কাজী লাবণ্য
‘বৃক্ষ মানুষের পরম বন্ধু’
এই বাণী আজকাল কেবল কাগজ কলমে থেকে গেছে এটা সত্যি হতো যদি আমি আমার দেশের মাটিতে বসে একথা লিখতাম। আমাদের অধিকাংশ বিষয়রই ঠাই হয় কেবল কাগজ কলমে। আদতে এ বাণী চিরন্তন। কেবলমাত্র একটি বৃক্ষকে তিন হাজার কিলোমিটার দূর থেকে নানা কসরত করে নানা প্রতিকূলতাকে নিজের গ্রিপে এনে যখন কেউ এটি নিজ এরিয়ায় রোপণ করে এবং সেটি মরে না গিয়ে তার প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রতিদান দেয়, বেঁচে থেকে, পাতা দিয়ে, ফুল দিয়ে তখন প্রমাণিত হয় এ কেবল কাগজ কলমে নেই।
যদিও সেই বৃক্ষের শাখায় পাতা থাকে বছরের ছয় মাস। তবে তার কা-ে সে কয়েক লক্ষ লিটার জল ধারণ করে রাখতে পারে।
ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ‘কিংস পার্ক অ্যান্ড বোটানিক গার্ডেন’ এ এই গাছটিকে তিন হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এনে পুনঃ রোপণ করেছে এ দেশের মানুষ। এই পার্ক বিশ্বের বৃহত্তম এবং নান্দনিক অভ্যন্তরীণ শহরের পার্কগুলির মধ্যে অন্যতম এবং ঐতিহ্যবাহী সমৃদ্ধ একটি স্থান। এটি ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনের আবাসস্থল, যা তিন হাজারেরও বেশি প্রজাতি প্রদর্শন করে, যা বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায় না।
লক্ষ লক্ষ লিটার জল ধারণ করা, দেখতে অন্যরকম গাছটির নাম ‘বাওবাব’। হিন্দিতে গাছটি ‘গোরক্ষী’ নামেও পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাডানসোনিয়া ডিজিটাটা। আঞ্চলিকভাবে এটি ‘বব’, ‘বোবোয়া’, ‘বোতল গাছ’ এবং ‘উল্টানো গাছ’ হিসেবেও পরিচিত। আরবিতে আবার গাছটি ‘বু-হিবাব’ নামে পরিচিত, যার অর্থ ‘অনেক বীজযুক্ত গাছ’। আফ্রিকাতে এটি ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ট্রি’ হিসেবে পরিচিত।
গাছে ৫টি পাপড়ি বিশিষ্ট ফুল ধরে। ফুলের রং বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে যেমন লাল হলুদ সাদা। অনন্য এই গাছটিকে দেখলে মনে হয় এর শিকড় উপরে আর কা- নিচে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি বাওবাব গাছ কা-ের মধ্যে ১,১৭৩৪৮ লিটার জল ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে। যেকারণে গাছগুলোকে ‘জীবনদানকারী গাছ’ও বলা হয়ে থাকে। এই ধরণের গাছ সাধারণত আফ্রিকার শুষ্ক অঞ্চলে দেখা যায়। আফ্রিকা মহাদেশের মাদাগাস্কারে এই প্রজাতির গাছ রয়েছে, যা বহু শতাব্দী প্রাচীন। মাদাগাস্কার দেশের এফেট্টি শহরে বহু শতাব্দী প্রাচীন এই গাছের নাম দেওয়া হয়েছে ‘টি-পট বাওবাব’। গাছটির বয়স আনুমানিক ১২০০ বছর। বাওবাব গাছ হিবিস্কাস বা ম্যালো পরিবারেরভুক্ত ৯টি পর্ণমোচী প্রজাতির একটি প্রজাতি। যার দেখা মেলে আফ্রিকান দেশগুলিতে। অস্ট্রেলিয়াতেও এমন প্রজাতির গাছ রয়েছে। মাদাগাস্কারে এই গাছের ৬ রকমের প্রজাতি রয়েছে, যার কান্ডের রং ধূসর-বাদামী থেকে লাল পর্যন্ত হয়ে থাকে।
