এখন সময়:রাত ১১:১২- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ১১:১২- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

দুপুর রঙের বৃষ্টি (পর্ব – ৭)

রাজকুমার শেখ : পাখিটা ডেকেই চলেছে। ভোর ভোর একটা ভাব। এখনো অনেক রাত। আসগর আলির ঘুম আসে না। কি জানি একটা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে?  ঠিক ঠাহর করতে পারছেন না। বয়স হলে সব কি তালগোল পাকিয়ে যায়। এক এক করে বয়সটা তো কম হল না। চোখ দুটোতে চালসে ধরে যায়। চশমা নিয়েছেন অনেক আগেই। কিন্তু চশমা পড়তে পারেন না। কেমন আদোবাদো ঠেকে। সব কথা মনেও থাকে না। আজকাল এমনটাই হচ্ছে। কিন্তু পাখিটা কি ভয় পেয়ে ডাকছে? আম বাগানে ওদের বাসা। অনেক পুরানো আম বাগান। নবাবী আমলের। অনেক আম গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। ভালো জাতের আম আছে। মন পসন্দ, বেগম খাস, কৈতুর আরও কত কিসিমে’র আম। এখন সব মনেও পড়ছে না। আমের সময় বাগানে গেলে কত আম পেকে থাকে গাছে। এই আম কতদিন নাদিরাকে দিয়ে এসেছেন। নাদিরা আম খুব ভালো বাসতো। সে সব কবেকার কথা। ও নিয়ে আর তিনি ভাবতে চান না। তামাদি হয়ে গেছে। এখন একটু ঘুমোতে চান। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমও হারিয়ে গেছে। কেমন এক ক্লান্তি অনুভব করেন এখন। রাতের সময়টা তিনি  বুঝতে পারেন না। কত রাত হল। ঘড়ি নেই। মাঝে মধ্যে বেরিয়ে পড়েন শহরের রাস্তায়। কখনো তোপখানা, কখনো আবার হাজারদুয়ারী, ইমামবাড়া এ সব করে বেড়ান। কে যেন তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। এখনো রাতে ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনতে পান। সে শব্দে তাঁর ঘুম টুটে যায়। এ শহরের গলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ে ঘোড়ার পায়ের শব্দ। তবে কি সিরাজদৌলার ঘোড়ার পায়ের শব্দ?  ওটা কি আসগর আলির মাথার মধ্যেই ঘুরপাক খায়? তিনি অবাক হোন। হয়তো কেউ ভাববে লোকটা বড্ড পাগল। কিন্তু তিনি  মনে করেন সিরাজ দৌলার মৃত্যু হয়নি।

সে অমর। সে বীর।

মনে করেন আসগর আলি সাহেব। তাহলে কেন তিনি বার বার আর্তনাদ শোনেন গভীর রাতে?  ১৭৫৭ এর পলাশীর যুদ্ধের হাহাকার আজও বাতাসে মিশে। হীরাঝিলে সিরাজদৌলার আশু লেগে ছিল। সেদিন সিরাজ দৌলার রক্ত মিশে ছিল মুর্শিদাবাদের এই পবিত্র ভূমিতে। আসগর আলি কিছুতেই এ হার মেনে নিতে পারেন না। আজও মীরজাফর এর কবর দেখলে ওর ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। মুঠো শক্ত হয়ে আসে আপনা থেকে। যেন মনে হয় সিরাজদৌলার তরবারিটা আঁকড়ে ধরে  চিৎকার করে বলতে

চান, বেইমান এর দল। আয়, তোদের মসনদের লালচ ঘুঁচিয়ে দেব।

কেমন যেন ভেতর ভেতর ঘেমে ওঠেন। শক্ত মুঠো বাতাসে ছোড়ে। মাঝে মাঝে এমন হয়ে যান। কি জানি এমন কেন আজকাল হয়? মনে মনে তিনি কিছুতেই পলাশীর যুদ্ধটা মেনে নিতে পারেন না। বড়ো ট্রাজেডি। ইতিহাস কখনোই ক্ষমা করবে না। সিরাজদৌলার চলে যাবার পর অনেক এর কাজ হারিয়ে যায়। রাজকোষে চলে লুট। কেমন ছিবড়ে হয়ে যায় সব। এখন কংকাল দাঁড়িয়ে। আসগর আলির বড্ড কষ্ট হয়। রাজধানী মুর্শিদাবাদ কেমন যেন ম্লান হয়ে গেল। ধুলোর মধ্যে ডুবে গেল মুর্শিদাবাদের জৌলুশ। যে মুর্শিদাবাদ কে লর্ড ক্লাইভ লন্ডনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। The City of Murshidabad is an extensive populous and rich as the City of the City of London with this difference that there are individuals in the first possessing infinctely greater property than in the last City.

