। তার দুধে আলতা রঙে কেউ ভালোবাসার হাত রাখবে। ভালোবেসে।
কেমন এক উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও। চা ঠান্ডা হয়ে যায়। আজ ওর মন করছে এখানকার বেড়া টপকে অন্য কোথা চলে যেতে। যেখানে ও নিজেকে খুঁজে পাবে। নিজ মনে গুনগুন করে গান গায়বে। এই পাগল কোকিলটার মতো তার মনের ভেতরের বসা পাখিটিকে ডাকবে। বেশ রোদের তাপ। নাদিরা ছাদ থেকে নেমে আসে। তার মখমলি চাদর দিয়ে ঢাকা খাটে বসে। যেন কোনো রাজরানি। আয়নাতে দেখা যাচ্ছে ওর মুখটা। রাতের ক্লান্তি নেই। গোসল করতেই সব ধুয়ে গেছে। রোজ রোজ আর কারো সামনে নিজেকে সাজিয়ে বসতে ভালো লাগে না। অনেক সময়ই গানের সুর তাল কেটে যায়। আজকাল এটা হচ্ছে। তবু তার গান শোনা চায়। পয়সা হয়তো দেয়। কিন্তু তার বিনিময়ে অনেক খানিই দিতে হয়। ও নিজেকে এলিয়ে দেয় বিছানায়। গোটা ঘরে ধুপের আর চন্দনের গন্ধ। ও বুক ভরে বাতাস নেয়। কেমন এক শান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। গত রাতের রজনী গন্ধার গন্ধটা এখনো আছে। নানহা ওকে ওর বাগান বাড়িতে রাখতে চায়। গর রাতেও বলেছে সে কথা।
আরে — নাদি, তোমাকে রানি করে রাখবো। মেহেফিল হবে। শুধু আমি আর তুমি।
কথাটা বলেই নাদিরাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে যায়। নাদিরা সরে গিয়ে বলে, অত সহজ আমি নই নানহা সাব। আমি রাত বেচি ঠিকই। কিন্তু তাই বলে আমি কারো বাদী হতে পারবো না।
ও- হো, একদম ভুলে গেছি নাদি। তুমি অনেক পয়সাওয়ালি আছো। তোমাকে তো কেনা যাবে না।
হা হা করে হেসে ওঠে নানহা। গোটা রাত খান খান হয়ে যায় সে হাসিতে। নাদিরার বুক কেঁপে ওঠে। নানহার জাল কেটে কেউ বের হতে পারে না। নবাবী আমল থেকেই তাদের বাড়বাড়ন্ত। রেশমের কারবারি ওদের পূর্ব পুরুষ। কাশিম বাজর বন্দরে চলতো তাদের ব্যবসা। কাশিমবাজার জনপদে ছিল তাদের যাতায়াত। এই বন্দরে আসতো ফারাসী, ইংরেজ, ডাচ্। আর কত দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন আসতো।
না- এখনো কেন এলো না আসগর? নাদিরা কাজের মেয়েটাকে ডাকে। আসগর আলি এসেছে কি না খোঁজ নিতে বলে। ওর আর চার দেওয়ালের মধ্যে মন ঠিকছে না। এবার ওকে যেতে হবে। এমন সময় টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে টাঙা নিয়ে হাজির আসগর। আজ ও একটু সেজেগুজে এসেছে। তার টাঙাতে রাজরানি বসবে। আসগর তাকে রানিই মনে করে। তার এত রুপ! ওর চোখ ধরে যায়। এমন রুপ সে এর আগে কাউকে দেখেনি। এই রুপের কদর সে জানে। নাদিরাকে সে মন ভরে দেখে। তার রুপের গুনগ্রাহী। এমন সময় নাদিরা বেরিয়ে আসে। আজ তার ঢলে পড়ছে। বসন্তর গন্ধ সারা বাগানে। কোকিলও হয়তো থেমে গেল নাদিরার রুপ দেখে। এ নাদিরা অন্য কেউ হবে। আসগরের দুচোখে তার রুপের ছটা। যেন চোখ ঝলসে যাবে।
আসগর, চলো।
বলেই নাদিরা ওঠে বসে টাঙাতে। আজ বেশ বাতাস দিচ্ছে। আসগর আর দেরি করে না। টাঙা ঘুরিয়ে নেয়। ছুটে চলে ঘোড়া। ঘোড়ার পায়ে বাঁধা ঘুঙুর ছমছম করে বাজতে থাকে। আসগর বলে, কোন দিকে যাবো?
তোমার যেদিকে খুশি।
আসগর বিপদে পড়ে যায়। নাদিরার কি আজ মন ভালো নেই? ও জানে কোথায় গেলে ওর মন ভালো হয়ে যাবে। আসগর কাঠগোলার রাস্তা ধরে। বনজ গন্ধ বাতাসে মিশে আছে। আসগর সে গন্ধ নেয়। নাদিরা আজ কি আতর মেখেছে কে জানে। বনজ গন্ধটা সে আতরের খুশবুতে ঢেকে যাচ্ছে। এমন সময় একটা আম বাগানের কাছে এসে আসগর ঘোড়াটাকে
থামায়। বেশ নির্জন জায়গা। কোনো মানুষের আনাগোনা নেই। নাদিরা নামে টাঙা থেকে। একটু এগিয়ে যায়। বাগানের ভেতর সবুজ ঘাসের মখমলি চাদর। নাদিরা বসে গিয়ে। আসগরকে বসতে বলে। তারপর একটু সময় নিয়ে বলে, আসগর, শান্তি কি? একদিন তোমাকে জিগ্যেস করে ছিলাম। মনে আছে?
হম। কিন্তু তোমার কোনো উত্তর পাইনি।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। আপনাকে কি বলে উত্তর দেব?
একটা কিছু বলোই না। আমি শুনবো।
আসগর মাথা চুলকাতে থাকে। ওর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয়না। নাদিরা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ও হেসে ফেলে।
হাসছেন যে?
হাসবো না তো কাঁদবো!
আসগর, তোমার সাহস নেই। এসো কাছে এসে বসো। তুমি যেন কোনো নবাবী হুকুম তামিল করছো। আমি সাধারণ।
এ কথা শুনে আসগর হা হয়ে যায়। কথা বের হয়না মুখ দিয়ে। আসগর, তোমাকে আমি একটা জিনিস দেব। নেবে তুমি?
কি?
এই ধরো আমার সব থেকে সেরা কিছু। যা তোমাকে কেউ দেয়নি।
আমি সামন্য টাঙাওয়ালা। কি আছে আমার?
তোমার যা আছে তা অনেকের কাছে নেই।
আসগর অবাক হয় এ কথা শুনে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে।
আমি বহু পয়সাওয়ালা মানুষ দেখেছি। কিন্তু তাদের মধ্যে সাচ্চা দিল দেখিনি। যা তোমার মধ্যে আছে।
আম বাগানের ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ এসে পড়েছে। নাদিরার মুখময় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। কেমন এক মায় জড়ানো মুখ। আসগর হাত দিয়ে সে ঘাম মুছিয়ে দিতে চায়। তার রেশমের শাড়ির আঁচল দিয়ে রোদকে আড়াল করে দিতে চায় ও। ওর চিরজীবনের ছায়া হতে চায় ও। কিন্তু কোথায় একটা বাঁধা। ও তো নাদিরার ছায়া হয়ে থাকতে চায়। সে ডাকলেই ও ছুটে আসে।
আসগর, তুমি যেখানে থাকো নিয়ে যাবে আমাকে?
আপনি যাবেন?
কেন যাবো না? তুমি নিয়ে গেলেই যাবো।
কিন্তু আমার তো তেমন ঘর নেই। ভাঙা চোরা ঘরে থাকি।
তাতে কি হয়েছে? যার দিল বড়ো। তার ঘর লাগে না।
আপনি যেদিন বলবেন নিয়ে যাবো।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আসগরের দিকে নাদিরা। একটা চাপাপড়া দীর্ঘশ্বাস আপনা থেকে বেরিয়ে আসে। বুকটা অনেক হালকা লাগছে। ওরা দুজন বসে থাকে। সময় বয়ে চলে। নাদিরা ফিরবার নাম নেয় না। বসে থাকে। দূরে কোথায় যেন একটা কোকিল কুহু কুহ করে ডেকে উঠলো। আসগর বুকের ভেতর কি?
রাজকুমার শেখ, গল্পকার, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ
পড়েছেনঃ 140