রাজকুমার শেখ
আজ ও সকাল সকাল কলেজ বের হল। সকালে আজ তেমন কিছু খেতে পারলো না। গত কাল বৃষ্টিতে সব কেমন যেন ভিজে ভিজে। রাস্তাতে শুকনো আম পাতা পড়ে। বাতাসে ঝরে পড়েছে। একটু শীত শীত ভাব। বৃষ্টি ওর ভালো লাগে না। ও কলেজ বের হবার সময় চিঠি গুলো নিল। মিনা ছাড়া এটা উদ্ধার হবে না। ও ভাবে মনে।
গতকাল থেকেই ও বেশ চিন্তায় আছে। নাজ নবাবী রাস্তাতে এসে অটো ধরে। নাজই এই রোডটাকে নবাবী রোড বলে। ও তো এখানে মানুষ। তার বাপ মা বলতে সেই ওর ফুপু। তাঁকে দেখেই ওর বড় হয়ে ওঠা। মায়ের মমতা সে পায়নি। কেন পায়নি একমাত্র তার উত্তর দিতে পারেন নোরিন ফুপু। নাজের মন ভালো নেই। ওর পাশে এ সময় কেউ থাকলে মনের কথা বলে একটু হালকা হতো। বেশ অনেকটা সময় ও দাঁড়িয়ে। অটোর দেখা নেই। বৃষ্টি ভেজা রাস্তা। আম পাতা। শুকনো পাতা গুলো ভিজে কেমন নেতিয়ে আছে। বাতাসে কেমন হিম ভাব। ওর রেশম ঘন চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ওর টিকালে নাকের ওপর এসে পড়ে গোটা মুখ দেখা যাচ্ছে না।
ওর টানা টানা চোখের ওপর চুলের ঢেউ। এ সকালটা বেশ অনুভব করছে ও। আজ ও শাড়ি পড়েছে। কপালে মিটি টিপ। সত্যি ও সুন্দরী। নাজকে কেউ সুন্দরী বললে ও গুটিয়ে যায়। কেমন লজ্জা করে ওর। কিন্তু ও যে সুন্দরী তা নিজে মানতে চায় না। গালে লাল রক্ত যেন ছলকে পড়ে। ওর গানের গলাও মিষ্টি। তবে ও গান গায় না সবার সামনে। নিজ মন চাইলে ও গায়। মিনা তো ওর গানের বড়ো গুণগ্রাহী। কথায় কথায় ও বলে, নাজরে, তুই ভালো গাস কিন্তু। একটু শোনা।
আমার আর গান! ওই একটু আধটু। মন চায়লে।
কলেজের অনুষ্ঠানে এবার তুই গাইবি। আমি অমরদাকে বলে নাম লিখে দেব। তুই গাইলে দেখবি কলেজের ছেলেরা প্রেমে পড়ে যাবে। এমনিতেই তোর যা রূপ। আগুন লেগে আছে ছেলেদের মনে।
খুব ফাজিল হয়েছিস মিনা।
ওরে আমার রাগ রানি।অত রাগ দেখাস না। তুই সুন্দরী বলেই তো আমার পিছন লাগে ছেলেরা। আমাকে হাত করে তোর কাছে পৌঁছাতে চায়। আমি ওদের পাত্তা দিই না।
তাই? আমার কাছে আসতে বলিস। তারপর যা দেব না। সব ভূত পালাবে।
মিনা এ কথা শুনে হাসতে থাকে। মিনাটা খুব ফাজিল হয়েছে। নাজ নিজ মনে হাসতে থাকে। ওকে এই সময় কেউ দেখলে ওকে পাগল ভাববে।
নাজ বেশ বিরক্ত হয়। অটোর দেখা নেই। সদরঘাটের ওখানে কিছু একটা হয়েছে। সাইকেল এক আরোহী বলতে বলতে গেল। নাজকে আজ কলেজ যেতেই হবে। চিঠি গুলোকে উদ্ধার করতে হবে। মনটা এমনিতেই ভালো নেই। নোরিন ফুপু তাকে কিছুই বলতে চায়না। এ শহরটা যেমন বদলে গেছে তেমনি যেন তার নোরিন ফুপুও বদলে গেছে। শহরটা শেষ হয়ে গেছে। আর সেই রবরবা নেই। কেমন সব অচেনা লাগে। কোনো রকমে যেন চলছে। অথচ পলাশীর যুদ্ধের আগেও তার জৌলুশ ছিল। মানুষ কাজ কাম পেত। সাধারণ মানুষের কাজ হারিয়ে গেল সিরাজ দৌলার পরাজয়ের পরই। লুট হয়ে গেল ধনদৌলত। হীরাঝিল দখল নিল ইংরেজরা। মীরজাফর মহল এ থাকলেও সে তাদের হাতের পুতুল মাত্র। ঘুণ ধরা একটা শহরে পরিণত হলো।
