এখন সময়:রাত ১০:৪৪- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ১০:৪৪- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

বাংলাদেশের ছোটকাগজ চর্চা

ড. ইসরাইল খান:  ‘বাংলাদেশের ছোটকাগজ চর্চা’ শিরোনামের আওতায় স্বাধীন বাংলাদেশের পুরো সময়কেই আমলে নিতে হয় ;Ñআর এই সময়ের ছোট কাগজগুলোর শুধু নাম-পরিচয় লিখতেও বেশ পরিসরের প্রয়োজন, কিন্তু এখানে সে সুযোগ নেই।

সাতচল্লিশে ‘আজাদ পূর্ব-পাকিস্তান’ বা ‘পূর্ববাঙলা’র বাঙালিরা ঢাকা-কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন ‘পাকিস্তান আমলের সাময়িকপত্র’-সাধনা দ্বারা ; তেমনি সৃজনশীল গঠনমূলক সাময়িকপত্র ঝাঁকে-ঝাঁকে নবগঠিত বাহাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যসমাজে দেখা গেলো না আর।

তথ্য বলছে-, ঊনিশ শো বাহাত্তর সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আগেই ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ অস্তিত¦-বিনাাশের নীল নক্শার অংশ হিসাবে একশ্রেণির সাংবাদিক-সাহিত্যিকের উদ্যোগে নানা রকমের সংবাদপত্র ও সাহিত্যের কাগজপত্রাদি প্রকাশের তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ যেন তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে। দেখুন-

কী আশ্চর্য-সংগতি,- ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনেই প্রকাশিত হল- কবি আল মাহমুদের  সম্পাদনায় ‘বাংলাদেশের মেহনতী মানুষের সাপ্তাহিক মুখপত্র’-‘গণকণ্ঠ’। এই পত্রিকার মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন আফতাবউদ্দীন আহমদ। উনিশশো বাহাত্তর-তেহাত্তর-চুয়াত্তর-পঁচাত্তরে নানা জাতের ও নামের যে-সকল কাগজ বের হয়; তাঁর মধ্যে ‘মানবমুক্তি ও সমাজগঠনের মহৎ ‘ব্রত’ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল এবং সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছিল যে-গুটিকয় সাহিত্যপত্র তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখ্য ‘গণসাহিত্য’-র নাম। অন্য কোনো উল্লেখযোগ্য কাগজের নাম আপাতত আমরা জানতে পারিনি।

এই পত্রিকার (গণসাহিত্য) ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২২ শে শ্রাবণ ১৩৭৯ ৭ আগস্ট ১৯৭২, সম্পাদক-আবুল হাসনাত। ১ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা থেকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নিযুক্ত হন মফিদুল হক (জানুয়ারি ১৯৭৩)। নানাজনের সহযোগিতায় ১৯৭৯ সালের জুলাই পর্যন্ত সাত বছরের মত চলে এটা বন্ধ হয়ে যায়।

‘গণসাহিত্য’ অভিধার মধ্যে যে ব্যঞ্জনা রয়েছে- তা সে পত্রিকার রচনাবলিতে ঠিকই মূর্ত হয়েছিল। সে কারণে কোনো আমলেই এ-পত্রিকার আবেদন ক্ষুণœ হয়নি, এখনও তা গুরুত্বপূর্ণ পঠনসামগ্রী। ‘বাংলাদেশের ছোটকাগজের পথনির্দেশক’-এই কাগজের যাত্রারম্ভের ঘোষণা ছিল :

‘‘মানবমুক্তির মহৎ ব্রত নিয়ে গণসাহিত্য আত্মপ্রকাশ করছে। রণক্ষেত্রে বৃহৎ সৈন্যদল চালনার জন্য চাই সেনাপতি। সাহিত্য-আন্দোলনও সেভাবে গড়ে ওঠে পত্র-পত্রিকা কেন্দ্র করে। আর সুপরিকল্পিত ও নিরন্তর সচেতন প্রয়াস ছাড়া সাহিত্যকে সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত রাখার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হতে পারে না। মানুষ সমাজের প্রয়োজনেই প্রকৃতিকে রূপান্তর করতে গিয়ে উন্মুক্ত করেছে শিল্প সংস্কৃতির যাদুর ভা-ার, আগুনের ফুলকির পরশ।…

স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষ ওঠে এসেছে প্রমিথিউসের মতোই, অত্যাচারে নতজানু নয়।… নতুন মানুষের কথা সাহিত্যের অঙ্গনে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে গণসাহিত্যের আবির্ভাব। …মৃত অতীত, বাস্তব বর্তমান ও আশাময় ভবিষ্যৎকে সামনে রেখেই গণসাহিত্য প্রকাশিত হল। গণসাহিত্য নামটিতে জীবনমুখিন মহৎ কল্যাণকর, সুন্দর ও মুক্তির যে অঙ্গীকার বহমান সে সম্পর্কে আমরা অতি সচেতন । এর যে কোনো লক্ষণ বা ধর্ম থেকে আমরা বিচ্যুত না হতে সতর্ক থাকবো।’’

গণসাহিত্য ‘মাসিক’ সাহিত্যপত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হওয়া শুরু করলেও সওগাত-সমকালের ন্যায় নিয়মিত ‘মাসিক সাহিত্য-পত্রিকা’-র আবহ তৈরি করতে পারেনি। সেই ‘শোনা-দেখা-স্মৃতিঘেরা’ ‘সাময়িক-পত্রের যুগ’ স্বাধীন বাংলাদেশে আর আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। কোনো ‘যুগ’ বা অধ্যায়েরও সুচনা করেনি কোনো সাহিত্য-সাময়িকী।

পঁচাত্তরের রক্তাক্ত পনেরই আগস্ট ঐতিহাসিক নৃশংস হত্যাকা-ের পর ‘প্রতিবাদী-সাহিত্য’ ও নতুন স্বদেশ গড়ার প্রত্যয়ে শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর সিকান্দার আবু জাফরের যুগান্তর সৃষ্টিকারী মাসিক সমকাল পত্রিকা নতুন করে হাসান হাফিজুর রহমান ও ইসমাইল মোহাম্মদের সম্পাদনায় ১৯৭৬ থেকে পুনঃপ্রকাশ ঘটিয়ে সেই চেষ্টা করেছিলেন একবার। আর একবার অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বিরাট উদ্যম নিয়ে ১৯৮২ সালে ‘সৃজনপ্রয়াসী মাসিক লোকায়ত’ পত্রিকা প্রকাশ করে তিন-চার বছর মোটামুটি নিয়ম রক্ষা করে চালাবার প্রয়াস পেয়েছিলেন।

কিন্তু সাময়িক-সাহিত্যের সেই ‘স্বর্ণযুগ’ আর ফিরে আসেনি।

ক্রমান্বয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে ‘শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকা’ বর্তেছে এখনকার ‘বাংলাদেশের ছোটকাগজের’ ওপরে। কিন্ত স্বাধীনতার পরে, বিগত পঞ্চাশ বছরে কয়টি সাহিত্য-সাময়িকী প্রকাশিত হয়েছে- যাকে প্রকৃতপক্ষে দুইশো বছরের ঐতিহ্যবাহী বাংলা সাময়িক-সাহিত্যের প্রতিনিধি বলা চলে?

বর্তমানে যে শতাধিক ছোট কাগজ ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকাশিত হয়ে আমাদের দেশের সামগ্রিকভাবে ‘সাহিত্য-পত্রিকার’ অভাব মিটাচ্ছে বা সমাজে সাহিত্য-শিল্পের ভূমিকা পালন করছে- তাদের পূর্বসূরীদের অবদান স্মরণ করতে গেলে আমাদের কয়েকটি সামাজিক-রাজনৈতিক কালপর্বে বিভক্ত করে ‘যুগের চাহিদা’ বা ‘কালের দাবী’ মেটানো জিজ্ঞাসার আলোকে তার বিবেচনা করতে হবে।

এইসব কালপর্বের একটি হল-বাহাত্তর থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাঘটনার ‘রক্তাক্ত-পঁচাত্তর পর্ব’। এই সময়ে কোন্ কোন্ পত্রিকা সদ্য-স্বাধীন শিশু-রাষ্ট্র-বাংলাদেশকে সযতেœ লালন-পালন ও বিকাশের জন্য সাহিত্য-শিল্পের পুষ্টিকর রসাস্বাদনে বিকশিত করার প্রয়াস গ্রহণ করেছিল- তার বিচার করতে হবে।

আরেকটি হল,- পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা-কল্পে মসীযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল কি না কোনো পত্র-পত্রিকা-; আর কারা তাঁর বিপক্ষে কলমের রক্ত ঝরিয়েছিল?- তা অনুসন্ধান করা।

