রাজকুমার শেখ: আজ কদিন হল নাদিরার সঙ্গে আসগর আলির দেখা নেই। বাগানবাড়ির অন্দরমহলে প্রবেশ নিষেধ। সেখানে নাকি কোন নবাব এসেছে নাদিরার গান শুনতে। সব কথা তো বাগান বাড়ির দেওয়াল গলে বাইরে আসে না। বাইরের কথা অন্দরমহলে প্রবেশ করে না। রোজ আসর বসছে। ঠুমরী আর গজল গোটা বাগানবাড়িতে বেজে উঠছে। ভরে গেছে কানাই কানাই। সে মধুর সুধা পান করছেন নবাব। এখানে নবাবরা আসেন গোপনে। কেউ সে খোঁজ জানে না। শুধু নবাবের লোক এসে জানিয়ে যায়। নবাব আসার আগে গোটা বাগান বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। ঝাড়বাতির আলোর রোশনাই ঝরে পড়ে আসর ঘরে। রজনীগন্ধা আর বেলফুলের মালা, চন্দনের ধূপগন্ধে ম ম করে সব। নাদিরার সাজ যেন সে কোন রাজরানি। সুরমা টানা চোখে যেন গভীর ঝিলের হাতছানি। নবাব বুঁদ হয়ে যান সে রূপ দেখে। গোলাপ জলে ভিজে যায় মন। সারেঙ্গীর মিঠে সুর বাতাসে মিশে ভেসে যায় নদীর ওপারে। রাতের রজনীগন্ধার ঘ্রাণ আর গোলাপের সুগন্ধি মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে। নবাব চলে যান। নাদিরা তখনও এক ঘোরের মধ্যে থাকে। শেষরাতে ঘুমোতে যায়। রাতের শীতল বাতাস ওকে জড়িয়ে ধরে। এভাবে ওর মন চায় না। সে মুক্ত আকাশে বাঁচতে চায়। এই ঠুমরী ওর গলা দিয়ে
আর বের হতে চায়না। তবু নবাবকে আনন্দ দেওয়ার জন্য গাইতে হয় ওকে। নবাব খুশি হলে নজরানা বাড়ে। অনেক সামগ্রী আসে তার কোঠিতে। এ সব চলে রাতের অন্ধকারে। নাদিরা একটু শান্তিতে বাঁচতে চায়। কিন্তু তার পেশা তাকে মুক্তি দেয় না। নিজেকে রোজ চিতা সাজাতে হয়। আর সেই আগুনে পুড়তে হয়। শুধু রোজ আনন্দ বিলি করো। শরীর খারাপের কোনো জায়গা নেই।
আজ নাদিরার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল। আম গাছে একটা বুনো টিয়া ডাকছে। তার ডাকেই ওর ঘুম টুটে যায়। পশ্চিমের খোলা জানালা দিয়ে বাতাস এসে ঘরের সব কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। পাশেই ভাগীরথী বয়ে চলেছে। গত রাতে অনেক রাত করে ও ঘুমোতে গেছে। নবাবের খাস খিদমত আলি খাঁ এসেছিলেন। সঙ্গে কিছু নজরানা। নবাব তার জন্য পাঠিয়েছে। গল্প করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেছিল। এক সময় আলি খাঁ ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যান। নাদিরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। বেচারার কিছু করারও নেই। এ কদিন তার কালঘাম ছুটে গেছে। তার ঘরে এখনো নবাবের দামি আতরের খুশবু ভাসছে চারপাশে। ও আর গন্ধটা নিতে পারছে না। কেমন যেন গা গুলিয়ে আসছে।
পাখিটা এখনো ডাকছে। অনেকদিন আসগর আলির সাথে দেখা নেই। তাকে খবর দিতে হবে। আজ কোথাও গিয়ে একটু মুক্ত বাতাস নিতে হবে। নাদিরা মখমলি বিছানায় আর একটু নিজেকে এলিয়ে দেয়। কেমন এক আরাম বোধ করে। মনটা এখন ভালো লাগছে। এমন সময় তার ঘরে আসে নাহিরা। ওর দেখভাল করে। তার হাতে গরম চায়ের কাপ। নাদিরা এ সময়ও চা খায়। তারপর বিছানা ছাড়ে। আজ ওকে চাটা রেখে দিয়ে যেতে বলল। নাহিরা চায়ের কাপ রেখে চলে গেল। সূর্যটা একটু একটু করে উঠছে। না এবার ওঠা যাক। ও মনে মনে বলে। নাহিরাকে ডেকে বলে, আসগর আলিকে আজ বসতে বলো। নাহিরা জলিলকে গিয়ে বলে কথাটা। নাদিরা চা খেয়ে গোসল করতে চলে যায়। যে কোনো সময় আসগর আলি চলে আসবে। নাহিরাকে রান্না করতে বলে। আজ খেয়ে বেরিয়ে পড়বে।
বেশ বেলা হয়ে গেল। আসগর আলি সময়মতোই এসেছে। ওর গাড়ি লাগিয়ে খবর দেয় অন্দরমহলে। নাদিরা আজ দারুণ সাজগোছ করে এসেছে। ওকে যেন নবাবি রাজকন্যা লাগছে। আসগর আলি চোখ ফেরাতে পারে না। আজ কোনদিকে যাবে তা আসগর আলির জানা নেই। যেদিকে যেতে বলবে সে সেদিকে যাবে। এ সময় নাদিরা বের হয় না। কিন্তু আজ তার মতি অন্য রকম। আসগর আলি নাদিরাকে আসতে দেখে আবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। একদিন ওকে দেখেনি বলে আসগর আলির মন খারাপ। কিন্তু সে কথা তো ওকে বলতে পারবে না। আজকাল এই বাগানবাড়ি কেন যে এত টানে কে জানে। সে সামান্য টাঙাওয়ালা। নাদিরা তাকে কেনো বার বার ডাকে?
আলি, চলো যেখানে ইচ্ছে।
নাদিরা বলে কথাটা।
আসগর আলি টাঙা গাড়িটাতে নাদিরাকে উঠতে সাহায্য করে। নাদিরা উঠে বসে। যেন একটা পরি এসে বসলো ওর টাঙাতে। চারপাশে ঝলমলে আলো ছড়িয়ে গেল। ওর চোখ দুটো যেন সে আলোতে ঝলসে গেল।
কী হল আলি, চলো?
হুম।
টাঙা টগবগ করে ছুটে চলল।
কোন দিকে যাবো?
তোমার যেখানে খুশি। আজ একটু খোলা আকাশের নিচে বসতে চাই আলি। আর ভালো লাগছে না। হাঁপিয়ে উঠেছি। চোখে আর নকল সুরমা লাগাতে ইচ্ছে করে না। গাইতে মন করে না। তবু নবাবদের মান রাখতে এ সব করতে হয়। কার ভালো লাগে আলি! জীবন নিজের মতো করে কাটাতে পারছি কই? এখানে কত মানুষ কাজ হারিয়ে না খেতে পেয়ে মরছে। কে খোঁজ রাখে বলো। নাহিরা রোজ এ সব গল্প করে।
সিরাজদৌলার পতনের পরই তো সব কী যেন হয়ে গেছে? মানুষের সুখ চলে গেছে। কত মানুষ কত কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সব কাজ হারিয়ে গেল। এ শহরটার হল কী!
কেমন আক্ষেপ ঝরে পড়ে আসগর আলির গলায়। সব বদলে যাচ্ছে। মানুষ কাজ হারিয়ে যেখানে সেখানে চলে যাচ্ছে। শহরটা ফাঁকা হয়ে গেছে। বাজারটা যেন চুপচাপ। নবাবি গন্ধ কেমন মরে আসছে দিনকে দিন। আসগর আলি যে জৌলুষ ছোটবেলা দেখেছে তা আজ যেন কংকালসার।
ওদের ঘোড়া ছুটে চলেছে। ভাগীরথীর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে জিয়াগঞ্জের দিকে। নশীপুর রাজবাড়ির পাশ ঘেঁষে। একটা সুন্দর আমবাগানে এসে থামে ওদের টাঙা। এখানে তেমন কেউ নেই। ছায়াঘেরা আমবাগান। সবুজ সবুজ গন্ধ।
নাদিরা নামে টাঙা থেকে। বুকভরে বাতাস নেয়। কতদিন পর এমন মুক্ত আকাশের নিচে এলো সে। আসগর আলি ঘোড়াটাকে খেতে দেয়। আজ ও বেশ সাজ করে এসেছে। আসগর আলিকে একটু অন্যরকম লাগছে। চোখে সুরমা দেওয়া। চুলগুলো যতœ করে ঝেড়েছে। টেরিটা বেশ লাগছে। আসগর আলির মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। নাদিরার চোখে ও শুধু টাঙাওয়ালা নয়। ও যেনো অন্য কিছু। ও মনে মনে ভাবে।
আলি, চলো ওদিকে গিয়ে বসি।
আলি নাদিরার পিছন পিছন হেঁটে এগিয়ে যায়। জায়গাটা সবুজ ঘাসের বিছানায় যেন ঢেকে আছে। সবুজ গন্ধটা বাতাসে মিশে আছে। নাদিরা বুকভরে বাতাস নেয়। বাগানবাড়িতে ওর দম আটকে আসে যেন। এখন আর ভালো লাগে না। নিজেকে ধূপের মতো একটু একটু করে শেষ করছে। না — এবার সে মুক্তি পেতে চায়। দূরে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ও। পাশে আসগর আলি বসে। কেমন যেন চুপচাপ সময় গড়িয়ে যায়। একসময় নাদিরা মৌনতা ভেঙে বলে, আলি, আমার জন্য তোমার কষ্ট হয়? এই যে এতদিন তোমার সাথে আমার দেখা নেই।
আসগর আলি কেমন থম মেরে যায়। হঠাৎ ওর মুখে কোনো কথা আসছে না। তারপর একটু সময় নিয়ে বলে, আপনি হলেন নবাবদের লোক। আপনার হুকুম তামিল করা আমাদের কাজ। আপনি যা বলবেন আমি করে দেব।
আমাকে কি তোমার তাই মনে হয়?
কি? ওই যে বললে, আমার হুকুমের দাস তুমি।
আসগর আলি কি কিছু ভুল বলে ফেলল? ও মাথা চুলকাতে থাকে।
আপনি আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের জন্য যেটুকু করেন তা অনেক বেশি।
তুমি খুব ভালো মানুষ। তোমার কোনো লোভ নেই। আমার কি তোমার কাছে কোনো মূল্য নেই? আমার রূপে কত নামি-দামি মানুষ পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে। আমার রুপ দেখে কি তোমার মনে এতটুকু কি রেখাপাত করেনি?
আমি সত্যি বলবো?
হ্যাঁ— বলো। আজ আমি শুনতে চাই।
কিন্তু কেন শুনতে চান?
আলি, জীবন কখনো একা একা কাটে না। মনের সাথি লাগে। সুখ দুঃখের বন্ধু দরকার হয়। এ সব কি তুমি বোঝো?
বুঝি। তবে আপনার মতো করে নয়।
তাহলে?
তবে আপনাকে একদিন না দেখলে আমার কাজে মন লাগে না।
নাদিরা এ কথা শুনে আলির দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার মানুষ চিনতে ভুল হয়নি। হোক না সামান্য টাঙাওয়ালা। তবু সে অনেক ভালো। তার ওপর ভরসা করা যায়। কিন্তু তাকে পেতে হলে সব ছাড়তে হবে। মেনে নেবে কি তার সমাজ? এ শহরে তার নাম সবাই জানে। তার কথা এ শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে কান পেতে রাখলে শোনা যাবে। সে যে কোঠিতে গান করে। নবাবের মন ভুলিয়ে রাখে। তার মনের সাধ মনেই থেকে যায়। কী হবে এ সব বলে আলিকে? সে বেচারা একটা ভালো মানুষ।
আলি, তুমি পারবে আমাকে সারাজীবন আগলে রাখতে? আমি বাঁচতে চাই আলি! আমি বাঁচতে চাই।
নাদিরার গলা ধরে আসে। ও আর কথা বলতে পারে না। আলি ওর কাছে এগিয়ে আসে। আলতো করে নাদিরার হাতে হাত রাখে। ও যেন কোনো শীতল নদীকে ছুঁলো। এ প্রথম নাদিরাকে সে ছুঁয়ে দেখলো।
আপনি শুধু শুধু মন খারাপ করছেন। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
এ কথা শুনে নাদিরা অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আলির দিকে। ওর গভীর ঝিল চোখ দুটোতে জল টলমল করছে। দূরে কোথায় যেন একটা ছাতার ডাকছে। এই গভীর আমবাগানে দুটি মন আজ যেন নতুন করে মিশে গেল এক গভীর ভালোবাসায়। যে ভালোবাসা মখমলি চাদরে মোড়ানো। হয়তো ওরা মিলিত হবে কোনো এক ভালো লাগা চাঁদনি রাতে। যেখানে কোনো বাধা থাকবে না। শুধু চাঁদের হিমেল অনুভূতি দুজনের মনে জড়িয়ে থাকবে। হয়তো বহুকাল।
নাদিরা আলির পাশ ঘেঁষে বসে। আজ আলির মনে উথাল-পাথাল ঢেউ। যে ঢেউ ওকে যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার মনে কেমন এক দ্বিধা কাজ করছে। এত সুখ তার কপালে সইবে তো? নবাবের কেউ জানতে পারলে তার জান চলে যেতে পারে। কেমন একটা ভয় করছে ওর। তবে ও সাহস আনে মনে। জয়ী তাকে হতেই হবে। এমন সময় নাদিরা বলে, আলি, তোমাকে একটা জিনিস উপহার দিতে চাই। তুমি ওটা যেন ফিরিয়ে দিও না। আমি কষ্ট পাবো।
বলেই ওর হাতে কিছু মোহর তুলে দেয়। এটা তোমাকে উপহার দিলাম।
কিন্তু কেন?
এমনি। তোমার কাছে এগুলো থাকলে আমার কথা মনে পড়বে।
আলি কেমন অবাক হয়ে যায়। মোহর সে কোনোদিনই দেখেনি। চকচক করছে। আলি ওগুলো নিতে চায় না। কিন্তু নাদিরা তাকে জোর করে দেয়।
ওদের অনেকটা সময় কেটে যায়। বেলা পড়ে আসছে। নাদিরা আরও কিছুক্ষণ বসে থাকতে চায়। ছাতার আর ডাকছে না। সময় গড়িয়ে যায়। বেলার শেষ আলোটুকু নিভে যাবে। আলো শেষ হবার আগে নাদিরাকে ফিরতে বলে। কিন্তু সে বসে থাকে। বাতাসে আজ ফুলের গন্ধ। ওর মনে আজ দোলা দিয়ে যায় আর এক ফাগুন বাতাস।
রাজকুমার শেখ, গল্পকার, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