ফজলুর রহমান :
২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোানিও গুতেরেস বলেছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপদ পানি ও পয়নিষ্কাশন নিশ্চিত করতে আমাদের যে লক্ষ্য, তা থেকে বিশ্ব বিপজ্জনকভাবে দূরে সরে যাচ্ছে। চলতি দশকের শেষ দিকে পানির সরবরাহের তুলনায় চাহিদা ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের তথ্য মতে, বিশ্বের প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ২৫ জনকে এখন পানির সার্বিক চাহিদা পূরণ করতে হচ্ছে হয় উন্মুক্ত জলপ্রবাহ ও পুকুর থেকে পানি সংগগ্র করে, নতুবা উচ্চমূল্যে তথাকথিত নিরাপদ পানি কিনে। ৪৪ শতাংশের ক্ষেত্রে বর্জ্যপানি অপরিশোধিত অবস্থায়ই প্রকৃৃতিতে ফিরছে। ফলে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, সারা বিশ্বের প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে না। সুপেয় পানি এবং নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাব মানবজাতিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করতে পারে। যে কারণে ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। ইউনিসেফের প্রতিবেদন বলছে,
২০৩০ সাল নাগাদ উন্নত উৎসের খাবার পানির সর্বজনীন প্রাপ্যতা অর্জন করতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে অগ্রগতির বর্তমান হার দশগুণ বাড়ানো দরকার। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে, যেখানে মানুষের নিরাপদ খাবার পানির ঘাটতির সম্ভাবনা দ্বিগুণ, সেখানে অগ্রগতির হার ২৩ গুণ বাড়ানো প্রয়োজন।
পানি আমাদের এই বিশ্বের প্রাণের অন্যতম উৎস। স্বাস্থ্য, পুষ্টি থেকে শুরু করে সবকিছুতেই মানুষের টিকে থাকা, ভালো থাকা, উন্নয়ন ও জাতির সমৃদ্ধির জন্য পানি অপরিহার্য। জলবায়ু পরিবর্তন পানির প্রাকৃতিক চক্রের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে দুষণ যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি হচ্ছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছাচ্ছে। ফলে পানিজনিত দুর্যোগ, রোগের প্রাদুর্ভাব, পানির স্বল্পতা ও খরা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি অবকাঠামো, খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের শৃংখলা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব ব্যর্থতার কারণে শত কোটি মানুষকে মূল্য দিতে হচ্ছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশেও মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক নানাবিধ কারণে পানীয় জল ও স্যানিটেশনের সংকট বিদ্যমান। নদী-নালা, পুকুর বা অন্যান্য জলাশয়ের অনিরাপদ পানি পানে আমাদের পানিবাহিত ও পানিজনিত রোগ হয়ে থাকে। আবার বাতাস থেকেও পানিতে প্রবেশ করতে পারে মারণঘাতী ব্যাক্টেরিয়া। ১৬৭৫ সালে বিজ্ঞানী অ্যান্টনি ভন লিউয়েন হুক সর্বপ্রথম তার নিজের তৈরি অণুবীক্ষণ যন্ত্রে বৃষ্টির পানি পর্যবেক্ষণ করেন। সেই বৃষ্টির পানিতেও জীবাণু পাওয়া যায়। বিজ্ঞানী লিউয়েন হুকের পরীক্ষা থেকে বোঝা যায়, ব্যাক্টেরিয়া শুধুমাত্র ভূ-পৃষ্ঠে না, বাতাসেও থাকতে পারে। যার কারণে বৃষ্টির পানিও সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত নয়। অসতর্কতায় হতে পারে নানা রোগ। একুশ শতকে এসেও মানুষ খুব নিশ্চিন্তে টিউবওয়েল বা সাবমার্সিবল পাম্পের পানি পান করছে চোখ বন্ধ করেই। কিন্তু বর্তমানে আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর, সেই সাথে দূষণ থেকে রক্ষা পায়নি ভূ-অভ্যন্তরে সংরক্ষিত পানিও। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য চাহিদা বাড়ছে এবং এই বিদ্যমান বিরাট অংশের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর জমিতে ক্ষতিকর কীটনাশক ও সার প্রয়োগ করা হচ্ছে বেশি ফসল উৎপাদনের নিমিত্তে।মাটিতে প্রয়োগকৃত এই সার ও কীটনাশকের ক্ষতিকর কেমিকেল ভূ-গর্ভস্থ পানির সাথে মিশে দূষিত করছে পানিকে এবং সেই পানি পানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ।
ফোটানো পানিতেও অবশিষ্ট থেকে যায় দ্রবীভূত ক্ষতিকর কঠিন পদার্থ বা ভারি পদার্থগুলো।যার ফলে সৃষ্টি হতে পারে মারাত্মক রোগ এবং বিকলাঙ্গতাও।তাই পানি ফোটানো হোক বা না হোক, নিরাপদ হওয়া আবশ্যক। বলা যায়, দেশের প্রতিটি মানুষের পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে আশা করা যায় প্রায় ৭০ শতাংশ অনাকাক্সিক্ষত রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে অপার সম্ভাবনাময় এই মানবসম্পদকে।
চঞ্চল চৌধুরী
‘আমি ও আমার পরিবার পানি ফুটিয়ে পান করতাম, হঠাৎ একদিন পত্রিকায় নতুন যুগের দূষণ যেমন, ই-কোলাই, সীসা ইত্যাদির ব্যাপারে জানলাম।’
পানির অপর নাম জীবন, কারণ পানি ছাড়া কোনো প্রাণিই বাঁচতে পারে না। কিন্তু সেই পানি নিরাপদ না হলে তা জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দূষিত পানি অনেক সময় মৃত্যুর কারণও হতে পারে। বর্ণহীন এই তরল পদার্থটি ছাড়া প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজের জন্যও আমাদের পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন।
প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের দৈনিক ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হয়। শহর এলাকায় কর্মজীবী মানুষেরা বোতলজাত পানি বা জার পানির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই বোতলজাত পানি বা জার পানি প্রতিদিন হোটেল-রেস্তোরাঁ, অফিস, বাসাবাড়ি ও রাস্তার পাশের দোকান থেকে শুরু করে উৎসব-অনুষ্ঠান এবং ভ্রমণপথে খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু এসব বোতলজাত খাবার পানি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ নয়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং ডঐঙ (ডড়ৎষফ ঐবধষঃয ঙৎমধহরুধঃরড়হ) এর আদর্শ মানমাত্রা অনুযায়ী পানীয় জলে শূন্য (০) ই-কোলাই এবং শূন্য (০) টোটাল কলিফর্ম থাকতে হবে।
পানির অপর নাম জীবন। জীবন বাঁচাতে পানির বিকল্প নেই তবে সেই পানি হতে হবে বিশুদ্ধ এবং নিরাপদ। সুস্থ শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য পানি অন্যতম একটি নিয়ামক। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন এর গবেষণা অনুযায়ী প্রতিদিন মাত্র ৫০০ মিলি লিটার পানি পান করলে দেহের বিপাক প্রক্রিয়া ৩০% বৃদ্ধি পায় এবং ২ লিটার পানি পান করলে ৪০০ কিলোজুল শক্তি উৎপাদন হয়। তাই আমাদের সকলের উচিত পরিমিত পরিমাণে…………
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমান বিশ্বে ৪ জনের মধ্যে মাত্র একজন নিরাপদ পানি পাচ্ছেন। এই নিরাপদ পানি সুস্থ জীবন যাপনের জন্য খুবই জরুরি। আর ইউনিসেফের তথ্যমতে, সারাবিশ্বে ১৪৪ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি ভূগর্ভস্ত অনিরাপদ পানি পান করছেন। সারাবিশ্বের মধ্যে নিরাপদ পানির সবচেয়ে বেশি সঙ্কট সাউথ এশিয়ায়।
বিশ্বব্যাংক এর প্রতিবেদন বলছে, সুপেয় পানির জন্য ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলে রিটার্ন আসে ৩ বিলিয়ন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরাপদ পানিতে অর্থ খাটালে আরও বেশি রিটার্ন পাওয়া যায়।
ডধঃবৎ, ধিঃবৎ, বাবৎুযিবৎব, অহফ ধষষ ঃযব নড়ধৎফং ফরফ ংযৎরহশ; ডধঃবৎ, ধিঃবৎ, বাবৎুযিবৎব, ঘড়ৎ ধহু ফৎড়ঢ় ঃড় ফৎরহশ.”
ঝধসঁবষ ঞধুষড়ৎ ঈড়ষবৎরফমব, ঞযব জরসব ড়ভ ঃযব অহপরবহঃ গধৎরহবৎ
উৎস থেকে সমুদ্র অবধি পানির অবারিত প্রবাহ ও ন্যায়সংগত ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমেই পানির সুষম প্রাপ্যতা ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সম্ভব।
পানির এই সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন পানির ব্যবহারের প্রতি সচেতন হওয়া। পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এই সংকট থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
প্রতিটি পানির ফোঁটার সর্বোত্তম ব্যবহারই নিশ্চিত করতে পারে সর্বজনীন পানি প্রাপ্যতা, পানির ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা। কিন্তু এই প্রাণের উৎসের প্রতিটি ফোঁটা দুষণের শিকার হচ্ছে, অতিব্যবহারে অপচয় হচ্ছে। অপচয় করার মতো এক মুহূর্তও আমাদের হাতে নেই। আসুন, ২০২৩ সালকে আমরা পরিবর্তন এবং মানবজাতির প্রাণের উৎস রক্ষায় বিনিয়োগের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করি। আসুন, পানির সুরক্ষা, টেকসই ব্যবস্থাপনা এবং সবার জন্য সমহারে নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে আমরা কাজ শুরু করি।
উপ-পরিচালক (তথ্য ও প্রকাশনা)
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় (চুয়েট)