এ সব ভাবলে নাজের ঘুম উধাও হয়ে যায়। কত রাত এ সব নিয়ে ও ভেবেছে।কত শক্তিশালী এই বাংলার নবাব সিরাজ দৌলা। কিন্তু তাঁর পরিণতি নাজ মেনে নেয় না। কতবার গেছে খোসবাগে। সিরাজ দৌলার কবরের কাছে বসে ভেবেছে ও। মানুষটার প্রতি তার শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেছে। সে কারো কাছে মাথা নত করেননি। তাঁর শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে বাংলাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর চারপাশে তাঁরই আপনজনেরা তাঁকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
হঠাৎ করে এ সব মনে পড়ায় নাজের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সকালটা আরও বেশি সেঁতসেঁতে মনে হচ্ছে।
এমন সময় অটো এসে থামে ওর সামনে। ফাঁকা অটো। নাজ চাপতেই অটো ছেড়ে দিল। বেশ শব্দ করে অটো চলছে। ভাগীরথীর গা ঘেঁষে অটো চলেছে। এ রাস্তার দুপাশে শুধুই আমবাগান। কচার বন। কোনো কোনো খেতে ভুট্টা লাগানো। সবুজ গন্ধ মেখে ও এক সময় কলেজে আসে। হাবুদা দোকানে চুপ করে বসে ছিল। আজ মনে হয় কোনো কবিতার ভেতর ডুবে আছে। আজ রমিও আসবে বলেছে। মিনার খোঁজ করে ও। এখনো সে আসেনি। ও না এলে চিঠিটার কোনো সার উদ্ধার হবে না। ও আবার কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে। হাবুদার চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। হাবুদা বলে, কি গো কলেজ থেকে যে বেরিয়ে এলে?
মিনাকে নিয়ে যাবো এক জায়গায় দাবুদা।
নাজ বলে কথাটা।
ও। চা দেব?
মিনা আসুক। তারপর চা খাবো। আচ্ছা হাবুদা, কেউ এমন আছেন যে উর্দু জানে?
হাবুদা একটু সময় নেয়। তারপর বলে, আছে একজন। উনি কাশিমবাজারে থাকেন। ওখানে যেতে পারো।
ঠিকানা দাও হাবুদা। মিনা আসুক। এক সঙ্গে যাবো।
হাবুদা একটা কাগজে লিখে দেয় ঠিকানাটা। নাজ ঠিকানা ভালো করে জেনে নেয়। এখনো মিনা না আসায় ও বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। এমন সময় হঠাৎ রমি এসে হাজির। নাজ ওকে দেখতে পেয়ে মনটা ভালো হয়ে যায়। রমি এসেই বলে, হাবুদা, আগে চা দাও।
কেন চা বুঝি সকালে খাওনি?
আর বলোনা নাজ। বাড়িতে সবাই যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আমি হয়েছি একটা।
ও আর কথা বাড়ায় না।
কি একটা?
নাজ জিজ্ঞেস করে।
ও কিছু না।
কিছু না মানে?
ও তুমি বুঝবে না।
তাই বুঝি?
হুম।
তুমি সব বোঝো তো?
তুমি কেন ডেকে ছিলে তাই আগে বলো?
রমি, কয়েকটি চিঠি পেয়েছি ফুপুর বাক্স থেকে। কিন্তু আমি উর্দু জানিনা। এতে নিশ্চয় কিছু আছে যা আমি মায়ের জন্য জানতে পারবো।
রমি অবাক হয়ে শুনছিল। নাজকে দেখে ওর সত্যি ওর কষ্ট হয়। মেয়েটি কত কষ্টে বড়ো হয়ে উঠলো। কিন্তু তার মা বাবার কোনো খোঁজ নেই। ও আগে এ সব বলতো না। ইদানীং সে বড়ো একাকিত্ব বোধ করে। কিন্তু ওর ফুপু সে ব্যাপারে কিন্তু জানাতেই চাই না। কিন্তু কেন? রমি এ সবের উত্তর খুঁজে পায়না।
হাবুদা চা দিল। মিনা একটু দেরি করেই এলো।
হাবুদার কাছে ঠিকানা নিয়ে ওরা রওনা হল কাশিম বাজার।
ওরা এক সময় কাশিমবাজার এসে গেল। কাশিমবাজার রাজবাড়ি ফেলে ওরা গেল স্টেশন এর দিকে। ফাঁকা রাস্তা। এক সময় কি রমরমা জনপদ ছিল। একে কাশিমবাজার বন্দর বলা হয়। ১৬৩০ সালের পর প্রসিদ্ধ কাশিমবাজারের সূচনা হয়েছিল। ১৮৩০ সালে তার অবসান ঘটে। এই বন্দরকে ঘিরে কাশিমবাজার জনপদ জেগে উঠেছিল। এই বন্দরে রেশমের গন্ধে গন্ধে এসেছে ডাচ, আর্মেনিয়া, ইংরেজরা। গুজরাটি পাঞ্জাবি রাও এসেছে এখানে ব্যবসা করতে। এখন সেই সব তামাদি হয়ে গেছে। ধুলোর রাস্তা মাড়িয়ে ওরা তিনজন হাঁটতে থাকে। এক সময় হাবুদার ঠিকানায় পৌঁছে যায় ওরা। আলি মির্জা। তিনি বাড়িতেই ছিলেন। বেশ বয়স হয়েছে। ফরসা রং। মাঝারি গড়ন। ওদের যত্ন করে এনে বসালেন ঘরে। হাবুদার কথা বলল নাজ। তিনি ভালোই চেনেন হাবুদাকে। নাজ এবার কথা বলে, আমার দরকারে এসেছি আপনার কাছে।
কি দরকার বলুন?
আমাকে তুমি বললে ভালো হয়। আমি আপনার বেটির মতো। আমি উর্দু জানি না। কয়েকটি চিঠি আছে যদি পডে বুঝিয়ে দেন।
ও। দাও।
নাজ ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে চিঠি গুলো বের করে দেয়। চিঠি গুলো দেওয়ার পর ও অধিক আগ্রহে চেযে থাকে আলী মির্জা
সাহেবের মুখের দিকে। তিনি নাড়াচাড়া করতে থাকে চিঠি গুলো। তারপর পড়তে থাকেন। কিছুক্ষণ পড়ার পর চুপ করে থাকেন। একটু সময় নিয়ে বলেন, এ গুলি কোথায় পেলে?
আমি আমার ফুপুর কাছে পেয়েছি।
ও। এতে লেখা আছে একটি বাচ্চার কথা। যার জন্য রাখা আছে অনেক সোনা দানা। বাচ্চাটা যখন বড়ো হবে। সে তখন তার মালিক হবে। চিঠি লেখকের নাম নেই। আর হ্যাঁ একটি বাগান বাড়ির মালিকও হবে ওই বাচ্চাটা।
শুধু ওইটুকু?
নাজ জিগ্যেস করে।
বাকিটা বলতে পারবেন হয়তো তোমার ফুপু। তিনি বলতে পারেন। তাঁর কাছে থেকে যদি চিঠিগুলো পেয়ে থাকো।
নাজকে বেশ হতাশ দেখাচ্ছে। রমি ওর হাতে হাত রাখে। এমন সময় একটা মেয়ে সরবত দিয়ে গেল। ওদেরকে খেতে বলেন আলি সাহেব। নাজের গলা দিয়ে সরবত নামছে না। কেমন এক ভাবনায় ডুবে যায় ও। সরবতে কেওড়া মেশানো। তার খুশবু ছড়িয়ে গেল গোটা ঘরে। মিনা চুমুক দিয়ে বলে, নাজ, সরবতটা খেয়ে নে।
আলি সাহেবের ওখান থেকে এক সময় ওরা বেরিয়ে আসে। বেলা গড়িয়ে গেছে। নাজ খুশি হতে পারলো না। কে বা কাকে এ চিঠি লিখেছেন? এমন চিঠি কেনই বা লিখলো? আর ওই শিশুটাই বা কে? ওর মন তোলপাড় করে ওঠে। মিনা, রমি ওর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। আজ আর কলেজ যাওয়া হবে না। মিনা ওকে বলে, নাজ, চল আমার বাড়ি। তোর মন ভালো হয়ে যাবে। মন খারাপ করিস না। ঠিক আমরা খোঁজ পেয়ে যাবো। কেউ এ ব্যাপারে তোকে আড়াল করছে। কিন্তু কেন? তোর জানবার অধিকার আছে। নোরিন ফুপুকেই ধরতে হবে। তা না হলে সব রহস্য থেকে যাবে।
মিনা এবার থামে। রমি বলে, একদম মিনা ঠিক বলেছে।
নাজ কোনো কথা বলে না। মরা রোদের ভেতর দিয়ে ওরা তিনজনে হাঁটছে। ওরা কাশিমবাজার রাজবাড়ি ফেলে চলে আসে। ওদের খিদেও পেয়েছে। একটা চায়ের দোকানে এসে বসে। তেমন কোনো লোকজন নেই। সবেমাত্র দোকান খুলছে। চা হবে কি না রমি জিজ্ঞেস করে। জল নিয়ে খায়। শুধু কেক ছিল তাই খেল তিনজনে। তারপর ওরা পয়সা মিটিয়ে আবার হাঁটতে থাকে। নাজ কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ও মিনার বাড়ি গেলে ওর ফুপু চিন্তা করবেন। এমনিতেই ওকে কোথাও যেতে দেন না। চারপাশটা অনেক বদলে গেছে। নাজ মিনাকে না ও করতে পারছে না। মন করছে যেতে। কিন্তু ও কি করবে ভেবে পাচ্ছে না? মিনা ওকে জোর করে। ও গেলে মনটাও হালকা হবে। রমিও ওকে বলে, মিনার সাথে যেতে। নাজ শেষমেস মিনার সাথে যাবো বলে। সূর্যটা ঢলে পড়েছে। ওরা যখন বাসে উঠলো তখন বেলা শেষ। রমি নাজের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল। মিনার পাশে বসে ও নিজেকে আলগা করে দিল। বাস ছুটছে। গাছগুলো চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে। গাঁজার মাঠও ফেলে চলে আসে বাস। নাজ একটু নিজেকে হালকা বোধ করছে। মনটা বাসের জানালা গলিয় অনেক দূরে হারিয়ে গেছে। আজ ও হারিয়ে যেতে চায়।
রাজকুমার শেখ
কথাসাহিত্যিক, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত