অমল বড়ুয়া:
পুরাণ সব লোককথা বা লোককাহিনি ও লোকসাহিত্যের আদি ও প্রাচীনতম উপাদান। পুরাণ ইতিহাস, আখ্যান-উপাখ্যান, ধর্মীয় বিধিবিধান ইত্যাদি সম্বলিত এক শ্রেণীর মিশ্র সাহিত্য। সাধারণ মানুষের গল্পরস আস্বাদনের আকাক্সক্ষা থেকে এর উৎপত্তি। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বর্হিভুত প্রাচীন পূর্বপুরুষদের অব্যাখ্যাত অভিজ্ঞতাগুলোর বর্ণনামূলক যে কাহিনিগুলো মৌখিক বয়ানের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে সেগুলোকে পুরাণ বা মিথ বলা হয়। প্রাক-কৃষি সভ্যতার সময়কালে রচিত এই সব কাহিনির ভিত্তি ছিল অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত বিষয়ের উপর বিশ^াস। মূলত সম্প্রদায়গত বা গোষ্ঠীগত প্রয়াসে সৃজিত হয়েছে পুরাণ কাহিনি, যার সাথে প্রাচীনকালের ধর্মবিশ^াসের সুগভীর সংযুক্ততা পরিলক্ষিত হয়। পুরাণ ব্যাসাদি রচিত প্রাচীন শাস্ত্রবিশেষ যাতে প্রাচীন কালের ইতিহাস ও কিংবদন্তি বা জনশ্রুতিমূলক কাহিনি আছে সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত-এই পাঁচ লক্ষণযুক্ত পুরাণ; পুরাণ শব্দটি সৃষ্ট পুরা + ন যোগে। ‘পুরা’ অর্থ পূর্বে বা প্রাচীনকালে এবং ‘ন’ অর্থ সংঘটিত বা জাত, অর্থাৎ পূর্বে সংঘটিত বা সৃষ্ট হয়েছে এমন কিছুকে পুরাণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে অভিধানে। বুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এ শব্দটি সংস্কৃত ‘পুরাতন’ থেকে এসে প্রাকৃত ‘পুরাণ’ শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ পুরাণের ধাতুগত অর্থ পুরাতন।
প্রাচীনকাল থেকে পুরুষানুক্রমে প্রবহমান কাহিনি, বিশেষত কোনো জাতির আদি ইতিহাস-সম্পৃক্ত বিশ্বাস, ধারণা ও নৈসর্গিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যা হলো পুরাণ।
পুরাণ প্রাচীনযুগীয় হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের গুরুত্বপূর্ণ আখ্যানমূলক ধর্মগ্রন্থ-সমুচ্চয়। পুরাণে সৃষ্টি থেকে প্রলয় পর্যন্ত ব্রহ্মা-ের ইতিহাস, রাজন্যবর্গ, যোদ্ধবর্গ, ঋষি ও উপদেবতাগণের বংশবৃত্তান্ত এবং হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্ব, দর্শন ও ভূগোলতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে। বৌদ্ধ পুরাণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল স্বয়ম্ভু পুরাণ এবং জৈন পুরাণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জিনসেনের মহাপুরাণ। লোকমতে, মহাভারত-রচয়িতা ব্যাসদেব পুরাণসমূহের সংকলক। যদিও পুরাণের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন পাঠগুলি গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খ্রিস্টীয় তৃতীয়-পঞ্চম শতাব্দী) সমসাময়িক। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে রচিত ছান্দোগ্য উপনিষদে পুরাণের একটি প্রাচীন উল্লেখ পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ পুরাণকে পঞ্চম ‘বেদ’ নামে অভিহিত করে। এতে প্রাচীন যুগে পুরাণের ধর্মীয় গুরুত্বের কথা জানা যায়। সম্ভবত সেই যুগে পুরাণ মৌখিকভাবে প্রচারিত হত। পুরাণ নামাঙ্কিত সাহিত্যধারায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মহাপুরাণ। সাধারণ বিশ্বাস অনুযায়ী মহাপুরাণের সংখ্যা আঠারো এবং এগুলি ছয়টি করে পুরাণযুক্ত তিনটি পৃথক শ্রেণিতে বিন্যস্ত। আদিমকাল থেকেই মানুষ নানান ধরনের সংস্কার ও বিশ^াসের বদৌলতে যেসব বিষয়কে কল্পনা করে এসেছে সেই বিষয়সমূহ কাহিনি রূপে সংগঠিত, সংযোজিত, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়ে লোকপুরাণ বা মিথ- এ পরিণত হয়েছে। তাই লোকপুরাণ বা মিথ হলো পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্য। ড. চন্দ্রমল্লী সেনগুপ্ত বলেছেন- ‘মিথ বলতে এক কথায় বোঝায়, বাস্তব বিরহিত পুরাকালের কিছু কাহিনিকেই।’ লোকপুরাণের বিষয়টিকে কয়েকটি সূত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন ড. পল্লব সেনগুপ্ত। প্রথম সূত্র- দৈব নির্ভরতা এবং আত্মপ্রত্যয়; এদের সম্পর্ক হলো বিষমানুপাতিক। দ্বিতীয় সূত্র- আদিম লোকপুরাণের সক্রিয় মূল একক হলো দৈব-নির্ভর পবিত্রতার বোধ; কালপ্রবাহে প্রথম সূত্রের শর্তানুযায়ী তাকে প্রত্যক্ষভাবে লঘু থেকে লঘুতর রূপে পায়, অর্থাৎ দৈব-পবিত্রতা লৌকিক কাহিনিতে গৌণ হতে হতে অবশেষে বহিরঙ্গে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় টেল, রূপকথা ইত্যাদির মধ্যে।
উৎপত্তি অনুসারে লোকপুরাণ বা মিথকে বিশেষজ্ঞগণ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা- বিশ^জগতের সৃষ্টি বিষয়ক, মহাপ্রলয় বিষয়ক, দেবতার উদ্ভব সম্পর্কিত, মানুষ ও জীব-জন্তুর জন্ম সম্পর্কিত, বিভিন্ন প্রাকৃতিক সংঘটনের হেতু সন্ধান বিষয়ক, পশু-পাখিদের শারিরীক বৈশিষ্ট্যসূচক, আগুনের আবিষ্কার কেন্দ্রিক, সভ্যতার বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় সুচক, সংস্কৃতিধাতা সম্পৃক্ত এবং বিভিন্ন সামাজিক রীতি-নীতির উৎসসমূহ। পুরাণ থেকে আবার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের রসদও পাওয়া যায়। বৌদ্ধ স্বয়ম্ভু পুরাণ থেকে কাঠমান্ডু উপত্যকার ইতিহাস ও জিনসেনের মহাপুরাণ থেকে প্রাচীন কন্নড় সাহিত্যের ইতিহাস জানা যায়। পুরাণকে বলা হয় সৃষ্টির গল্পরূপে, আদিকালের মানুষের ইতিহাসরূপে। উনিশ শতকে পুরাণকে মনে করা হতো অতিকথা, লোককথা, নীতিগল্প বা ফেবল, রূপক বা রূপকথা ইত্যাদি রূপে। বিংশ শতাব্দীতে গবেষকগণ তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, সমাজ ভাবনা, আচার-অনুষ্ঠান, পোশাক-খাদ্যাভাস থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক চর্চার নানা অনুষঙ্গের গতিধারা খুঁজতে চেয়েছেন পুরাণে। ভারতীয় ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে পুরাণগুলি থেকে মূল্যবান উপাদান সংগ্রহ করে অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে। পুরানগুলি সুষ্টি, প্রলয়ের পর নতুন সৃষ্টি, ঋষি ও দেবগণের বংশাবলী, মনুদের রাজত্বকাল এবং প্রাচীন রাজবংশাবলীর ইতিহাস নিয়ে রচিত হয়েছিল।
লোকাচার ও লোকবিশ^াসের উপর ভর করে বহু হাজার বছর ধরে ক্রমরূপান্তর ঘটেছে পুরাণকথার। প্রাথমিক পর্যায়ে পুরাণকথার উপজীব্য ছিলো দৈবীশক্তি নির্ভরতা; আগুন ও অস্ত্র নির্মাণ স্তরে পুরাণে বৈদীশক্তি ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের আত্মপ্রতিষ্ঠা আর কৃষি ও পশুপালনের মাধ্যমে নিজের গভীরতর আত্মবিশ^াসের বহিঃপ্রকাশ অন্যতম। প্রাগৈতিহাসিক যুগের খোলস ছেড়ে নগর সভ্যতার উত্তরণে লোক পুরাণ আর নব উদ্যমে গড়ে উঠতে পারেনি। তবে দৈবীশক্তির উপাদানটিই কাহিনি গড়ার ক্ষেত্রে যেখানে ব্যাপকতা লাভ করেছে- সেখানেই গড়ে উঠেছে লিজে-। ফলে যাদুশক্তি এবং বস্তুর অন্তর্গত সত্তা পশু ও মানুষের মধ্যে সমধর্মিতার কল্পনা- প্রভৃতি ব্যাপার নিয়ে তৈরি হতে শুরু হলো রূপকথা, উপকথা, নীতিকথা, ফেয়ারি টেল প্রভৃতি কাহিনি-প্রকরণ। পুরাণকথা মূলত প্রাগৈতিহাসিক দেব-কল্পনা কেন্দ্রিক, লিজে- সচরাচর ঐতিহাসিক বলে স্বীকৃত বা বিবেচিত চরিত্রের অর্ন্তলীন অলৌকিক কিংবা অতি-মানবীয় ক্ষমতার প্রত্যয় ভিত্তিক।
পুরাণ বলতে ভারতে যে বিশেষ ধরনের সাহিত্য বোঝায়, তার সাথে স্মার্তবিধিশাসিত সমাজব্যবস্থার একটা সুনিবিড় যোগাযোগ ছিল বলে, আমাদের দেশে লোকপুরাণ এক সুদীর্ঘস্থায়ী অবহেলার শিকার হয়েছে। বলতে গেলে লোকপুরাণের অস্তিত্বই আমাদের শ্রেণি-ভিত্তিক সমাজে প্রায় বিস্মৃত হয়ে থেকেছে। চীনা লোকপুরাণ বা গ্রিক কিংবা টিউটনীয় মিথলোজির ক্ষেত্রে এই অবস্থা হয়নি; মিশরীয় এবং মেসোপটেমিয় পুরাণও সে দুরবস্থার হাত থেকে বেঁচেছে। ড. নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, ‘যত ক্ষুদ্র হোক প্রতি কিংবদন্তি ও পুরাণকাহিনির মূলেই একটি সত্য থাকে। সেই সত্য জাতির জীবনে পবিত্র, তাৎপর্যপূর্ণ আদর্শ রূপে থাকে।’
লোকপুরাণ বা মিথ থেকে সময়ের পালাবদলে তৈরি হয়েছে টেল বা কথার; যাতে মিথ-সম্পৃক্ত ধর্ম ও অলৌকিকতাকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে প্রচলিত লোকজীবনের আখ্যানে। লোককাহিনিতে যখন অতিমানবিক জীবের স্থলে মানুষ কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন এটা মিথ না হয়ে লিজে- বা উপকথা হিসেবে পরিগণিত হয়। আবার লোককাহিনির মধ্যে যখন অতিমানবিক প্রাণিদের ভূমিকা থাকে এবং তা যদি কোনো প্রথাগত মিথের অংশ না হয়, তবে তাকে ফোকটেল বা লোককাহিনি বলে। লোকপুরাণে ব্যবহৃত মিথ শব্দটি গ্রীক। কিন্তু মিথ শব্দটি ভারতীয় সংস্কৃত কাব্যেও দেখা যায়। ঋক্সুক্ত থেকে শুরু করে বৃহৎকথা বা বিভিন্ন সংস্কৃত কাব্যের যে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলো তার সর্বত্রই মিথঃ শব্দটির মৌলিক অর্থ পারষ্পরিক আলোচনা। গ্রীক বা ল্যাটিনে শব্দটি ছিল গুঃযড়ং বা গুঃযঁং; ঠিক তেমনি ভারতীয় আর্যভাষায়ও শব্দটি মূলে মিথস্। ইংরেজিতে হয়েছে গুঃয বৈদিক মিথস হয়েছে মিথঃ। ইউরোপীয় গুঃযঁং এর মতই ভারতীয় ভাষায় মিথুন একটি শব্দ আছে। এরও আভিধানিক মৌলিক রূপ মিথ। বৈদিক সভ্যতার পরেই কিন্তু গ্রিক সভ্যতার গোড়াপত্তন। কাজেই গ্রিক শব্দ হতে মিথ শব্দটি ভারতীয় আর্যভাষায় অনুসৃত হওয়ার অনুমান সঠিক হতে পারে না। আর্যদের আগমনের পর ভারতবর্ষে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্যরাজ দরায়ুস প্রথম বিদেশি হিসেবে আক্রমণ করেন। গ্রীকরাজ আলেকজে-ার প্রথম ভারত আক্রমণ করেন খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে। আর ঋক্ সুক্ত এর বহু আগেই রচিত হয়। আর এখানেই মিথঃ বা মিথস শব্দের ব্যবহার হয়, যার অর্থ দাঁড়ায়- ‘পারষ্পরিক কথোপকথন’। ভারতীয় বা ইউরোপীয় আর্যদের প্রাচীনতম বাসভূমি ‘মধ্যপ্রাচ্য’। তৎকালীন মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন জরস্ত্রীষ্টীয় ধর্মের পারস্য দেবতা ছিলেন- ‘মিথ্র’। ভারতের বৈদিক ধর্মে যার নাম ছিল মিত্র বা সুর্য। পরবর্তীকালে সৌরশক্তিতে, পৌরোহিত্যের ব্যাখ্যায় রূপান্তরিত হলেও মূলত ইনিই ছিলেন অর্ধনারীশ^র বা মিথুন দেবতা। গ্রিক গুঃযড়ং বা গুঃযঁং ইংরেজি গুঃয ভারতীয় মিথস বা মিথঃ, পারস্যের মিথ্র একই শব্দ,- সর্বত্রই যার অর্থ পারষ্পরিক মিলন, আদান-প্রদান। ভারত কিংবা মধ্যপ্রাচ্য অথবা দূরপ্রাচ্য বা ইউরোপ সবখানে পুরাণ বা মিথের ঘটনা, কাহিনি, আচার-আচরণ সবই অতিপ্রাকৃত, অবিশ^াস্য ও কাল্পনিক হিসেবে পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু প্রতিটি দেশের মিথ বা দেব, ধর্মপুরাণের সংজ্ঞায় বারে বারে স্বীকার করা হয়েছে যে, প্রাচীনকালে এইসব কাহিনিকে বাস্তব বলেই জানতো। তবে বর্তমানে এসব কাহিনি অবাস্তব, কাল্পনিক অথবা অতিলৌকিক মনে হয়। কারণ হিসেবে বলা যায়- প্রথমত সভ্যতার ক্রমবিকাশের যে স্তরে এদের জন্ম, সেই সময়টাকে এতো পেছনে ফেলে এসেছে যে তাকে ভাবতেও পারে না। দ্বিতীয়ত সেই জীবনযাত্রার লোকাচার-লোকাচরণ এমন পর্যায়ের ছিল, আজকের সভ্যতা চিন্তাই করতে পারে না যে, আমাদের অতিবৃদ্ধ পিতৃপুরুষরা তেমন জীবনযাত্রার অভ্যস্থ ছিলেন। তৃতীয়ত দেব- ধর্মপুরাণগুলির উপর আবহমানকালের এত বৈচিত্র্যময় হস্তাবলেপন পড়েছে যে হাজার বছরের পুরোনো বটগাছের মত মূল শেখড়টি খুঁজে পাওয়া কঠিন। চতুর্থত: মূলকাহিনি বা অভিজ্ঞতার মিথ-কথার উপর পৌরোহিত্যের সুপরিকল্পিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, সেই ব্যাখ্যার খোলস ভেঙ্গে সত্যকে স্বরূপে প্রকাশ অত্যন্ত দুরূহ। (মিথ ও লোকাচার, দীনেন্দ্রকুমার সরকার, লোকপুরাণ ও সংস্কৃতি, পৃ. ১৭-১৮, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৬০)।
সমাজ-ইতিহাসের ‘প্রথম যুগের উদয়-দিগঙ্গনে’ মানুষ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছিল পশু থেকে, শ্রম পদ্ধতির ধীর অথচ সুনিশ্চিত পরিবর্তনের পথ বেয়ে। তার সেই আদিমতম স্তর থেকে বহু সহ¯্র বছরের পথ হেঁটে সে আজকের সুসভ্য আধুনিক মানুষ হয়ে উঠেছে। সেই দীর্ঘ চলার পথের বিভিন্ন পর্যায়ে সে কী করত, কী ভাবত, তা জানার কৌতূহল নিরন্তরভাবেই এ-কালে বেড়ে চলেছে।—— এই খোঁজে বার করার পদ্ধতিতে গবেষক ও তাঁর গবেষণার অন্বিষ্ট আদিম পিতৃপুরুষের মধ্যে বহুকাল ধরে ছিল অপরিচয়ের এক বিরাট ফাঁক।—– কিন্তু আজকের গবেষণায় নতুন নতুন পথের হদিশ মিলছে প্রাগৈতিহাসিক প্রপিতামহেরা কেমনভাবে আধুনিক মানুষের অন্তিত্বের মধ্যে সজীব হয়ে মিশে আছে, সেই যোগসূত্র রচনার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য। ভূ-তত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, শিল্পকলা- এই সমস্ত জ্ঞানবৃত্তের পাশাপাশি পুরাণবৃত্ত-চর্যাও সেই সন্ধানের এক অনিবার্য উপকরণ হয়ে উঠেছে এখন। লোকপুরাণ বা মিথোলজির ঐ-চর্চা আজকের মানুষকে তার পুর্ণায়ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করেছে। সেই অতীতের কথা না বুঝলে, মানুষের সংস্কৃতি হয়ে পড়বে ছিন্নমূল। (ড. পল্লব সেগুপ্ত, পূর্বকথা, লোকপুরাণ ও সংস্কৃতি, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৬০)।
সভ্যতার বিবর্তন একটি সুনির্দিষ্ট স্তর পরম্পরায় সর্বত্রই ঘটেছে বলে প্রথমে লুই হেনরী মর্গ্যান, তারপরে ফ্রিডরিশ্ এঙ্গেলস্ এবং অবশেষে ভি. গর্ডন-চাইলড প্রমাণ করেছেন যেভাবে, তাতে মানুষের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিবর্তনও অনুরূপ একটি পরম্পরাকে অবলম্বন করে ঘটে চলেছে, এমনটিই মেনে নিতে হয়। সভ্যতার বিবর্তন সর্বত্রই সমানভাবে হয়নি, কিন্তু বিবর্তনের ছকটি সর্বত্রই এক: ক. নি¤œস্তরের বন্য পর্যায় (ভাষার উদ্ভব, ফল-মুল সংগ্রহ করে জীবন নির্বাহ করা), খ. মধ্য-স্তরের পর্যায় (আগুনের ব্যবহার আয়ত্তে আনা ও মাছ ধরা), গ. উচ্চ-স্তরের বন্য পর্যায় (তীর ধনুকের ব্যবহার), ঘ. নি¤œ-স্তরের বর্বর পর্যায় (মাটির বাসন-কোসন তৈরী), ঙ. মধ্য-স্তরের বর্বর পর্যায় (পশুপালন ও কৃষির পত্তন), চ. উচ্চ-স্তরের বর্বর পর্যায় (ধাতুর দূব্যবহার শুরু) এবং ছ. সভ্য পর্যায় (ধ্বনি নির্ভর হরফ এবং লেখার সূত্রপাত)। (ড. পল্লব সেগুপ্ত, মূখবন্ধ, লোকপুরাণ ও সংস্কৃতি, পৃ. ২, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৬০)।
একই রকমের সামাজিক বিবর্তন সব সমাজেই কোনো-না-কোনো সময়ে অনিবার্য হয়েছে যেহেতু, তাই পৃথিবীতে বিভিন্ন সমাজেই মিথের অন্তর্লীন চরিত্র এবং বাহিরঙ্গিক প্রকাশও বহু সময়েই এক। তাছাড়া সভ্যতা যত অগ্রসর হয়েছে, ততই এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর, এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতির সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও ঘটেছে বাণিজ্য, যুদ্ধ, মৈত্রী ও বিবাহের সূত্রে। এর ফলে অন্যান্য অনেক কিছুর মতো একের মিথও অন্যের ঐতিহ্যে মিশেছে। (ড. পল্লব সেগুপ্ত, মূখবন্ধ, লোকপুরাণ ও সংস্কৃতি, পৃ. ২, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৬০)। পৃথিবীর বিভিন্ন কৃষ্টির মধ্যে ভাবরূপগত ঐক্য যেমন পুরাণের মাধ্যমে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, তেমনি সংস্কৃতির মেলবন্ধনও পুরাণই ঘটায়। লোকপুরাণ সংস্কৃতির লোকায়ত ও ধ্রুপদি দুটি পরম্পরা সাপেক্ষ ঐতিহ্যের মধ্যে মেলবন্ধন করে। প্রজন্ম পরম্পরা এই পুরাণ লোককথার ঐতিহ্যকে ধারণ করে এগিয়ে চলছে আগামীর পথে, ভাবী প্রজন্মের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ঋদ্ধ করতে। সহজাত বারতায় বেঁচে থাক পুরাণের মতো অনিন্দ্য সাহিত্যধারা আর সমৃদ্ধ হোক আমাদের লোকসাহিত্য।
অমল বড়ুয়া, গবেষক ও প্রাবন্ধিক