নুসরাত সুলতানা:
ফিরোজ শেখ সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্ত্রীকে তাড়া দেয় আমার বাজান রে আধাসের দুধ, দুইটা ডিম, নরম করে দুইটা রুটি আর সরবি কলা দিছনি শামীমের মা? ফরিদা বেগম হাসিমুখে বলে, হ, দিছি। সবই আপনের বাজানে খাইলে তো! নামাজের পাটি থেকে ফিরোজের মা বলে ওঠেন, জুয়ান বয়সে যাত্রাপালা বন্ধু-বান্ধব আর সিনেমা বায়োস্কোপ কইরা কইরা প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে বিয়া কইরা এখন পোলা লইয়া আর সোহাগ ধরে না। আরে মার দিকেও একটু দেখ। ফিরোজ গিয়ে ষাটোর্ধ্ব মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে, তুমি, শামীম আর ফরিদাই আমার সুখ-শান্তি। বাজান হার্টের অসুখে অকালে আমাগো ছাইড়া চইলা গেল।
আকলিমা বেগমের বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। কতটুকুইবা পেয়েছেন তিনি স্বামী নামক মানুষটাকে? সতীন আর সতীনের দুই মেয়ে থাকতেই তিনি সংসারে এসেছেন। সতীনের আর বাচ্চা হচ্ছিল না। শ্বশুরের একশত বিঘা জমির উত্তরাধিকার দরকার।
শ্বশুর-শাশুড়ি তাই নিয়ে আসেন শ্যামবর্ণ, বড় চোখ, কোমর অব্দি একহারা চুল আর শক্ত শারীরিক গঠনের আকলিমা বেগমকে। ফিরোজের জন্মের পর জন্মেছিল আরও একটি পুত্রসন্তান কিন্তু দুই বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় মারা যায়। দুই পুত্রসন্তানের জন্ম দেওয়ার সুবাদে শ্বশুর-শাশুড়ি আকলিমা বেগমকে ভালোই বাসতেন। আকলিমা বেগমের বাবার বাড়ির অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল না কিন্তু তার সতীন ছিলেন ফর্সা, সুন্দরী আর সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে। তাই সতীনের বাপের বাড়ি থেকে সবসময় টাকা-পয়সা উপঢৌকন দিয়ে স্বামীর মন সতীনের দিকেই ফিরিয়ে রাখতেন।
সতীন মারা যাওয়ার পর বুড়ো বয়সে হলেও স্বামীর যতœআত্তি পেতে শুরু করেছিলেন আকলিমা বেগম। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক করে সতীনের মৃত্যুর বছর দেড়েকের মাথায়ই স্বামীও ইহকাল ত্যাগ করেন। এখন শ্বশুরের নব্বই বিঘা জমির ভেতরে সতীনের দুই মেয়েকে দেওয়ার পরও পুত্র ফিরোজের ভাগে প্রায় পঞ্চাশ বিঘা জমি আছে। আর ফিরোজের একমাত্র ছেলে শামীম সেই সম্পদের উত্তরাধিকারী। সেই কারণে শামীমের কদর ফিরোজ শেখ, আকলিমা বেগম আর ফরিদার কাছে আকাশতুল্য।
ফরিদা বেগম খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে স্বভাবের। মাছ কড়া করে ভাজা, মাংস প্রচুর তেল-মশলা ছাড়া একদম মুখে রোচে না। বাড়িতে আজ অপূর্ব স্বাদের সব খাবার রান্না হয়েছে। বেড়াতে এসেছেন ফরিদা বেগমের ছোট ভাই শাহেদ। শাহেদ খুলনা শহরে একটা একটা অফিসে কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি করে। শাহেদের দুই মেয়ে। শাহেদ শামীমকে বলে জামাই। ফরিদা বেগমও মুখ টিপে হাসে। শাহেদের আপ্যায়নে রান্না হয়েছে বাগদা চিংড়ির কোরমা, দেশি মুরগি, বড়মাছ, গরুর মাংস, পায়েস, নারিকেল পুলি ইত্যাদি ইত্যাদি।
শামীমের শারীরিক গঠন কিছুটা দুর্বল। লম্বা হয়েছে বেশ ভালোই। এখন সে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। কিন্তু গায়ে গতরে একেবারেই গোশত লাগেনি। এই নিয়ে আকলিমা বেগম আর ফিরোজের আফসোস খুব। ফরিদা বেগম বলে, বয়স হলে এমনিই স্বাস্থ্য হবে, আশ্বস্ত হন আকলিমা বেগম। কারণ বিয়ের পরেই ফিরোজের শরীর স্বাস্থ্য ফিরেছে।
ফরিদা বেগমের মৃদুভাষী স্বভাবের কারণে পছন্দ করেন সবাই। এমনকি দুই ননদও বয়সে বড় এবং স্বামীর বড়বোন হওয়া সত্ত্বেও তাকে ভাবি বলে ডাকেন। সবাই খুব দুশ্চিন্তাগস্ত হয়ে পড়েছে ফরিদাকে নিয়ে। ইদানীং প্রায়ই জ্বর আসে ফরিদার গায়ে, র্যাশও দেখা যায়। প্রায়ই বমি আসে খাওয়া-দাওয়া ও করে না বললেই চলে। কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে দেখানোর পর ডাক্তার খুলনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলে। শাহেদকে সব খবর জানায় ফিরোজ। শাহেদ বলে, দুলাভাই, আপনি আগামীকালই আপাকে নিয়ে খুলনা চলে আসেন। আমি আজই ডাক্তারের অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে রাখব। ফুলেও উঠেছে ফরিদার শরীর।
ফিরোজ নিয়ে যায় আকলিমা বেগমকে খুলনা মেডিক্যালের সহযোগী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের কাছে। মাথাভর্তি সাদা চুল আর চোখে ভারি চশমা পরা কৃষ্ণবর্ণের প্রফেসর ফরিদাকে দেখেই বলেন, সমস্যা তো প্রায় দু-তিন মাস ধরে বোধহয়। বেশ দেরি হয়ে গেছে। আরও আগে আসা উচিত ছিল। যাক, আগের প্রেসক্রিপশনগুলো দিন। খুলনায় তিনদিন থেকে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিডনিতে সমস্যা ধরা পড়ে। ডাক্তার জানান, দুটি কিডনিই প্রায় নষ্ট হওয়ার পথে। এ ক্ষেত্রে দুটি উপায় আছেÑ এক. কিডনি পেলে ম্যাচ করে প্রতিস্থাপন করা; দুই. ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে যতদিন সম্ভব রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা।
ফিরোজ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে, কিডনি লাগাতি গেলি কত টাকা লাগতি পারে ডাক্তার সাব?
ডাক্তার জানান, ম্যাচ করেÑ এমন কিডনি আগে পেতে হবে। যদি কেউ ডোনেট করে তাহলে খরচ বিশ-পঁচিশ লাখের ভেতর হতে পারে। আর কিডনি কিনতে হলে খরচ পড়বে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখ। তবে আপনাদের জন্য সহজ পদ্ধতি হয়তোবা ডায়ালাইসিস। আর রোগীর রুটিন মেনে খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাকভাবে করা। আপনারা চাইলে ঢাকায় গিয়েও করতে পারেন, আবার খুলনায়ও করতে পারেন। মাসে দুবার আপাতত ডায়ালাইসিস করলেই চলবে। প্রতিবার ডায়ালাইসিসে খরচ পড়বে পাঁচ হাজার টাকা করে। ফিরোজ বলে, ডাক্তার সাব, এইবার ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করে দিন।
ডায়ালাইসিস করে ফিরোজ ফরিদা বেগমকে নিয়ে বাড়ি ফিরে মাকে সব বুঝিয়ে বলে। আরও বুঝিয়ে বলে দেয়, বাড়িতে একজন কাজের মানুষ দরকার হবে। কারণ ফরিদা এখন থেকে আর কোনো কাজকর্ম করতে পারবে না। ফরিদার বিশেষ যতেœর প্রয়োজন। ফরিদার খাওয়া-দাওয়া ডাক্তারের পরামর্শমতো হতে হবে। ৬৫ বছরের আকলিমা কেঁদে কেবলই বুক ভাসাতে থাকেন। নামাজে বসে শুধু আল্লাহকে বলতে থাকেনÑ আল্লাহ, এই বুড়া বয়সে তুমি এই কষ্ট দিও না।
বাড়ির পাশের এক গরিব মহিলাকে রেখেছেন কাজে। নিজে ফরিদার সবজি সিদ্ধ করে পানি ফেলে দিয়ে রান্না করে দেন। রান্না করে দেন জাউভাত। ননদরা মাঝে মধ্যে এসে দেখে যায় ফরিদাকে। যে মানুষ তেল-ঝাল, মাছ-মাংস ছাড়া খেতে পারে না, তাকে খেতে হয় সিদ্ধ সবজি আর জাউভাত। কালে-ভদ্রে তেলে না ভেজে হালকা মশলায় রান্না করা মাছ। ফরিদার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেন না আকলিমা বেগম। ডাক্তার ছয় মাসের মাথায় প্রতিসপ্তাহে ডায়ালাইসিস দিয়েছে এবং ঢাকায় গিয়ে করতে পারলে ভালো হয় বলেছেন। ফিরোজ এলাকার একজন বড় ডাক্তারকে ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে। সংসার, জমিজমা, চাষবাসÑ সব অযতœ অবহেলায় পড়ে থাকে।
মাঝেমধ্যে ফিরোজের দুইবোন হাসপাতালে থাকতে এলে ফিরোজ বাড়ি চলে যায়। কিছু টাকা-পয়সা ফিরোজ শ্বশুরবাড়ি থেকে পেয়েছে। তারপরও প্রায় পাঁচ বিঘা জমি শেষ।
আকলিমা বেগম কেবলই চোখের জলে বালিশ ভেজান। অবশেষে ফিরোজের বিয়ের মাস পৌষে ফরিদা পরপারে পাড়ি জমায়। প্রায় দুইশ মানুষ ডেকে খাইয়ে ফিরোজ কুলখানি করে।
একেবারে মন নেই ফিরোজের সংসারের প্রতি। সেই অবিবাহিত সময়ের মতো হাট-বাজারে পড়ে থাকে। এরই মধ্যে শরীরের অনেক অবনতি হয়েছে। সেই সুখী চেহারা আর থলথলে ভূড়ি আর নেই ফিরোজের।
আকলিমা বেগম মাস তিনেক পর কথা পাড়েন। আমি এই বয়সে কীভাবে সংসার সামলাই ক দেখি? সংসারের একটা ব্যবস্থাকরন লাগে যে! ফিরোজ জিজ্ঞেস করে, কী ব্যবস্থা করতে চাও? আকলিমা বলেন, ঘর থাকলে গৃহিণী লাগে। একজন গৃহিণী আনার ব্যবস্থা করি। ফিরোজ মাকে জিজ্ঞেস করে, কই পাবা? আকলিমা বেগম বলেন, ঘটকরে আসতে বলছি। ঘটক আসুক। ফিরোজ মাকে জানায়, চেহারা-ছবি যা-ই হোক, এই বায়ান্ন বছর বয়সে আমি আবার বাপ হইতে চাই না। বাঁজা মেয়েমানুষ খুঁজে আনো। আর বয়স ৪৫ বা তার ওপরে। রান্না-বান্না জানে, শামীমের যতœ আর সংসার চললেই হয়।
ছেলের সম্মতি পেয়ে ঘটকের খোঁজ লেগে যান আকলিমা বেগম। একদিন পড়ন্ত বিকালে পান চিবাতে চিবাতে আফসার মোল্লা এসে বলেন, ভাউস বেশি করে জর্দা দিয়া আগে পান বানাইয়া আনো। আকলিমা বেগম হাসিমুখে বলেন, খালি পান নি? চা, বিস্কুট, মিষ্টি সব খাওয়ামু। সুখবর আছেনি ভাই? আফসার মোল্লা দরাজ গলায় বলে, আইজ পর্যন্ত আফসার মোল্লা পারে নাই এমন কোনো কেইস আছে?
ঘটকের কাছে বসে আকলিমা বেগম মমতাজের ছবি দেখেন। একটু বেশিই শ্যামলা, খাটো আর শরীর-স্বাস্থ্য বেশ ভালো। খোঁজ-খবর নিয়ে ঘটক জেনেছেন, বাঁজা। তাই আগের স্বামী তালাক দিয়েছে। এখন ভাইদের সংসারে আছে। চোখগুলো কোটরে ঢুকে আছে। ঠোঁটগুলো চ্যাপ্টা। আকলিমা বেগম ভাবেন, ভালোই হবে গরিবের ঘরের মেয়ে আনলে ভালো খেতে, পরতে দিলেই খুশি থাকবে।
এক শুক্রবার গিয়ে আকলিমা বেগম মমতাজের ভাইদের সঙ্গে দেখা করে পাকা কথা দিয়ে আসেন। মমতাজের ভাইরা গরিব হলেও খুব চেষ্টা করেছে আকলিমা বেগমকে আদর-আপ্যায়ন করতে। পুলি পিঠা, মিষ্টি, নুডুলস, সুজির হালুয়া, ফল-পাকুড়Ñ সবই আয়োজন করেছে তারা। মমতাজের যে একটা গতি হচ্ছে, তাতে ভাইবউরা খুবই খুশি।
পাকা কথার পরের শুক্রবার ফিরোজ গ্রামের মেম্বার, মসজিদের মুয়াজ্জিন, কাছের দু-চার বন্ধু নিয়ে যায় মমতাজের বাড়ি। স্যুটকেস ভরে দুটো ভালো শাড়ি, দুটো পরার শাড়ি, তেল, সাবান, শ্যাম্পু, স্নো, পাউডার, লিপস্টিকÑ সবই নিয়েছে। দিয়েছে পাতলা দেখে গলার একটা সোনার চেইন আর কানের দুল। কিন্তু ফরিদার গয়না আর শাড়ি সযতেœ তুলে রাখতে বলেছে শামীমের বউয়ের জন্য।
বিয়ে করতে যাওয়ার আগে ফিরোজ শামীমকে সব স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলেছে। ফিরোজ শামীমকে বলেছে, তোমার মায়ের জায়গা আমার কাছ থেকে কেউই কোনোদিন নিতে পারবে না। কিন্তু আমার বৃদ্ধ মা আর সংসার চালাতে পারছেন না। আর তোমারও বিয়ের বয়স হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে এই বয়সে আবার এ কাজ করা লাগতেছে। কিন্তু পৃথিবীতে তোমাকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। শামীম মাথা নেড়ে নিশ্চুপ সম্মতি দিয়েছে।
বাড়িতে নিয়ে এসে প্রথম রাতেই ফিরোজ মমতাজকে বলেছে, আমার বউ মারা গেলেও এই বয়সে বিয়া করার কোনো সাধ ছেল না। ছেলের বিয়ের বয়স হইলে ছেলেরেই বিয়া দিতাম। ছেলের যতœ, সংসারের খেয়াল রাখা আর মায়ের যা দরকার, তা দ্যাখলেই আমি খুশি থাকপ। তোমার প্রয়োজন আমি দেখবানি। মায়ের কাছে সংসারের সবকিছু বুঝে নিও।
ধীরে ধীরে মমতাজ সংসারে নিজেকে মিশিয়ে দিতে শুরু করেছে। সকাল থেকে রাত অব্দি সব কাজ নিগূঢ় যতেœ আর পরম মমতায় করে যায়। শাশুড়ির প্রয়োজন, শামীমের খাওয়া দাওয়া, যতœ-আত্তি, স্বামীর পছন্দ-অপছন্দÑ সবই খেয়াল রাখে। মমতাজ নিজের মনকে বোঝাতে চায়, এ সংসার তো আমারই আর মানুষগুলাও আমারই আপনজন। মমতাজ খুব চেষ্টা করে স্বামীর মন পেতে। প্রতিরাতে ঘুমাতে গেলে মাথা টিপে দেয়, হাত-পায়ে তেল মালিশ করে দেয়। ভালো খাওয়া-দাওয়া আর শরীরে মালিশ পেয়ে জেগে ওঠে ফিরোজের পুরুষদ- আর তাকে শান্ত করতে প্রয়োজন পরে মমতাজের শক্ত-সামর্থ্য শরীরের নদী আর সুউচ্চ স্তনের। কিন্তু দক্ষিণ মেরুর মতো অজেয়, অধরা থেকে যায় ফিরোজের মন, মায়া, যতœ আর সম্মান। মিলনের পরের দিনই মাথায় বাসমতি তেল মেখে, স্নো-পাউডার মেখে বিশেষ সুগন্ধি জর্দা দিয়ে পান সাজিয়ে নিয়ে আসে মমতাজ ফিরোজের জন্য। ভাবে, হয়তো ফিরোজ একটু বুকে টেনে নেবে, কপালে একটা চুমু দেবে। কোনোদিনই মমতাজের আশা পূরণ হয় না। ফরিদা যদি অচল হয়ে ঘরে পড়ে থাকত, তাহলে হয়তোবা তাকে মমতাজ সেবা আর খাটুনি দিয়ে তাকে হারাতে পারত। কিন্তু মৃত ফরিদা অনেক বেশি শক্তিশালী। মমতাজ সামনে এলেই ফিরোজের মনে পড়ে যায় ফরিদার ডাগর চোখ, চিবুক, দুধে আলতা রঙ, মৃদুভাষণ, আদর করার সময়ের ঈষৎ হাসিতে প্রশ্রয় দেওয়া সব। সেখানে মমতাজকে বড়জোর সয়ে নেওয়া যায় কিন্তু এর অধিক ফিরোজ কী-ইবা দিতে পারে? সব পুরুষের মতো ফিরোজও কোনোদিনই মমতাজের মনের মাধুর্য ছুঁয়ে দেখতে চায়নি। কারণ মমতাজের শরীর সুন্দর না তার গায়ে অভিজাত নারীর গন্ধ নেই।
শামীম এই ছমাসে কেবল কয়েকবারই আম্মা বলে ডেকেছে মমতাজকে। তাও আকলিমা বেগম অনেকবার বলার পরে। ব্যতিক্রম কেবল আকলিমা বেগম হয়তোবা তিনিও গরিবের ঘরের মেয়ে ছিলেন বলে মমতাজের দুঃখ বোঝেন। ফিরোজকে দিয়ে শাড়ি আনিয়ে দিয়েছেন এর মধ্যে আবার। মমতাজের ভাইরা এলে এটা-সেটা হাতে দিয়ে দেন।
মমতাজ নিজের মনকে বুঝ দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিল সংসার। এরই মধ্যে বিয়ের নয় মাসের মাথায় স্ট্রোক করে মারা যান আকলিমা বেগম। একা হয়ে যায় মমতাজ; শামীমও। শামীম ফিরোজকে বলে, সন্ধ্যার পরেই যেন ঘরে ফিরে আসে। কারণ তার খুব একা লাগে আর ভয় করে। শামীম এখন দশম শ্রেণির ছাত্র। কিন্তু গ্রামের অন্য সব ছেলের মতো শামীম গ্রামের চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া, চা-সিগারেট খাওয়া এসব করে না। ফরিদা ছোটবেলা থেকেই তাকে খুব আদর্শবান করে বড় করেছে। আকলিমা বেগম মারা যাওয়ার পর তিনটা মানুষ যেন তিনটা দ্বীপে পরিণত হয়েছে। যদিও ফিরোজ শামীমকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু এতদিনে দুজনের ভেতর অনেক দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে।
অনেক বলে-কয়ে ফিরোজ শামীমকে রাজি করায় শামীমের মামা বাড়ি যাওয়ার জন্য। শামীমের ছোট মামা দাওয়াত দিয়ে খুব করে বলেছে, মমতাজসহ সবাই যেন আসে, অনেকদিন পর বাড়ি এসেছেন তিনি সবাইকে নিয়ে।
ফিরোজ সবাইকে নিয়ে ফল, মিষ্টি নিয়ে যায় শামীমের মামাবাড়ি। ফিরোজের খুব মনে পড়ে সেই সময়ের কথা বিয়ের পর-পরই যখন ফরিদাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যেত। পথে এটা-ওটা কিনে দিত ফরিদা কিছুতেই খেতে চাইত না। ফরিদার ভাইরা খুব আপ্যায়ন করে সবাইকে। সবাইকে নতুন কাপড় কিনে দিয়েছে। মমতাজকে দামি শাড়ি কিনে দিয়েছে।
আসার আগের দিন শামীমের বড়মামা একান্তে বসে ফিরোজের সঙ্গে। বলে ফরিদা মারা গেছে, খালাম্মাও নাই। তোমারও বয়স হচ্ছে জমিজমাগুলো শামীমের নামে উইল করে দাও। ওর তো আঠারো বছর হলো বলে।
পান নিয়ে আসছিল মমতাজ। দরোজার আড়ালে সবই শুনেছে সে। ফিরোজ কথা দেয় বড় শ্যালককে, বাড়ি ফিরেই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে সে।
বাড়ি ফিরে এলে একদিন সন্ধ্যায় কথা তোলে মমতাজ জমিজমা শামীমের নামে লেইখা দিলে আমারে কতটুক কী দেবেন? ফিরোজ বলে, দেখি চিন্তাভাবনা কইরা। মমতাজ বলে, পাঁচ বিঘা জমি দেবেন আমারে। আপনে না থাকলেও যেন ভাইদের কাছে যাইয়া ওঠন না লাগে। ফিরোজ বলে, এইভাবে বইলো না। শামীম তোমারে দেকবে। আমি শামীমরে বইলা যামু। মমতাজ একটা বিকট হাসি দিয়ে বলে, সতিনে তবু সয়, সতিনের পেটের কাঁটায় সয় না।
ফিরোজ জোরে ধমক দেয় মমতাজকে। বলে, এরকম কথা আর কোনোদিন বলবা না। ওর জন্যই তোমারে এই বাড়িতে আনা।
এর দুইদিন পর ফিরোজ একদিন সকালে বেরিয়ে যায়। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। হাতে ঘড়িও পরেছে। ফিরোজের মুখচ্ছবি আজ কেমন অন্যরকম লাগছে। মমতাজের সন্দেহ হয়। মমতাজ কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কই যান? ফিরোজ শুধু বলে, কাজ আছে, ফিরতে সন্ধ্যা অইতে পারে।
তারপরের দিন ফিরোজ বাড়িতেই থেকেছে। একসঙ্গে দুপুরে ছেলেকে নিয়ে খাবে বলে মমতাজকে দেশি মুরগি, বাগদা চিংড়ি, টেংরা মাছ ঝোল রান্না করতে বলেছে। দুপুরে তিনজন একসঙ্গে খেয়ে সন্ধ্যায় ছেলেকে বলে, চল, আজ একটু বাজারে যাবি আমার সঙ্গে। গরম রসগোল্লা খাওয়াবেনে। মিষ্টির দোকানের এক কোণে বসে ফিরোজ সবিস্তারে শামীমকে উইলের কথা বলে। বলে, যে জমি আছে মোট ৪২ বিঘা। একবিঘা জমি মসজিদে, ১ বিঘা জমি মমতাজরে আর ৪০ বিঘা জমি তোর নামে উইল করে দিয়ে গেলাম। উইলের কপি আমার আলমারিতে নীল রঙের ফাইলে রাখা আছে। আমি মরে গেলেও তুই বিএ পাস করে চাকরি করবি। এলাকার আশপাশে কোনো স্কুলে মাস্টারমশাই হবি। আর সঙ্গে জমিজমা তো থাকলই।
শামীম বলে, আমি আম্মারে দেইখা রাখমু। তারপর বাড়ির জন্য মিষ্টি নিয়ে শামীম সন্ধ্যায় বাড়ি চলে আসে। এসে বলে, আম্মা, আপনের জন্য মিষ্টি আনছি। মমতাজের মন খুশিতে ভরে ওঠে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সন্দেহ দানা বাঁধে।
রাতে অনেকক্ষণ ধরে ফিরোজকে শরীর মালিশ করে দেয় মমতাজ। বিভিন্ন ররকম আদর-সোহাগ করে বুকে মাথা রেখে বলে, আমি জানি আপনে জমির কাগজ করছেন। আমারে কতটুক জমি দেছেন শুনি? ফিরোজ এড়িয়ে যেতে চায়। মমতাজ তখনই ফিরোজের ঠোঁটে চুমু এঁটে দেয়। ফিরোজের মন গলে যায়। বলে, দেখো, আমার বাপের ছিল একশ বিঘা জমি। সেখান থেইকা ভাগ বাটোয়ারা হইয়া আমার ছিল ৫০ বিঘা। তারপর ফরিদার চিকিৎসা আর অন্যান্য দরকারে গেছে এইভাবে ৮ বিঘা। থাকল ৪২ বিঘা, শামীমরে ৪০ বিঘা দিয়া তোমারে একবিঘা আর মসজিদে একবিঘা দিছি। এ বছর তোমারে ধান উঠলে আমি তোমারে ১৫ হাজার নগদ টাকা দিমু। আর শামীমরে বলছি, তোমারে না ফেলতে। সে বলছে, তোমারে দেইখা রাখবে।
এক ঝটকায় মমতাজ সরে যায় ফিরোজের কাছ থেকে। বলে আপনে কাগজ পাল্টাইবেন। আমারে পাঁচবিঘা জমি লেইক্ষা দেবেন। ফিরোজ একবাক্যে বলে দেয়, সেইটা সম্ভব না। মমতাজ চিৎকার করে বলে, তাইলে বিয়ে কইরা আনছিলেন ক্যান? সারা দিন-রাত সংসারে হাঁড়ভাঙা খাটুনি খাটি। আমারে তো স্ত্রীর মর্যাদা দিলেন না। ওই ছেলে শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর আমারে আম্মা পর্যন্ত ডাকে না! ওই ছেলের পেটে পেটে হিংসা। ও আমারে দেকবে? সব স্বার্থপর, বেঈমান। আল্লাহর গজব পড়বে। এবার ফিরোজ নেমে এসে চুলের মুষ্টি ধরে লাথি দিতে থাকে আর বলে, ফকিরনীর ঘরের ফকিরনী, তোরে বিয়া কইরা আনছি দেইখা তো খাইয়া-পইরা ভালো আছস। আবার আমার পোলারে অভিশাপ দ্যাস? তোরে আমি তালাক দিমু! মমতাজ মার খেতে খেতে বলে, দেন তালাক। এই বাড়িতেও আমি কাম কইরা খাই মাইনসের বাড়িতেও কাম কইরা খামু।
ফিরোজ জোরসে লাথি দিয়ে বলে, দূর হ আমার চোখের সামনে থেইকা।
পরদিন ফিরোজ সকাল-সকাল বাজারে বেরিয়ে যায়। মন-মেজাজ খুবই খারাপ। দুয়েকজন শুভাকাক্সক্ষীর সঙ্গে কথা বলবে কী করা যায়।
শামীম রাতে কিছুটা টের পেয়েছে রাতের ঝগড়া। সকালে ঠান্ডা ভাত খেয়ে স্কুলে চলে গেছে। স্কুল থেকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। দুপুরে রুইমাছ দিয়ে বেগুন, আলু রান্না আর সজনে ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছে।
মমতাজই বেড়ে দিয়েছে। খাবার শেষে শামীমকে দুধ আর গুড় দিয়ে ভাত খেতে দেয়। দুধভাত শেষ হতে না হতেই শামীমের বুকে ভীষণ জ্বালাপোড়া শুরু হয়। শামীম বলে পানি! মরে গেলাম! এইরকম আট-দশ মিনিট বলতে বলতে শামীম নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মমতাজ ঠায় বসে থাকে নিজের জায়গায়।
এরই মধ্যে গ্রামে খবর রটে যায়, মমতাজ বিষ দিছে শামীমরে। খবর পায় ফিরোজও। দৌড়ে এসে দেখে পড়ে আছে শামীম। চিৎকার করে বলে, ফরিদা, তুমি অসময়ে কেন চলে গেলা। তুমি দ্যাকতে পাও আমার মানিকরে ওই ডাইনি খাইয়া ফালাইছে। ডাইনিরে আমি আনছিলাম আমার মানিকরে দ্যাকতে!
চেয়ারম্যান খবর দিয়েছেন পুলিশকে। পুলিশের কাছে মমতাজ একবাক্যে স্বীকার করে, হ, বিষ দিছি। আর এইডা নিয়া আমার কোনো অনুশোচনা নাই। আমি শুদু পাঁচ বিঘা জমি চাইছিলাম। যাতে আমার উনি মারা গেলেও রাস্তায় ওডা না লাগে। উনি দিলেন না। আবার ভাইগো ধারে যামু না। আর ওই ছেলের জন্যই আমারে বঞ্চিত করছে। আমিও প্রতিশোধ নিছি। সারাজীবন মাইনষের ঘানি টানতে আর ভালো লাগে না। কেউ একটু ভালোবাসলো না, সম্মান করল না। যা বিচার অবার, অউক।
পুলিশের সঙ্গে সিনা টাইট করে, মাথা উঁচু করে চলে যায় মমতাজ। ফিরোজ উ™£ান্তের মতো দশ বিঘা ভিটাটার এ মাথা ও মাথা হাঁটতে থাকে। উঠানে জনসমাগমের মাঝে পড়ে থাকে শামীমের শুকনো-লম্বা নিথর দেহ!
নুসরাত সুলতানা, কবি ও গল্পকার