আর একটি পর্ব-আশির দশকের বিশেষ সময়। আরেকটি নব্বইয়ের দশক ও একুশ শতকের সন্ধিক্ষণ। বিশেষ-বিশেষ সময়ে আমরা দেখবো কিছু কিছু ছোটকাগজ সময়োপযোগী অবিস্মরণীয় সাহসী ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু এইরকম প্রশ্নের আলোকে আমাদের বিগত পঞ্চাশ বছরের সাময়িক পত্র-পত্রিকার মূল্য নির্ধারণের জন্য এখনো কোনো একাডেমিক গবেষণা পরিচালিত হয়নি।

এমনিতেই আমরা সাধারণভাবে কোনো পত্রিকাকে ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’ বলে আসছি।

দুই

১৯৭২ থেকে ১৯৮০-৮১ পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতর থেকে সাপ্তাহিক মাসিক বা বিশেষ পর্ব উপলক্ষ্যে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার এক বিরাট অংশই অনিয়মিত সাময়িকী ও ‘একুশের সংকলন’। প্রায় প্রতিটি আমলেই ফেব্রুয়ারি মাসে লিটল

ম্যাগাজিন বা একুশের সংকলন প্রকাশ করার আগ্রহ-উত্তেজনা তরুণ-সমাজে যেভাবে সঞ্চারিত হয় তাতে জাতির আশাবাদী হওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যেতো, যদি নাÑতার নেপথ্যে কার্যকর থাকতো তৎকালীন সামরিক স্বৈর-শাসকদের হীন চক্রান্ত। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সামরিক ও স্বৈর সরকার ১৯৭৫ সালের পরে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান বন্ধের কূট-কৌশল গ্রহণ করে ব্যর্থ হওয়ার পরে মিডিয়ার অবাধ প্রকাশের সুযোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ঐকালের কাগজে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও তাঁর ‘সোনার বাঙলা’র কথা ছিল না। পাকিস্তান ছিল তাঁদের কল্পনায়। এই সময়েও কিছু ছোট কাগজ ছিলÑমূলধারার সাহিত্য-শিল্পচর্চার মহৎ উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের ভাবনাতে। নব-পর্যায়ের সমকাল, গণসাহিত্য, বক্তব্য, এপিটাফ, ধানসিঁড়ি, এরকম ক’টা গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার সমকালে আমরা সাম্প্রতিক, কাশবন, বিকাশ, শিল্পতরু, ধারণী, জয়ধ্বনি, অরণি, অনিন্দ্য, একবিংশ, নান্দীপাঠ প্রভৃতি কাগজের কথা জানি।

 

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কণ্ঠস্বর বাংলাদেশ আমলের সাহিত্যের মুখপত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করল ১৯৭২ থেকেই, কিন্তু তাতে নতুন প্রাণের স্পন্দন ধ্বনিত হলো না। আমিনুল ইসলাম বেদু সম্পাদিত সাম্প্রতিক, আনওয়ার আহমদ সম্পাদিত অতলান্তিক ও রূপম, মহসিন শস্ত্রপাণির উন্মেষ, সংস্কৃতি, জনান্তিক, আজকাল, ত্রিভুজ, ড্যাফোডিল, থিয়েটার, অতলান্তিক নিয়মিত বের হতো। একালের নামকরা সাহিত্যপত্র ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’। কিন্তু কী সমস্ত রচনাদি থাকতো তাতেÑ তা আজো অপরীক্ষিত।

তবে সাধারণভাবে আমাদের সমকালে প্রকাশিত ঐসব পত্র-পত্রিকায় স্বাধীন বাংলাদেশ আমলের সক্রিয় কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিকগণ লেখালেখি চিন্তাচর্চার সুযোগ লাভ করেছিলেন। কিছু ভালো লেখা তাতে ছাপা হয়েছিলোÑযার সুফল জাতি ভোগ করেছিলো।

আবদুল মান্নান সৈয়দ ও আবদুস সেলিম সম্পাদিত শিল্পকলা ও চারিত্র, সপ্তক ওসমানের সংলাপ, স্বরগ্রাম, ঊষালোকে এবং সন্ধিক্ষণ ; চট্টগ্রামের সুনীল নাথ সম্পাদিত মফস্বল, স্বপন দত্ত সম্পাদিত স্পার্ক জেনারেশন, শিশির দত্ত সম্পাদিত সম্পাদক ইত্যাদি বিশ শতকের শেষ তিন দশকের নামকরা কিছু ছোট কাগজ।

 

একালে সম্ভাবনাময় একটি কাগজ হতে পারত ‘সাহিত্যপত্র’, যেটা সম্পাদনা করতেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। মালিক ছিল প্রকাশনা সংস্থাÑমুক্তধারা। ত্রৈমাসিক হিসেবে ৭ বছরে ২৮টি সংখ্যা এর প্রকাশিত হয়Ñযাতে অনেক বিতর্কিত বিষয়ও স্থান পায়; অনেক লেখা ছিল প্রাগ্রসর চিন্তার বাহন। কিন্তু দু-চারটি রচনা দিয়ে কি একটি পত্রিকা আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে? ব্যক্তি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বিতর্ক সৃষ্টি করার স্বকীয় লেখকসত্তা থাকলেও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মুখপত্রে  বেশি সংখ্যক মানুষকে অখুশি করার মতো সত্য-তিক্ত ভাষণ মুদ্রণ সম্ভব ছিল না বলেই সম্পাদকের যোগ্যতার পূর্ণ প্রতিফলন তাতে ঘটেনি।

একই অবস্থা মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত ত্রৈমাসিক ‘সুন্দরম’, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সম্পাদিত দীপঙ্কর, এখন, খান সারোয়ার মুরশিদের স্ত্রীর নামে (নূরজাহান মুরশিদ) ‘একাল’ বা ‘এদেশ একাল’ প্রভৃতি পত্রিকার কপালে ঘটে। একালের আর একটি দীর্ঘস্থায়ী পত্রিকা মুহম্মদ হাবীবুল্লাহ সম্পাদিত ‘সমালোচনা’Ñ ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত টিকেছিল। বইয়ের আলোচনা ও সমালোচনা সাহিত্য ছিল তাঁদের পত্রিকার মূল বিবেচ্য বিষয়।

সত্তর ও আশির দশকের আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকার মধ্যে পাওয়া যায়  মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা সম্পাদিত গণসংহতি ; মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর সম্পাদিত রবীন্দ্রচর্চা; আইউব হোসেন সম্পাদিত মনন ; বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সহযোগিতায় লিয়াকত আলীর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘মুক্তবুদ্ধির মুখপত্র’ চিহ্নিত প্রেক্ষিত ; আবদেল মাননান সম্পাদিত মৌলিক ; ‘নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট’-যার অন্যতম উপদেষ্টা সৈয়দ আলী আহসান ও আল মাহমুদ; ফরহাদ মযহার সম্পাদিত প্রতিপক্ষ, অধুনা এবং ভাষাপত্র (১৯৮১-৮৬) প্রভৃতি।

‘অধুনা’ যাঁরাই প্রকাশ করুন না কেন, এতে উপদেষ্টা হিসেবে নাম ছাপা হতো এদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের। ভাষাপত্র বাংলাদেশ ভাষা সমিতির মুখপত্র বলে মনে হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ ভাষা সমিতির চরিত্র ছিল মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারী মুসলিম সাহিত্য সমাজ বা সওগাত সাহিত্য মজলিশের মতো একটি উদারপন্থী চিন্তাচর্চা কেন্দ্র। যদিও এর কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল ‘ভাষা’ বা ‘বাঙলাভাষা’।

ঐ সময়ের অরুণিমা, অরুন্ধতী, মঙ্গল-সন্ধ্যা, আত্মপ্রতিকৃতি প্রভৃতি বেশ নাম করেছিল। হাবিব ওয়াহিদ সম্পাদিত অনিন্দ্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ছাত্র সাজ্জাদ আরেফিন সম্পাদিত নান্দীপাঠ-এ আধুনিক সাহিত্যের এবং শিল্পকলার নতুন চিন্তার সম্প্রচার করার পরিচয় পাওয়া যায়। অরণি, অনিন্দ্য ও নান্দীপাঠ এখনও সচল। এঁদের পত্রিকা প্রয়াসই ছোট কাগজের ধারাকে সক্রিয় রেখেছে অনেকদিন ধরে।

১৯৯০ দশকের প্রথম দিকেই মেসবাহ কামালের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সমাজচেতনা’। এই পত্রিকা প্রগতির ধারায় সামাজিক রূপান্তর সাধনের প্রতিশ্রুতিমূলক প্রবন্ধ, অনুবাদিত নিবন্ধ এবং চলতি ঘটনার বিশ্লেষণমূলক রচনা প্রকাশ করে। মার্কসীয় আদর্শের প্রতি আনুগত্য তাঁদের সম্পাদকীয় নীতি ছিল।

আজকের কাগজ কর্তৃপক্ষও শেষকালে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নাম সম্পাদক হিসেবে ছেপে প্রকাশ করেন মাসিক ‘সভ্যতা’। ১৯৯৮ সনে এর কয়েকটি সংখ্যাই মাত্র বের হয়। বেক্সিমকো বের করেছিল ‘শৈলী’। কিন্তু কোনো নাম সুনাম প্রভাব সৃষ্টি না-করেই সেগুলো উঠে যায়। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি মালিক কর্তৃপক্ষ দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ও  জনতাকে নিয়ন্ত্রণ বা কাবু করার নিয়তে যা বের করতে উদ্যত হয়েছিলেন, তাতে সৃজনশীল চিন্তা বিপথগামীই হয়েছে, পথ হারিয়েছে।

উপরে উল্লিখিত সৃজনপ্রয়াসী, ছোট লিটল ম্যাগাজিন নামধেয় পত্র-পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে নতুন লেখক সৃষ্টির প্রয়াস নিয়ে, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভাবনায় নতুন গতিপথ নির্দেশ করার চেষ্টা করে বিদ্বৎসমাজে যে একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিলেন সম্পাদক-প্রকাশকগণ,–নব্বইয়ের দশকে এনজিও-তৎপরতায় অসংখ্য দৈনিক, সাপ্তাহিক প্রকাশিত হওয়াতে, বিশ্বরাজনীতিতে বিশ্বায়নের প্রাকৃতিক ধোঁয়া তুলে যে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি করা হয়, দৈনিক পত্রিকার হঠাৎ ভীড়ে সৃজনপ্রত্যাশী সাহিত্য-সাময়িকী তথা ছোটকাগজের অস্তিত্ব তখন প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে একজন প্রত্যক্ষদর্শী সমালোচক মন্তব্য করেছিলেনÑ

‘একবিংশ শতাব্দীতে বাঙালীর সৃজনশীলতার বিকাশ কী কী মাধ্যমে সাধিত হবেÑপ্রশ্ন জাগে মনে। আরও ভাবিয়ে তুলছে বিশ্বায়নের এই যুগে বাংলা সাহিত্যের গতি কোন্ দিকে মোড় নেবে, অথবা এর পরিণতি হবে কী ?’Ñ

কিন্তু এইসব সংশয়ের আবর্ত থেকে আমাদের উদ্ধার করেছেÑ একবিংশ শতকের সূচনালগ্ন থেকেই আবার নতুন উদ্যমে বের হতে থাকা গভীর চিন্তা-চেতনা ও অগ্রগামী সাহিত্য-ভাবনার প্রতীক সাময়িকীসমূহÑযথা: নিসর্গ, নান্দীপাঠ, অনিন্দ্য, পুষ্পকরথ, চিহ্ন, শালুক, অরণিকা, লোক, চর্যাপদ, গা-িব, ধমনি, মনন রেখা, মগ্নপাঠ, লিরিক, কর্ষণ, অমৃতাক্ষর, খড়িমাটি, ঘুংঘুর, অনীক প্রভৃতি।

এইকালে শিল্প ও সাহিত্যসমাজে গুরুত্বপূর্ণ একটা চাহিদার যোগান দেয় আহমাদ মাযহার সম্পাদিত কেবলমাত্র ভালো বইয়ের শিল্পসম্মত সমালোচনা-আলোচনার কাগজ ‘বইয়ের জগৎ’। এদের সাথে যুক্ত হয়েছে আরো প্রায় শতশত ছোটকাগজÑযেসবের চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের দিন অবশ্য সামনেই রয়ে গেছে।

এই এক ঝাঁক ছোট কাগজ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজের অগ্রগতির লক্ষ্যে তাঁদের পবিত্র শ্রম ও সাধনা নিয়োজিত করেছেনÑ। ফলস্বরূপÑ  একটা চমৎকার ভবিষ্যৎ আমরা নিশ্চয়ই অত্যন্ত প্রশান্তি নিয়ে প্রত্যক্ষ করতে পারব।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত ‘লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনী ও সম্মাননা ২০২৩’ অনুষ্ঠানে ৬ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে পঠিত রচনা।)

 

ড. ইসরাইল খান, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে