শাহানারা স্বপ্না
শখের পর্যটক মাজিদ শেখালয়েভের দেশের নাম ’দাগেস্তান’। মাতৃভূমির আলাপে, সৌন্দর্য বর্ণনায় মাজিদের যেন তৃপ্তি নেই। দৃষ্টিতে ফোটে এক দেশ প্রেমিকের গর্বিত অহংকার। ঘুরে ফিরে মুখে কেবল নিজ দেশের এলাকার খুঁটিনাটি বিষয়ের কথা। তার নিজের ভাষায় “অনেক শহর অনেক দেশ পরিভ্রমন করেছি, কিন্তু আমার দাগেস্তানের মত এমন নয়নাভিরাম শান্তির দেশ আর একটিও পাইনি।মানুষের স্বল্পায়ূ জীবনটাতো সুখের খোঁয়ারী দেখতে দেখতে কাটে, তো সে সুখ দাগেস্তানের মাটিতেই পাওয়া সম্ভব”। মাজিদ রাশান কালচারে শিল্পকলার কাজের সাথে জড়িত। মাজিদ আমাদের এখানে অনেক দিন ভাড়া থাকার সুবাদে গল্প হতো। সে প্রায়ই বিকেলে গল্প করার জন্যই চলে আসতো। ইরাকে প্রবাসী থাকার সময় প্রচুর ’রুশী’র সাথে আমার মেলামেশার সুযোগ হয়েছিল। এতটাই অন্তরঙ্গতা ছিল যে, কথা বলার সুবিধের জন্য স্বেচ্ছায় রুশ ভাষাও শিখেছিলাম। তাই মাজিদের কথাবার্তা বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয়নি।
’ল্যন্ড অব দি মাউন্টেনস’ হিসেবে বিখ্যাত দাগেস্তান। পাহাড়ি সৌন্দর্যের লীলাভূমি। এখানকার রঙ-বেরঙের পাথরের সামাহার বিধাতার এক অপরূপ দান। লাল, নীল, কমলা, সবুজ, হলুদ ইত্যাদি হরেক রঙের সারি সারি পাহাড়- একেকটি যেন ওমর খৈয়ামের ‘রুবাই’। আকাশের কিনার ঘেঁষে সাজানো রঙধনুর সবক’টি রঙ। বিশাল বিপুল সেই রঙদার উপল শ্রেণীভার তোমার দুচোখ ধাঁধিয়ে দেবে! আর কি মসৃন! যেন কোন ভাস্কর তার ছেনি দিয়ে কুঁদে রেখেছে। প্রকৃতি নিজেই সৃজন করে রেখেছে নিজের মর্মর-মূর্তি। সেই মর্মরে আছড়ে পড়া সূর্যের সোনালী আলো মুহুর্মুহু যে উর্মিমালার তরঙ্গ সৃষ্টি করে, সে দৃশ্য চোখে না দেখলে বর্ণনা করা কঠিন। মাজিদ শেখালয়েভের চোখে সেই সৌন্দর্যের রেশ প্রচ- আবেগে বিন্দু বিন্দু জল হয়ে ঝরে।
দাগেস্তান বর্তমানে রাশিয়ার একটি প্রজাতন্ত্র দেশ। এর উত্তরে আজরাবাইজান, দক্ষিণে ককেশাস অঞ্চল, পশ্চিমে জর্জিয়া, রাশিয়া এবং পূর্বে বয়ে চলেছে কাস্পিয়ান সাগর। এর উত্তর-পশ্চিম পাশ ঘেঁষে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চল রঙিন পাথুরে পাহাড়, হরেক রকম ঔষধি গাছ এবং ক্রিসমাস ট্রি’র মতো প্রচুর গাছে পরিপূর্ন। ছোট-বড় পাহাড়ে ঢাকা দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলের দাগেস্তানীরা খুবই স্বাধীনচেতা ও দু:সাহসী। লড়াইপ্রিয় দাগেস্তানীরা কাউকে ভয় বা পরোয়া করে না। জনসংখ্যা প্রায় ২.৫ মিলিয়নের বেশি। দাগেস্তান মুসলিমপ্রধান দেশ। অধিবাসীদের ৯৩ ভাগই মুসলিম বাকি ৭ ভাগ খ্রিস্টান। এখানে সুফিজমের প্রাধান্য বেশি। সুফি ভাবধারাসিক্ত দারেগস্তানীরা একদিকে যেমন ভাবুক প্রকৃতির অন্যদিকে স্বাধীন মনোভাব সম্পন্ন। তারা সুন্নি এবং সুফি তরিকার অনুসারী।
দাগেস্তানের ইতিহাস বহু প্রাচীন। স্বাধীনতাপ্রিয় দাগেস্তানবাসী সহজে কারো কাছে মাথা নত করে না। ইসলামের ‘সব মানুষ স্বাধীন’ এ আপ্তবাক্য তাদের শিরায় শিরায় মজ্জাগত। তাদের জীবনাচরণে ইসলামী ভাবধারা সুস্পষ্ট। সুপ্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত নিজেদের স্বাধীনতা তারা অক্ষুণœ রাখতে পেরেছিল। চারপাশে প্রবল প্রতিপক্ষ রাশিয়া ও অন্যান্য প্রজাতন্ত্রের মাঝে ছোট্ট দাগেস্তান ছিল ‘হংস মাঝে বক যথা’ মাথা উঁচু এক শৈল-শিখর। দাগেস্তান তার পাথরের কঠিন ‘শৈলশির’ সগৌরবে অক্ষুন্ন রাখতে বহুকাল ধরে অসংখ্য যুদ্ধ করেছে। স্বীয় স্বাতন্ত্র্য বজায়ে হাতিয়ার হাতে লড়েছে আপ্রান। রাশিয়া বারংবার আক্রমণ চালিয়েছে দখলের জন্য। শত-সহস্র আঘাত সংবরণ করে মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে অজস্র বীর সেনানী প্রাণ দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে আপামর জনসাধারন। লড়াকু জাতি দাগেস্তানীদের পরাস্ত করা সুকঠিন। চল্লিশ পঞ্চাশ বছর ধরে তারা সংগ্রাম করেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। গাজী মোহাম্মদ, গুমজত বেগ, ইমাম শামিলের মতো ইসলামী চিন্তাবিদ নেতারা নেতৃত্ব দিয়েছেন সংগ্রামের। বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম শামিল এই দাগেস্তানেরই সন্তান। এই ককেশীয় মহানায়ক প্রায় ২৫ বছর ধরে মাতৃভূমির স্বাধীনতা বাঁচানোর সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন।
রাশিয়া অনবরত অভিযান চালায় এবং দাগেস্তানকে দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। অবশেষে ‘কাবকাজ’ নামক ভয়াবহ যুদ্ধে রাশিয়া দাগেস্তানকে কাবু করে ফেলে। পুরো দাগেস্তানকে দুমড়ে মুচড়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। অবিরাম যুদ্ধের ফলে দাগেস্তানী তরুণরা প্রায় নি:শেষ। যুদ্ধ করার মত শক্তিশালী জনবলও আর তাদের ছিল না। শেষ পর্যযন্ত ১৯২১ সালের ২০শে জানুয়ারি দাগেস্তান হেরে যায়, বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সেই দু:সহ স্মৃতি যুদ্ধ-পরবর্তীতে জন্ম নিলেও মাজিদ যেন নিজের কোষে কোষে অনুভব করে আজও। তারা কখনো সে যুদ্ধকে ভুলতে দেয় না।
রাশান ঐতিহাসিকদের মতে, দাগেস্তান পৃথিবীরিএকেবারে আদি ও প্রাচীন বসতির একটি, মানব সমাজ বসতির প্রথম স্থপতি বিশুদ্ধ আর্য-জাতি। দুর্গম পাহাড়ের সুরক্ষিত কন্দরে নিরাপত্তা খুঁজে পেতো আদিম মানুষ। এখানকার আর্যরাই ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র। প্রাচীন আর্যদের মধ্যে ছিল দুই ভাগ- লেজগিন ও অ্যারিয়ান। লেজগিনরা এশিয়া মহাদেশের দিকে চলে যায়। আ্যরিয়ানরা ছড়িয়ে পড়ে সাইবেরিয়া, ইউরোপ হয়ে উত্তর আমেরিকা ও অন্যান্য দেশে। দাগেস্তানীদের উচ্চারণে বিশেষ এক প্রকার টান রয়েছে যা আমেরিকার দুর্গম অঞ্চলে বসবাসরত রেড ইন্ডিয়ান কিছু গোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে। অনাদিকালের আর্যজাতি হিসেবে দাগেস্তানীরা নিজেদের নিয়ে গর্ব করে থাকে।
দাগেস্তানবাসীরা মূলত: পাহাড়ি উপজাতির সমষ্টি। এখনো রয়েছে বড় বড় উপজাতীয় এথেনিক গ্রুপ। প্রধানতম গ্রুপগুলো হচ্ছে-আভারস, লেজগিনস, দার্গিনস, কামাখস, নোগীজ, চেচেনস, রুশী, লাকস, আগুলস, আ্যজেরীস ইত্যাদি। দাগেস্তানে প্রায় ৩০টি ভাষা প্রচলিত। তবে প্রধান ভাষা ৭টি-লেজগিনি, দার্গেনজি, আভারসি, লাকসি, কুমিখি, তাবাসারনি এবং রুক্সী বা রুশ ভাষা। প্রতিটি বই এবং সংবাদপত্র এই প্রধান ৭টি ভাষায় প্রকাশিত হয়। রেডিয়ো, টেলিভিশন এবং অন্যান্য মিডিয়া প্রোগ্রাম প্রচারিত হয় ১৪টি ভাষায়। মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিত দাগেস্তানের মানুষদের পোশাক আরবদের মতো ঢিলেঢালা। পুরুষদের মাথায় পাগড়ি ও মেয়েদের মাথায় হিজাব ঐতিহ্যবাহী পোষাকের অনুসঙ্গ। বর্তমানে পাশ্চাত্যের প্রভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত পাশ্চাত্য ড্রেসও জনপ্রিয়। সামাজিক জীবন যাপনে ইসলামিক ভাবধারা লালন করে থাকে। দাগেস্তানের রয়েছে ১০টি বড় শহর এবং ৪২টি সুবৃহৎ জেলা। সবচেয়ে প্রাচীন শহরের নাম ‘ডারবেন্ট’।
ইসলাম-পূর্ব দাগেস্তান ছিল অসংখ্য ক্ষদ্র ক্ষুদ্র পার্বত্য গোত্রভুক্ত দেশ। কেন্দ্রীয় শাসন-কর্তৃত্ব, নিয়ম-শৃঙ্খলা কিছুই ছিল না। সামান্য কারণে একদল আরেকদলের ওপর চড়াও হতো। মারামারি, লুটপাট, হত্যা, রাহাজানি, অন্যায়-অবিচারসহ যাবতীয় অশান্তির রাজত্ব ছিল পার্বত্য দেশটি জুড়ে। কেউ কারুর কথা বিন্দুমাত্র মানতে পারতো না। সমসমায়িককালের বিখ্যাত লেখক রেজুল মেগুমেদভ লিখেছেন-” ইসলামপূর্ব দাগেস্তানী জাতিগুলোর মধ্যে তীব্র অন্তর্কলহ এবং দ্বন্ধে লিপ্ত ছিল। তারা হারিয়ে ফেলেছিল মানবীয় সম্পর্ক ও দেশ-জাতি-ভাষা-ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। অন্যান্য ককেশিয়ান জাতিগুলোর মতই তাদের অবস্থা ছিল। পারস্পরিক শত্রুতা ও বিরোধিতায় নিমজ্জিত ছিল তারা। ইসলামের ছায়াতলে আসার পর বিভিন্ন গোত্রগুলি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে একই বিশ্বাসের পতাকাতলে সমবেত হয়, জাগরিত হয় ভ্রাতৃত্ববোধ। সমূলে নির্মূল হয় এথেনিক দ্বন্ধ ও কোন্দল। ইসলামী নৈতিক শিক্ষা দূর করে দেয় সমস্ত অরাজকতা ‘।
বর্তমান সময়ে এসে দাগেস্তানে ইসলাম অনেকটাই শিথিল আকার ধারণ করেছে। ইসলামের মূল লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে।এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রেজুল মেগুমেদভ বলেন-”
”বর্তমানে আমাদের জাতিগুলো পুনরায় অনৈক্যের মুখোমুখি। নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্ধ জাগিয়ে তুললে দেশ মুখোমুখি হবে গভীর বিপর্যয়ের। দেশ ও জাতিগত ঐক্যের ভিত্তি মজবুত করতে পারে একমাত্র ইসলাম। প্রাচীনকালে আমাদের বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী ও ধর্মীয় জ্ঞানী-গুণীদের মাঝে ইসলামের শিক্ষা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এবং সাহায্য করেছিল উপজাতি পাহাড়ি গোত্রগুলির মধ্যে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্প্রীতি ও ভারসাম্যমুলক সম্পর্ক তৈরি করতে। বর্তমানেও সব বিভেদ পরিহার করে ইসলামকে সেই লক্ষ্যে পরিচালিত করা উচিত”।
দাগেস্তানে শিক্ষার হার শতকরা একশতে একশ। শিক্ষার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে রাষ্ট্র। জনগণের শিক্ষার দায় ও ব্যায়ের সকল দায়িত্ব রাষ্ট্রের ওপরই অর্পিত। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরকে সামরিক শিক্ষা ও প্রত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়াবলী শিক্ষা দেয়া হয়। ফলে জীবনের শুরু থেকেই প্রত্যেক নাগরিক কর্মঠ হিসেবে বেড়ে ওঠে এবং সৎ ও পরিশ্রমী মানুষরূপে জীবন গড়ার সুযোগ পায়। তাদের এ শিক্ষা যে কতটা উৎকর্ষ, তা মাজিদের কর্মকা- থেকেই বোঝা যায়। সে যখনই এখানে আসে, খুঁজে খুঁজে নষ্ট ইস্তিরি , লাইট এমনকি ভাঙা পাতিলও মেরামত করতে পছন্দ করে। এ ব্যাপারে দারুণ বিষ্ময় প্রকাশ করলে বলে যে,-
– ”ইলেকট্রিকের যাবতীয় ঘরোয়া কাজ শিখি আমরা ইস্কুলেই। আর মেয়েরাও শেখে গৃহস্থালির সবকিছু। সবাই আমরা কাজে দক্ষতা শিখি”!
দাগেস্তানীদের মধ্যে পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতি রয়েছে অতুলনীয় শ্রদ্ধা, সামাজিক শিষ্টাচার ও মূল্যবোধ। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য পারিবারিক ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখা বাধ্যতামূলক কর্তব্য বলে মনে করে। প্রতিটি পরিবারে নিজেদের বংশ-লতিকা চার্ট করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা হয় এবং পূর্ব-পুরুষদের কমপক্ষে ১২সিঁড়ি পর্যন্ত নাম-ধাম মুখস্থ রাখা প্রত্যেক সদস্যের জন্য অবশ্যই পালনীয়। তাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন খুবই দৃঢ় এবং পরিবারের নারী সদস্য, বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রবীণদের প্রতি রয়েছে গভীর শ্রদ্ধাবোধ। এখানকার মানুষের গড়-আয়ূ বেশি। আধুনিক চিকিৎসার চেয়ে ঐতিহ্যবাহী ভেষজ চিকিৎসার প্রতি রয়েছে তাদের অপরিসীম দুর্বলতা। এখনো তারা মেশিনে তৈরী ঔষধের চেয়ে বাগানের গাছ-গাছালির নির্যাসকেই প্রাধান্য দেয়। ‘মানুষ প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃতির হাতেই রয়েছে মনুষ্য শরীরের যাবতীয় সমাধান’-বলে তারা বিশ্বাস করে।
সমাজের প্রবীণ শ্রেণি বেশীরভাগই সুফিজম দ্বারা প্রভাবিত ও সূফীজমের ভক্ত। তারা ধর্মীয় কর্তব্য পালনে ও ধ্যানে বেশী মগ্ন থাকে। পাহাড়ের পাদদেশে কিংবা সুউচ্চ টিলা জুড়ে ছোট ছোট আরামদায়ক ঘর তৈরী করা হয়। নির্জনে ধ্যান ও রোজা রাখার জন্য প্রবীণরা পাহাড়ে চলে যান। শুকনো ফল ও খাবার মজুত করা হয় সেখানে। সারা বছর রোজা, মারেফাত, মি’রাজ ইত্যাদি চর্চা নিয়ে তারা সানন্দে মশগুল থাকেন। রাজধানী মাখাচকালা, ডারবেন্ট, কিজলিয়ার, কাসপিয়স্ক, বুইনাকক্স ইত্যাদি বড় বড় শহরগুলো ব্যস্ততম ও আধুনিক শহুরে জীবন-যাত্রায় অভ্যস্ত হলেও গ্রাম বা পাহাড়গুলো নিরিবিলি, শান্ত। সেখানে আন্তরিকতা ও পারস্পরিক হৃদয়ের উষ্ণ সম্পক্র্ অটুট। লোকেরা শান্তিপূর্ণ জীবন কাটানোর সাধে শহর ছেড়ে লোকালয়ে আবাস গড়ে।
চারদিকে মনোমুগ্ধকর খাঁজকাটা পাহাড়ের সারি। রঙবেরঙের পাথুরে নিশানে বাহু ছড়িয়ে ঘোরাফেরা করে স্নিগ্ধ বাতাস। পাহাড়ি শুকনো মাটিতে ফোটে প্রচুর ফুল, ফল আর ঔষধি গাছ। স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া আর ঔষধি গাছের ভেষজ দাওয়াই দাগেস্তানীদের সুস্থ জীবনের মূল উপাদান। রুক্ষ ভূপ্রকৃতির অন্যান্য আরব দেশগুলোর মতো প্রিয় খাবার ফলমূল, রুটি, পনির, ছানা, মাখন, ঘি, নুন ইত্যাদি। গ্রামীন লোকেরা এসব নিজেরাই তৈরি করতে বেশি পছন্দ করে। ভেড়া ও খচ্চর লালন পালন, কম্বল-কার্পেট তৈরী, মূল্যবান পাথর বিক্রয়, কাঠ-পাথরের খোদাই করা তৈজস ইত্যাদি প্রধান আয়ের উৎস। কার্পেট বোনা মেয়েদের অন্যতম আয়ের উৎস। রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে সুদৃশ্য কার্পেট, মার্বেল পাথর, রৌপ্য ও পাথরে খোদাই সুক্ষ্ম কাজ, ভেড়ার মাংস, ক্যাভার’ নামক কালো মাছের ডিম ইত্যাদি। কাস্পিয়ান সাগর ছাড়া অন্যতম নদীগুলো হলো-সুলক, সামুর, ও তেরেখ। তবে কাস্পিয়ান সাগর দাগেস্তানের জন্য করুণাময়ের পরম আশীর্বাদ। কাস্পিয়ান সাগরের ’এ্যাসিস্ত্রিনা’ নামের দুর্লভ মাছের দুর্লভ ডিম এদেশের সেরা সম্পদ। এই ডিম বা ক্যাভার অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বিখ্যাত। বিশ্বজুড়ে রয়েছে এরে বিপুল চাহিদা। একমাত্র কাস্পিয়ান সাগরেই এ মাছ পাওয়া যায়। ভেষজ গুণাবলী সমৃদ্ধ এই মাছের ডিম খুব উচ্চমূল্যে বিক্রয় হয়। রক্ত পরিষ্কার, রক্তশূন্যতা দূর ও অন্যান্য রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই মহার্ঘ্য ডিম। আজরাবাইজন, কাজাখাস্তান, তুর্কমেনিয়া ও ইরানেও এ মাছের ডিম অল্প পরিমাণে পাওয়া যায়।
দাগেস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলগুলো বিভিন্ন রকম সম্পদে পরিপূর্ণ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রায়। একেক অঞ্চল একেক প্রকার পন্যের জন্য বিখ্যাত। সূক্ষ্ম কারুকার্যময় আসবাবপত্রের জন্য খ্যাত ’উনচখুল’। এখানকার কাঠ ও নানারকম ধাতুর তৈরী নকশাখচিত তরবারি, খঞ্জর, আসবাবপত্র অতুলনীয়। হাতে তৈরী অসাধারণ নিখুঁত নিপুণ ‘ এ্যাপলিকের কাজ বিদেশীদের অন্যতম আকর্ষণের বস্তু। ‘কুবাচি’র তৈরি রূপা, পাথর ও অন্যান্য বস্তুর ওপর মিনা, অ্যাপলিকের খ্যাতি দেশ ছেড়ে বিদেশেও ছড়ানো। উন্নত রঙ, ডিজাইন, সৌন্দর্যশীল সূক্ষ্ম কারুকাজের শাল, কার্পেট তৈরি হয় ‘খিবায়’। খিবার কার্পেটের দারুন চাহিদা পুরো রাশিয়া জুড়ে। তুর্কি, সিরিয়া, জার্মানী, ইউরোপ প্রভৃতি দেশের পর্যটকগণ এখানে ছুটে আসে দৃষ্টিনন্দন পণ্যের জন্য।
দাগেস্তানের জল-বাযু খুব উন্নত ও স্বাস্থ্যকর। এখনকার মানুষেরা কর্মচঞ্চল, কর্মঠ, সৃষ্টিশীল ও সঙ্গীতপ্রিয়। দিগন্তের রঙিন সুউচ্চ পাহাড়শ্রেণির উঁচুনিচু তরঙ্গ যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবি। অবারিত খোলা জায়গা, কাস্পিয়ান সাগরের নীল ঢেউ, মনোরম ফুলের সুবাসভরা বাতাস আর আখরোট গাছের নিচে ভেড়া চরানিয়ার দফে’র সুর মনকে চুম্বকের মতো টানে। যাদুময় প্রকৃতির কোলের সন্তান দাগেস্তানীরা তাই বেশ ভাবালু টাইপের। তারা যেমন শান্তিপ্রিয় তেমনি আমোদপ্রিয়। সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত দাগেস্তানবাসীরা সামান্য আনন্দেই নাচে-গানে মেতে ওঠে। তাদের জীবনে রয়েছে অনাবিল আনন্দের বহি:প্রকাশ। নাচ-গান তাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনুষঙ্গ।
রাজধানী মাখাচকালা বহু মুসলিম স্থাপত্য ও প্রাচীন পুরাকীর্তির নগরী। খোদ রাজধানীতেই রয়েছে ৭টি জাতীয় থিয়েটার এবং ২টি জাতীয় জাদুঘর। জাতীয় নাচ-গানের দল রয়েছে অনেকগুলি। প্রধানতম দলের নাম-’লেজজিনকা’। এদেশে অনেক বিখ্যাত কবি-শিল্পী, দার্শনিক ও চিন্তাবিদ জন্মগ্রহণ করেছেন, যারা বিশ্বের অঙ্গনে সুপরিচিত।
পরিবারে মহিলাদের মর্যাদা অতি উচ্চে। যে কোনো সামাজিক কাজে নারীরা সমানভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। সম-সাময়িক বিখ্যাত কবি রসুল হামজাতভ এবং মহিলা কবি ফাজু আলিয়েভা। আলিয়েভা ‘সাখালোভা’ নামে একটি শিশু পত্রিকা এবং ‘গোরইনকা’- (পাহাড়ি মেয়ে) নামক একটি পত্রিকার সম্পাদনায় নিয়োজিত।
দাগেস্তানে মৌসুমভিত্তিক অসংখ্য রকম ফল-মূল, শাক-সব্জি ও ফুলের সমারোহ দেখা যায়। কয়েকপ্রকার সুমিষ্ট আঙুর, কিমমিশ, বাদাম, আখরোট, তরমুজ ইত্যাদি সারা বছরজুড়ে জন্মায়। এখানকার পাথুরে ভূমিতে জন্মানো ফল অত্যন্ত মিষ্টি ও সুস্বাদু। পাথুরে আবহাওয়া বেশিরভাগ সময় শুকনো ও স্বাস্থ্যকর বিধায় কোন জিনিসই পচনশীল নয়। এক ধরনের গোলাপি ও লাল রঙের ফুল সারা বছর দাগেস্তানের পাহাড়-পর্বত, পথ-প্রান্তর, পরিবেশ-প্রতিবেশ রঙিন এমন মনোমুগ্ধকর করে রাখে যে, সুফিজমে দ্রবীভূত দাগেস্তানী মন গৈরিক বাসনায় আপ্লুত হয়ে ওঠে। সোনালি আলো ঝলমল ঢেউ খেলানো পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে রঙিন ফুলের গুচ্ছ, নতুন পাতার ফুলকারী, পাকা ডালিম, আঙুরের সৌরভ, মৌমাছির ওড়াওড়ি, বাদাম গাছে গাছে ধূসর মৌচাক, পাহাড়ি ফুলের সুবাসভরা মধুর বাতাসে ভাসে সুফি সাধকের গজলের সুর। দাগেস্তানী মাজিদ বিড় বিড় করে আবৃত্তি করেÑ
’এক সোরাহি সুরা দিও, একটু রুটির চিলকে আর, প্রিয়া সাকী তাহার সাথে একখানি বই কবিতার’..!
শাহানারা স্বপ্না, আইনজীবী ও প্রাবন্ধিক