কত যুগের কথা। আসগর আলির ঘুম আসে না। নানান কথা শুধু ঘুরপাক খায় মাথার মধ্যে। ঝিম মেরে বসে থাকেন। রাত গড়িয়ে যায়। দূরে আম বাগানে রাতচোরা পাখির ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ হয়। রাতের নিস্তব্ধতা। তারা গুলো জেগে আছে। এই তারা গুলো আকাশের বাহার। কত সুন্দর লাগে। আসগর আলি মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখেন তারা গুলোকে। তারা গুলোর ঘুম নেই। ভাবেন আসগর আলি সাহেব। ঘোড়া আর টাঙা নিয়ে জীবন কেটে গেল তাঁর। এখন আর পারেন না তেমন কাজ করতে। মেয়েটি না থাকলে উনার চলা দায় হয়ে যেত। তবে তিনি কখনো থেমে থাকেননি। মানুষকে এক সময় থামতে হয়। তার কর্ম ক্ষমতা কমে যায়। অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। তবু জীবন চলে জীবনের মতো।

না আজ আর তাঁর ঘুম আসবে না। বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়েন। হাত মুখে জল দেন। তারপর বাড়ির গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়েন। এ শহর তাঁকে ঘুমোতে দেবে না। কে যেন হাতছানি দিচ্ছে। এ শহরকে কখনো কখনো অচেনা মনে হয়। কত রক্ত। কত দীর্ঘশ্বাস। হাহাকার। এখনো যেন সব তাজা হয়ে আছে। বুকের ঘা কখনো শুকাই না। তিনি এ শহরের মৃত্যু দেখেছেন। তাঁর পূর্ব পুরুষগণ সাক্ষী।

তিনিও অনেক কিছুর সাক্ষী। তাঁর বুকে সিরাজদৌলার ক্ষত। যা তিনি আজও বহন করে চলেছেন। তিনি কখনো ভুলতে পারেন না সিরাজদৌলাকে। এ শহরে সিরাজ দৌলার রক্ত মিশে আছে। আসগর আলি হাঁটতে হাঁটতে এ সব ভাবছেন। আজকাল বড্ড বেশি করে এ সব কথা তাঁর মনে আসছে। তিনি এক সময় ইমামবাড়ার কাছে চলে আসেন। এখনো কি ঘোড়ার পায়ের শব্দ শোনা যায়? সেদিন কি তিনি ভুল শুনেছিলেন? তবে মালেকাও সে কথা বলেছে। আজ শোনা যায় কিনা তাই তিনি ইমামবাড়ার কাছে এগিয়ে যান। রাতের হিমেল বাতাস বয়ছে। গঙ্গা থেকে ওঠে আসা শীতল বাতাসে আসগর আলি সাহেব এর মন জুড়িয়ে যায়।  রাস্তাতে এখন কেউ নেই। চারপাশে শুনশান। ঝিঁঝি পোকা ডেকেই চলেছে। কান ধরে যায়। হাজারদুয়ারীর আলো গুলো মিটমিট করে জ্বলছে। একটা পেঁচা হঠাৎ মাথার ওপর দিয়ে উড়ে পালালো। তার ডানার শন শন শব্দ শোনা যায়। রাতের আকাশে মিলিয়ে গেল পেঁচাটা। আসগর আলি সাহেব আর দেখতে পান না। নিঝুম রাতে এরা শিকার ধরে। ইমামবাড়ার গায়ে হেলান দিয়ে একটু দাঁড়ান। আজ সব যেন চুপচাপ। কোথাও কোনো শব্দ নেই। রাতের হিম পড়ছে। তিনি আরও কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকেন। দূরে কোথায় যেন মসজিদে আজান দিচ্ছে। তবে এখন ভোর হয়ে এলো। ভাবেন আসগর আলি সাহেব। এ ভোরটা আজ অন্য রকম মনে হচ্ছে। এ ভোরে যদি সিরাজদৌলা বেঁচে থাকতেন? ভোরের আজানে উঠে তিনি নামাজ আদায় করতেন। সব মানুষের জন্য দোয়া করতেন। একটা সুখী বাংলা চেয়েছিলেন। কিন্তু তা হতে দিল না। তারাও এক এক করে ধ্বংস হয়েছে। বাংলা বিহার উড়িষ্যার মসনদে কেউ শান্তি ভাবে বসতে পারেন নি। সে সব এখন তামাদি হয়ে গেছে। সে ইতিহাসের পাতাতে মরচে পড়ে গেছে। এখন তা ভেবে কি লাভ? কিন্তু আসগর তা মানতে পারেন না। তাঁর মনে এখনো সিরাজদৌলা। যার এখনো মৃত্যু হয়নি। সে এখনো ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ায় গোটা শহরে। আসগর আলি তা মনে মনে বিশ্বাস করেন। তাঁর যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এই শীতল শান্ত ভোরে তিনি কেমন ঘেমে ওঠেন। কাটরা মসজিদ এর মিনারে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আঁধার কেটে যাবে। নতুন সকাল উদয় হবে। দিন যাবে। কিন্তু সিরাজ দৌলা বেঁচে থাকবে মানুষের অন্তরে। তাঁকে মোছা যাবে না কোনো কালেই। এ শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে তাঁর নাম লেখা আছে। থাকবে।

আসগর আলি পথে একা হাঁটছেন আর ভাবছেন। ফজরের আজান হচ্ছে। তিনি কান পেতে আজান শুনছেন। পবিত্র ভোর। মনটা যেন কেমন হয়ে যায়। তিনি একা চলতে চলতে কত কিছু দেখতে পান। থমকে দাঁড়িয়ে পাখির ডাক শোনেন। পাখিদের ডানার শব্দ শোনেন। ফুলের গন্ধ। আরও নানান রঙের বাহারি ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে থাকে ভোরের বাতাসে। মনটা ভালো হয়ে যায়। তিনি ফজরের নামাজ আদায় করে চলে আসেন মালেকার চায়ের দোকানে। মালেকাকে চা দিতে বলেন। মালেকা এক পিয়ালি চা এগিয়ে দেয়। গরম চায়ে চুমক দিয়ে বলেন, মালেকা, আর কোনো খোঁজ পেলে?

না। তবে ঘোড়ার পায়ের শব্দ অনেকই শুনেছে।  তবে সত্যি কী ব্যাপারটা? আমার তা মনে হয় না। বলেই হাসে মালেকা।

এমন সময় আরও দুচারজন চা খেতে আসে। মালেকা ব্যস্ত হয়ে পরে। চা খেতে খেতে আসগর আলি এক গভীর ভাবনায় ডুবে যান। চায়ে চুমক দিতে ভুলে যান। তবে কি যে ঘোড়ার পায়ের শব্দ তিনি  শোনেন তা সত্যি নয়? না তাঁর ভুল হচ্ছে না। তিনি  ঠিকই শুনেছেন। তাঁর এত বড় ভুল হতে পারে না। কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও কিছুটা সময় বসে থাকেন। রোদ উঠেছে ঝলমলিয়ে। না এবার ফিরতে হবে। মালেকার চায়ের দোকান থেকে চলে আসেন। একা একা হাঁটতে থাকেন। মাথার ভেতর আবার চিন্তার বাসা ঘুরপাক খেতে থাকে। তিনি এগিয়ে চলেন। নবাবী আমলের কিছু বাড়ির দেওয়ালে গাছ গজিয়ে উঠেছে। ভাঙা পাঁচিলের উপর একটা কাক বসে কা কা করছে। সকালটাকে কেমন খান খান করে দিচ্ছে। তিনি এ ডাক শুনে একটা ঢিল নিয়ে ছুড়ে মারলেন। কাকটা ভশ পেয়ে পালিয়ে গেল। নাÑ তিনি কাকের ডাক শুনতে ভালোবাসেন না। কাক ডাকলেই কেমন একটা ভয় হয়। একদম কাককে সহ্য করতে পারেন না। তিনি আবার এগিয়ে চলেন। ইরানিদের পাড়া ফেলে এগিয়ে যান বাড়ির দিকে। বকরি গলি থেকে আসগর আলি সাহেব এর বাড়িটা বেশ দূরে। নাগিনা বাগ বামে ফেলে আরও কিছুটা পথ। তিনি  হাঁটতে ভালো বাসেন। সকালটা আজ বেশ সুন্দর। মাথার ভেতর চিন্তাটা একটু হালকা লাগছে। ফুরফুরে হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন। অনেক দিন পর আজ ভালো লাগছে।

 

-ক্রমশ

রাজকুমার শেখ, কথাসাহিত্যিক, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে