জ্যোতির্ময় নন্দী :
সুররিয়ালিজম কথাটা আমার গোচরে আসে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, উনিশশো একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর। আমি তখন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ। স্বাধীনতার হাত ধরে আমাদের দেশে কবিতা, নাটক (গ্রুপ থিয়েটার), চিত্রকলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে ছোটখাটো জোয়ারটা এসেছিলো, তাতে এই সুররিয়ালিস্টিক ধ্যানধারণার কিছু কিছু ব্যবহার বা প্রয়োগ দেখা যায়। তারুণ্যের উন্মাদনায় কবিতা আর গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হতে গিয়ে আমি এই সুররিয়ালিজম কথাটার সাথে পরিচিত হই। সুরেলা শব্দটা শুরুতেই আমার মনোযোগ টেনে নিয়েছিলো, যদিও আমার সতীর্থদের অনেকেই ভুল করে সেটাকে বলতো ‘সাররিয়ালিজম’।
সুররিয়ালিজম, কথাটা মূলত ফরাসি, যদিও ইংরেজি ও অন্যান্য ইউরোপীয় এবং বাংলাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাষাতেও শব্দটা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত। ফরাসিতে ‘সুর’ (ংঁৎ) মানে হলো ‘উপরে’, আর ‘রিয়ালিজম’ (ৎবধষরংস) মানে ‘বাস্তববাদ’। অর্থাৎ, সুররিয়ালিজম বলতে বাস্তববাদের ঊর্ধ্বে কিছু বোঝায়।
এর বাংলা প্রতিশব্দ করা হয়েছে– ‘পরাবাস্তববাদ’। সংস্কৃত ‘পরা’ শব্দের অর্থও হলো ‘উচ্চতর’ বা ‘শ্রেয়তর’।
তার মানে, পরাবাস্তববাদ বাস্তব সত্যের ঊর্ধ্বের বা বাইরের কোনো সত্যের কথা বলে। এ মতবাদ বিকশিত হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)-এর সময়ে উদ্ভূত দাদাবাদ (উধফধরংস) থেকে। পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে শরিক কবি-শিল্পীরা মূলত অবচেতন মনের নানা ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট, অদ্ভুত, ব্যতিক্রমী সব উপমা ও রূপকল্প দিয়ে প্রকাশ করেছেন বা করতে চেয়েছেন। এ আন্দোলনের সূচনা ১৯২০-এর দিকে প্যারিসে, যার মূল প্রবক্তা ছিলেন ফরাসি কবি-সমালোচক আঁদ্রে ব্রেতঁ (অহফৎল্ক ইৎবঃড়হ)। দাদাবাদীরা চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ বাতিল করে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী হতে, যার সাহায্যে ছিন্ন করা যাবে প্রচলিত নিরর্থক রীতিনীতি আর ভ-ামির বেড়াজাল, পৌঁছা যাবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে। পরাবাস্তববাদীরা আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন, প্রকৃত সত্যের অবস্থান শুধুমাত্র অবচেতনেই।
সূচনালগ্ন থেকেই পরাবাস্তববাদী চিন্তাধারা ক্রমশ ঢুকে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও ভাষার কাব্য-সাহিত্য, নাটক বা দৃশ্যকাব্য, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতে। এমনকি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রচিন্তা ও চর্চা, দর্শন এবং সমাজতত্ত্বেও পরাবাস্তববাদ জায়গা করে নেয়।
আঁদ্রে ব্রেতঁ বাদে পরাবাস্তববাদী কাব্য-সাহিত্যের মূল প্রবক্তা ও পথিকৃৎ হিসেবে আমরা আরো যাঁদের গণ্য করি, তাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য কয়েকজন হলেন পল এলুয়ার, লুই আরাগঁ, অঁরি মিশো, গার্সিয়া লোরকা, সালভাদর দালি প্রমুখ। এঁদের মধ্যে ফরাসি কবি পল এলুয়ারের কিছু কাব্যকৃতির তরজমা প্রসঙ্গেই এ নিবন্ধের অবতারণা।
পল এলুয়ার
পল এলুয়ার (চধঁষ ঊষঁধৎফ, ১৮৯৫-১৯৫২)-এর জন্ম প্যারিসে এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। সম্ভবত পারিবারিক আর্থিক অবস্থা বা দুরবস্থাই তাঁকে বামপন্থী রাজনীতির দিকে টেনে নিয়ে যায়, যা তাঁর কাব্যকর্মকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বস্তুত এলুয়ারের চিন্তাজগতে বামপন্থী রাজনৈতিক ধারণা আর পরাবাস্তববাদী দর্শনের মধ্যে এক টানাপোড়েনের সৃষ্টি করেছিলো, যার ছাপ তাঁর কবিতায় সুস্পষ্ট। তবে এটা অনস্বীকার্য যে, পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় এলুয়ারের কাজে।
এলুয়ারের কাব্যের উঁচুমাত্রার গীতিময়তা ছিলো এক গভীর আবেগজাত, যার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘লামুরুজ’ (খ’অসড়ঁৎবঁংব) বা ‘প্রেমিকা’ (১৯২৩), ‘মুরির দ্য ন্যো পা মুরির’ (গড়ঁৎরৎ ফব হব ঢ়ধং সড়ঁৎরৎ) বা ‘মরতে না মরতে’ (১৯২৪), ‘কাপিতাল দ্য লা দ্যুলর’ (ঈধঢ়রঃধষব ফব ষধ ফড়ঁষবঁৎ) বা ‘বেদনার পুঁজি’ (১৯২৬) এবং ‘লামুর লা পোয়েজি’ (খ’অসড়ঁৎ ষধ ঢ়ড়ল্কংরব) বা ‘কাব্যপ্রেম’ (১৯২৯) প্রভৃতিতে। এক্ষেত্রে আঁদ্রে ব্রেতঁ ও পল এলুয়ারের যৌথ রচনা ‘লিমাক্যুলেট কঁসেপশিয়ঁ’ (খ’ওসসধপঁষধঃব ঈড়হপল্কঢ়ঃরড়হ) বা ‘পবিত্র গর্ভধারণ’ (১৯৩০)-এর কথাও স্মরণ করা যেতে পারে।
এলুয়ারের মতে, কবিতার লক্ষ্য হলো ভাষার পুনর্নবীকরণ, যাতে অস্তিত্বের সমস্ত ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটানো যায়। তিনি তাঁর কবিতাকে পাঠকদের মধ্যে সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম একটি শিল্পকর্ম হিসেবে দেখেছিলেন এবং তাকে চিহ্নিত করেছিলেন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং যৌন মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত বামপন্থী সংগ্রামের সঙ্গী হিসেবে।
এলুয়ার সাংস্কৃতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনের সদস্য হিসেবে। তিনি ব্রিটেন, বেলজিয়াম, চেকোসেøাভাকিয়া, মেক্সিকো এবং রাশিয়া সফর করেছেন, কিন্তু কখনো যুক্তরাষ্ট্রে যাননি। কারণ তিনি কম্যুনিস্ট হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিলো। জীবৎকালে তাঁর সত্তরটির মতো বই প্রকাশিত হয়। মারা যান ১৯৫২-তে, ফ্রান্সের শারঁতঁ-ল্যো-পঁ-তে।
পরাবাস্তববাদ পরবর্তী সময়ে কোনো কোনো দার্শনিক সম্প্রদায়ের বিরূপ সমালোচনারও সম্মুখীন হয়েছে। যেমন দৃষ্টান্তবাদী বা প্যারাডাইমিস্টরা পরাবাস্তববাদীদের অবচেতন মন সম্পর্কিত ধারণাকে স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, অবচেতন মনের ক্রিয়াকর্মকে নির্বিচারে গ্রহণ করলে সাহিত্য ও দর্শন চর্চায় দৈব বা আধিভৌতিক সত্তা তথা উদ্ভট, অদ্ভুত, অবাস্তব রূপকল্প হাজির হয়ে যায়। প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে– পরাবাস্তববাদীদের এ ধারণার বিরোধিতা করে দৃষ্টান্তবাদীরা বলছেন, প্রকৃত সত্যের অনুভব চৈতন্যে বিদ্যমান এবং সাহিত্য এই চৈতন্যেরই শিল্পিত উচ্চারণ। পরাবাস্তববাদী লুই আরাগঁ ও ফিলিপ সুপো (চযরষরঢ়ঢ়ব ঝড়ঁঢ়ধঁষঃ) প্রস্তাবিত ‘অটোমেটিক রাইটিং’ বা ‘স্বয়ংক্রিয় লিখন’-এর বিরোধীদের মতে, কবি শুভবোধ বজায় রেখে অনিয়ন্ত্রিত বা স্বেচ্ছাচারী হতে পারেন, কিন্তু তাই বলে যা কিছু মনে আসবে চটজলদি তা লিখে সাহিত্য বলে চালিয়ে দিয়ে সমাজকে নৈরাজ্যপূর্ণ আর সাহিত্যকে অপ্রয়োজনীয় পাঠে যেন পরিণত না করেন।
এ কথাগুলো আমার নিজের জীবনে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। সুররিয়ালিজমের চৈতন্যদেব আর রবীন্দ্রনাথের মধুর গীতল রোম্যান্টিকতায় আপাদমস্তক নিমজ্জিত আমার জীবনে এই দাদাবাদ, পরাবাস্তববাদ এগুলো এসেছিলো বিধ্বংসী ঝড়ের মতো, যা আমার স্বাভাবিক জীবন আর চিন্তাধারাকে বিকৃত, বিভ্রান্ত আর বিপথগামী করেছিলো বলে আমার মনে হয়। গত শতকের সত্তরের দশকের শেষদিক আর আশির দশক জুড়ে পরাবাস্তববাদী ধারায় বেশকিছু কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি। আসলে ওই সময়ে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাংলা কবিতার সেরা পরাবাস্তববাদী প্রয়াত জীবনানন্দবাবু। বিনয়, আলোকরঞ্জন, মান্নান সৈয়দ প্রমুখ আরো অনেকের কবিতায় তখন প্রবল পরাবাস্তববাদী প্রভাব পরিদৃশ্যমান।
তখন আর পূর্ব-পশ্চিম উভয় বঙ্গেই পরাবাস্তবাদ ও বিমূর্ত শিল্পরীতির অনুসরণ ছিলো কাব্য-চারুকলা জগতের চলতি ফ্যাশন। কবিতা লিখবে, অথচ পরাবাস্তববাদের অনুসারী হবে না, এমনটা তখন চিন্তাও করা যেতো না। তখন ছোট-বড়, খ্যাত-অখ্যাত সব কবিই কবিতায় পরাবাস্তববাদী রীতি কম-বেশি অনুসরণ করতেন, জেনে বা না জেনে। আমার নিজের লেখা পরাবাস্তববাদী কবিতার কিছু নিদর্শন সামনে তুলে ধরার ইচ্ছে রইলো, এ মতবাদ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনাসহ। আমি তখন গোটা দু-তিন সুররিয়ালিস্টিক নাটকে অভিনয়ও করেছিলাম, চট্টগ্রামে ও ঢাকার মঞ্চে আর টেলিভিশনে।
কিন্তু এতকিছুর পরও পরাবাস্তববাদ আমার কাছে কিছুটা ধোঁয়াশায় ঢাকা। কারণ পরাবাস্তবের চরিত্রই এমন। এ তো আর ‘বাস্তব’ নয়! এ হলো বোঝা না বোঝায় মেশা এক প্রপঞ্চ, যার অনুধাবনে অঙ্গাঙ্গী মিশে থেকে যায় কিছুটা সত্য, কিছুটা অনুমান, কিছুটা ভ্রান্তি।
পরাবাস্তববাদীদের অন্যতম প্রধান অগ্রদূত পল এলুয়ারের বিখ্যাত কয়েকটি কবিতার বাংলা অনুবাদ পরবর্তী পৃষ্ঠায় দেয়া হলো।
পল এলুয়ারের কবিতা: ভাষান্তর- জ্যোতির্ময় নন্দী
১.
আমাকে জানতে পারা যায় না
তুমি আমাকে যতটুকু জানো তার চেয়ে বেশি
আমাকে জানতে পারা যায় না
তোমার যে চোখে আমরা ঘুমাই
আমরা দুজন একসাথে
আমার পুরুষ দীপ্তির জন্যে তৈরি করেছি
সাধারণ রাতগুলোর চেয়ে শ্রেয়তর একটা নিয়তি
তোমার যে চোখে আমি ঘুরে বেড়াই তারা
রাস্তা বরাবর সঙ্কেত দিয়ে দিয়েছে যার অর্থ পৃথিবীর অজানা
তোমার চোখে যারা প্রকাশিত হয় আমাদের কাছে
তারা আমাদের অন্তহীন একাকিত্ব
তারা নিজেরা যা হবে বলে ভেবেছিলো সেটা আর নয়
আমি তোমাকে যতটুকু জানি তার চেয়ে বেশি
তোমাকে জানতে পারা যায় না
২.
সত্যের নগ্নতা (আমি যা ভালোই জানি)
হতাশার কোনো পাখা নেই,
ভালোবাসাও নেই
কোনো অবয়ব নেই:
তারা কথা বলে না।
আমি তাদের দেখি না,
ওদের সঙ্গে কথা বলি না,
কিন্তু আমি বাস্তব আমার ভালোবাসা আর আমার হতাশার মতোই।
৩.
সান্ধ্য আইন
আমরা কী আর করতে পারি, কারণ দুয়ারে দুয়ারে পাহারা ছিলো,
আমরা কী আর করতে পারি, কারণ তারা আমাদের বন্দী করেছিলো,
আমরা কী আর করতে পারি, কারণ সড়কগুলো আমাদের নিষিদ্ধ করেছিলো,
আমরা কী আর করতে পারি, কারণ শহরটা ঘুমিয়ে ছিলো?
আমরা কী আর করতে পারি, কারণ সে ক্ষুৎকাতর ছিলো,
আমরা কী আর করতে পারি, কারণ আমরা ছিলাম আত্মরক্ষার উপায়হীন,
আমরা কী আর করতে পারি, কারণ রাত নেমে এসেছিলো,
আমরা কী আর করতে পারি, কারণ আমরা প্রেমে পড়েছিলাম।
৪.
নদী
আমার নদীটা আছে আমার জিভের নিচে,
অকল্পনীয় জলরাশি, আমার ছোট্ট নৌকা,
এবং পর্দা নেমেছে, এসো কথা বলি।
৫.
স্বাধীনতা
আমার স্কুলের খাতায়
আমার ডেস্কে আর গাছপালায়
বালিতে তুষারে
আমি তোমার নাম লিখি
পড়ার সব পৃষ্ঠায়
সব সাদা পৃষ্ঠায়
পাথরে রক্তে কাগজে বা ছাইয়ে
আমি তোমার নাম লিখি
সোনালি ছবিগুলিতে
যোদ্ধাদের হাতিয়ারে
রাজাদের মুকুটে
আমি তোমার নাম লিখি
অরণ্যে আর মরুভূমিতে
পাখির নীড়ে আর ঝোপঝাড়ে
আমার শৈশবের প্রতিধ্বনিতে
আমি তোমার নাম লিখি
রাতের বিস্ময়ে
দিনের সাদা রুটিতে
বাগদানের ঋতুতে
আমি তোমার নাম লিখি
আমার নীল কাপড়ের টুকরোগুলোতে
শ্যাওলা ঢাকা রোদেলা পুকুরে
জীবন্ত চাঁদের সরোবরে
আমি তোমার নাম লিখি
দিগন্তছোঁয়া মাঠে
পাখির ডানায়
আর ছায়াকলে
আমি তোমার নাম লিখি
ভোরের প্রতিটি নিঃশ্বাসে
সাগরে নৌকায়
পাগল পাহাড়ে
আমি তোমার নাম লিখি
মেঘের ফেনায়
ঝড়ের ঘামে
ভারী আর মৃদু বৃষ্টিপাতে
আমি তোমার নাম লিখি
ঝলমলে রূপে
রঙের ঘণ্টায়
শারীরিক সত্যে
আমি তোমার নাম লিখি
জাগ্রত পথে
খুলে যাওয়া রাস্তায়
উপচে পড়া চত্বরে
আমি তোমার নাম লিখি
আলো দেয়া বাতিতে
নিভে যাওয়া বাতিতে
আমার পুনর্মিলিত বাড়িতে
আমি তোমার নাম লিখি
অর্ধেক কাটা ফলে
আয়না থেকে আর আমার ঘর থেকে
আমার তোশকহীন খাটে
আমি তোমার নাম লিখি
আমার লোভী আর ভীরু কুকুরের গায়ে
তার খাড়া কানে
তার আনাড়ি থাবায়
আমি তোমার নাম লিখি
আমার দরজার গোবরাটে
চেনা জিনিসপত্রে
আগুনের পবিত্র স্রোতে
আমি তোমার নাম লিখি
মঞ্জুর হওয়া সব মাংসে
আমার বন্ধুদের ললাটে
প্রসারিত প্রতিটি হাতে
আমি তোমার নাম লিখি
চমকের কাঁচে
মনোযোগী ঠোঁটে
নৈঃশব্দ্যের অনেক উঁচুতে
আমি তোমার নাম লিখি
আমার বিধ্বস্ত আশ্রয়স্থলে
আমার ভেঙে পড়া বাতিঘরে
আমার একঘেয়েমির দেয়ালে
আমি তোমার নাম লিখি
নিষ্কাম অনুপস্থিতিতে
নগ্ন একাকিত্বে
মৃত্যুর মিছিলে
আমি তোমার নাম লিখি
পুনরুদ্ধারকৃত স্বাস্থ্যে
কাটিয়ে ওঠা বিপদে
স্মৃতিহীন আশায়
আমি তোমার নাম লিখি
আর এই একটি শব্দের শক্তিতে
আমি আবার শুরু করি আমার জীবন
তোমাকে জানার জন্যই আমার জন্ম
তোমাকে নাম দেয়ার জন্য
৬.
এমন সুন্দর রাতের কথা স্বপ্নেও ভাবিনি
এমন সুন্দর রাতের কথা স্বপ্নেও ভাবিনি
বাগানে নারীরা আমাকে চুমু খেতে চাইছে
আকাশ ব্র্গাুলো, স্থির গাছগুলো
তাদেরকে ধরে রাখা ছায়াকে তারা বাঁধে দৃঢ় আলিঙ্গনে।
বিবর্ণ হৃদয়ের এক নারী
রাতটাকে রেখে দিলো তার পোশাকে
প্রেম আবিষ্কার করল রাতটা
স্পর্শেও অবোধগম্য তার স্তন সম্পর্কিত
আমি কিভাবে সবকিছু উপভোগ করতে পারি?
তার চেয়ে সবকিছু মুছে ফেলাই ভালো।
পূর্ণ গতিশীলতার,
সর্বাত্মক ত্যাগের, সম্পূর্ণ বিজয়ের মানুষটা
ঘুমায়। ঘুম, ঘুম, ঘুম।
তার দীর্ঘশ্বাসের সাথে সে মুছে দেয় ক্ষুদে, অদৃশ্য রাতটাকে।
সে ঠান্ডা বা গরম কোনোটাতেই ভোগে না।
তোমার বন্দী পালিয়ে গেছে ঘুমের দেশে
সে মরেনি, ঘুমিয়ে আছে।
যখন ঘুমাচ্ছিলাম
সবকিছু স্তম্ভিত হয়ে গেলো,
জোর খেললো,
দেখলো,
শুনুন।
আপনার শেষ কথা:
“যদি ফের নতুন করে শুরু করি, আমি তোমাকে খুঁজে পাবো না তাকিয়েই।”
সে ঘুমায়, ঘুমায়, ঘুমায়।
ভোর বৃথাই তার মাথা তোলে,
সে ঘুমায়।
৭.
একটি মুহূর্তের আয়না
বাতিল করে দাও দিনটাকে,
পুরুষদের প্রতিবিম্ব বিকৃত করে দেখায় এটা,
পুরুষদের হৃদয়চাঞ্চল্যের সম্ভাবনাকে দূরে সরিয়ে দেয়,
এটা পাথরের মত কঠিন,
নিরাকার পাথর,
নড়াচড়া ও দৃষ্টির পাথর,
এবং এটার এমন উজ্জ্বলতা যা সমস্ত বর্ম আর মুখোশকে মিথ্যে করে দেয়।
হাত যা নিয়েছিলো তা এমনকি হাতের রূপ নিয়ে নিতেও প্রসন্ন বোধ করে না,
যা বোঝা গিয়েছিলো তা আর নেই,
পাখিটি বিভ্রান্ত হয়েছিলো বাতাসে,
আকাশ হয়েছিলো সত্যে,
মানুষটা হয়েছিলো তার বাস্তবতায়।
৮.
শব্দাবলীর অধীনে
স্মৃতিতে দুঃস্বপ্নকে
পাক খাওয়ানো হাতের চেয়েও বেশি চমকদার
অগ্নিশিখা আছে
মুগ্ধতায় আমরা পৌঁছে যাই সূর্যের কাছে
ভালোবাসার স্বাদ কাঁচের মতো
এটা সমুদ্র থেকে উঠে আসা প্রবাল
এটা অরণ্যে ফিরে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া সুগন্ধ
এটা তোমার ঋণ পরিশোধকারী স্বচ্ছতা
এটা সবসময়
স্বাদুভাবে বিস্ফারিত ঠোঁট নিয়ে সেই মাথা
দেয়ালের এপাশে
আর ওপাশে হয়তো অ-এর শেষপ্রান্ত
৯.
অপরিহার্যতা
দেশে বড় কোনো অনুষ্ঠান নেই
যারা ভারসাম্য রাখেন তাদের সাথে
পূর্ণ বিশ্রামের এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায়
ভালো পথের খুব কাছাকাছি
গুরুগাম্ভীর্যের ধুলোয়
আমি সংযোগ স্থাপন করি নারী ও পুরুষের মধ্যে
সূর্যের বন্দুকধারীরা আর ভবঘুরেকে মারধরের মধ্যে
মন্ত্রমুগ্ধ গুহাগুলো আর বীণার মধ্যে
অন্ধকার বৃত্ত আর নাকাল হওয়া হাসির মধ্যে
অগ্রঘোষক পাখি এবং রসুন তারার মধ্যে
অনুসন্ধান আর বাতাসের শব্দের মধ্যে
পিঁপড়েদের ঝরনা এবং র্যাস্পবেরি চাষের মধ্যে
ঘোড়ার নাল আর আঙুলগুলোর ডগার মধ্যে
রতœপাথর আর তীব্র শীতের মধ্যে
ঝোপটার চোখের তারাগুলো আর প্রমাণিত ভাঁড়ামোর মধ্যে
ক্যারোটিড ধমনী আর নুনের বর্ণালীর মধ্যে
বুনো পাইন আর একটা বামনের মাথার মধ্যে
রাস্তার মোড়গুলোতে পাতা রেলিং আর লালচে ঘুঘুর মধ্যে
পুরুষ এবং নারীর মধ্যে
আমার একাকিত্ব আর তোমার মধ্যে
১০.
হওয়া
পরাজিত একটা পতাকার মতো কপাল নিয়ে
আমি যখন একা থাকি তোমাকে টেনে নিয়ে যাই
বরফে ঢাকা রাস্তাগুলো দিয়ে
অন্ধকার ঘরগুলোর পাশ দিয়ে
দুর্ভাগ্য ঘোষণা করতে করতে
আমি ছাড়তে চাই না
আমার আবদ্ধ আয়নায় জন্ম নেয়া
তোমার পরিচ্ছন্ন আর জটিল হাত
বাকি সবকিছু নিখুঁত
বাকি সবকিছুই আরো বেশি অকেজো
এমনকি জীবনের চেয়েও
তোমার ছায়ার নিচে মাটি খোঁড়ো
স্তন দুটোর পাশে একটা পুকুর
যেখানে ডুবতে হবে
পাথরের টুকরোর মতো
১১.
শেষ চিঠি
রোল্যান্ড পেনরোজ*
(১)
কোমলতা সামুদ্রিক জলবায়ুর আর
নৌকায় রক্তিম অলকের
আর সেই তলদেশের যা জেগে উঠছে
যা আছড়ে পড়ছে জলের কিনারায়
আমাকে দেখাচ্ছে দূর সমুদ্র থেকে এসে
একজন নারীকে
অবশেষে অর্থহীন
এবং আমি এটা অনেক দূরে লুকিয়ে রাখি
আর মুখোমুখি হতে যাচ্ছি শীতলতার
(২)
রাতে এটা সম্ভব
আমার স্বপ্নগুলো গুলি করে ধসিয়ে দাও মূলধন
আমার মূলধন মিনিট
মিথ্যাচারিতার রঙ আমি খসিয়ে ফেলেছি
আমার মেয়েলি পুঁজি
মানবদেহের সীমানায়
আমি মেনে নিই প্রেমে পড়ার বিপদ
আর বেঁচে থাকি
(৩)
আমি বন্দি, আমি বোবা
আমি যেন জলে মাছ
চোরদের খেলায়
বিজয়ের চিহ্ন হিসেবে আমার কাছে আছে চুমুর টেক্কা
আমার নৌকার ভেতরে আর বাইরে
আমার হাতে আছে ঢেউয়ের নগ্নতা
অন্তরঙ্গ জগৎ থেকে জনসাধারণের জগতে
দুটো মিলন চালিয়ে যেতে
বিশৃঙ্খল জীবনের
অভিযান যোগসূত্রে
আমি খুব সহৃদয়
এবং আলো আগুনের খুবই গোঁয়ার অভিভাবক
ঘনিষ্ট একটি নগ্ন শরীরের প্রতিফলন জোয়ার শান্ত করে
লালচুলো ঋতু আমার বেপরোয়ার পক্ষপাতী
তোমার লাল চুল আমার সামনে খুলে দেয় তোমার শরীরের বিস্তার
*ইংরেজ শিল্পী, ইতিহাসবিদ এবং কবি স্যার রোল্যান্ড অ্যালজের্নন পেনরোজ সিবিই (১৯০০-১৯৮৪) ছিলেন আধুনিক শিল্পের একজন প্রধান প্রবর্তক ও সংগ্রাহক এবং যুক্তরাজ্যের পরাবাস্তববাদীদের একজন সহযোগী।
জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি ও অনুবাদক