স্বপন মাহমুদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১তম ব্যাচ-এর জনৈক বন্ধুর একটি পোস্ট আমার আজকের ভাবনার উৎস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষকতাকে শ্রেষ্ঠ পেশা-হিসেবে উল্লেখ করে দেয়া এই পোস্ট আমার নিউরনকে অনুরণিত করলো। বৈরী হাওয়ার বন্ধুর পথে শিলা-প্রস্তর, ইট-সুরকির ঘষাঘষিতে পিষ্ট শিক্ষকের জীবন। তাই চেতনার বোধশক্তির ছুরির বুক ও পিঠ দুদিকে চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আজ না হয় পিঠটা কাজে লাগিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যায় বিষয়টির সিদ্ধান্ত টানবো। অনেকে শিক্ষকতাকে শ্রেষ্ঠ পেশা বলে প্রশংসা করেন। আমি এতে খুব একটা পুলকিত হই না; কারণ প্রশংসাটি কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে করা হলো এবং কে করলেন, কেন করলেন? তা ভাবনার বিষয়। তাই উক্তিটিতে মুগ্ধ না হয়ে ভাবনায় মগ্ন হই। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রবন্ধের কথা মনে পড়তেই বুঝে যাই তেলের নৈমিত্তিক ব্যবহার। তেলে অবগাহন করা বা করানো শিক্ষকের কাজ নয়। তবুও তৈলাক্ত বাক্যের চটচটে ব্যবহারে অভিষিক্ত করে অনেকেই সফল হয়েছেন। মাঝে-মাঝে এই শব্দটির ভেজাল তেলের গন্ধে আমার নাসিকা কুঞ্চিত হয়ে আসে। কারণ তা যে ব্যক্তি বিশেষের অন্তরের কথা নয়, তা ব্যক্তির আচরণেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই শ্রেষ্ঠ শব্দটির মাধ্যমে তেল সিঞ্চন করে মানুষকে খাটানোর একটি দুর্বুদ্ধি অন্তরালে থেকে যায়। এই কারণে শব্দটি বিশেষণ না বিশোষণমূলক শব্দ’, তা নিয়ে আমার ব্যাকরণ-বিভ্রান্তি ঘটে। আমার ভেতরের মানুষটি ভাবে, তবে কি এর প্রয়োগে প্রতিনিয়ত মানুষ ‘বিশেষিত’ না ‘বিশোষিত’ হচ্ছেন? ভাবনা আমাকে তাড়া করে যৌক্তিকতার অনুসন্ধানে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘প-িত মশাই’ গল্পের তিন পা-বিশিষ্ট কুকুরের কথা মনে পড়লে নিজের পেশাটি নিয়ে অন্তহীন লজ্জায় আবর্তিত হই। গল্পে স্কুল পরিদর্শনে-আসা ইংরেজ সাহেব গাড়ি থেকে নামলেন। তাঁর সাথে নামলো তিন পা-বিশিষ্ট তাঁর প্রিয় কুকুরটিও। গল্পে প্রদত্ত তথ্যে জানা যায়, সাহেব তার এই প্রিয় কুকুরের জন্য মাসে ব্যয় করতেন পঁচাত্তর টাকা। পদমর্যাদার (পায়ের সম্মান) হিসেবে গেলে কুকুরের তিন পায়ের খরচ পঁচাত্তর টাকা।
গাণিতিক সমাধানে গেলে কুকুরের প্রতি পায়ের জন্য বরাদ্দ পঁচিশ টাকা। আর দুঃখজনক হলেও সত্যি তখন প-িত মশাইয়ের (আট সদস্যের পরিবারের ষোলো পা-এর) মাসিক বেতন ছিল পঁচিশ টাকা। এক পায়ের হিসাবটা টেনে লজ্জাটা আর বাড়াতে চাই না। এই বেতনে প-িত-মশাইয়ের আট সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ চালানো হতো। আহা! এত লজ্জা নিয়ে যুগ যুগ ধরে এই পেশাটি তেলাপোকার মতো টিকে আছে। ভেবে কষ্ট পাই। এই নষ্ট সমাজ বৃক্ষের পরিচর্যা না-করেই কৃশকায় বৃক্ষ শাখায় পুষ্ট ফল কামনা করে। এই ফল ভক্ষণ করেই হৃষ্টপুষ্ট জীবনযাপন করতে চায়।
দান-অনুদান বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের অন্তর-ভুবনের খোঁজ কেউ রাখেন না। রাষ্ট্রের দান যেখানে উৎসাহ বা প্রণোদনা সেখানে ব্যক্তির দান গ্রহীতার মনে জড়তা ও হীনতার মনোবেদনা; যা বৈষম্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। শিক্ষকতা পেশায় এই বৈষম্য বা নমঃশূদ্র বিভাজন কারো কাম্য নয়। ব্যক্তির দানকে খাটো করে দেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়। ব্যক্তি অবশ্যই রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে দান করে জনসেবায় এগিয়ে আসবেন। এমনকি ব্যক্তি উদ্যোগে গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের কাছে ব্যক্তির দান হিসেবে গৃহীত হবে। জাতি যেটিকে ব্যক্তির অবদান বা সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবে স্মরণ রাখবে।
আনন্দ আর আবেগে অভিষিক্ত হয়ে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছেন অনেক নিবেদিত প্রাণ। শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা আর সম্মান প্রাপ্তিতে ভরপুর জীবন। কিন্তু অন্তরালের সম্মানির দর পতন-বৃদ্ধি নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিচরিত্র, সক্ষমতা ও সদিচ্ছার উপর; কারণ শিক্ষা সরকারি হলেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি নয়। শিক্ষার্থীদের বৃহৎ অংশের শিক্ষায় দায়িত্ব পালন করছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ। আর্থিক সঙ্গতির মাপকাঠিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে উচ্চ, মধ্য ও নি¤œ শ্রেণি। ফলে আর্থ-সামাজিকভাবে সবল ও দুর্বলের কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষাকার্যক্রম।
জীবিকার টানাপড়েনে পোড়-খাওয়া শিক্ষকের মোহ যদিওবা কখনো প্রশমিত হয়, কিন্তু বিবেক তাকে আবদ্ধ করে নির্মম নিয়তির জালে। পেশা তাকে বিত্তহীন করলেও ¯েœহ-ভালোবাসার বৃত্ত তাকে চিত্তবান করে তুলে। প্রতিষ্ঠানভেদে শত ভিন্নতা ও বৈষম্য থাকলেও এই পেশায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্কের কোথাও ঘাটতি থাকে না, কারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের মানস-সন্তান।
ব্যক্তির দান-অনুদান, অনুকম্পায় অনুরক্ত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চললে শিক্ষাকার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, কারণ এতে দাতার উদ্দেশ্য ও আদর্শের বাস্তবায়ন করার সুযোগ থেকে যায়। এই উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের শিক্ষার উদ্দেশ্যের মূলধারার সাথে সাংঘর্ষিক হলে শিক্ষাঙ্গনের মুক্তচিন্তার পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। মুক্তাঙ্গনের আলো-হাওয়া ছাড়া জ্ঞান অঙ্কুরিত হয় না। জ্ঞানালোকের সত্য ও সুন্দরের বিকিরণে শিক্ষার্থীর প্রাণ জাগাতে না পারলে শিক্ষকের আত্মা বাঁচে না। মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে শিক্ষকের চেতনায় জং ধরে বিবেক দংশনে নিপতিত হয়।
আবার যাদের জন্য শিক্ষকতা পেশা সেই শিক্ষার্থীরাও ভালো নেই। মানসিক বিকাশের পরিবেশ বিস্তৃত ক্যাম্পাস, উন্মুক্ত মাঠ, অবারিত আকাশ তাদের নেই। ফলে তাদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়ে চিন্তার জগৎ সংকুচিত হচ্ছে। উন্মুক্ত পরিবেশে শিশুর ভাবনার জগৎ প্রসারিত হয়ে মনে ঔদার্য আনে। বৃত্তের বেষ্টনী পেরিয়ে বৈশ্বিক হয়ে ওঠে। কিন্তু যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা শিক্ষাখামারে শিশুর মানসিক বিকাশের পরিবেশ নেই বললেই চলে। শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির কথা ভাবতে গেলে বিনিয়োগকারী খামারিদের শিক্ষাবাণিজ্য ব্যাহত হবে। তাই বিনিয়োগ ধর্ম মেনেই উচ্চ মুনাফার জন্য শিশুর অপোক্ত মননে চলে উচ্চ ফলনশীল বিদ্যার চাষাবাদ।
অন্যদিকে শিক্ষার্থী নিজের মতো করে জীবনকে ভাবতে ও এগিয়ে নিতে পারছে না। সে সুযোগ অবরুদ্ধ। অভিভাবক তার পক্ষে সকল ভাবনা, আশা ও নিয়ত করছেন বা স্বপ্ন দেখছেন; অথচ পড়তে হবে শিক্ষার্থীকে। অভিভাবকরা আবদার করে বলেন, আমি নিয়ত করেছি আমার সন্তানকে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার বানাবো। স্যার, তাকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির সুযোগ দিন। এই এক অদ্ভুত আবেদন। একটি নিষ্পাপ শিশুর ওপর অভিভাবক চাপিয়ে দেন নিজের স্বপ্নের মানস। স্বপ্নের ফসল ফলাতে সন্তানকে নিয়ত করেন ইংরেজি বা আরবি মাধ্যমে, আর নেহাত মধ্যপন্থি স্বপ্নবাজরা নিয়ত পূর্ণ করতে সন্তানকে ভর্তি করান বাংলা মাধ্যমে।
একটি সত্য ঘটনা দিয়ে এই প্রসঙ্গটি স্পষ্ট করতে চাই। দ্বাদশ শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষার কক্ষ পরিদর্শনকালে শিক্ষক দাঁড়িয়ে অতিরিক্ত উত্তরপত্রে স্বাক্ষর করার ফাঁকে পরীক্ষার্থীদের প্রতি দৃষ্টি রাখলেন। বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী বারবার শিক্ষকের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে লিখছে। শিক্ষক ভাবলেন নিশ্চয়ই কোনো অসদুপায় অবলম্বন করে লিখছে। ত্বরিৎ-বেগে শিক্ষক তার কাছে যেতেই শিক্ষার্থী অঝোরে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ভয় ও প্রচ- অনুতাপে বললো, ‘বিশ্বাস করুন স্যার, আমি বিজ্ঞান পড়তে চাইনি। আমার মা আর আপু জোর করে বিজ্ঞানে ভর্তি করালো।” অর্থাৎ এই শিক্ষার্থী পরিবারের নির্মম নিয়তের শিকার। আর এভাবে নিয়তের খেলায় জীবন ব্যর্থতাকে অনেকেই নিয়তি বলে সান্ত¡না খুঁজে পায়।
উত্তরপত্র দেখে শিক্ষক বিস্মিত হয়ে গেলেন। তাতে সে শিক্ষকের অনুরূপ চিত্র আঁকলো, যাতে স্বাক্ষররত একজন শিক্ষক চিত্রিত হয়েছে। জানালার ফ্রেমে দেখা বিস্তৃত মাঠ ও মাঠের কোণে বাঁধানো আমতলার দৃশ্যও ঠাঁই পেয়েছে। এটি যেন ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তাকে তার পরিবার বিজ্ঞান পড়ানোর প্রতিবাদী চিত্র। কিন্তু কয়জন তার মতো জীবনের লক্ষ্য আর লক্ষ্যচ্যুতি টের পায় এবং প্রতিবাদ করে। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির অনুকরণে বলা যায় : অধিকাংশ শিক্ষার্থী অভিভাবকের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নেয় কিন্তু মনে নেয় না। তাই পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করলেও বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষার্থীই বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠছে না। বিজ্ঞানকে খাটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ একই কথা অন্য বিভাগগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অন্যদিকে জিপিএ-নামক তিনটি বর্ণে বিবর্ণ হয়ে গেছে শিশুর সোনালি শৈশব। শিশুকাল থেকেই তার পিঠে ব্যাগভর্তি বিদ্যার পাথর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে শিশুর পদযুগল বিদ্যালয়মুখী হলেও পিঠের বোঝা তার শরীর ও মনকে পেছনেই টানছে। অর্থাৎ টানা- পোড়নের নীরস অনুভূতির মধ্য দিয়ে শুরু হয় একালের শিশুর শিক্ষা জীবনের পথচলা। আমাদের অভিভাবকদের অভিন্ন লক্ষ্য জিপিএ নামক আলাদিনের চেরাগ। এটি অর্জনের জন্য মা-বাবা জমিকর্ষণের মতো শিশুর মস্তিষ্ক কর্ষণে মরিয়া হয়ে উঠেন। এতে শিশুর মনোজগৎ প্রকৃতি ও সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাগজের হরফে আটকে যাচ্ছে। অভিভাবকদের বাঁধভাঙা আকাক্সক্ষার সুযোগ নিয়ে দুষ্টচক্র প্রশ্নপত্র ফাঁসের ফাঁদ পেতে রাখে। ভালো জিপিএ-প্রাপ্তির নির্লজ্জ প্রতিযোগিতার অন্ধ নীতিহীন কিছু অভিভাবক সে-ফাঁদেই সাফল্য ক্রয় করেন। ফাঁসকৃত প্রশ্ন দিয়ে সন্তানের জীবনে গড়ে দেন দুর্নীতির প্রথম সোপান। আর এই সোপান যাত্রাকে সুবর্ণ সুযোগ জ্ঞান করেই শিশুর মন সুযোগসন্ধানী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ শিশুকালেই পারিবারিক নীতিহীন বলয়ে দুর্নীতির প্রথম পাঠ সম্পন্ন হয়। বাসনা পূর্ণ করতে গিয়ে এসব পরিবার শিশুর মগজে অবচেতনে দুর্নীতির বীজ বপন করছেন। অনুকূল আলো-বাতাস বা পরিবেশ পেলে তাতে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ অঙ্কুরিত হয়ে ডালপালা বিস্তার করবেই। কারণ পরিবারের অপআকাক্সক্ষা এবং পরবর্তীকালে সমাজের প্রশ্রয় বা উদাসীনতা ও মূল্যবোধহীনতা এই বীজ সংরক্ষণ উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে। ফলে পরিবার ও সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধের আদলে শিশুমন বিকশিত হয়। কারণ দুর্নীতিবাজ হয়ে কেউ জন্মায় না। সমাজ-মানসের প্রভাবে দুর্নীতির বিকাশ ঘটে।
মনুষ্যত্ব, বিবেক ও দেশাত্মবোধ চর্চা ছাড়া শুধু বিদ্যার জোরে জাতি সম্পদে পরিণত না হয়ে ভয়াবহ দুর্নীতিবাজ কিংবা স্বার্থপর হয়ে উঠতে পারে। কারণ আমরা তো আমাদের স্বপ্নের আদলে সন্তানকে মানুষ (!) করেছি; তারপর তার স্বপ্নে এগিয়ে চলে পরবর্তী জীবন। কিন্তু যার ভিত্তিতে মনোজগৎ এগিয়ে যাবে সে উপাদানÑমনুষ্যত্ব ও মানবিকতায় সামাজিকীকরণ না করে বরং তা থেকে শিশুকাল থেকেই আমরা তাকে সযতনে সরিয়ে রেখেছি। আত্মকেন্দ্রিক চিন্তাচেতনায় বিকশিত করে সন্তানের জীবনকে সার্থক করতে গিয়ে তাকে স্বার্থপর মানুষ বানিয়েছি। তাই কর্মজীবনে দায়িত্ব ও কর্তব্য নামক নীতিকথা যথোপযুক্ত মনুষ্যত্ব ও দেশপ্রেমের অভাবে তার চেতনাকে স্পর্শ করে না। শিক্ষা আলোর মতো অন্ধকার দূর করে। কিন্তু এই আলো প্রক্ষেপণে সমতা না থাকলে জাতির মেধা ও বিবেক সমভাবে জাগ্রত হবে না। জাতির মূল্যবোধ ও মননের ঐকতানে জাতিকে শিক্ষায় এগিয়ে নেয়ার মহান কাজ দান নয়, অবদানের বিষয়। শিক্ষা জাতির মেরুদ-। এই মেরুদ-কে সচল রাখতে শিক্ষায় মনুষ্যত্ব ও দেশাত্মবোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষাকেন্দ্রিক সকল অপচর্চার অবসান না হলে শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। শিক্ষার উন্নতির পথ ধরেই দেশ এগিয়ে যাবে। আর রাষ্ট্রকেই শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব নিতে হবে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উদ্যোগে গড়ে উঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য, বিশ্বাস, ভাব প্রতিষ্ঠা এবং ব্যবসায়ের সুযোগ থেকে যায়। এতে শিক্ষার মাধ্যমে মনুষ্যত্ব বিকাশ ও দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। কারণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করা শিক্ষায় রাষ্ট্রস্বার্থ গৌণ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। রাষ্ট্র অঞ্চলভিত্তিক জনসংখ্যা অনুপাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রস্বীকৃত মানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হলে বন্ধ হবে শিক্ষাবাণিজ্য, শিক্ষাবৈষম্য ও অনিয়ম।
বাঙালি জাতি ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে জগৎখ্যাত হয়েছে। সেই চেতনার ধারাবাহিকতায় এই জাতি দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। অথচ এই জাতির শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম বাংলা নয় কেন? একটি আদর্শ বয়স বা শ্রেণি পর্যন্ত একই মাধ্যমের শিক্ষা থাকলে শিশুর মানসিক বিকাশে বৈষম্য থাকে না। বিভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ নিতে গিয়ে শিশুকাল থেকেই শিশুরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিভাজিত হয়ে পড়ছে। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে বিদ্বেষ, বিরোধ এবং অহংকার বোধে অভ্যস্ত হচ্ছে। এতে বাংলা ব্যতীত অন্য মাধ্যমের শিশুরা বাংলা মাধ্যমের চেয়ে নিজেদের অভিজাত বা পুণ্যবান ভাবতে শিখে। ফলে শিশুকালেই শিশুর পবিত্র মন চিন্তার বৈষম্যপাঠে বিভাজিত হচ্ছে। অথচ একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত একই ধারার শিক্ষা বিদ্যমান থাকলে শিশুমনে চিন্তার বৈষম্য তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। যে বয়সে শিশু আত্মোপলব্ধি অর্জন করে সে বয়সটা হতে পারে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি। এই নির্দিষ্ট শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর সম্ভাবনা, পারদর্শীতা এবং শিশুর আগ্রহের ভিত্তিতে তার পছন্দের শিক্ষার মাধ্যমে ও বিভাগে পড়ার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে অভিভাবকের স্বপ্ন, মানস বা নিয়ত চাপিয়ে দিলে শিশুর নিজস্ব বিকাশ অঙ্কুরেই চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু আমাদের শিশুরা অভিভাবকের স্বপ্নের কথা শুনতে শুনতে নিজের স্বপ্নদেখা ভুলে গেছে। মাতৃভাষার ভিত বা গাঁথুনি ঠিক না করে অন্য ভাষায় শিক্ষা নিতে গেলে ভাষার প্রকৃত অর্থ ও রস অনুধাবন করা যায় না। প্রত্যেক ভাষার শব্দের রয়েছে মুখ্যার্থ ও গূঢ়ার্থ। যেকোনো ভাষার ভাব আস্বাদনের জন্য মাতৃভাষা হলো প্রকৃত মাধ্যম। কারণ মাতৃভাষার ভিত্তি ছাড়া অন্য ভাষায় সাফল্য আসতে পারে না। মাতৃভাষার শব্দ ভান্ডারের ভাবরস ভাষান্তরিত হয়েই বিদেশি ভাষার দক্ষতা অর্জিত হবে। তাই একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক হলে জ্ঞানবিকাশে সমতা রক্ষিত হবে। বিদেশি ভাষাকে বর্জন নয় বরং মাতৃভাষার উপলব্ধি দিয়ে বিদেশি ভাষার দক্ষতা অর্জিত হবে। মাতৃভাষার আশ্রয়ে অন্য ভাষার চর্চায় জ্ঞান বিস্তৃত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি এ মাটিতে জন্ম নেয়া কিছু মানুষ বাংলাকে রেখে ইংরেজি ও আরবি বয়ানে কথা বলে নিজেদের ধন্য মনে করেন। সাধারণ মানুষের বোধের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সাধারণের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্যে বা বয়ানে এরা বাংলাকে এড়িয়ে যান। ফলে বক্তব্যের অবোধ্য মর্মকথা আলো-আঁধারি আবেগের ভাবরসে সাধারণ মানুষের কর্ণকুহরে ঘুরপাক খায়। সতেরো শতকে চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি আবদুল হাকিম আক্ষেপ করে তাঁর ‘বঙ্গবাণী’ কবিতায় লিখেছেন : ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ … ‘দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায় নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।”
এবার পেশার প্রসঙ্গে ফিরে যাই। কার কাছে কোন্টি শ্রেষ্ঠ পেশা, সেটা নির্ভর করে সে মানুষটির পরিবার, জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিক মানদ-ের উপর। বাজার-অর্থনীতির নিক্তিতে পেশার শ্রেষ্ঠত্ব মূল্যায়িত হচ্ছে। শিক্ষার সুদূরপ্রসারী সুফলের কথা না ভেবে নগদ প্রাপ্তিটা সবার নজর কাড়ছে। লাভ আর লোভের নেশায় অমানবিক পথটাই বিকশিত হচ্ছে। তাই চিত্তের চেয়েও বিত্তের কদর বেড়েছে। ঘুস-দুর্নীতিবাজ চাকুরের গাড়ি-বাড়ির জৌলুস ছড়ানো পরিবারের পাশের বাড়ির নৈতিক চাকুরের পরিবারে অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাসে নৈতিকতার ভিত কেঁপে ওঠে। ফলে নৈতিকতার প্রাচীর যতই শক্ত হোক না কেন, কারো না কারো ক্ষেত্রে একদিন ফাটল ধরবেই। এই অপ্রকাশিত ফাটল ঠেকা দিয়ে নৈতিকতা নিয়ে অন্তিম অন্তে চক্ষু মুদে বিবেকের দংশন থেকে অনেকে মুক্তি পান। আর কেউবা ফাটল গহ্বরে নৈতিকতাকে সমাহিত করে খুঁজে নেয় জীবনের জয়রথ এবং বিবেক-বর্জিত বিপথে নিজের অর্থনৈতিক মুক্তির সাফল্য অর্জন করেন। আমরা তাঁর সাহচর্যে ধন্য হই, করতালিতে অনুপ্রাণিত করি এবং অনুগামী হই। তাই ‘শ্রেষ্ঠ’ শব্দটিতে প্রতিনিয়ত আমি বিব্রত হই।
স্বপন মাহমুদ
(মূল নাম-মুহাম্মদ আবদুল মোমেন)
সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেপজা কলেজ, চট্টগ্রাম