অনুবাদ: আলমগীর মোহাম্মদ : পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয় হলো পানি। আর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চা এই দ্বিতীয় জনপ্রিয় পানীয়ের জনপ্রিয়তা গড়ে উঠে মূলত চীন দেশকে ঘিরে। হাজার হাজার বছর ধরে চীনা কৃষকরা চা ব্যবসায় একক আধিপত্য বিস্তার করেছেন। গ্রীষ্মম-লীয় ও প্রায়-গ্রীষ্মম-লীয় এলাকায় চায়ের চাষাবাদ শুরু হয়েছে বেশিদিন আগে নয়।
ভারতের আসামে চা চাষের শুরু ১৮৩৯ সালে। আমাদের অঞ্চলে চা বাগানের পরীক্ষামূলক যাত্রা শুরু হয় ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে। এবং বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান চালু হয় ১৮৫৪ সালে। তখন থেকে চা শিল্প অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। ১৯৪৭ সালে ভারতভাগ ও ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এই দুইটি ঘটনা চা শ্রমিকদের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এই দুইটি ঐতিহাসিক পটপরিবর্তনের ফলে পর্যাপ্ত সরকারি জমির উপর ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাতে গড়ে ওঠা চা বাগানগুলোর মালিকানা বদল হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ১৬৩টি চা বাগান আছে। এদের মধ্যে ৩৬ টির অবস্থা দুর্বল। নিকট অতীতে গড়ে উঠা পঞ্চগড়ের সাতটি চা বাগান ছাড়া বাকিগুলোর জমির মালিকানা বাংলাদেশ সরকারের। কলোনিয়াল উত্তরাধিকারসূত্রের কারণে আমাদের চা বাগানগুলো বিস্তৃত জায়গা জুড়ে আছে এবং মালিকদের আচরণ অনেকটা জমিদার ও সাহেবদের মতো। উদ্বেগের বিষয় হলো বরাদ্দকৃত মোট জমির ৪৫ ভাগ চা উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়। চা চাষের জন্য বরাদ্দকৃত জমির একটা বিশাল অংশ অন্য কোন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা অন্যায় এবং এই ধরণের অন্যায়ের ফলে চা শ্রমিকদের সাথে অবিচার করা হয়।
বাংলাদেশে চা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো ভারত ভাগের পরে এ দেশে উৎপাদিত চায়ের বেশিরভাগ ভোগ হতো পাকিস্তানে। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান আমাদের সবচেয়ে বড় চা আমদানিকারক হিসেবে আছে। যাহোক, বর্তমানে দেশে উৎপাদিত সিংহভাগ চায়ের গ্রাহক বাংলাদেশীরা। ২০০৭ সালে উৎপাদিত মোট চায়ের পরিমাণ ৫৭.৯ মিলিয়ন কেজি। এর মধ্যে শুধু ১০.৬ মিলিয়ন কেজি রপ্তানি হয়েছিল। এই রপ্তানির ৮২ ভাগ আবার পাকিস্তানে। আশংকার বিষয় হলো চা উৎপাদনের পরিমাণ যদি উল্লেখযোগ্য হারে না বাড়ে, এবং একই সাথে চা গ্রাহকের সংখ্যা বাড়তে থাকে অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশে চা আমদানি করতে হবে। বাস্তবতা হলো রপ্তানি দ্রব্য হিসেবে চা এখন খুব একটা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারছে না যদিও ২০০৭ সালে চা উতপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে এদেশের অবস্থান ১০তম।
চা নিয়ে আলোচনা, চা উৎপাদন, খরচ ও ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম প্রতিনিধিত্ব চা বাগান শ্রমিকদের। চা শিল্প অন্যান্য শিল্পের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। চা উৎপাদনের সাথে কৃষি ও শিল্পের যোগসূত্র আছে। এই দুই ক্ষেত্রে শ্রমিক বন্টনের বিশেষত্ব হলো অধিকাংশ শ্রম-শক্তি কৃষির সাথে জড়িত। চা বাগানে অথবা মাঠে। চা শিল্প বাঁচিয়ে রাখেন যেসব শ্রমিক তাঁরা স্থানীয় নয়। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো তাঁদেরকে সিলেট অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল বিহার, মাদ্রাজ, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে। শর্তাবদ্ধ এই শ্রমিকদের দূর্ভাগ্যের শুরু চা বাগানে তাঁদের অভিষেকের মাধ্যমে। সূত্রমতে, আমদানি করা এই শ্রমিকদের তিন ভাগের এক ভাগ মারা গিয়েছিলেন দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি ও কঠিন শ্রম ও প্রতিকূল পরিবেশে বসবাসের কারণে। চা বাগানে আসার ফলে এই শ্রমিকরা নতুন একটা পরিচয় লাভ করেন। তাঁদের নতুন পরিচয় হলো কুলি এবং চা কোম্পানিদের সম্পদে পরিণত হলেন। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর এই শ্রমিকরা গহীন জঙ্গল কেটে পরিষ্কার পরে চা রোপণ, চারার পরিচর্যা, ছায়াতরু রোপণ, এবং মালিকদের জন্য বিলাশবহুল বাংলো নির্মাণ করেন। কিন্তু, নিজেদের নিয়তির পরিহাসে তাঁদের স্থান হলো শ্রমিক লাইনের নিজ হাতে নির্মিত কুঁড়েঘরে।
তাঁরা প্রথম যখন এলেন তখন চার বছরের চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এটাই ছিলো তাঁদের গোলামি বরণের শুরু। দেড়শো বছরের বেশি সময় ধরে, প্রায় চার প্রজন্ম কেটে গেছে শ্রমিক লাইনে চা শ্রমিকদের যুক্ত হওয়ার পর। কিন্তু, তাঁদের জীবন ও জীবিকা শুরু থেকে একই জায়গায় আটকে আছে। তাদের কোন পছন্দ থাকতে নেই এবং দারিদ্র্যই তাদের স্বত্ব। মজুরির পাশাপাশি, যা বর্তমান অর্থনৈতিক মানদন্ডে নিতান্তই কম, অল্পকিছু সুযোগ সুবিধা তাঁরা পান। শ্রমিক লাইনের মালিকপক্ষের দেওয়া শীর্ণ ঘরগুলো এসব সুবিধার মধ্যে অন্যতম। একজন শ্রমিক একটা ঘর পেয়ে থাকেন যার দেখভালোর দায়িত্ব মূলত মালিকপক্ষের। যাহোক, সাধারণত শ্রমিকরাই এই ঘরগুলোর দেখভাল করে থাকেন। এইসব ঘর বসবাসের জন্য অনেকাংশে অনুপযোগী এবং অস্বস্তিকর। লাইনের ঘরগুলোতে একটামাত্র কক্ষে পরিবারের নানা বয়সী সদস্যদের নিয়ে বাস করতে হয় তাদেরকে। এসব ঘরগুলতে মানুষের সাথে অনেকসময় গৃহপালিত গরু ছাগলও বসবাস করে। কিছু কিছু পরিবার অতিরিক্ত একটা ঘর নির্মাণের চেষ্টা করেন। অবশ্যই এর জন্য তাঁদেরকে কতৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়।
চা শ্রমিকদের দৈনিক বা মাসিক মজুরিই হলো সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। শ্রমিক প্রতি সর্বোচ্চ দৈনিক নগদ মজুরি হলো ৩২.৫৫০ (২০০৮ সালে) যা বর্তমানে এক মার্কিন ডলারের এক তৃতীয়াংশেরও কম। এই নিম্নতম মজুরি শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যদিও তাঁরা বেতন ছাড়াও রেশনে কিছু খাবার পান তবুও একজন শ্রমিকের পক্ষে মানসম্মত খাবার খাওয়া সম্ভব হয় না। বস্তুত, তাঁদের কোন বেলার খাবারে পর্যাপ্ত প্রোটিন থাকে না। শারিরীক অবস্থা দেখে বোঝা যায় তাঁদের পাতে পুষ্টিগুণসম্পন্ন আহার জুটে না। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন যা শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং বাংলাদেশ চা এসোসিয়েসন যা মালিকদের প্রতিনিধিত্ব করে প্রতি দুই বছর অন্তর সম্মতি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ষেষ চুক্তি কার্যকর হয়েছিল ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। দুই বছর মেয়াদি চুক্তির কার্যকরীতা শেষ হয়েছে ৩১ অগাস্ট, ২০০৭। দেশে জরুরি অবস্থা এবং চা শ্রমিকদের মধ্যে বিবাদমান দুই পক্ষের বিবাদের ফলে যথাসময়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। যাহোক, চুক্তি না থাকায় মালিকপক্ষ অন্তর্র্বতীকালীন সময়ে আড়াই টাকা বেতন বৃধি করেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন তাঁদের দাবিতে শতভাগ মজুরি বৃদ্ধির দাবি করেছিল। কিন্তু, মালিকপক্ষ সেই জায়গায় প্রতি দুই বছরে দুই টাকা করে মজুরি বাড়িয়েছিল যা শেষমেশ বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন মেনে নিয়েছিল। ২০০৮ সালে নির্বাচিত বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ ২০০৯ সালে পেশ করা দাবিদাওয়াতে শ্রমিক প্রতি দৈনিক নগদ মজুরি ৩২. ৫০ টাকার স্থলে ৯০ টাকা করার প্রস্তাব দেন। এখন এটা দেখার বিষয় মালিকপক্ষ চা শ্রমিকদের এই দাবিদাওয়া কীভাবে মেনে নেয়।
নগদ মজুরি ও ঘর ছাড়া অন্যান্য সুবিধাগুলো হলো কিছু ভাতা, উপস্থিতি প্রণোদনা, রেশন, ক্ষেত করার সুযোগ (যারা ফসল ফলানোর অনুমতি দেন তাঁদের রেশন কেটে নেওয়া হয়), মেডিকেল সুবিধা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন ইত্যাদি। চা এসোসিয়েশনের হিসেব অনুযায়ী চা শ্রমিকদের পেছনে তাঁদের দৈনিক গড় খরচ ৭৩ টাকা। নবনির্বাচিত শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের হিসেব অনুযায়ী তা আরো কম।
দীর্ঘকাল ধরে “চা শ্রমিক অধ্যাদেশ ১৯৬২” ও “চা শ্রমিক আইন ১৯৭৭” অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শ্রমিক কল্যাণ নিয়ে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ সংজ্ঞায়িত করে আসছে। ২০০৬ সালে এই দুইটিও আইন অন্যান্য শ্রম আইনসহ বাতিল হয়। পূর্বতন মোট ২৫ টি শ্রম আইন বাতিল কত্রে নতুন করে শ্রম আইন ২০০৬ পাস হয়। চা বাগান শ্রমিকদেরও এ আইনের আওতায়ভুক্ত করা হয়। নতুন আইনে শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিক প্রতি সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৫০০ টাকা। চা শ্রমিক, যারা এই আইনে প্রস্তাবিত সর্বনিম্ন মজুরির চেয়েও কম পেতেন, তাঁরা মজুরি বৃদ্ধির দাবি তোলেন। তাঁদের সেই দাবি মানা হয়নি। ২০ জুলাই ২০০৮ তারিখে ডেপুটি ডিরেক্টর অব লেবার, চা- শিল্প শ্রমিক কল্যাণ বিভাগ, শ্রীমঙ্গল, মৌল্ভীবাজার, এক চিঠিতে ঘোষণা করেনঃ গেজেটে ঘোষিত সর্বনিম্ন মজুরির অংক চা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।“ চিঠিতে আরো বলা হয় চা শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে সরকার ইতোমধ্যে আলাদা একটা ওয়েজ বোর্ড গঠন করেছেন এবং সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণের বিষয়টা বিবেচনাধীন। “ওয়েজ বোর্ডের কার্যক্রমের গতি কেমন হবে সেটা এখনো দেখার বাকি।
ভারতের চা শ্রমিকদের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের বেতন অনেক কম। দার্জিলিং, তেরাই এবং পশ্চিমবঙ্গের দোয়ার্স এলাকায় ২০০৮ সালে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল ৫৩. ৯০ রুপি। তিন ধাপে বৃদ্ধি পেয়ে যা ২০১১ সালে দাঁড়াবে ৬৭ রুপিতে। শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন এর পেছনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের তুলনায় ভারতের শ্রমিকরা অন্যান্য সুবিধা যেমন রেশন, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বোনাস ও গ্যাচুইটি প্রভৃতি কম পান। কিন্তু, আপনি বিভ্রান্ত হবেন জেনে যে বাংলাদেশের চায়ের আন্তর্জাতিক নিলাম মূল্য দক্ষিণ এশিয়াত্র অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। অথচ উৎপাদন খরচের দিক দিয়ে ভারত, শ্রীলংকা ও কেনিয়ার চেয়ে কম খরচ করে বাংলাদেশ। অবশ্যই অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ইউনিট প্রতি চা উৎপাদনের হার কম এদেশে। অনেকে বিশ্বাস করেন বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের কম মজুরি দেওয়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। তাঁরা আরো বেশি মজুরি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
চা শ্রমিক যারা দিনের প্রায় পুরো সময়টা জুড়ে খরতাপে পুড়ে কাজ করে তাদের বাসস্থানের নাজুক অবস্থা একটা উদ্বেগের বিষয়। একজন নারী শ্রমিক অবসরের আগ পর্যন্ত তাঁর কর্মঘন্টার প্রায় পুরো সময় দাঁড়িয়ে পাতা তোলেন যা সময়ের হিসেবে ৩০-৩৫ বছর। চা শ্রমিকদের মধ্যে যারা পাতা তোলেন তাঁদের দৈনিক কর্মঘন্টা সাত-আট ঘন্টা। শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত তাঁরা কাজ করেন। রবিবার হলো তাঁদের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। কিছু অতিরিক্ত আয়ের জন্য আরো কাজ করা মানে অতিরিক্ত বেদনার ভার নেওয়া।
একটি সমাজের রূপান্তর বা উন্নয়ন ঘটে শিক্ষার মাধ্যমে। এই শিক্ষা গ্রহণে পিছিয়ে চা শ্রমিকরা । বাংলাদেশ চা বোর্ডের হিসেব (২০০৮) মতে, ১৫৬টি বাগানে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ১৮৮ টি । যেখানে প্রায় ২৫, ৯৬৬ জন শিক্ষার্থী ও ৩৬৬ জন শিক্ষক আছেন। চা বাগান মালিকদের প্রতিষ্ঠিত কিছু স্কুল ছাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা একেবেরে হাতে গোনা। বর্তমানে বিভিন্ন এনজিও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্কুল পরিচালনা করে। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিশ্চিত হচ্ছে কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয়। একটা বড় সংখ্যক চা শ্রমিকদের ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে এবং এক প্রকার বাধ্য হয়ে অন্য চাকরি না পেয়ে চা বাগানে শ্রমিকের কাজে যোগ দেয়।
চা শ্রমিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। তাঁরা রাষ্ট্রের বিশেষ বিবেচনা পাওয়ার যোগ্য। শুধু সমান আচরণ নয়। কিন্তু, দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো তাঁরা সামাজিকভাবে একঘরে, অল্প মজুরি পান, অধিকাংশক্ষেত্রে নিরক্ষর, বঞ্চিত ও বিচ্ছিন্ন। তাঁরা তাঁদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, এবং একতা হারিয়েছেন। চা বাগানের শ্রমিক লাইনের তথাকথিত আবাসনের তারা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাস করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে তাঁদের কোন যোগাযোগ নেই বলললেই চলে। অধিকন্তু, বাঙালিরা তাঁদেরকে অচ্ছ্যুত মনে করেন। মননের উতকর্ষ সাধনের অভাবে তাঁরা নিজের জীবনের মর্যাদা হারিয়েছেন। তাঁদের এই পিছিয়ে পড়ার কারণে লাভকারী মালিকপক্ষ তাঁদের আরো বেশি শোষণের সুযোগ পেয়ে যান। বঞ্চিত, বিচ্ছিন্ন এবং শোষিত অধিকাংশ চা শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন।
ভাবনার বিষয় হলোঃ চা বাগান শ্রমিক সম্প্রদায় আর কতদিন বাগানের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে? চার প্রজন্ম ধরে চাষ করে আসা ভূমিতে তাঁরা কি কোন পছন্দ বা অধিকার ছাড়া জীবনযাপন করে যাবেন? সম্ভবত মালিকপক্ষ চান বর্তমান অবস্থা চালিয়ে নিতে যাতে তাঁরা সস্তায় শ্রম পান। কিন্তু, চা শ্রমিকরা বর্তমানে আগের চেয়ে কিছুটা অধিকার সচেতন এবং তাঁরা ন্যায্য আচরণ চান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা, পানি ও স্যানিটেশন প্রভৃতি বিষয়ে রাষ্ট্র ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো থেকে পরিকল্পিত সেবা চান। তাঁরা আরো চান তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিরাপদ থাকুক।
চা বাগানের বাইরে সম্পূর্ণ অজানা একটা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত চা সম্প্রদায় সবসময় হীনমন্যতায় ভুগেন এবং এই কারণে তাঁরা প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে ভয় পান। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাঁরা দেশের যেকোন অঞ্চলে বসবাসের অধিকার রাখে। কিন্তু, বাস্তবতা হলো তাঁরা কখনো চা বাগানের বাইরে বের হননি। একটা অদৃশ্য শৃঙ্খল তাঁদেরকে বাগানের ভেতর আটকে রেখেছে। আর্থ-সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, ভূমিহীনতা, এবং মালিক ও বাঙালি প্রতিবেশিদের কাছে বিরূপ আচরণের শিকার হওয়ার কারণে তাঁরা নিজেদেরকে বন্দী শ্রমিক হিসেবে ভাবতে শুরু করেন।
আলমগীর মোহাম্মদ, শিক্ষক ও অনুবাদক