রাজকুমার শেখ
নাজ আজ কলেজ যায়নি। মিনাও আজ আসবে না। কার বিয়ে আছে সেখানে যাবে। রমির সঙ্গে দেখা হবার কথা। কিন্তু ও সকাল সকাল খেয়ে বের হল। নোরিন ফুপুকে কিছু বলল না। গত রাত থেকে ও আলি মির্জার কথা ভাবছে। মানুষটিকে ওর কেমন রহস্য মনে হয়েছে। সেদিন চিঠিটা পড়তে গিয়ে কেমন যেন গন্ধ পেয়ে ছিলেন। আর সেটা জানা নাজের খুবই জরুরি। তাকে জানতেই হবে। ও আবার কাশিমবাজারে এলো। বেশ বেলা হয়েছে। এখানে এলেই কেমন এক ইতিহাসের গন্ধ পায় ও। সেনাপতি কাশিম খাঁর নামেই নামাঙ্কিত হয় কাশিমবাজার। একসময় কত রমরমা জনপদ ছিল। বিশাল বন্দর। ডাচ্, ফরাসি, ইংরেজ, মারাঠি আসতো। ব্যবসা চলতো নদী পথেই। রেশমের রমরমা ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের বাজারে। আজ কেমন সব চুপচাপ। যেন অন্ধ গলির ভেতর ও ঢুকে পড়েছে। এঁদো রাস্তা। আম গাছের আড়ালে রোদ তেমন পড়ে না। সেদিন ও অত ভালো করে জায়গাটা পরখ করেনি।
আজ ও চারপাশে চেয়ে চেয়ে দেখছে। কত রকমের পাখি। শুকনো পাতা পড়ে। মরমর শব্দ। খসখস করে যাচ্ছে বাতাস লেগে শুকনো পাতা। ওর রেশম ঘন চুল এলোমেলো হয়ে গেল বাতাসে। নাজ একা হাঁটতে থাকে। কেউ ওকে দেখলে ভাববে যে, ওর যাবার ঠিকানা নেই। ও যেন কোথাও হারিয়ে যেতে চায়। কেমন মন মরা। নাজের কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। ও হাঁটতে হাঁটতে এসে হঠাৎ থেমে গেল। কাশিমবাজারে ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের সিমেটারি। নাজ একটা কবরের কাছে এসে থেমে যায়। তাতে লেখা আছে–
ঞড় ঃযব সবসড়ৎু ড়ভ
গৎং ডধৎৎবহ ঐধংঃরহমং
অহফ যবৎ ফধঁমযঃবৎ ঊষরুধনবঃয
১৭৫৯ সালে মৃত্যু হয়েছেছিল। স্মৃতি ফলকটি লাগিয়েছিলেন ওয়ারেনিং হেস্টিং নিজেই। নির্জন কবরস্থান থেকে নাজ বেরিয়ে আসে। ও আরও ইতিহাস থেকে জেনেছে। এখানে এক বিরাট মহামারি হয়। তাতে বহু মানুষ মারা যায়। আর খামখেয়ালি নদীর দিক পরিবর্তন হয়ে যায়। তাতে এই বন্দর ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮৫৮ থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের গভর্নর জেনারেল এজেন্ট ছিলেন কলিন ম্যাকেঞ্জি। তাঁর স্ত্রীর জবানি থেকে জানা যায়, ফরাসিদের কুঠি ভেঙে গেছে। ফরাসিদের গোরস্থান নদীগর্ভে অন্তর্হিত হয়েছে। ডাচদের কুঠি নেই। কিন্তু কবরস্থানের মনুমেন্টগুলি এখনও আছে। আর কাশিমবাজারের রেসিডেন্সি অস্বাস্থ্যকর জায়গা বলে গণ্য হয়েছে। রেসিডেন্সির ইট কাঠ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এই থেকে জানা যায় উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধই কাশিমবাজারের দুর্দশা ঘনিয়ে এসেছিল। মুর্শিদাবাদের অনেক আগেই গড়ে উঠেছিল কাশিমবাজার। সম্রাট শাহজাহানের বাদশাহী আমলে শাহজাহান হুগলী বেড়াতে এসেছিলেন। কিন্তু পূর্তগিজ দস্যদের হাতে অপমানিত হন। শাহাজান পতœীর কয়েকজন সেবিকাকে অপহরণ করে। কোনক্রমে আত্মরক্ষা করেন। শাহজাহান পর্তুগিজদের দমন করতে বিশ্বস্ত যোদ্ধা কাশিম খাঁ’কে পাঠান। ১৬৩২ সালে কাশিম খাঁ হুগলীতে আক্রমণ করেন।
পর্তুগিজদের দমন করেন। আর ওদের অনেক নারীকে বন্দি করেন। আর তাদের বন্দি করে মাসুমা বাজারে রাখেন। আর এই মাসুমা বাজার হয় কাশিম খাঁর নামে কাশিম বাজার।
নাজ এ সব নিয়ে ভাবতে ভাবতে এসে পৌঁছায় আলি মির্জা সাহেবের কাছে। তিনি বসেছিলেন। কেমন এক ভাবনায় ডুবে আছেন যেন। পাকা দাড়িতে মুখম-ল ছেয়ে। মাথায় সাদা টুপি। মানুষটিকে দেখলে ভক্তি বেড়ে যায়। তিন পেলে খান না পেলে খান না। তিনি বহু কিছুর সাক্ষী। অনেক বয়স হয়েছে। এত মিষ্টি করে কথা বলেন। তিনি ফারসি বলতে লিখতে দুটোই পারেন। হাবুদা কেমন করে পেলেন এই মানুষটিকে? নাজ ভাবে।
ও গিয়ে সামনে দাঁড়ায়। নাজকে দেখে হাসেন তিনি। বলেন, এসো বেটি। আবার কি হল?
নাজ একটু সময় নেয়। তারপর বলে, আপনার কাছে কিছু জানতে এসেছি। আপনিই তার উত্তর দিতে পারবেন।
আমি বেটি! আগে বসো। তারপর বলো কি বলবে?
আপনি সেদিন চিঠিটা পড়ে একটু হাসি ফুটেছিল আপনার। কিন্তু কেন? আমি জানতে চাই আপনি কিছু জানেন কি না?
আলি ও মির্জা সাহেব চুপ করে বসে থাকেন। একটু সময় নেন। তারপর বলেন, বেটি, সে অনেক লম্বা কাহিনি। তখন আমি মুর্শিদাবাদে থাকতাম। আমার আতরের ব্যবসা ছিল। তখন আমার বয়স খুব বেশি নয়। আমার পূর্ব পুরুষ আতর বা খুব দামি খুশবুদার সুগন্ধি নবাব মহলে পাঠাতেন। আমাদের ব্যবসা একদিন বন্ধ হয়ে গেল। নবাব সিরাজ দৌলার পরবর্তী নবাবদের ক্ষমতা তেমন ছিল না। যা করতেন ইংরেজ। আমি কিছুটা সময় আতর ব্যবসা করি। আমাদের পূর্ব পুরুষ পারস্য দেশ থেকে এসেছিলেন। আমরা থাকতাম নাগিনাবাগে। এখানেই আমরা মানুষ। কিন্তু যার জন্য বেটি তুমি জানতে চাইছো তা অন্য রকম। তুমি জেনে কি করবে?
দরকার আছে আমার। খুবই দরকার বাবা।
বেটি, বুঝতে পারছি। ঠিক আছে। আমি আতর দিতাম একটি কোঠিতে। যেটা বাগানবাড়ি। সেখানেই থাকতো নুরশা বানু। অবশ্য আমি নুরশা বানুকে দেখিনি। দেখেছি নাদিরাকে। তার বয়স তখন বেশি না। নাদিরা তখন তালিম নিচ্ছে। ওর আগে ছিল বীণারানি। ওই বীণারানি নাদিরাকে দিল্লি থেকে নিয়ে এসেছিল। নাদিরা দেখতে খুব সুন্দরী। ওর টানে আসতো নবাব। গান শুনতেন। নাদিরার নাম হয়ে গেল। আমি আতর বেচতাম ওকে। আমি প্রায় যেতাম আতর দিতে। নাদিরা খুশবুর কদর জানতো।
একটানা বলে তিনি একটু থামেন। নাজ অধীর আগ্রহে শুনছে। চোখের পলক পড়ছে না। ও যেন অন্য জগৎ এ হারিয়ে গেছে। এখানে না এলে ওই কোঠি বাড়ির কিছুই জানতে পারতো না। নোরিন ফুপুর কাছে কেন চাবি থাকে? ওর মনে সন্দেহ কাজ করছে। তিনি তাহলে সবই জানেন। তিনি নাদিরাকেও চিনতেন।
তারপর আবার আলি সাহেব শুরু করেন, আমি বহুবার গেছি। বিশেষ করে ঈদের সময় বেশি যেতাম। আতর নিত অনেক রকমের। গোটা শহর জুড়ে সাজ সাজ রব। সে একটা দিন গেছে বেটি।
আপনি নাদিরার আর কোনো খবর জানতেন?
জানতাম। ও কাউকে ভালো বাসতো। যেমন রূপ তেমনি গানের গলা। তবে ওর পিছন নিয়েছিল হালফিল পয়সাওয়ালা নানহা। ওকে শহরের অনেক মানুষ চিনতো। নানহার দাদার সোনার ব্যবসা ছিল। হঠাৎ করেই ফুলে ফেঁপে ওঠে। নবাবদের মতো চালচলন। ও নাদিরাকে তুলে নিয়ে যায় ওর বাগানবাড়িতে। কিন্তু ও নাদিরাকে আটকে রাখতে পারে না। নাদিরার লোকজন কম ছিল না। কোঠির ভেতরে কেউ কিছু করতে পারতো না। তবে বেটি, নাদিরার খোঁজ পেলে তুমি সব জানতে পারবে।
কিন্তু এখন তো কোঠি বন্ধ। সেখানে কেউ নেই।
জানি বেটি। সবই তো বন্ধ হয়ে গেল। সিরাজ দৌলার পরাজয়ই বাংলা শেষ হয়ে যায়। এখানকার মানুষ কাজ হারিয়ে চলে যায় বাংলা ছেড়ে। যে বাংলার এত রমরমা। সেই বাংলা ইংরেজদের হাতে চলে গেল। লুট হল সব। সিরাজদৌলা বেঁচে থাকলে বাংলাতে সোনা ফলতো। বড়ো নেক আদমি। তাঁর প্রতি যতই কুৎসা রটাক ঐতিহাসিকরা। মানুষটা ছিল খাঁটি। ইংরেজদের, ফরাসিদের তিনি ব্যবসা করতে দিয়েছেন। তাদের কাছে শুধু অস্ত্র রাখতে দেননি। নবাব আলীবর্দি খাঁ কেন তবে সিরাজদৌলাকেই ভাবী নবাব বেছে নিয়েছিলেন? তাঁর মধ্যে সেই তেজস্বীতা দেখেছিলেন। কালি সহজে লাগানো যায় বেটি। সিরাজদৌলার মতো নবাব আর হয়নি কেউ।
আলি মির্জা সাহেব একটু থামেন। কেমন এক ভাবনায় তলিয়ে যান। কথা বলেন না। দূরে তাকিয়ে আছেন। যেন সেই নির্মম রাত তিনি দেখতে পাচ্ছেন। সিরাজদৌলাকে যেদিন হত্যা করা হলো। বাংলার মসনদ কেঁপে উঠেছিল। আমিনার কান্না এখনো মুছে যায়নি। তিনি বাংলাকে এক নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন।
নাজ চুপ করে বসে। পরিবেশ কেমন ভারী হয়ে ওঠে। ধুলো জমেছে অনেক। কিন্তু সেই সোনার বীর যোদ্ধাকে ঢাকা যায়নি। আজ তা আলি মির্জা সাহেব স্পষ্ট করে দিলেন।
নাজ আর কোনো কিছু জিগ্যেস করে না। বসে থাকে মুখোমুখি। নাজের মনে ঝড় বইছে। কোঠির খবর এখানে না এলে সব জানা যেত না। নাদিরাকে কি খুঁজে পাওয়া যাবে? না তিনি এ শহর ছেড়ে চলে গেছেন? ও আরও ভাবতে থাকে। নাদিরার সঙ্গে নোরিন ফুপুর কি এত সম্পর্ক? সব জানতে হবে ওকে। নাজ জিগ্যেস করে, আপনি এখানে কেন চলে এলেন?
সে অনেক কথা বেটি। আমার আতরের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল। অনেক মানুষ কাজ না পেয়ে চলে গেল মুর্শিদাবাদ শহর ছেড়ে। আমি পড়ে রইলাম এখানে। আর বয়সও হল। বুকের মধ্যে অনেক জমানো কথা আজ কিছুটা বলে হালকা লাগছে। এমন সময় সেই আগের মানুষটি শরবত দিয়ে গেলেন। নাজ শরবতে চুমুক দেয়। বেলা যে কখন গড়িয়ে গেছে তা ও বুঝতে পারেনি। এবার তাকে উঠতে হবে। ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। আরও কিছুটা সময় ওর বসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ও একা ফিরবে। কাশিমবাজারের রাস্তাতে রাত নামলে ওর কেমন যেন লাগবে। তাই ওকে উঠতে হয়।
বেটি, আবার এসো। ভালো লাগলো কথা বলে। তুমি খুব সমঝদার। তুমি খুব বড়ো ঘরানার মেয়ে বলে মনে হয়। এসো বেটি।
নাজ বিদায় নিয়ে এগিয়ে যায়। কাশিমবাজারে কেমন হিম হিম সন্ধ্যা নামে। ও দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় অটো ধরবে বলে।
রাজকুমার শেখ, কথাসাহিত্যিক, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