নুরেআলম মিনা বিপিএম (বার), পিপিএম :
আইনগত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৭১ সালে হলেও জাতিগতভাবে এর গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয় হাজার বছর আগে থেকেই। বাংলার আবহাওয়া, নদ-নদীর, ভূমি ও মানুষের সৃষ্টিশীল বিবর্তন ধারার কোন এক অনুকূল পরিবেশে জন্ম নিয়েছিল ‘বাঙালি জাতিসত্ত্বা’র ভ্রুণ। আবহমানকালের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি দ্বারা পুষ্ট হয়ে সে ভ্রুণই ক্রমবিকশিত হয়ে পূর্ণসত্তা লাভ করে একাত্তরের বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মাধ্যমে। অতীত কর্মকা-ের ফল হচ্ছে বর্তমান এবং বর্তমান আবার অলক্ষ্যে সৃষ্টি করে চলেছে ভবিষ্যতের রূপরেখা। বিশ্ব ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, পরিবর্তন ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম। ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পথ ধরেই বাংলা ও বাঙালি জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্ররূপে বিগত তিন শতাব্দীর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তিনটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী, উত্তরাধিকার-রাষ্ট্র; যেমনÑ নবাবি রাষ্ট্র, বৃটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র। প্রশাসনিক শক্তিকাঠামোয় যখন পরিবর্তন দেখা দেয়, সার্বিক বিরাজমান অবস্থা তখন আর অপরিবর্তিত থাকতে পারে না। এ সত্য আমরা উপলব্ধি করতে পারি নি¤েœাক্ত সময়ের ঘটনাপ্রবাহ থেকে।
নবাবি শাসনামলে শক্তিশালী বেনিয়া ও ভূস্বামী শ্রেণীর উদ্ভব, রপ্তানি বাণিজ্যে ইউরোপীয়দের ব্যাপক অংশগ্রহণ, পলাশীর যুদ্ধ, ঔপনিবেশিক শাসন, পাশ্চাত্য শিক্ষা, সভা-সমিতি প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, বঙ্গবিভাগ (১৯০৫), সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, মুসিলিম বিচ্ছিন্নতাবাদ ও দ্বিজাতিতত্ত্ব, কংগ্রেস-লীগ দ্বন্দ্ব, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, পাকিস্তান সৃষ্টি ও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বাংলা বিভাগ, ভাষা আন্দোলন, পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগের জন্ম, মুসলিম লীগের পতন, সামরিক শাসন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন (৬ দফা), অসহযোগ আন্দোলন এবং সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ-প্রভৃতি ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরা এমন সম্পর্কিত ও অবিচ্ছেদ্য যে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যেন কোন এক অদৃশ্য নিয়তির নির্দেশনাতেই স্বাধীন বাংলাদেশ অভিমুখে অবশম্ভাবীভাবে ঘটে যাচ্ছে একের পর এক ঘটনা।
কিন্তু আসলে কি তাই? যা ঘটৈ গেল তাই ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু কেন ঘটল এ ঐতিহাসিক ঘটনার পরম্পরা? আমরা যদি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে অনুধাবন করতে পারি যে, মোগল সরকারের নির্বিচার ও অবাধ বাণিজ্যনীতি এবং দেশের অভ্যন্তরে বিদেশীদের বসতি স্থাপনের উদার-অনুমতিদানের সঙ্গে সম্পর্কিত পলাশীর ঘটনা। আগেরটি না ঘটলে পরেরটি ঘটার প্রশ্নই ওঠে না। যেমন, কোম্পানীর শাসনের ফল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। মুসলিম লীগের প্রতি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কট্টর নেতিবাচকÑআপোষহীন নীতি গ্রহণ না করলে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় থাকলে পাকিস্তান রাষ্ট্র আদৌ সৃষ্টি হতো কিনা সেটি বিতর্কের বিষয়। অনুরূপভাবে পাকিস্তান সরকার স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী মেনে নিলে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত দলকে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে বাধা প্রধান না করলে অন্তত সে সময় বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রবলভাবে শুরু হত কিনা তা-ও বিবেচনার যোগ্য। অনেকে যুক্তি প্রদান করেন যে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হতো না! কিন্তু এর অর্থ কি এই যে, বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্যই পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল? ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক পাকিস্তানের অবসান পর্ব কখন হতে শুরু হলো? ভাষা আন্দোলন থেকে? আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম থেকে? পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পতন থেকে? আসুন আমরা ইতিহাসের সত্য ঘটনার দিকে তাকাই তাহলে অনুধাবন করতে পারব কিভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছিল।
ুঞযব াড়রপব ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব রং ঃযব াড়রপব ড়ভ এড়ফ”. লাতিন ভাষার এ প্রবাদটি যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে যা দাঁড়ায় তাহলো জনগণের কণ্ঠস্বরের যদি ন্যায্যতা থাকে, তাহলে সে কণ্ঠস্বর এতটা শক্তিশালী হয় যে তা ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর হিসেবে গণ্য হয়। জনগণের কণ্ঠস্বরের ন্যায্যতা বিনির্মানে মূল ভূমিকা বা অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করে রাজনৈতিক দল। জনগণকে দলীয় আদর্শে সংগঠিত করা, জনগণের মধ্যে দলীয় চেতনার অনুপ্রবেশ ঘটানো, জনগণের ন্যায্য দাবিকে শক্তিশালীকরণ এবং ইতিবাচক আন্দোলনের মাধ্যমে দাবির যৌক্তিকতা সরকারের নিকট তুলে ধরা-এসবই মূলত: রাজনৈতিক দলের কাজ। বাঙালি জাতির মননে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফলপ্রসূ এবং কার্যকরী অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল যে রাজনৈতিক দল সে দলই হল ‘‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ”। উপেক্ষা, বঞ্চনা এবং পীড়নের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে প্রথমে জন্ম সংগঠন, দ্বিতীয়ত প্রতিবাদ, অতঃপর প্রতিরোধ, সবশেষে সশস্ত্র রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকই ছিল আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। বলা বাহুল্য-তরুণ, উদ্যমী ও সফল সংগঠক রাজনীতির কবি শেখ মুজিবুর রহমান এর অভূতপূর্ব, অনন্যসাধারণ সাংগঠনিক নৈপুণ্য আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রা দূর্বার গতিতে এগিয়ে চলে মুক্ত, স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ অভিমুকে। পূর্ববঙ্গের বঞ্চনাক্লিষ্ট, অবহেলিত, শোষিত জনগণের চোখে তাদের অধিকারের রক্ষক ও অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মহান নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ এর হাত ধরে রক্তাক্ত মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রটি জন্মগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের ইতিহাস তাই অভিন্ন, এক সুতোয় গাঁথা।
আওয়ামী লীগের পরিচয়: জন্ম, প্রতীক ও আদর্শ
বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ, পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত এ রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে পরিচিত ছিল। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে এক সভায় এ রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন ‘মুসলীম লীগে’র বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। খুব দ্রুতই পূর্ব পাকিস্তান জনপ্রিয়তা এবং গণভিত্তি লাভ করে। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ সালে ২১-২৩ অক্টোবর তৃতীয় কাউন্সিল সভায় ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হিসেবে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়Ñযাতে অমুসলিমরাও এ দলে যোগ দেবার সুযোগ পান অর্থাৎ দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আওয়ামী লীগ’। বর্তমানে এ দলটির নাম ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, ঢাকায় এ দলটির সদর দপ্তর অবস্থিত। ‘নৌকা’ এ দলের নির্বাচনী প্রতীক। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ যুবলীগ, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ কৃষক লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগ ও সহযোগী সংগঠন। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, মুজিববাদ, সমাজতন্ত্র সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আওয়ামী লীগের অন্যতম মূল আদর্শ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অদ্যাবধি এ রাজনৈতিক দলের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নেতা হলেন “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান” (বাংলাদেশের জাতির পিতা)। বর্তমানে এ দলটির সভাপতি হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা ‘শেখ হাসিনা’ (বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী)।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট: বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা
১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ ভূ-খ-ের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ এবং বিশ্ব মানচিত্রে “বাংলাদেশ” নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ঘোষণা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় এক অদ্ভুত রাষ্ট্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত হয় পূর্ব পাকিস্তান। মূলত: পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী জনসমষ্টির স্বার্থ বিরোধী নীতি অনুসরণ এ অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত করে। পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালিরা ছিলেন পাকিস্তানের বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী; বৃহত্তম স্বতন্ত্র জাতিসত্তা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্ঠি যা মোট জনসখ্যংার শতকরা ৫৪ ভাগ। পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগণের একটি ধারাবাহিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা’য় দীর্ঘকালীন পরিসরে বসবাসের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। দুই অংশের জনগণের মধ্যে শুধু বিদ্যমান ছিল একরাশ সাধারণ ইসলামি মূল্যবোধ এবং হিন্দু আধিপত্যের ভারতে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র মুসলিম আবাসভূমি রচনার রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের কিছু অভিজ্ঞতা। মূলত পাকিস্তানের দুই অঞ্চল স্বাধীনতা লাভের সময় উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে স্বতন্ত্র সামাজিক কাঠামো এবং ভিন্ন প্রকৃতির রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এসব কারণে পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জন্ম লাভ করে পঞ্চম দশকের প্রারম্ভ থেকেই। এ সময় নবগঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দ্রুতই এ আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। পাকিস্তানের শাসনকারী এলিট গোষ্ঠী প্রথম থেকেই এমন সব নীতি অনুসরণ করেছেন যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি একাত্মতা সৃষ্টির পরিবর্তে বৈরীভাব সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর গৃহীত প্রভূসুলভ অন্যায়-দাবীর বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে সচেষ্ট হয়।
বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের প্রেক্ষাপট দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত। আমরা মোটা দাগে এ প্রেক্ষাপটকে নানা পর্বে বিভক্ত করতে পারি। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলকে যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিজয় লাভ এবং পাকিস্তানের শাসক দল মুসলিম লীগের ভূমিধ্বস পরাজয়, সামরিক শাসন (১৯৫৮), ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি পেশ এবং এ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা শাসক গোষ্ঠীর তথাকথিত ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, দীর্ঘ বিলম্বিত ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং আইনগত কাঠামো আদেশ (খবমধষ ঋৎধসব ড়িৎশ ঙৎফবৎ) অনুযায়ী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠন করতে না দেয়া, বারংবার পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের সাথে মিথ্যা এবং ছলনার আশ্রয় নেয়া-সমগ্র বাঙালি জাতিকে একটি সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে ধাবিত করে অতঃপর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের আইকনিক, অবিসংবাদিত নেতা ও সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাক মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ হলো উল্লিখিত ঘটনা প্রবাহের শেষ অংক।
সাংস্কৃতিক অঙ্গীভূতকরণ নীতি ও ভাষা আন্দোলন:
পাকিস্তানের শাসনকারী এলিটরা বিশ্বাস করতেন যে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ঐক্য সুদৃঢ় হবে যদি উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান থাকেক একই ভাষা ও সংস্কৃতি। এ ধারণা সুষ্পষ্ট করেন পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ১৯৪৮ সালে প্রথম সফরে ঢাকায় তিনি ঘোষণা করেন, ‘আপনাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে যাচ্ছে উর্দু এবং অন্য কোন ভাষা নয়’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জিন্নাহর এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের একজন সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে গ্রেফতার হন তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম নেতা)। ১৯৪৮-১৯৫২ ভাষাভিত্তিক এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই জন্ম নেয় আওয়ামী লীগ নামক রাজনৈতিক সংগঠন। এ সংগঠনের ২১ দফার অন্যতম দফাও ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। জায়ারিং এর মতে, ভাষা আন্দোলন বাঙালিদের একটি স্বতন্ত্র জাতিতে পরিণত করে তোলে। এর ফলে ‘‘সুপ্ত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ’’ রাজনৈতিক লক্ষ্যের সাথে মিশে গিয়ে জনগণের মধ্যে সৃষ্টি করে এক অবিচ্ছেদ্য ঐক্যসূত্র এবং ফলে জেগে উঠে রাজনৈতিকভাবে সচেতন এক জনসমষ্টি।
২১ ফেব্রুয়ারি রাতে শেখ মুজিবুর রহমান জেলে বসে ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলির খবর পান। বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখেন, ‘‘মুসলিম লীগ সরকার কত বড় অপরিণমদর্শিতার কাজ করল। মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই। আমি ভাবলাম, দেখবো কিনা জানি না, তবে রক্ত যখন আমাদের
ছেলেরা দিয়েছে তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উপায় নাই।” অবশেষে ২৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমান তাঁকে নিয়ে জেল গেটে আসেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্মিত হয় শহীদ মিনার। ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদের স্মরণে রচিত হয় কবিতা, গান। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় যে স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি রচিত হয়, তার পথ ধরেই চলতে থাকে পরবর্তী আন্দোলন, সংগ্রাম; যা ১৯৭১ সালে মুক্তিসংগ্রামে পূর্ণতা লাভ করে।
১৯৫৪ সালের নির্বাচন:
“আওয়ামী মুসলিম লীগ’’ নামের রাজনৈতিক দলটির জন্মগ্রহণের অব্যবহিত পর থেকেই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের আপোসহীন প্রবক্তা হিসেবে আর্বিভূত হয় আওয়ামী লীগ। জনগণ থেকে সর্বোচ্চ সমর্থন আদায় ও ঐক্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘যুক্তফ্রন্ট’ মোর্চা গঠিত হয়। জোটের নেতৃত্বে ছিলেন সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী এবং ফজলুল হকের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা এবং তরুণ ও উদ্যমী নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর উপর ন্যস্ত ছিল জোটের সাংগঠনিক কাঠামো নির্মাণের কঠিন দায়িত্ব। মূলত: আওয়ামী লীগ গঠনের মধ্য দিয়েই পূর্ব বাংলার রাজনীতির ভবিষ্যত গতিধারা সূচিত হয়। শহর ও পল্লী উভয় অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বের দাবীদার আওয়ামী লীগ ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবিভূর্ত হয় এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ জোটের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে বাঙালি নির্বাচক মন্ডলী মুসলিম লীগের দূর্গে প্রথম আঘাত হানে। মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত ২৩৭টি আসন এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মাত্র ১০টি আসনে জয়লাভ করে। যুক্তফ্রন্ট যে চমকপ্রদ বিজয় অর্জন করে, তা ছিল অসাধারণ। কারণ, এ বিজয় একটি গনসমর্থনপুষ্ট সরকার গঠনের ভিত্তি গড়ে তোলে। অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, নেতা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পাকিস্তানকে ঘিরে উন্মাদনা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল ১৯৫৪ সালের নির্বাচন কাল হতেই।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন:
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর গঠিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় আরোহনের ছয় সপ্তাহের মধ্যে দেশদ্রোহিতা এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র হতে পূর্ববঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে ফজলুল হককে সরিয়ে দেয়া হয়। একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে গভর্ণরের শাসন জারীর মাধ্যমে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারী হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য ছিল যুক্তফ্রন্টের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করা। গভর্ণরের শাসন জারির নেপথ্যে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর হাত ছিল। ১৯৫৪ সালের ১৭ মে পূর্ববঙ্গ প্রদেশের গভর্ণর হিসেবে মেজর জেনারেল ইস্কান্দর মীর্জাকে প্রেরণের সাথে মির্জা খুব দ্রুততার সাথে যুক্তফ্রন্টের একহাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার, ফজলুল হককে আটক ও শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেন। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে কুটিল রাজনীতি শুরু হয়। নানামুখী ঘটনার মধ্যেও ‘বাংলা’ পাকিস্তানের দুইটি রাষ্ট্রভাষার একটি হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পূর্ববঙ্গকে সামান্য প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানসহ পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে পূর্ববঙ্গ কিছুটা স্থান করে নেয়।
ঘটনার বিবর্তনে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিল করা হয়। জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালের মার্চে ‘পেডো’ ও আগস্ট মাসে ‘এবডো’ নামে দুইটি অধ্যাদেশ জারি পূর্বক এর অপ্রয়োগে প্রায় ৭০০০ ব্যক্তিকে রাজনৈতিক অঙ্গন হতে অপসারণ করেন। ১৯৫৯ সালে ‘দি বেসিক ডেমোক্রেসি অর্ডার’ এর মাধ্যমে শঠতাপূর্ণভাবে সামরিক সরকারের বৈধতা দানের উদ্যোগ নেন। ১৯৬০ সালে ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলোকে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াই আইয়ুব খানকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে বলা হয়। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ আইয়ুব খান একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন। এ সংবিধান নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করে। ১৯৬২ সালে জাতীয় কাউন্সিল ও পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল সৃষ্টির পর-এগুলি সংবিধানেরই সমালোচনার মূল মঞ্চ হয়ে ওঠে। কাউন্সিলগুলির বাইরে আওয়ামী লীগ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং দু’প্রদেশের মধ্যে বৈষম্য হ্রাসের ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। মৌলিক গণতন্ত্রের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় কাউন্সিল ১৯৬২ এর সংবিধান প্রেসিডেন্টকে প্রচুর স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা প্রদান করে। সংবিধানে ‘পূর্ববঙ্গ’কে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে নামকরণ করে এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে একক ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৬২ সালের এ সংবিধান বাঙালিদেরকে তেমন কোন ছাড় দেয়নি এবং দু’অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। ফলে পূর্ববঙ্গে তা প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়।
আইয়ুব কয়েকটি আইন এবং অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্ত্বশাসন খর্ব করেন। এজন্যে ক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ সংবিধানবিরোধী সমালোচনায় নেতৃত্ব দেয়। সংবিধানের কপি প্রায় প্রতিদিনই ক্যাম্পাসে পোড়ানো হয়। শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদদের কর্মকা-ের পাশাপাশি ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবীরাও সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেন। ছাত্রবিক্ষোভ এবং হরতাল হয়ে পড়ে নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের পূর্ব পাকিস্তান সফরে সময় ছাত্র এবং কর্তৃপক্ষের মধ্যে প্রবল সংঘাত দেখা দেয়। ছাত্ররা একই সাথে ১৯৬২ সালের জাতীয় শিক্ষা রিপোর্টের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানায়।
১৯৬২ সালে রাজনৈতিক বন্দিদের নামে হেবিয়াস কর্পস রীট মামলা দায়ের করা হয় এবং সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে ছয় মাসের অধিককাল আটক রাখার পর মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর ছয় সপ্তাহের মধ্যেই লাহোরে বিরোধী দলগুলির এক সম্মেলনে তিনি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের ঘোষণা দেন। সোহরাওয়র্দীকে রাজনৈতিক কর্মকা- থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে আইয়ুব খান ১৯৬৩ সালের ৬ জানুয়ারি দুটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এ কড়াকড়ি আরোপের প্রেক্ষিতে সোহরাওয়ার্দী স্বেচ্ছানির্বাসনে যান। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যুর পর রাজনৈতিক নেতৃত্ব চলে আসে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে, যিনি স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের জন্য ইতোমেধ্যই সুপরিচিত ছিলেন। এক জেলখানা থেকে আরেক জেলখানায় ঘন ঘন স্থানান্তরিত এ নেতা বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়ান। মুজিব ছিলেন একজন শক্তিশালী বক্তা, যিনি জনগণের আবেগকে আন্দোলিত করতে পারতেন। তাঁর সাংগঠনিক গুণাবলি ছিল অসাধারণ। আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানে শেখ মুজিব ছিলেন মুখ্য শক্তি। ১৯৬৫ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইয়ুব খান জয়ী হলেও গণঅসন্তোষের চিত্র প্রকট হয়ে ওঠে ও পতনের শুরুটা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
১৯৬৬ সালের ৬ দফা
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচির এক নতুন ফর্মুলা উপস্থান করেন। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বের প্রেক্ষাপট হিসেবে ছয় দফা ছিল বাঙালির জন্য যুগান্তকারী ইতিহাসের বাঁক ঘোরানোর দাবী। শেক মুজিবুর রহমান নিজেই ছয় দফাকে “আমাদের বাঁচার দাবী” হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ছয় দফা আন্দোলন অতীতের আন্দোলন থেকে স্বতন্ত্র ছিল। একদিকে যেমন তার অভ্যন্তরীণ উপাদানে, অন্যদিকে তেমনি তার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল ছয় দফার। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সংসদীয় গণতন্ত্র, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে শুধু প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষমতা, দুটি সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা, কর ধার্যের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের, বৈদেশিক বাণিজ্য ও মুদ্রা প্রাদেশিক সরকারের হাতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আধা সামরিক বাহিনী গঠনের প্রস্তাবসমূহ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব জানান দেয় এ দফাগুলো। শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সার্থক এবং কার্যকরভাবে ছয়দফাকে সামনে রেখে এদেশের মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে সক্ষম হনÑযা মুক্তিযুদ্ধে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে আহুত সর্বদলীয় সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের জন্য মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল তাসখন্দ চুক্তি ও তার পরিণতি। শেখ মুজিব তাসখন্দ চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহ না দেখিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত “ছয় দফা” দাবি উপস্থাপন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের জন্য এমন একটি দাবিনামা পেশ করতে শেখ মুজিবের সাহস, সততা এবং ধৈর্য দেখে পাকিস্তানিরা বিস্মিত হয়েছিল। ছয় দফা দাবি এমন একটি উপযুক্ত মুহূর্তে প্রণয়ন করা হয়েছিল, যখন বাঙালিরা তাঁদের পুনরুজ্জীবিত জাতীয় গৌরব প্রকাশের জন্য এবং একটি রাজনৈতিক কাঠামোর আওতায় পর্যাপ্ত স্বাধীনতা লাভের আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য একটি বাস্তব কাঠামো খুঁজছিল। এ সময়ে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ পুর্ববঙ্গের এ রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে একটি অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এ যুদ্ধ পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদেরকে ভৌগলিক হুমকির ব্যাপারে সচেতন করে তোলে। এ বাস্তব অবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবির পক্ষে যৌক্তিকতা যোগায়। সংখ্যায় অল্প হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙালি সৈন্যদের দক্ষতা ও সাহসিকতা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে গর্বের সঞ্চার করে।
১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে লাহোর থেকে ফেরার পর শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার উপর দেশব্যাপী রেফারেন্ডাম দাবী করেন। ছাত্র-বুদ্ধিজীগণ ছাড়াও শহরের বিত্তহীন শ্রমিক শ্রেণি স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে যোগদান করে; গ্রামাঞ্চলেও এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য যে, ৬ দফার প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু পরিধান করতেন কালো কোর্ট। এ কোর্টে মোট ৬টি বোতাম ছিল। তিনি নিজেই বলেছেন-এই ৬ বোতাম ৬ দফার প্রতীক। স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের অবিশ্বাস্য সাফল্যে পাকিস্তান সরকার ভীত হয়ে পড়ে। আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সার্বভৌম বাংলা স্কিমের উস্কানিদাতা বলে আক্রমণ করেন এবং এর পরিণতি ভয়াবহ হবে বলে হুমকি দেন। অনেক দনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পরও আন্দোলনের অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ না করতে পেরে ১৯৬৬ সালের ১৭ এপ্রিল শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। এরপর তাঁকে একবার মুক্তিদান করে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। এভাবেই এক জেলখানা থেকে আরেক জেলখানায় তাঁর দু’বছরের দুঃসাহসিক যাত্রা শুরু হয়, যা ১৯৬৮ সালে শেষ হয়; যখন তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়ে যান।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান:
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ৬ জন বাঙালি বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাসহ মোট ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়, কারাবন্দী শেখ মুজিবকে ষড়যন্ত্রের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। নানা দমন-পীড়ন সত্ত্বেও প্রচ- গতিতে আন্দোলন চলতে থাকে, অবশেষে ১৯৬৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা কর্মসূচীর প্রথম বার্ষিকীতে এ আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানের রূপ পরিগ্রহ করে। শেখ মুজিব কারারুদ্ধ থাকা অবস্থাই পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন উভয় প্রদেশ থেকে সমর্থন নিয়ে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে একটি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে সকল মত ও আদর্শের অনুসারী ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি। এ কমিটি ছয় দফাকে অর্ন্তভুক্ত করে একটি ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করে। ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ১১ দফার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা অস্ত্র এবং গ্রেফতারের পথ বেছে নেয়। কিন্তু অদম্য বাঙালিকে তারা দমাতে পারেনি এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। আওয়ামী লীগ এসময় গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয় যা মুক্তিযুদ্ধের সময় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জনগণের সমর্থনপুষ্ট দুর্বার ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ মুজিবকে কারাগারে রেখে বিরোধীদের সাথে আলোচনা ফলপ্রসু হবে না বুঝতে পেরে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ অন্যান্য বিরোধী নেতাদেরকে বিনা শর্তে মুক্তি দেন।
১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে দায়েরকৃত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাও প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ‘ডাকসু’র ভিপি ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ রেসকোর্স ময়দানে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই থেকে তিনি হয়ে উঠলেন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’।
এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র প্রতিবাদ ও হরতালসহ চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করার প্রেক্ষাপটে শিল্পোৎপাদন এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকা- বন্ধ হয়ে যায়, আইন-শ্ঙ্খৃলার দ্রুত অবনতি ঘটে, আমলাতন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান তাঁর দায়িত্ব পরিত্যাগ করে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দেশের যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রদান করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেনা প্রধান হিসেবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালনকালে ১৯৬৯ সালের ৩১ মার্চ নিজেকে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন।
আইনগত কাঠামো আদেশ ও ১৯৭০ সালের নির্বাচন:
ইয়াহিয়া তাঁর প্রশাসনকে একটি অর্ন্তবর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে দেখেন এবং ক্ষমতাগ্রহণের পর পরই অনতিবিলম্বে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন ইয়াহিয়া দুটি বিতর্কিত ও বিরোধপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সাল থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের যে একক সত্তা কার্যকর ছিল, তা ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর বিলোপ করে দেন। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের আদি চারটি প্রদেশের পুনরুজ্জীবন ঘটে। তিনি একই সাথে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সকল আসনে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের আদেশ জারি করেন। সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানকে এক কক্ষবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬২টি আসন বরাদ্দ করা হয়।
১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ ইয়াহিয়া একতরফাভাবে একটি আইনগত কাঠামো আদেশ জারি করেন, যাতে নির্বাচনের পূর্বে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য জাতীয় পরিষদের জন্য নির্বাচনী বিধি এবং সংবিধানে সংযোজনার্থে কিছু বিধানের রূপরেখা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ আদেশ প্রদেশ ও অঞ্চলসমূহের সমন্বয়ে একটি ফেডারেশনের ধারণা দেয়।
১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে রাজনৈতিক দলগুলির কর্মকা-ের উপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের পর পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল নির্বাচনপূর্ব প্রচারণা শুরু হয়। ঠিক তখনই ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের উপকূলীয় অঞ্চলের ৮,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় আঘাত হানে। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ৩,৫০,০০০ মানুষ প্রাণ হারায়; যোগাযোগ অবকাঠামো এবং সম্পদেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। বঙ্গবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘আমাদের এক বিশাল সেনাবাহিনী আছে, কিন্তু আমাদের মৃতদেহগুলো কবর দেওয়ার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল ব্রিটিশ নাবিকদের উপর।” তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পাকিস্তানের ঐক্যের ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং বলেন, ‘সকল গ্রাম, গৃহ ও বস্তিতে এখন সকলের মনে এ অনুভূতি প্রবল হয়েছে যে, আমরাই নিজেদেরকে শাসন করব। সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমরাই গ্রহণ করব। আমরা আর আমলা, পুঁজিপতি ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্তবাদী গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারী শাসন মেনে নেব না।’’ ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তীকালে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আবেগের দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ঘূর্ণিঝড়ের পর চার সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে বাঙালিদের অনুভূতিক সম্পূর্ণরূপে অবজ্ঞা করে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। পাকিস্তানে সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য জাতীয় পরিষদে বরাদ্দকৃত ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টিতেই জয়লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ঘোষিত ফলাফলে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮টি লাভ করে। বস্তুত ১৯৪৭ সালে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, ১৯৭০ সালের নির্বাচন তার পতনের সূচনা করে। আওয়ামী লীগের বিস্ময়কর নির্বাচনী বিজয় জাতীয় পরিষদে তার নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করে। আওয়ামী লীগের যুগান্তকারী নির্বাচনী বিজয় বঙ্গবন্ধুকে বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে। আর আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক বিজয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিচল অভিব্যক্তি হিসেবে গণ্য হয়। বাঙালির জাতীয় পরিচয়ে পুনরজ্জীবিত ও দৃঢ় সংকল্প প্রেরণা এবং বাঙালি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি সরা পূর্ববঙ্গকে উদ্দীপ্ত করে।
নির্বাচন পরবর্তী ঘটনাবলী:
আইনগত কাঠামো আদেশ অনুযায়ী জাতীয় কাউন্সিল কর্তৃক ১২০ দিন সময়কালের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের কথা থাকলেও ইয়াহিয়া কূটকৌশল অবলম্বন করে। তিনি ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। ভুট্টো জনসমক্ষে ঘোষণা দেন যে, তাঁকে কেন্দ্রে ক্ষমতার ভাগ না দিলে তাঁর দল জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগদান করবে না। সেনাবাহিনীর সকল জেনারেল শংকিত হয়ে পড়ে এবং তারা নির্বাচনের ফলকে একটি বিপর্যয় বলে গণ্য করে। ইয়াহিয়া কিছুকালের জন্য নিস্ক্রিয় থেকে নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবনের চেষ্টা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি ঢাকা আসেন। বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার প্রথম সাক্ষাৎটি ছিল ‘তিক্ততাপূর্ণ’। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ভাষায় বলেন যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অবিলম্বে আহ্বান করা উচিত এবং সংখ্যাঘরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে তাঁকে সরকার গঠন করতে দেওয়া উচিত। ইয়াহিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল যে, ছয় দফা কর্মসূচির বিরুদ্ধে তাঁর কিছু বলার নেই, কিন্তু শেখ মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সমর্থন লাভ করতে হবে। প্রায় সাত ঘণ্টা স্থায়ী ইয়াহিয়া-মুজিব শীর্ষ বৈঠক ছিল অন্ত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক। ইয়াহিয়া কালক্ষেপণ করে গোঁজামিল দিয়ে চলতে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ভুট্টো এবং জেনারেলদের একজোট হতে সহায়তা করতে ইয়াহিয়া ধোঁকা দেওয়ার জন্য করাচিতে ফিরে সাংবাদিকদের জানালেন, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।
এদিকে ইয়াহিয়া একদল জেনারেলসহ ১৭ ফেব্রুয়ারি লারকানাতে ভুট্টোর বাড়ি গমণ করেন। ইয়াহিয়ার পরামর্শে ভুট্টো শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করার জন্য এক বৃহৎ দলীয় প্রতিনিধি নিয়ে ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় ঢাকায় আসেন। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব দেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখান করে আবার বলেন যে, ছয় দফা নিয়ে দরকষাকষি করা চলবে না। শেখ মুজিব ছিলেন অন্য ধাঁচে গড়া; তাঁকে হয়ত ভাঙা যেতো, কিন্তু নীতির প্রশ্নে মচকানো যেতো না। ২৯ জানুয়ারি ভুট্টো ঢাকা ত্যাগের পর ১১ ফেব্রুয়ারিতে যখন ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাক্ষাৎকালে ভুট্টো ইয়াহিয়াকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বিলম্বে আহ্বান করার পরামর্শ দেন। ইয়াহিয়া ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেন যে, সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে। কিন্তু ১ মার্চ সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এ স্বেচ্ছাচারী পদক্ষেপের সংবাদ পাওয়া মাত্রই পূর্ব পাকিস্তান অভূতপূর্ব গণবিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তখন ইয়াহিয়া কঠোর ভাষায় কয়েকটি বক্তৃতা দেন, অতিরিক্ত দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং বেসামরিক ছদ্মাবরণে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন যে, তাঁর কর্মসূচি তিনি ৭ মার্চ উপস্থাপন করবেন। ইয়াহিয়া ৩ মার্চ একটি ব্যক্তিগত নিমন্ত্রণপত্র জারি করেন, যাতে তিনি ১২টি সংসদীয় দলের নেতৃবৃন্দকে ১০ মার্চ ঢাকায় তাঁর সাথে বৈঠকে বসার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু একে একটি ‘নিষ্ঠুর কৌতুক’ বলে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখান করেন। অব্যাহতভাবে সামরিক শীক্ত বৃদ্ধির প্রতিবাদ করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সরল বিশ্বাসে বৈঠকে যোগদান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়; সংবিধান প্রণয়ন সংক্রান্ত সকল আলোচনা হওয়া উচিত পরিষদে, ব্যক্তিগত বৈঠকে নয়। বঙ্গবন্ধুকে ঠৈকিয়ে রাখা এবং সামরিক প্রস্তুতির জন্য আরো সময় নেওয়ার লক্ষ্যে ইয়াহিয়া ৬ মার্চ ঘোষণা দেন যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২৫ মার্চে আহ্বান করা হয়েছে।
হুমকি এবং ভীতিপ্রদর্শন সত্ত্বেও শেখ মুজিব তাঁর পূর্বের অঙ্গীকার মোতাবেক জনগণের সামনে আওয়ামী লীগের কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। ৭ মার্চ ১৯৭১-এ বঙ্গবন্ধুর আবেগময়ী অসাধারণ ভাষণ জনমানসে স্বাধীনতার ভিত্তি গ্রোথিত করে। ঐতিহাসিক ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে সেদিনের বাগ্মিতাপূর্ণ আবেগমথিত ভাষণে তিনি ঘোষণা দিয়ে শেষ করেন; ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তাঁর উদাত্ত আহ্বানে তিনি জনগণকে তাদের কাছে যা কিছু আছে তা নিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে নির্দেশ দেন। তিনি বেশকিছু প্রশাসনিক নির্দেশনামাও জারি করেন, যেগুলির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হবে। ১৮ মিনিটের সেই অনিন্দ্য সুন্দর ভাষণটিকে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে’ ‘বিশ্ব ঐতিহ্য সম্পদ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধুর ১৩০৮ শব্দের অলিখিত এ ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন, অনন্য উচ্চতায় আসীন, নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত মুক্তিকামী মানুষের পথের দিশা। অধ্যাপক ও গবেষক শামসুজ্জামান খান ভাষণটিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে, ‘বাঙালি শত শত বছর ধরে যে স্বাধীনতা স্বপ্ন দেখেছে, সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে, অসংখ্য কৃষক-বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে, এবং তার ফলে স্বাধীনতার যে প্রত্যাশাটি উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে তাকে ভাষা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের এই ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত একটি ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি সৃষ্টি করেছিলেন। তাই তিনি বাঙালি জাতির ¯্রষ্টা এবং এই সংগ্রামের ফলে সৃষ্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।”
ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ আবার ঢাকায় আসেন। বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া যখন রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আলোচনা করছিলেন, তখন জেনারেল টিক্কা খানের বাহিনী সন্ত্রাসী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছিল। প্রহসনের এ বৈঠক ১৬ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত চলে। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোও আলোচনায় যোগদান করেন। ইয়াহিয়া আকস্মিক ঢাকা ত্যাগ করলে ২৫ মার্চের মধ্যরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যার অভিযান শুরু হয়। পাকিস্তানি সৈন্য ঢাকা শহরের মধ্যে প্রবেশ করে সামনে যা কিছু পায় সবই ধ্বংস করে দেয় এবং যুবক, বৃদ্ধ, শিশু, নারী সবাইকে নির্র্বিচারে হত্যা করে। ফুটপাতে ঘুমন্ত আশ্রয়হীন দরিদ্র জনগণও রেহাই পায়নি। তারা রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার ইপিআর সদর দপ্তর এবং আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়সহ পুরনো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ পরিচালনা করে। রাজারবাগে প্রায় ১০০০ বাঙালি পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগান, কামান ও ট্যাংকের সাথে টিকতে পারেনি। মাত্র কয়েকজন বাঙালি পুলিশ ব্যতীত সকলেই শহীদ হয়। পাকিস্তান সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল (ইকবাল হল, জগন্নাথ হল ও রোকেয়া হল আক্রমণ করে এবং নির্বিচারে ছাত্রদের হত্যা করে। তারা হল সংলগ্ন শিক্ষকদের বাসগৃহে হামলা চালিয়ে শিক্ষকদেরকেও হত্যা করে। পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িও আক্রমণ করে নির্বিচারে গুলি চলায়। তারা ঐ রাতে (২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে করাচিতে নিয়ে যায়। ঢাকার বাইরে অন্যান্য স্থানেও একইসাথে পাকিস্তানি সৈন্যরা অভিযান পরিচালনা করে নৃশংসতার পরিচয় দেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের এহেন বর্বরোচিত হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নেওয়ার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণ সংকল্প গ্রহণ করে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাঙালি কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, নারী, শিক্ষক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীসহ সকল পেশাজীবী মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঘোষিত হয় স্বাধীনতার বাণী।
মহান স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ:
২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের আপামর জনসাধাণের উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে মহান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘ইহাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহ্বান জানাইতেছি যে, যে যেখানে আছ, যাহার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে রুখে দাঁড়াও, সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ কর। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলার মাটি হইতে বিতাড়িত না করা
পর্যন্ত এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাও।”
সর্বস্তরের জনগণ বর্বরোচিত গণহত্যার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে হাতে অস্ত্র তুলে নেয় এবং বাংলাদেশের নগরে বন্দরে গ্রামেগঞ্জে অমিতেজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধযুদ্ধ আরম্ভ করে। ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, শ্রমিক, কৃষক ও লক্ষ লক্ষ মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণ সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠে। তারা যার যা আছে তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মুক্তিবাহিনী কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত হয়। পাকিস্তানে চাকুরিরত বাঙালি সৈন্য, পুলিশ, ইপিআর, আনসার ও অন্যান্য আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের পেছনে একতাবদ্ধ হয়। মুষ্টিমেয় পাকিস্তানপন্থী দালাল ব্যতীত সমগ্র বাঙালি জাতি পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকালে থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
তাজউদ্দীন আহমদ ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেতারভাষণে ‘মুজিবনগর সরকার’ গঠনের কথা ঘোষণা করেন। ১০ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মুজিবনগরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশকে এগারটি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং সেক্টরে কমা-ার নিয়োগ করা হয়। ১০ নং সেক্টর ব্যতীত সকল সেক্টরে আওয়ামী লীগের এমপি এবং নেতৃদের সমন্বয়ে সেক্টর উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। কর্ণেল এম.এ.জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নবগঠিত মুজিবনগর সরকার শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার অন্তর্গত বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আ¤্রকাননে এক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রথমে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করেন। পুলিশ ও আনসারের একটি সুসজ্জিত দল মহকুমা পুলিশ অফিসার মাহবুবব উদ্দিন এর নেতৃত্বে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও নতুন মন্ত্রীসভাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, ক্যাপ্টেন এ.আর. আজম চৌধুরী, সিভিল সার্ভেন্ট তৌফিক এলাহী চৌধুরী ও অন্যান্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তখন উপস্থিত ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৭ মার্চ ভারতীয় লোকসভায় বাঙালি জাতির সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বাচন করে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য সীমান্ত এলাকায় অসংখ্য যুবশিবির গড়ে উঠে। এসব যুবশিবিরে প্রথাগত যুদ্ধ এবং গেরিলাযুদ্ধ উভয় প্রকার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সীমান্ত এলাকায় পশ্চিম বাংলা, আসাম, বিহার, মেঘালয় এবং ত্রিপুরার রাজ্য সরকার অসংখ্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র এবং শরণার্থী শিবির গড়ে তোলে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্ব থেকে গতানুগতিক প্রথাগত যুদ্ধের পাশাপাশি মুজিবনগর সরকার গেরিলা, রাজনৈতিক যুদ্ধ এবং কুটনৈতিক যুদ্ধের সমন্বয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা গেরিলা অভিযানের ফলে নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। নভেম্বরে মুক্তিবাহিনী সীমান্তলগ্ন অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করে নেয়। হতোদ্যম পাকিস্তানি সৈন্যরা সর্বত্রই পশ্চাদপসরণ শুরু করে। ৩ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তান বিমান বাহিনী আকস্মিকভাবে অমৃতর, শ্রীনগর ও কাশ্মীর উপত্যকায় অঘোষিত বোমাবর্ষণ করলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় বাহিনীকে পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিহত করার আদেশ দিলে যৌথ কমা- কার্যকর হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমা-ের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত হয়। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং সকল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানায়। যৌথবাহিনীর অভিযানে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের অধিকাংশ বিভাগ ও জেলাসমূহ শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। পাক দখলদার বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে রাজাকার, আলবদর, আল-শামস্সহ অবাঙালি ও বিহারীদের সহায়তায় এ ভূখ-কে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবীদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল হতে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত লক্ষ লক্ষ মানুষের জয়ধ্বনির মধ্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে রমনার রেসকোর্স ময়দানে লে.জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পরাজিত পক্ষ হিসেবে লে.জেনারেল নিয়াজী তাঁদের অধিনস্থ বাহিনীর পক্ষে আত্মসমপর্নের দলিলে স্বাক্ষরদানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়। অবশেষে বন্দুকের শক্তি পরাজিত হয় এবং বীর জনতার বিজয় হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু এবং ভারত, পাকিস্তানের স্বাধীনতা:
ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। প্রথমে যদিও বৃটিশ উপনিবেশিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু অচিরেই এ দলে বৃটিশ বিরোধী মনোভাব শক্তিশালী হতে থাকে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে এ দলের নেতৃত্বেই বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। ভারতীয় ঐতিহাসিক শ্রী পট্টভি সীমারাইয়া তাঁর ‘ঞযব ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ওহফরধহ ঘধঃরড়হধষ ঈড়হমৎবংং’ গ্রন্থে কংগ্রেসের উৎপত্তি সম্পর্কে বলেন, ‘কংগ্রেসের উৎপত্তি রহস্যাবৃত। ১৯৭৭ সালে কলকাতার সর্বভারতীয় দরবারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা নেতাদের মনে জাগে। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজের অডিয়ার সমুদ্র উপকূলে থিওজফিক্যাল সোসাইটির সম্মেলনে সমবেত নেতাদের মধ্যে ১৭ জন নেতা গোপনে আলোচনা দ্বারা কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেন।’’
সীতারামাইয়ার মতে, এ্যালান অক্টাভিয়ান হিউমই কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৮৮৫ সালের মার্চ মাসে ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন নামে পুনায় এক ভারতীয় অধিবেশন ডাকেন। পুনায় কলেরার প্রকোপ দেখা দিলে বোম্বাই শহরের মূল গোকূলদাস তেজপাল হলে ২৫ ডিসেম্বর, ১৮৮৫ সালে সমিতির অধিবেশন ডাকা হয়। ইতিমধ্যে সমিতির নাম বদল করে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ ‘ওহফরধহ ঘধঃরড়হধষ ঈবহমৎবংং’ রাখা হয়। এ বিবেচনায় ১৮৮৫ থেকে ১৯৪৭ অর্থাৎ বাষট্টি বছরের দীর্ঘ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।
বৃটিশরা তাদের উরারফব ধহফ জঁষব চড়ষরপু’ মাধ্যমে কখনো কখনো মুসলমানদের কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করলেও মুসলমানরা কোনোভাবেই বৃটিশ সরকারের উপর আস্থা রাখতে পারেনি। ১৮৮৫ সালে বৃটিশ ভারতের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস আত্মপ্রকাশ করলেও মূলত এটি ছিল হিন্দু নেতৃবৃন্দের একটি প্লাটফরম। একারণে ভারতবর্ষের মুসলমানরা কখনই কংগ্রেসকে তাদের প্রাণের সংগঠন হিসেবে দেখেনি। ১৯০১ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুসলমানরা নিজেদের অধিকার রক্ষার জন্য ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। পাকিস্তান আন্দোলনের মূল রাজনৈতিক দল হল মুসলিম লীগ, ১৯০৬ থেকে ১৯৪৭ অর্থাৎ প্রায় ৪১ বছরের মাথায় মুসলিম লীগের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান জন্মলাভ করে।
তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী লীগের জন্মের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ভিন্ন হলেও এ বৃহৎ রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে কিছু সাধারণ মিলও লক্ষ্যনীয়। আন্দোলনের গুণগত ধরণ এবং মাত্রা আজকের এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তারপরও অন্তর্নিহিত দৃষ্টি দিয়ে দেখলে দেখা যায় ভারত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তেমনি বাংলাদেশ স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ‘মুখ্য ভূমিকা’ পালনকারী রাজনীতিক দল। ভারত এবং পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগকে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে হাঁটতে হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচারে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ এর চাইতে অনন্য ভূমিকা পালনকারী একটি রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতা অর্জনকালীন এ তিন বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মূল নেতৃত্বের কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় মহাত্মাগান্ধী এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উভয়ে নিজ দলের পক্ষ থেকে বৃটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ দলের পক্ষ থেকে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন। কিন্তু তিন নেতার মধ্যে গুণগত যে অমিল তা হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ থেকেও প্রবাসী সরকারের রাষ্টপতি ছিলেন। বন্দী মুজিব মুক্ত মুজিবের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। এ বিরল ভূমিকা অন্য দুই নেতার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। সার্বিক বিচারে তাই বলা যেতে পারে আওয়ামী লীগ মানে বঙ্গবন্ধু; বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
শেষ কথা:
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রূপ বা পরিণতি। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে কালক্রমে বঙ্গ থেকে বাঙ্গাল বা বাংলা, সুরে বাংলা, নিজামু, বেঙ্গল, পূর্ব বাংলা, পূর্ব বঙ্গ, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে পরিশেষে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
বাঙালি জাতি রাষ্ট্র গঠনের এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায়, রাষ্ট্রভাবনার যোগসূত্র, এর সঙ্কট ও বিকাশ ধারাকে যদি বিবেচনা করি তাহলে আওয়ামী লীগের জন্মের পূর্বকার এবং পরের সময়ের মধ্যে বিরাটতর গুণগত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এ পথ পরিক্রমায় একক রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’; এ দলের কিংবদন্তী নেতা ‘শেখ মুজিবুর রহমান এবং ‘বাংলাদেশ’-মিলেমিশে একাকার। আমাদের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের বীরত্বগাঁথায় এ সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে অনেক বীর, অনেক মহান ব্যক্তি, সংগ্রামী নেতার আবির্ভাব ঘটেছে। তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মুক্তির আন্দোলন নানা সময়ে নানা মাত্রায় বেগবান হয়েছে। কিন্তু তাঁদের কেউ আমাদেরকে মুক্তির কাক্সিক্ষত বন্দরে নোঙর করাতে পারেনি। মুক্তির সোপান বেয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায়, তাঁরই নেতৃত্বে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ এর মাধ্যমে আমরা নোঙর করি স্বাধীনতার স্বপ্নীল বন্দরে।
তথ্যসূত্র :
১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, চতুর্থ মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৮ খ্রি.।
২. বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১ (১ম ২য় ও ৩য় খন্ড), সম্পাদক: সিরাজুল ইসলাম, এশিয়াটি সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলা সংস্করণ, ডিসেম্বর ১৯৯৩ খ্রি.।
নুরেআলম মিনা বিপিএম (বার), পিপিএম,
ডিআইজি, চট্টগ্রাম রেঞ্জ