সূর্যাস্তলগ্নে মিষ্টি হাওয়ায় সবুজ ঘাসে বসে সুস্বাদু খাবার শেষ করি। কিংস পার্কের সান্ধ্যকালীন সৌন্দর্যের অতি সামান্যতম অবলোকন করে রেলিং এ দাঁড়িয়ে অদূরেই যখন ‘সোয়ান’ নদীর তীরবর্তী শহরের অপরূপ রূপে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছি, সৌন্দর্য তৃষ্ণা মেটাচ্ছি, কিংস পার্কের একেকটা হাতী সমান ‘পামট্রি’ আর হাজার হাজার অজানা বৃক্ষ যখন আমাকে আবেশিত করে রেখেছে তখন,
আমার গার্ডিয়ান গাইড বলে, চল, তোমাকে এমন একটা জিনিস দেখাই যা দেখে তুমি চমকে উঠবে।
মনে মনে ভাবি আমি তো চমকের মাঝেই আছি। চারপাশের অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শান্ত পরিবেশ, সবুজ বৃক্ষমালা, লেক, মানুষের সৃষ্ট নানান ম্যুরাল, ভবন, পথঘাট, পার্ক দেখে দেখে।
গার্ডিয়ানের স্মুথ ড্রাইভিং এ পৌঁছে যাই এই অভিনব বৃক্ষতলে।
এটি নাকি খুবই উপকারী একটি গাছ। আফ্রিকার স্থানীয় মানুষ এই প্রজাতির গাছগুলি নানা কাজে ব্যবহার করে থাকে। এই গাছের পাতা ভোজ্য হয়। গাছের ফল থেকে এক ধরণের সতেজ পানীয় তৈরি করা হয়, যা ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গাছের ছাল থেকে ফাইবার পাওয়া যায়, যা থেকে দড়ি, কাপড়, তৈরি করা হয়ে থাকে। আবার আফ্রিকার অনেক দেশে গাছগুলির ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে।
তবে, কয়েক দশক ধরে জলবায়ুর পরিবর্তন গাছ গুলির উপর প্রভাব ফেলছে। ২০০৫ সাল থেকে আফ্রিকার ১৩টি প্রাচীনতম গাছগুলির ৯টি ধ্বংস হয়ে গেছে। এর সাথে আফ্রিকায় এই প্রজাতির যে ৬টি বৃহত্তম গাছ ছিল তারমধ্যে ৫টি ধ্বংস হয়ে গেছে।
গাছতলে দাঁড়িয়ে আমি যেন অবাক হতেও ভুলে যাই। রেলিং এ হাত রেখে কেবল তাকিয়ে থাকি। কিছুটা দূরে গাছটির বিবরণ পড়ে আরো অবাক হই। তিন হাজার কিলোমিটার দূর থেকে এই বিশাল গাছটিকে না জানি কত যতেœ, কত কৌশলে, কত প্রযুক্তির সাহায্যে তারা এখানে এনে আবার রোপণ করেছে।
এটি যে অনেক যতেœ এবং আন্তরিকতার সাথে আনা হয়েছে তা বোঝা যায় এর বেঁচে থাকা দেখে।
পাহাড়খেকো, বৃক্ষখেকো, নদীখেকো মানুষের দেশ থেকে আসা মানুষ আমি এদের এসব কারবারে নিজেকে অর্বাচীন লাগে, আর্ত হয়ে পড়ি।
এই লেখা লিখতে লিখতেই দেখি, চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকার ৪৬টি বৃক্ষ নিধনের এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
একসময় এই এলাকায় থাকতাম। সন্তান পড়ত পলোগ্রাউন্ড স্কুলে। এ ছিল নিত্য আসা যাওয়ার পথ আমার। জানামতে দেশের একমাত্র দোতলা পথ এই স্কুলের পথ। এখানে শতবর্ষী বৃক্ষগুলি কাটা আর নিজেদের পায়ে করাত চালানো একই কথা। এমন একেকটি বৃক্ষ পেতে আমাদেরকে এক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়।
বাঁচতে হলে বাঁচাতে হলে বৃক্ষবান্ধব হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
কাজী লাবণ্য, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক