জাকিয়া শিমু
আশ্বিন মাসের পড়ন্তবেলায় ঢাকা-মাওয়াগামী লক্কড় ঝক্কর ‘ইছামতী’ নামধারী বাস,- নিমতলা বাসঘাটে এসে খানিকক্ষণের বিরতি নিতে থামে। গালকাটা আব্দুল মতিন কাঁধের ঝোলা ডান হাতে শক্তভাবে চেপে অন্যহাতে বাক্সপেটরা নিয়ে ধীরপায়ে বাস থেকে নেমে আসে।
ঢাকার অদূরের-স্থান হলেও এখানকার বায়ু শহরের মতো ধোঁয়া-ধুলোয় মাখামাখি নয়, বেশ হালকা- গায়ে লাগতে তার বেশ আরামবোধ হল। শীতল বায়ু নীরবে বইছে, শীত আগমনের পূর্বাভাস। বুকপকেটে কুঁচকানো কাগজটায় আরও একবার চোখ রাখলো,গালকাটা আব্দুল মতিন। নীল বলপয়েন্টে অভিজ্ঞ ডা.প্রেসক্রিপশনের আদলে দুর্ভেদ্য-হস্তাক্ষরে ঠিকানা লেখা! সে কাগজের ভাঁজ খোলে সামনের দিকে ঝুকে, চোখ-কপালে যৎসামান্য ভাঁজ ফেলে মনোযোগে পড়ে ঠিকানা উদ্ধারে চেষ্টা চালায়।
বাসঘাট থেকে মাইল দু’য়েক উত্তর দিকে এগুতে পথ তিন ভাগে ভাগ হয়ে সাপের দেহের মতো একে বেঁকে সবুজ মাঠের ভিতর দিয়ে অজানায় গিয়ে ঠেকেছে। হাতের ডান-বাঁ’য়ের পথ রেখে নাক বরাবর আরও মাইলখানেক হেঁটে নজরে পড়বে-প্রাচীন-বয়োঃবৃদ্ধ এক বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়ালে সমুখে দেখা মিলবে- বহুপুরনো প্রাচীর ক্ষয়ে পড়া আধভাঙ্গা-মাথার অতীতকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক-মঠ। মঠ দাঁড়িয়ে আছে সেকেলের এক মজা-দিঘিরপাড় ঘেঁষে।
গালকাটা আব্দুল মতিন এ-পর্যায়ে এসে দম ফুরিয়ে যাওয়া নিঃশ্বাস ফিরে পেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে যতদূর দম থাকে বড়ো করে নিঃশ্বাস টানে। খানিকটা হলেও যেন দম ফিরে পায়। এরপর আবার কাগজে চোখ বুলায়- দিঘিরপাড়ের উত্তরকোনার বাড়িটিই তার গন্তব্য।
গালকাটা আব্দুল মতিনের কাছে গন্তব্যের-ঠিকানা’ অনেকটা স্কুলের শেষ বর্ষের পাটিগণিতের মতো অযথা জটিল কিছু মনে হল! যেন ঠিকানা উদ্ধারে মস্তিষ্কের খোঁদলের নিউরনগুলো কেমন জীবন্ত নড়েচড়ে উঠল! কপালে দুধের সরের মতো কুঁচকানো ভাবটা কাটল তো না-ই, আরও একপ্রস্ত যেন বেড়ে গেল। তারপরও গন্তব্যের সুরাহা করা গেল না। তার প্যান্টের পকেটে যোগাযোগের অমূল্য মাধ্যম একটা ফোন রয়েছে কিন্তু ফোনটা বিশেষ কারণে বন্ধ করে রাখা আছে। সে আবার শুরু থেকে ভাঁজ-কাগজ পড়তে শুরু করল।
একহাতে লেইস ফিতার চৌকোণা ভারি কাচ-কাঠের বাক্স, অপর কাঁধে ঝুলানো গোপন জিনিসপাতিতে ঠাসা সাদা কাপড়ের ঝোলাটা বড্ড যন্ত্রণা ধরিয়ে দেয়। মনে হয় যেন কেউ তার দু’বাহু ধরে বানরের মতো ঝুলে আছে। সে বারকয়েক দু’হাতের জিনিস অদলবদল করে, তারপরও স্বস্তি মেলে না। গালকাটা আব্দুল মতিনের পেটে ভোকও লেগেছে। সকাল সকাল তার খাওরার অভ্যাস নাই। বাসঘাটের দু’পাশে নানানপদের দোকানপাট। খাবারের দোকান চোখে পড়তে ভোকের মাত্রা চৈত্রমাসের রোদের মতো যেন তেতিয়ে উঠে!
অজপাড়াগাঁ, সবেমাত্র পল্লিবিদ্যুতের সুবিধা পেতে শুরু করেছে। পল্লির প্রকৃতদশা এই পল্লিবিদ্যুতে স্পষ্ট ধরা দিয়েছে। দিনেরবেলায় বিজলিবাতি কুপিবাতির আদলে নিভুনিভু জ্বললেও রাতে তারও খোঁজ পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। তারপরও সবার ভাগ্যে তা জুটে না। ‘মায়ের দোয়া’ ভাতের হোটেলের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আধ-নেংটা এক ছোকরা, বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার বাহাদুরি হাঁকিয়ে খদ্দের ডাকাডাকি করছে। যাদের দোকানে পল্লি বিদ্যুতের নামকাওয়াস্তে ফ্যান-বাতি ঝুলছে তাদের বেচাবিক্রি একটু বেশিই বাড়তি মনে হল। আব্দুল মতিন হোটেলের নিকটে এসে হাতে-কাঁধে ভারী বোঝার ভারে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভারী বোচকার টানে শীতের সকালে দূর্বাঘাসের ডগায় যেমন ফোঁটায় ফোঁটায় শিশির জমে থাকে তার আদলে সারা শরীরে ঘাম জমে উঠেছে। বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়া যদি একটু কপালে জোটে সে-ভরসায় সে ‘মায়ের দোয়া’ নামের ভাতের হোটেলে ঢুকে পড়ে। হোটেলে ঢুকতে তার মনটা নেতিয়ে পড়া ফুলের মতো মিইয়ে যায়, অসহায় চোখে মাথার উপর ঝুলে থাকা অনড়-স্থির ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদিকে হোটেলের দরজার সাথে লাগোয়া খদ্দেরদের হাত ধোয়ার সুব্যবস্থা যদিও বা রয়েছে। বাধ্যগতের মতো হাত পরিষ্কার করতে আব্দুল মতিন এগিয়ে যেতে- দেয়ালজুড়া আয়নায় নিজের ছদ্মবেশী প্রতিবিম্ব দেখে সহসা কেমন আনমনা হয়ে উঠে !
ছিপছিপে গড়নের বারমাস্যা অম্বলরোগী গালকাটা আব্দুল মতিনের পক্ষে ভারী বাক্সপেটারা নিয়ে হেঁটে এতখানি পথ পেরোনো চাট্টিখানি কথা নয়। তাও সোজাসাপটা পথ হলে কথা ছিল। এবড়ো-থেবড়ো, ভাঙাচোরা, খানাখন্দকে- বন্ধুর মেটোপথ। সবে বর্ষাকাল গত হয়েছে। রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে বর্ষাকালের জমাপানির গর্ত শুকিয়ে মাটি শক্ত পাথর হয়ে আছে। হাঁটতে গেলে খালি পায়ে আঘাত লাগে।
তারপরও পথের দু’ধারের দৃশ্যপটে চোখ রাখতে সমস্ত ধকল যেন পুষিয়ে নেওয়া গেল অনায়াসে। একপাশে নদী অন্যপাশটায় দিগন্তছোঁয়া খোলা মাঠ। মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে পটে আঁকা ছবির মতো বসত বাড়িঘর। পথের দু’ধারের ঢোলকলমির ঝোপ। ঝোপের ফাঁকফোঁকরে নানান পদের নাম অজানা গাছগাছড়া-বনফুলে ঠাসা। ঘন কালচে সবুজে কলমির এলানো ডালধরে বাঁদরঝোলা হয়ে ঝুলে আছে সতেজ সাদা-বেগুনি কলমির ফুল। ওদিকটায় চোখ পড়তে গালকাটা আব্দুল মতিনের মনটা প্রচ্ছন্নতায় ভরে উঠে। ঢোল কলমির শরীর জুড়ে সোনালি আঁকশিলতা জড়াজড়ি করে ধরে আছে মায়ের আঁচলে যেরূপে আটকে থাকে অবুঝ সন্তান, সেরূপে। সেদৃশ্য দেখে মনে পড়ে যায় মৃত-মায়ের মুখখানা, তার শৈশবকাল- তাদের দখিনের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা কুলবরই গাছটার কথা। কণ্টকযুক্ত গাছটার শাখা-পাতায় জড়িয়ে থাকত গুচ্ছ গুচ্ছ স্বর্ণলতা। স্বর্ণলতায় দেহ মুড়িয়ে বন্ধুরা দিনভর ছুটে বেড়াত মাঠে- ঘাটে, বনবাদাড়ে কিংবা ঘাঘট নদীরপাড়ে। সেইসবের কিছুই আজ আর নেই- শৈশব, মা কিংবা কুলবরই গাছটা! নদীটাও মরে গেছে! শুধু ধূসর স্মৃতিরা মাথার খোলের ভিতরে নীরবে লুকিয়ে আছে। সময়ে- অসময়ে বেরিয়ে এসে মনোঃকষ্টের জোগান দেয়।
কোন কারণে,কে জানে! এতক্ষণের মাথায় বাজ-পড়া ধরনার সমস্যাটা তার মাথা থেকে সহসাই উড়ে চলে গেছে। যেন এমন পথে সারাজীবন হেঁটে পার করা যায়। শরীরে ঘাম ঝরছে, গন্তব্যের ঠিকানার সুরাহা হয় নাই তারপরও সে হেঁটে চলে সামনের দিকে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে ফেরিওয়ালা রিকসায় চড়ে সদাইপাতি বিক্রি করে না। তাতে গাঁয়ের সহজসরল লোকও সন্দেহ করবে। হেলাল বেপারির সাথে সে নিজে বুদ্ধিতে এ পথ বাতলেছে। গালকাটা আব্দুল মতিন কাঁচা কাজ করে না। কাজে বিন্দুমাত্র ফাঁক-ফোকর সে রাখে না। সে অতিমাত্রায় ধুরন্ধর এবং চতুর। তার অবয়বেও তা প্রকাশ পায়। দাড়িগোঁফে জঞ্জাল মুখখানায় গাম্ভীর্যের কঠিন আচ্ছাদন। লালচে কমলারঙের চোখজোড়ায় দৃষ্টিপড়লে রাজ্যের আতঙ্ক এসে ভর করে মনে। ঘনঘন কাজ সে করে না তবে যে কাজটা সে হাতে নেয় সেটা বেশ চতুরতার সাথে এবং নাটকীয়ভাবে করে। নিজে ইচ্ছেমতো নাটক সাজিয়ে সুনিপুণ অভিনয় অবলীলায় করে যায়। এঅবধি জাঁদরেল পুলিশ-দারোগাও তার কাজের হদিস খোঁজ পায়নি। হেলাল বেপারি বহু চেষ্টা তদবিরের পরে তাকে পেয়েছে। এসব কাজে নির্ভরতার অভাব হলে কঠিন ঝামেলায় পড়তে হয়। কাজেই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে পাকাদস্তুর ফেরিওয়ালা’র পাঠ করে যেতে হবে। চুক্তির অর্ধেক টাকা তার পকেটে জমা হয়ে আছে, বাকিটা কাজ শেষে পাওয়া যাবে। এতসবের পর হাত গুটিয়ে নেওয়া যায় না।
হেলাল বেপারীর ক্রিয়াকলাপ বেশিজলের জলজ প্রাণীর মতো। তার খুব কাছের মানুষও তার গতিবিধি বুঝতে পারে না। সারাদিন ঘুরেফিরে, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। সে অবশ্য তার এহেন ভবঘুরে স্বভাবচরিতের দায়, বেশ গর্বভরে তার বংশের পূর্বপুরুষের ওপর চাপিয়ে দেয়। পূর্বপুরুষ এই ঘরনার ছিল বলেই তার চরিত্রে এইস্বভাব রয়ে গেছে। এটা দোষ কিংবা গুণ যাই হউক তা-সে নিজের নয়, বংশধারা থেকে এসেছে।
হেলাল বেপারীর যুক্তি অবশ্য একবাক্যে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতোও নয়। বংশপরম্পরায় এমন আমলও বেশ রয়ে গেছে। তার বড়দাদা, একদিন বলা নাই কওয়া নাই একতারা হাতে সেই যে গানের দলের সাথে দেশ ছাড়লেন আর কখনো বাড়ি ফিরলেন না। বাকি জীবনে কেউ তার হদিস পেল না।
হালের ছোট চাচা, সেও একই কাজ করল। বয়েস ষাট পেরিয়ে গেছে তাও বছর দুই হলো। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যাত্রাদলের সাথে দেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি ঘুরে বেড়িয়েছেন। গান-বাজনা জীবনের ব্রত করেছেন। একটা সময়ে এদেশে যাত্রাপালার সুসময় ছিলো,দাপটও ছিল। গাঁয়ে-গঞ্জে অহরহ যাত্রাপালা হত। ছোট চাচার গা-গতর অনেকটা প্রাচীন মিশর দেশের রাজাদের মতো ছিল। শরীরের গঠন সুপারিগাছের মতো লম্বা-পাতলা মেদশূন্য। চোখ-নাক খাড়াখাড়া। কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো একগুচ্ছ ঝাঁকড়াচুল কাঁধ অবধি এসে ঝুলে আছে। গলার স্বরে গাম্ভীর্যের কমতি নেই। পুরোদস্তুর নায়কের প্রতিচ্ছবি। দুর্দান্তভাবে যাত্রাপালায় নায়কের পার্ট করে গেছেন যুগের পর যুগ। মাঝে মধ্যে বছর ঘুরতে একবার বাড়ি এসে ঘুরে যেতেন বটে কিন্তু ঘর সংসার তাকে কখনো বাঁধতে পারে নাই।
শেষমেশ গত প্রায় বছরপাঁচেক হয় ছোট চাচা বাড়িতে পাকাপোক্তভাবে ফিরে এসেছেন। যাত্রাপালার সেই সুদিন আর নেই। এখন দেশেরমানুষ যাত্রাপালায় আকৃষ্ট হতে পারছে না। নানানপদের সস্তা বিনোদনের বিপরীতে যাত্রাপালার মতো ঐতিহ্যবাহী বিনোদন অতীত ইতিহাসের অংশ হয়ে ইতিহাসের বইয়ে জায়গা করে নিয়েছে। বলতে গেলে খুব দ্রুত প্রেক্ষাপট, পাল্টে গেল। ছোট চাচা আফসোস করে প্রায়ই একটা কথা বলেন- ‘নতুনপ্রজন্ম জানবেও না যাত্রাপালা’ নামক একপ্রকার বিনোদনে এককালে তার পূর্বপুরুষগণ আনন্দ-উৎসবে ডুবে ছিল’। তিনি কথা সত্য বলেছেন।
যাহোক এবার ছোট চাচার বর্তমান অবস্থার দিকে ফেরা যাক। ছোটচাচা যখন বাড়ি-ছাড়েন তখনকার বাড়ির চিত্র এখনকার মতো ছিল না বলাবাহুল্য। দাদা-দাদি, চাচা-ফুফু এবং তার নিজের মা-বাবা ভাইবোন তো ছিলই আশেপাশের পড়শিদের সাথেও সেকালে নিজপরিবারের মতো অতিশয় ঘন- সম্পর্ক থাকত। যাত্রাপালা’র মতো এখানেও ঢের পরিবর্তন এসেছে। তার এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির সময়ের মাঝে একেএকে প্রায় সবাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। হেলাল বেপারির বাবা-মাও বেঁচে নেই। বাবার পক্ষের একমাত্র ছোট চাচা ছাড়া হেলাল বেপারীর ধরাধামে আর কেউ নেই। মানুষগুলো না থাকলেও তাদের বিষয়-সম্পদ ওয়ারিশ মাফিক ভাগ-বাটোয়ার হয়েছে। চাচার অংশও রয়েছে। চাচা অবশ্য ফিরে এসে হেলাল বেপারীর সংসারে সাদরে যুক্ত হয়েছেন।
হেলাল বেপারীর বাবার কর্কট রোগ ছিল। নিশ্চিত মৃত্যুরোগ। এ রোগে মানুষটা যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিষয়-সম্পত্তি নিঃশেষ করে পরিবারকে পথে বসিয়ে তবেই সে চলে যায়। তদ্রুপ তার বাবাও চিকিৎসায় নিজের অংশের জমিজিরত প্রায় সব-ই খুইয়ে গেছেন। হেলাল বেপারির নিজের বলতে কিছুই নেই। ভোগ-দখলে যা-কিছু আছে এসবই ছোট চাচার। চাচা যখন ফিরে এল তখন তার মধ্যে সম্পদ হারানোর একটা ভয় ছিল। কিন্তু আজ অবধি ছোট চাচা তার বিষয়আশয় স্বেচ্ছায় বুঝে নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি এমনকি কখনও তার সম্পদের হিসেবটা পর্যন্ত জানতে চাননি। জীবনভর এসব দূরে সরিয়ে গানবাজনা নিয়েই পড়ে থেকেছেন। সে অভ্যাস এখনো থেকে গেছে। নিজের মনে গানবাজনা করেন, ঘুরে বেড়ান, মন চাইলে বাড়ি ফিরেন নয়তো ফেরেন না। এতদিন সবকিছু ঠিকঠাক এমনভাবেই চলছিল।
কিন্তু গতবছর হুট করে ছোট চাচা এক হুলস্থুল কা- বাঁধিয়ে বসল। শুধু হেলাল বেপারী নয় গাঁয়ের সকলে তার এই কা-ে থ মেরে গেল। বাড়িতে চাচার যাত্রাদলের এক পুরনো বন্ধু বেড়াতে আসে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রায়ই চাচার বন্ধুবান্ধব বেড়াতে আসে, একত্রে তারা গানবাজনা করে, মনের আনন্দে ঘুরেফিরে আবার চলেও যায়। চাচাও হরহামেশা এমনভাবে বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া-আসা করেন। তো চাচা একসময় বন্ধুর সাথে বন্ধুরবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এরপর মাস ঘুরে মাস আসে কিন্তু চাচা ফিরে আসেন না। বাড়ির কেউ বন্ধুর ঠিকানা জানত না তাই চাচার খোঁজ করা হয়ে উঠে না। প্রথম প্রথম বাড়ির সবার মধ্যে তাকে নিয়ে উৎকণ্ঠা কাজ করলেও একসময় তা অভ্যস্ততায় পরিণত হয়।
প্রায় পাঁচমাস পর আশ্বিন মাসের ভর সন্ধ্যেবেলায় হেলাল বেপারী দাওয়ায় বসে আছে। হাতে আকিজ বিড়ির প্যাকেট, বুকপকেট থেকে আনমনে ম্যাচের বাক্স বের করে আনেন। রাতের খাওয়ার পর নিরালায় বসে আয়েশ করে একখানা বিড়িতে সুখটান দেওয়া তার বহুকালের অভ্যাস। তো রাত বাড়তে রাতের গায়ে আঁধারের প্রলেপ বেশ গাঢ় হয়ে পড়তে শুরু করে। বাড়ির উত্তর সীমানাঘেঁষা ঝোপজঙ্গল হতে দলে দলে জুনি-পোকারা বেরিয়ে আসে। অন্ধকার গাঢ় হতে এদের আনন্দ যেন আর ধরে না। দলবেঁধে হাওয়ায় উড়ে উড়ে বেড়ায়। রাত যত বাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার গলার আওয়াজ সমান তালে বাড়ে। বাড়ির সম্মুখের কদম গাছটায় বাদুর ঝুলে আছে। ওরা কালো চকচকে চোখে হেলাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে থাকে। হেলাল বেপারী সারাদিন উঁচিয়ে থাকে রাতের এসব নিখুঁত সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
হেলাল বেপারী আয়েশি মেজাজে বিড়ি ধরায়। মনের সুখে বিড়িতে লম্বা একটা টান দেয়। মুখ থেকে একদলা অশুদ্ধ-ধোঁয়া, আশ্বিনী হালকা কুয়াশা-ভরা হাওয়ার সাথে মিলেমিশে একাকার হতে, অন্ধকার রাতের মুগ্ধতায় অমাবস্যার চাঁদের মতো সেও ডুবে যায়। এমন সময়ে তার খুব নিকটে দাঁড়ানো দু’জন মানুষের ফিসফাস আওয়াজে তার ধ্যান ভাঙ্গে। বিড়ির আগায় জমে থাকা আগুনের ফুলকি আর জুনিপোকার মৃদু আলো ছাড়া চারপাশে কোনো আলো নেই।
হেলাল বেপারী আচমকা উঠে দাঁড়ায় কিন্তু তাদের ঠাহর করতে পারে না। একসময় ছোট চাচা নিজের উপস্থিতি জানাতে মৃদু-শব্দে কাশি দেওয়ার ভান করলে, হেলাল বেপারী চাচাকে ফিরে পেয়ে খুশিতে তাকে জাপটে ধরে। চাচা অবশেষে ফিরে এসেছেন, তবে, তিনি একা নন। নিজের বয়সের অর্ধেক-বয়সী এক কন্যা তার সাথে। কন্যা, লাল বেনারসির ভেতর জড়োসড়ো হয়ে ছোট চাচার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চাচা স্বভাবতই এহেন কর্মে অনভ্যস্ত। সেও বউর সাথে লজ্জাবনত চোখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
হুট করে এমন অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে হেলাল বেপারী প্রচ- হতাশ হয়ে পড়ে। তার কপালে মিহি ঘাম জমে উঠে। মুখ ছেয়ে যায় ঘুটঘুটে আঁধারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, তার মাথায় বুঝি ঝুরঝুর করে আস্তআকাশটা ভেঙেচুড়ে আছড়ে পড়ল। চাচির বয়েস অল্প, তা সে যদ্দূর ঘোমটার আড়াল থেকে দেখতে পেয়েছে তাতে বয়স আন্দাজ করতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। তার নিজ-বউয়ের চেয়েও বয়সে কম করে হলেও বছর দশকের ছোট হবে, তা সে নিশ্চিত। ভবিষ্যৎ ভাবনায় হেলাল বেপারী চূড়া-ভেঙে পড়া পাহাড়ের মতো ভগ্ন-হৃদয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
নির্ঘুম রাতশেষে ভোরসকালে মৃদু অন্ধকারে হেলাল বেপারীকে দাওয়ায় পরে বাঁশেরমোড়া পেতে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায়। মাথার উপর তার বিশাল চিন্তার-বোঝা চেপে বসে আছে স্বভাবতই ঘুম তার চোখ থেকে উবে গেছে। অবশ্য হেলাল বেপারীর ভাবনাচিন্তা মোটেও অবান্তর ছিল না। চাচির শরীরজুড়ে গর্ভধারণের পরিস্ফুট ছাপ-চিহ্ন বাড়ির সবার নজরে পড়ে। হেলাল বেপারীর চোখের কোণায় ছায়াছবির দৃশ্যের মতো তার নিজের ভবিষ্যতের করুণ পরিণতি একের পর এক ভেসে উঠছে। আশ্বিনের ভোরবেলাকার হাওয়ায় শীতের আমেজ বেশ সরবর হলেও দুশ্চিন্তায় হেলাল বেপারী ঘেমে উঠে। এতকাল চাচার বিষয়সম্পদ নিজের ভেবে হাঁটুভাঁজে বসে-বসে খেয়েছে। চাচা অবধারিতভাবে সম্পদ ফিরিয়ে নেবেন, কারণ তার নিজের একটা সংসার হয়েছে। কিন্তু তার নিজের সংসারের কী হবে!
ভবিষ্যতের ভাবনায় সে অতিশয় অস্থির-দিশাহারা হয়ে উঠে। রাতে ঘুমাতে পারে না। দিনের বেলায় চুপচাপ বসে ঝিমোয়। সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া হয়ে দিনরাত ভাবনায় ডুবে থাকে। কিন্তু কোনো পথই তার ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার সুরাহা দিতে পারে না। এরইমাঝে একদিন হুট করে বহুদিন আগের এক ঘটনা মনে পড়ে যায়।
চৈত্রমাসের ফকফকা এক চাঁদনীরাতে- হেলাল বেপারী পাশেরগাঁয়ে বন্ধুর এক পরিচিতের বাড়ি বেড়াতে যায়। পরিচিত শহুরে-মানুষ, মাঝেমধ্যে গ্রামেরবাড়িতে আসে। বিশাল জমিদার বাড়ি। একসময়ে তার দাদা নামেমাত্র টাকায় দলিলপত্র নিজের নামে করিয়ে নিয়েছিল। পৈতৃকসূত্রে বিশাল সেই সম্পদের মালিক এখন সেই লোক। ভোগদখল ঠিকঠাক রাখতে মাঝেমধ্যে সে আশপাশের অকর্মা ছেলেপুলেদের ডেকে নিয়ে আমুদ-ফুর্তির সুযোগ করে দেয়।
শহরের নানান বর্ণের নানার স্বাদের পানীয়ের স্বাদ হেলাল বেপারী প্রথম সেই বাড়িতে পায়। তার অবশ্য আগে থেকেই দেশিয় নেশা-ভাংয়ের এক-আধটু অভ্যাস ছিল। এরমধ্যে এমন আস্কারা পেয়ে সে বেজায় খুশি হয়। তারপর থেকে সে নিয়মিত সেই লোকের আঁখড়ায় যেত। একসময়ে ঘনঘন যাতায়াতের সুবাদে সেই লোকের সাথে তার বেশ সখ্যতা তৈরি হয়। একদিন কি-মনে করে কে জানে, মাতাল অবস্থায় সে গালকাটা আব্দুল মতিনের খোঁজ, হেলাল বেপারীকে দেয়। সেদিন তার কাছে গালকাটা আব্দুল মতিনের ঠিকানা অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও আজকের পরিস্থিতিতে তার কাছে এই একটিমাত্র পথকেই যথোপযুক্ত মনে হল। এবং তিনি এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে গালকাটা মতিনকে ভাড়া করে আনতে মনস্থির করলেন।
হেলাল বেপারীর বাহির বাড়িতে দাদাকালানের একখানা আধভাঙা-পলেস্তারা খোয়া বাংলাঘর। বাড়ির অতীত আভিজাত্য ধরে রাখতে কোনোমতে আজও কোমরভাঙা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে-আমলে অবশ্য অবস্থাপন্ন প্রায় সববাড়িতে মূলবাড়ির বাইরের অংশে বাংলাঘর থাকার প্রচলন ছিল। মূল ঘরের চেয়ে বাংলাঘরের গঠনশৈলী উন্নত করা হত। আগেরদিনে উন্নাকালে এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম ছিল পায়ে হাঁটাপথ। বহুপথ হেঁটে এসে পথিক ক্লান্ত হয়ে এসব বাড়ির বাংলাঘরে বিশ্রাম নিত। তাদের আপন মেহমানের মতো সন্মান এবং খাদিমদারি করা হত। দূরদেশের পথিক নির্ভয়ে বাংলাঘরে গৃহস্থের আপ্যায়নে রাত কাটাত। হেলাল বেপারীর বাড়ি সে-প্রথা আজও রয়ে গেছে। যদিও এখন প্রকৃত পথিকের দেখা মেলা ভার। শহরের মতো গ্রামাঞ্চলেও মানুষ পায়েহাঁটার অভ্যাস ভুলে গেছে। তারপরও হকার, ফকির ধরনের লোক প্রায়ই তাদের বাংলাঘরে রাত কাটায়। হেলাল বেপারি কৌশলী লোক। গালকাটা মতিনকে সে হকার সাজিয়ে তার বাড়িতে ঢোকানোর ব্যবস্থা করে রেখেছে।
ওদিকে গালকাটা আব্দুল মতিনের মূল অভিনয় শুরু হয়ে যায়। ঠিকানা মোতাবেক সে হেলাল বেপারীর বাড়ি পৌঁছে যায় এবং তা দিনের আলো থাকতেই। সারাদিনের বিক্রিবাট্টায় মেহনত করে অতিশয় ক্লান্ত হয়ে হেলাল বেপারীর বাড়ি ঢোকে। বাংলাঘরের খোলা বারান্দায় কাঁধের ঝোলায় শিথান পেতে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়ে। এটা অবশ্য অভিনয় নয়, সে আসলেই ক্লান্ত। এতদূরের পথ পদব্রজে তারওপর হাতে-কাঁধে অনভ্যস্ত বোঝার ঝক্কি শরীরটাকে কাহিল করে দিয়েছে। ঘর্মাক্ত দেহে বারান্দার পাকামেঝের শীতলভাব শরীরটাতে কেমন আরাম-স্রোত বয়ে যায়। আরামে গালকাটা আব্দুল মতিনের চোখ বুজে আসে। এবং সে খুব আল্প সময়ে সত্যি সত্যি ঘুমিয়েও পড়ে।
ছোট চাচা শেষবেলায় গোসল সেরে বাহির বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনকার অভ্যাসমতো ভেজা গামছা নিংড়ানো জল পায়ে ঢালতে ঢালতে চোখে রাখে, বাংলা ঘরের বারান্দায়। তিনি আব্দুল মতিনকে গা-হাতপা ছড়ায়-ছিটায়ে পড়ে থাকতে দেখেন। ছোটচাচা-ই সচরাচর এসব পথিকের দেখাশুনা করেন। তিনি অভ্যাসমতো পথিকের যত্নআত্তিতে তৎপর হয়ে পড়েন। হেলাল বেপারী অন্দরবাড়িতে ছিল। সে বেরিয়ে এসে ছোট চাচার এহেন কাজকারবার নিয়ে বরাবরের মতো বিরক্ত হওয়ার ভান করে। সে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে চড়া গলায় বলতে শুরু করে- ‘অচিন মানুষ, এত যত্ন-আত্তি করতে নাই। দিনকাল ভালো না! সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে যাবে’ ছোটচাচার কানে এসব কথা ঢুকলেও বরাবরের মতো তাতে সে তেমন পাত্তা দেয় না।
ওদিকে ছোট চাচাকে দেখামাত্র গালকাটা আব্দুল মতিন এক ঝটকায় শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। পথিকের এহেন আচরণে ছোট চাচা যার পরানই ভড়কে যান। অবশ্য দ্রুত আব্দুল মতিন নিজেকে শান্ত করে আবার তার অভিনয়ের খোলসে ফেরত যান।
ঘটনাকাল প্রায় কুড়ি বছর পেছনকার। আব্দুল মতিনের বাবা একদিন বিয়ানবেলায় দাওয়ার পরে শীতলপাটি বিছিয়ে সবার সাথে নাস্তা খেতে বসেছেন। প্রতিদিন যেমন বসেন। আব্দুল মতিনের বয়স তখন দশ বারো হবে হয়তো। সেও বাবার সাথে বসা ছিল। সহসা বাবা মাটির পড়ে ঢুলে পড়লেন। এবং ঢুলে পড়ার সাথে সাথেই তিনি নাই হয়ে গেলেন। চোখের পলকে ঘটে গেল এমনতরো ঘটনা। লোকে বলল, সন্ন্যাস রোগ, এ রোগে ডা-বোদ্দি ডাকার সুযোগ হয় না। বাবার মৃত্যুর পর অল্পবয়সের পিঠাপিঠি চার ভাইবোন নিয়ে তার মা পড়লেন মহা মুছিবতে।
ছোট চাচা সেসময়ে তাদের অঞ্চলে বেশ দাপটের সাথে যাত্রাদলে নায়কের পার্ট করে বেড়ান। গালকাটা আব্দুল মতিনের বাবাও সে-পালায় ছোটখাটো এক চরিত্রের পাঠ করত। নাস্তা সেরে ছোটচাচার সাথে একত্রে বাবার সেই পালায় যাওয়ার কথা ছিল। সেসূত্রে ছোটচাচার সাথে তাদের বাড়ির একটা সম্পর্ক ছিল। তার বাবা ছিলেন ভবঘুরে। ঠিকঠাক মতো পরিবারকে দু’বেলা ভাতের জোগান দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মা, ছুটাছাটা কাজ করে বাবার সাথে সংসারের হাল ধরেছিলেন। বাবা চলে যাওয়ায় মায়ের-সংসার অবধারিতভাবে পড়ল চরম দুঃসময়ে।
সেসময়ে মায়ের পাশে আপন মায়ের পেটের ভাইয়ের ভূমিয়ায় ছোট চাচা এসে দাঁড়ালেন। প্রায় চারপাঁচ মাস তিনি অত্র এলাকায় ছিলেন। বাবার ভূমিকা পুরোটাই সে একহাতে করেছেন। এবং এরপর সে তাদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পরও বহুকাল পোস্ট অফিসে মায়ের-নামে টাকা পাঠাতেন। লোকটা মানুষ না, সাক্ষাত ফেরেশতা। গালকাটা আব্দুল মতিনের ছোট্টবেলার সেসব স্মৃতিতে ছোটচাচার মুখটা আজও শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করে দ্যুুতি ছড়াচ্ছে। মানুষটা দেখতে সেই আগের মতোই রয়ে গেছেন। ভালো মানুষের শরীরের গঠন সহজে নষ্ট হয় না। মন্দ লোকের চেহারা দ্রুত ভেঙে চূড়ে খাটাশের মতো রূপ নেয়। তার নিজের চেহারা আয়নায় দেখলে তার নিজের কাছেই বড় অচেনা ঠেকে। হেলাল বেপারীর সাথে চুক্তি মোতাবেক আজ রাতে গালকাটা আব্দুল মতিন নিজহাতে ছোট চাচাকে খুন করবে।
নিশুতি অমাবস্যার রাত। চারপাশ কালো আঁধারের ঘন প্রলেপে ডুবে আছে। ঝোপঝাড় থেকে দলে দলে জুনিপোকা বেরিয়ে আসছে এবং টিমটিম আলো জ্বেলে এদিক-ওদিক অকারণ ছোটাছুটি করছে। দূরের বনজঙ্গল থেকে রাতজাগা পাখির ভয়ধরানো কাঁপাকাঁপা কণ্ঠের আওয়াজ কানে ভেসে আসে। গাঁয়ের গোরস্থান থেকে শিয়াল খাটাশ ক্ষণে ক্ষণে ডেকে উঠে রাতের প্রহরের জানান দেয়। বাংলা ঘরের দুয়ারে বাড়ির সীমানা ঘেঁষা ঝাঁকড়া-মাথায় নির্ভীক দাঁড়িয়ে থাকা কদম গাছটায় বাদুড় ঝুলে আছে। আব্দুল মতিন ধীরপায়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। বাদুড়ের চোখে চোখ পড়তে কেমন যেন একটা ভয়ের স্রোত পুরো-দেহটাকে অসাড় করে দেয়। চোখগুলো মানুষের চোখের মনির মতো কুচকুচে কালো। এরআগে বাদুড় এত সামনে থেকে দেখা হয় নাই। রাতের এতসব নিস্তব্ধ রহস্যময়তার মাঝে, নিজেকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলে গালকাটা আব্দুল মতিন। আদতে আজ পূর্ণিমার তিথি,কৃষ্ণপক্ষ নয়। সে নিরবচ্ছিন্ন ভাবনার-ঘোরে পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এরপর শান দেওয়া ছুরিটা হাতে নিয়ে সে নদীর পাড়ের দিকে ধীরে সুস্থে এগিয়ে যায়।
হেলাল বেপারী পূর্ব পরিকল্পনা মতো ছোট চাচাকে চোখমুখ বেঁধে নদীর পাড়ে কাশবনের ঝোপে এনে দাঁড় করায়। এসময় ছোটচাচার বন্ধ-গলা দিয়ে অনবরত বিরবির আওয়াজ বেরিয়ে আসে। তার কপালে সারিসারি ভাঁজের রেখা অতিশয় স্পষ্ট হয়ে জেগে উঠেছে। শেষরাতে ছোটচাচার বাহ্যে করার অভ্যাস আছে। সেসময়ে কৌশলে হেলাল বেপারী তাকে বাড়ির শেষপ্রান্তে ডেকে নিয়ে আসে। এবং হুট করে চোখ-মুখ গামছা দিয়ে শক্ত আঁটে বেঁধে ফেলে। টেনেহিঁচড়ে নদীর দিকে নিয়ে আসে। ছোট চাচা এখনো কিছু আঁচ করতে পারছে না। সে অবাক হয়ে হেলাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করছে।
গালকাটা আব্দুল মতিন জায়গা মতো এখনো এসে পৌঁছেনি। হেলাল বেপারী অপেক্ষা করে। অপেক্ষার সময় বড়ো দীর্ঘ হয়। হেলাল বেপারী ঘেমে উঠেছে।
এ সময়ে গালকাটা আব্দুল মতিন ধীরপায়ে নদীর তীরে এসে দাঁড়ায়। মৃদু ঢেউয়ের শান্ত-নদী রাতের মতো ঢিলেঢালা শব্দে বয়ে চলেছে। নদীর দু’কূল জুড়ে রাজহংসের পালকের মতো ধবধবে সাদা কাশফুল হালকা হাওয়ায় তিরতির করে দুলছে। আকাশ থেকে রূপালীধারায় চন্দ্রকিরণ ঝর ঝরিয়ে ঝরে পড়ছে, ফকফকে জ্যোৎস্নাস্রোতে ভেসে চলেছে বিশ্বচরাচর, জগৎসংসার। গালকাটা আব্দুল মতিন উদাস হয়ে উঠে। সহসা তার হাতেধরা ধারালো ড্যাগার ছুরিটা প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে যায়! এরপর ভোর সকালে কাশবনে কে বা কারা বাহ্যে সারতে গেলে, হেলাল বেপারির পেটকাটা-মড়া পড়ে থাকতে দেখে। এবং নদীর অদূরে শিমুলগাছের তলা থেকে ছোট চাচাকে হাত-মুখ বাঁধা কিন্তু অক্ষত অবস্থায়।
জাকিয়া শিমু, গল্পকার