মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ : বাতাসের সাথে গোল্লাছুট খেলতে খেলতে ক্লান্ত মুকিত যখন বাড়ি পৌঁছুলো,তখন পশ্চিম আকাশটাকে শেষ বেলার রাঙা চেলি পড়া বধূর মতই লাগছিল। হামাগুড়ি দেয়া জীবনের নদীটা তীর ভাঙা ঢেউ নিয়ে চলে। অবসন্ন রোগীর মতো হাঁপাতে থাকে।
গণিতে ভালো ছাত্র ছিলো না, বিধায় কু-ু স্যারের বেতের যন্ত্রণায় যেন এখনো পিঠের দিকটা চিরিক মারে। স্কুলের জীবনটা এমনি করে থেমে গেল। নেতিয়ে পড়া সৌভাগ্যের চম্পা- চামেলিরা পায়ের কাছে শিশিরের সাথে মৌন খেলায় মাতছিল। কিন্তু দুয়ার ঠেলে বেরিয়ে এসেছে কি আসে নাই, তার কোনো দলিল নেই ।
পরির মতো সুন্দর নয়। নামটা পরি। ভাঁপা পিঠার মতো উম দেয়া উষ্ণতার রেশটুকু রেখে যায়।যথেষ্ট লাবণ্যরঙে রাঙিয়ে না থাকলেও তার দেহের ভাঁজে অমিত জোছনার আলো,চোখের ফিনিশিং যেন পিকাসোর রেখাচিত্র ।
একবার দেখেই খেই হারিয়ে ফেলেছে মুকিত।কিন্তু চেপে গেছে বরাবরই।
আজকের ট্রেন থেকে নেমে মুকিত একরকম স্থির। আজ পরির সামনে গোপনের হাড়িটা ভাঙবেই। পরিকে বলেই দেবে সব। তাতে যা হবার হোক ।
ট্রেনে দীর্ঘ সাতাত্তর কিলোমিটার দূরের পথ ধরে এসেছে। মনের বাঁধ শক্ত করে ধরেছিল মুকিত।কতদিন আর এভাবে ?
হকারী জীবনের অবিচ্ছেদ্য আঙ্গিকে এটাকে শ্রেষ্ঠ একটি ঘটনা বলে মনে করে মুকিত।
সারাদিন বইয়ের বোঝা কাঁধে সে ট্রেনের বগি বদলায় চলতি অবস্থাতেই। মায়ের জন্য ঔষুধ– পথ্য কিনতে ভুল করে না মুকিত। সারাদিনের হকারির উপার্জন ঢেলে দিতে প্রস্তুত।
বই সবাই কেনেনা। বিশেষ করে এসি চেয়ার কোচের যাত্রি সবাই আশরাফ।কানের দুই ছিদ্র বেদখল।এয়ারফোন কানে দিয়ে আরামসে হিন্দি বাংলা গান শুনে শুনে যেন মুখস্থ করে চলেছে। সিট নাম্বার যুক্ত যাত্রীরা আপাতত, স্বস্তিতে ।
গমগমে একটা কোঠা। এখানে সকল প্রকার যাত্রীদের হৈচৈ। কেউ কেউ সামনা সামনি সিটে বসা। কেউ কেউ টিকেট না করেও সিটে বসে পা নাচানাচি করে। বনেদী পরিবারের মতো সিগারেট মুখে দিয়েছে।
মায়ের জন্য টাকা তুললো মুকিত।
কিছু বই বিক্রি হলো ।
ঔষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারাও একটু কষ্ট।বিশেষ করে দৈনন্দিন আয়ের সাথে খরচের ম্যালা পার্থক্য।
পরি বই কেনে। মূল্য দেড়শো টাকা। পাঁচশো টাকার নোট বের করে। মুকিত একরকম কিছু ফলাফলের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সবাইকে জানানোর চেষ্টা করে ।
ভাঙিয়ে নিতেই হবে।
পরি আশ্বস্ত করে,
ওটা তোমার কাছে রাখো, টাকা ফেরত দিতে হবে না ।
কেন?
তোমার বৌ, বাচ্চার জন্য কিছু কিনে নিও ।
আমার যে বৌ-বাচ্চা নেই। গরিব মানুষ দেখলেই করুণা করেন?
পরির হাসিটা সে–ই রকম লাগে।
অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো মুকিত।
আজ মনের গোপন ঘরটা খুলে যাচ্ছে। পকেটমারের ভয়। ভিড়ের মধ্যেই উনসত্তর, একাত্তরের গল্প বলে গেল।বই পড়ার উপকারিতা ব্যখ্যা করতে করতে ঘেমে যাচ্ছিল। যাত্রী সাধারনের মধ্যে কিছুটা আরাম। কিছুটা ব্যারাম।
আর কিছু বোধের জন্ম দিতেই মুকিতের প্রচেষ্টা বরাবরের মতোই ফ্রেশ। সামান্তরিক জীবনের দুটি বাহু যেন পরি আর মুকিত।
মুকিত রতœগর্ভা হাসি উপহার দেয়। চোখের গোপনে যতেœ বেড়ে ওঠা জ্যোতি সহসা বলে ফেললো, আপনাকে ভালোবাসি।
পরির চিবুক বেয়ে বুক পর্যন্ত নেমে যাওয়া রেশমি চুলের ওপর বেহায়া বাতাস বইছে।
এবার পরির হেসে ওঠার পালা। তবুও আচমকা এক পর্যায়ে ছোট একটা ঝাঁকুনিতে পরির চেতনা আসে।
মুকিতকে বহুদিন ধরে এই ট্রেনে দেখেছে। হকারী করা মুকিতের হয়তো কাউকে ভালো লাগার,ভালোবাসার অধিকার আছে। কিন্তু ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পরির মুখ থেকে সেই অধিকার কেড়ে নিয়েছে সমাজ। তার ভেতরের গোপনীয় সিন্দুকের চাবি যেন অদৃশ্য কেউ ছিনিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছে।
ট্রেনটা স্টেশনের কাছে এসে গেছে। পরি লাগেজ গুছিয়ে নিচ্ছে। একটা অন্তিম ক্যাঁচ্ ক্যাঁচ্ শব্দে ট্রেন থেমেছে।
মুকিত অপেক্ষা করছিল, পরি কিছু উত্তর দেবে।
আজও নেমে গেছে নিঃশব্দে। প্লাটফরমে অপেক্ষমাণ লোকটা পরির হাজব্যান্ড সন্দেহ নেই।
ওদিকে গার্ড পতাকা নাড়াচ্ছে। ট্রেনে মুকিত আরো অনেকটা সময় কাটাবে
মায়ের চিকিৎসা করাতে আরো অনেক টাকা খরচ হবে। এই টাকা তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, গল্পকার