রাজকুমার শেখ
কোঠি বাড়ির থমথমে ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। নাচঘরে তানপুরার মিহি সুর ছাদ অবধি ভেসে আসছে। ছাদ থেকে অনেক দূর দেখা যায়। সবে রাত নামতে শুরু করেছে। নানহার কাছ থেকে আসবার পর আর মুজরা বসেনি। নাদিরা সব বন্ধ রাখতে বলেছে। তবু ওর বাজনদাররা বসে। সুর তোলে। ঝাড়বাতির আলো ছড়িয়ে পড়ে। গোলাপ জলে ধোয়া হয় পান গ্লাস। ফুলের ঝাড় আসে নাগিনাবাগ থেকে। আতরের খুশবু ছড়িয়ে দেওয়া হয় মখমলি চাদর এ। পানদানি। সব গুছিয়ে রাখে। যে রাগে আজ মাতাল হবে রাত। নাদিরা শুধু একজনকে শোনাবে তার দিলখুস করা গানা। তার মন বাগিচায় আজ রং লেগেছে। সব লুটিয়ে দেবে তার কদমতলে। একেই কি বলে, ভালো বাসা? ও জানে না। কত জন আসে তার কোঠিতে। কেউ তাকে ভালো বাসা দেয় না। যা দিয়ে যায় তা হল দরদ। সেই দরদ নিয়ে তার সারারাত কাটে। মেকি সব। টুটে যাক তার পায়ের ঘুঙুর।
ছোড়দে পিয়া,
আব জবানী না রাহা———
তুমি যতদিন সুন্দরী আছো ততদিনে তোমার কদর। তোমার চোখের সুর্মা মুছে গেলেই তুমি নবাব দরবারে চাকরানি। কোনো দাম নেই। এ জগৎ সে চেনে। তার বহু পূর্বে এখানে রাজ করতো নুরশাবানু। তাকেও এই নিমক হারামরা ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এখন কোঠির আর তেমন রমরমা নেই। নাদিরার পর সব বন্ধ হয়ে যাবে। এ লাইনে আর কেউ নেই। নাদিরা যে কদিন আছে। নানহার মতো রহিসরা আসবে। তার রূপের রস পান করবে চোখের পেয়ালা ভরে।
নাদিরা ঢেলে দেবে তার রূপের মদিরা মেকি সব নিমক হারামদের পেয়ালাতে। ও ভালো করে এদের চেনে। কিন্তু উপায় কি? ওকে এ লাইনেই থাকতে হবে।
এ সব যখন ভাবছিল তখন বাগানের রাস্তাতে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা গেল। আসগর আলি আসছে। আজ শুধু তার সঙ্গে নাদিরা রাত কাটাবে। খুলি আকাশে তারা দেখবে। ডুবে যাবে কি নতুন কোনো মনের মদিরায়? আজ ওর মাতাল হতে ইচ্ছে করছে। সব লুটিয়ে দিয়ে ইচ্ছে করছে। আসগর আলিকে আজ সব দিয়ে দেবে। সে হোক সামান্য টাঙা ওয়ালা। কিন্তু তার খাঁটি দিল আছে। সে নাদিরাকে ভালোবাসে। ওর মতো কাউকে আজ অবধি দেখেনি। ওর রুপে সে পাগল হয়নি। তাকে এত কাছে পেয়েও ছুঁয়ে দেখেনি। অবাক হয়েছে নাদিরা। নানহার সঙ্গে কত ফারাক। নাদিরা মরলে আসগর আলির কদমতলে মাথা রেখে মরবে। আজ সে তার কোঠির খাস মেহমান। তার মন আজও জয় করে নেবে। তার মখমলি বিছানায় আসগরকে সব ঢেলে দেবে। তার রূপের পেয়ালা তুলে দেবে আসগরের হাতে। সে তার আসল প্রেমিক। নাদিরা অনেক আগেই বুঝেছিল তাকে। কিন্তু আসগর এগিয়ে আসেনি। কেমন দূরে দূরে থাকতো। কিন্তু সে—ই তো তাকে অসময়ে সাথ দিয়েছে। ও ছাড়া জীবন সঙ্গী কা ভাবতে যাবে? এবার ও এ সব ছেড়ে দেবে। আসগরকে সে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দেবে।
এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের চেনা শব্দ পেল ও। নাদিরা বিছানা থেকে উঠে বসে। আজ কিন্তু ও কোনো সাজ করেনি। নকল রং মেখে তার সামনে আসতে চায় না। আজ তার আসল রূপ দেখে আসগর আলি মুগ্ধ হোক। তার কাছে সে এমন ভাবেই থাকতে চায়। ও জানে এ পায়ের শব্দ শুধু এক জনের—ই। আসগর। আজ বিনা অনুমতি ছাড়ায় সে এলো নাদিরার অন্দর মহলে। সত্যি যেন কোনো নবাব জাদী। তার রূপ দেখে আজও মুগ্ধ হল আসগর আলি। ওকে আলতো করে আদাব জানালো।
নাদিরাও মাথা ঝুঁকিয়ে আদাব করলো। গোটা ঘরে গোলাপ জলের সুগন্ধি ছড়িয়ে। নাদিরা বসতে বলে ওর খাটে। আসগর বসে এক পাশে। আজ ও নতুন পোশাক পরে এসেছে। যুবক আসগর। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তার পূর্ব পুরুষ নবাব মহলে কাজ করতো। আসগরের মধ্যেও কেমন যেন নবাবী একটা ভাব। কিন্তু মানুষ হিসেবে ভীষণ ভালো। সরল। কদর করতে জানে। নাদিরা মানুষ চিনতে ভুল করেনি। তার চোখে এড়িয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। তার শরীরকে খুবলে খেতে চেয়েছে কতজন। কিন্তু নাদিরা নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। সেও একটি ভালো ঘরনাতে বড়ো হয়েছে। তালিম নিয়েছে ভালো উস্তাদ এর কাছে। একটু একটু করে এ জগতের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। জীবনের অনেক গলি পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু একজন খাঁটি মানুষ পায়নি ও।
আলি, আজ তুমি আমার খাস মেহমান। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আজ এ সাম তোমার জন্য আলি। বলো কি নেবে এখন?
কিছু না।
নাদিরা শরবত আনতে বলে। ওর কাজের মেয়ে এসে শরবত দিয়ে গেল। আলি চুমুক দেয়। খুশবুদার শরবত। ও একটু একটু করে চুমুক দেয়। নাদিকা দুচোখ ভরে দেখছে। এমন সাধারণ বেশে আগে কখনো দেখেনি ও। এত সুন্দর দেখতে। ঘরটা যেন ওর রুপের ছটায় ভরে গেছে। মনে হল ওর লম্ব আঙুল গুলো ছুঁয়ে দিতে।
আলি, আজ এখানে খাবে। গল্প করবো সারারাত। আকাশের দিকে কতদিন তাকাইনি। ভুলে ছিলাম সব। আর ভালো লাগে না। মরে যেতে ইচ্ছে করে।
ইস! এ কথা বললে যে পাপ হবে।
পাপ! মুক্তি নেই আমার। মরণে সে মুক্তি পাবো বোধহয়। বিচার তো হবে একদিন। ছাড় পাবো না আমি। চলে যেতে পারলে হয়!
নাচ ঘরে সুরের মূর্ছনা ভেসে আসছে। যার দেয়ালের পরতে পরতে লেপ্টে আছে নাদিরার চাপা পরা আর্তনাদ। আসগর একটু তাকে সুখ দিতে চায়। যে সুখে ও হাসবে ওকে কাছে পেয়ে। তার জন্য ও ছুটে এসেছে। নাদিরা ভালোবাসা চায়। সে তা দেবে কোনো বাধা না মেনেই। ও ফুরিয়ে যেতে চায় নাদিরার মাঝে। মিশে থাকবে তার মনে।
চলো ছাদে যাই। আজ চাঁদ দেখবো। তুমি এখানেই থাকবে। সারারাত তোমার কথা শুনবো। কতদিন ভালো করে কারো সাথে কথা হয় না। আসলে মনের মতো তেমন করে কাউকে পেলাম কই? আমার শরীর নিয়ে খেলতে চায়। আমার মনের কদর কজন বোঝে? মনই আসল। শরীর নয়। নারীকে চেনা যায় তার মন খোলা হাসিতে। আলি, ঠিক বললাম কি?
নাদিরা আপন মনে হাসতে থাকে। ওর হাসিতে যেন হাজার চুড়ির শব্দ ছড়িয়ে গেল ঘরে। মুগ্ধ হয়ে নাদিরাকে দেখছে আসগর আলি। এত রূপ! সে তার বুকে জায়গা দেবে কি করে? ও যেন কাঙাল হয়ে যাবে। পুড়ে যাবে সব। অবশ্য ও আজ পুড়তেই এসেছে। নাদিরার আগুনে ও আজ পুড়বে।
নাদিরা ছাদে যায়। পিছনে আলি। রাত নেমেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আম বাগানের মাথায় চাঁদটা উঁকি মারছে। বাতাসে নবাবী গন্ধ। এ শহর যতদিন থাকবে ততদিনে এই নবাবী গন্ধটা থাকবে। নাদিরা রাতকে রঙিন করে তোলে রোজ। আজ আলিকে ঢেলে দেবে তার সাজানো মনের পেয়ালা থেকে ভালোবাসার মদিরা। ওর প্রথম প্রেম। সোহাগে ভরিয়ে দেবে রাত।
আলি, অত দূরে কেন? এসো দুজনে রাতের তারা দেখি। সব ঘুমিয়ে গেলে তোমাকে গান শোনাবো। আজ আমার ভালো লাগা যত গান। তুমি শুনবে?
শুনবো। আমার মা আমাকে সেই ছোটবেলায় গান শোনাতেন। নবাবদের গল্প বলতেন। কত সুখী ছিল মানুষ। আমার পরিবার কত সুখী ছিল। নবাব দরবারে কাজ করতেন। তারাও একদিন চলে গেল। নবাব এর স্বর্ণ দিন শেষ হয়ে এলো। আমরা পথে বসলাম। আর আজ!
থাকনা ও কথা! কি হবে বলে? রাতটাকে নষ্ট করতে চাই না আলি। তুমি আজ আমার মেহমান। বিশেষ করে তুমি খাস মেহমান। আমার দিল। এতদিন কেন দূরে ছিলে তুমি? আমার চোখের ভাষা বোঝোনি? আমি কতখানি তোমাকে ভালোবাসি। আসগর আমার যা কিছু আছে সব তোমার। যদি তা গ্রহণ করো। আমি গান গেয়ে রোজগার করেছি। আমি নিজেকে নষ্ট করিনি আজও। তবে আজ আমি নিজেকে তোমার মধ্যে বিলীন হতে চাই। আমাকে নাও তোমার দুবাহুতে জড়িয়ে। আমি আর পারছি না।
নাদিরা কেমন টলে পড়ে। আসগর আলি ওকে তার শক্ত বাহতে জড়িয়ে ধরে।
না নাদি, আমি তোমাকে পড়তে দেব না। আমিও তোমাকে ভালো বাসি।
নাদিরা মুখে আলতো হাসি খেলে যায়। নাদিরা ওকে জড়িয়ে ধরে। দূরে কোথায় যেন একটা রাতচোরা পাখি ডাকছে। নাচঘরের সমস্ত বাতি যেন জ্বলে উঠলো। আজ হাজার তারার আলো ছড়িয়ে গেল চারপাশে। নাদিরা সুখগুলো আজ যেন সত্যি হল। সে একজন মানুষ ভালোবাসতে চেয়েছিল। নাচঘরের রহিসদের নয়। টাকা পয়সা দিয়ে তাকে কেউ আজও কিনতে পারেনি। আর পারবেও না।
চলো ঘরে। আজ তোমার সঙ্গে সারারাত গল্প করবো। আমাকে তুমি তুলে নাও। আমি হাঁটতে পারবো না আলি। আজ যে আমি তোমার হলাম।
আসগর সুন্দরী নাদিরাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে আসে। মখমলি বিছানায় শুইয়ে দেয়। নাদিরা হাত ধরে টান দেয় আসগরের। আসগর টাল সামলাতে না পেরে নাদিরার ওপর এসে পড়ে। নাদিরার ভরাট বুক চেপে বসে আসগরের বুকে। কেমন এক ঘোর লাগা সুগন্ধিতে আসগরের নেশা লেগে যায়। ও দিকে রেশমি কাবাব ঠান্ডা হতে থাকে। ওরা রাতের খাবার খেতে ভুলে যায়। নাদিরার নরম বুকে আসগর মাথা রাখে। নাদিরা আসগরের মাথা তার ণরাট বুকে চেপে ধরে। আসগর মুখ ঘষতে থাকে তার মুখময়। পুরুষালি ঠোঁট নাদিরার ঠোঁটে চেপে ধরে। নাদিরা এক গভীর ভালো লাগায় ছটফট করে ওঠে।
রাত বয়ে যায়। নাদিরার বুকের কাপড় সরিয়ে দেয় আসগর। নগ্ন বুকে ভালোবাসার শিশির পড়তে থাকে একটু একটু করে। নাদিরা চোখ বন্ধ করে আসগরের সোহাগে ও ডুবে যায় এক গভীর অতলে। যেখানে ওদের দুজনের সুখের ঠিকানা। দুটি মন মিশে গেল আদিম কামে। ভালোবাসায়।
রাজকুমার শেখ, কথাসাহিত্যিক