জ্যোতির্ময় নন্দী
বুকার পুরস্কার ২০২৩ পেলেন আইরিশ কথাসাহিত্যিক পল লিঞ্চ। ৪৬ বছর বয়সী লিঞ্চ একজন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান লেখক। বুকার পুরস্কারের তিনি আরো বেশ কিছু সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়েছেন তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্যে।
পল লিঞ্চের জন্ম ১৯৭৭-এ আয়ারল্যান্ডের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে মুনস্টার প্রদেশের লিমেরিক শহরে, তবে তিনি বড় হয়েছেন দেশটির সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত ডোনেভান কাউন্টিতে। বর্তমানে তিনি তাঁর স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন রাজধানী ডাবলিনে। ২০০৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত তিনি আয়ারল্যান্ডের ‘সানডে টিউন’ পত্রিকায় কাজ করেছেন প্রধান চলচ্চিত্র পর্যালোচক হিসেবে। এ ছাড়াও তখন তিনি ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকাতেও চলচ্চিত্র নিয়ে নিয়মিত লিখতেন। পরে তিনি সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে উপন্যাস লেখায় আত্মনিয়োগ করেন।
পল লিঞ্চ বুকার পেয়েছেন তাঁর ‘প্রফেট সং’ উপন্যাসটির জন্যে। এটা কোনো হরর নভেল নয়, তবুও প্রবল আতঙ্কজনক। কারণ, আধুনিক যুগোচিত ফ্যাসিবাদের এক পুনরুদ্ভবের সম্ভবপরতা এ বইয়ে এত যুক্তিসঙ্গতভাবে তুুলে ধরা হয়েছে যে, এতে পাঠকের মগজ ক্রমবর্ধমান ভীতিতে আক্রান্ত হতে বাধ্য।
‘প্রফেট সং’-এ বর্ণিত হয়েছে, রাজনৈতিক পচন কীভাবে একটা জাতিকে শ^াসরুদ্ধ করে তোলে। স্বৈরাচারের কফ জমে জমে ফুসফুস বিকল হয়ে যায় আর নেমে আসে ভয়াবহ মৃত্যু। তবে সমগ্র শাসনতন্ত্রের পচন পর্যালোচনার বদলে লিঞ্চ তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন এমন বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে ডাবলিনে নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে একজন নারীর জীবন সংগ্রামের ওপর।
‘প্রফেট সং’ উপন্যাসে আসলে আয়ারল্যান্ডকে একটি নব্য ফ্যাসিবাদী জাতীয়তাবাদী সরকারের শাসনের অধীনে কল্পনা করা হয়েছে। বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র এলিশ স্ট্যাক নামের এই মহিলা একজন সম্মানিত অণুজীববিজ্ঞানী, চার সন্তানের মা, এবং একজন ইউনিয়ন নেতার স্ত্রী। সারাদিনের হাড় ভাঙা খাটুনির পর একটা শান্তি আর স্বস্তির রাতের জন্যে তাঁর প্রাণ আকুল হয়ে থাকে। অথচ তাঁর জীবনে সত্যিকারের অন্ধকার রাত যখন এসে হাজির হলো, দরজায় তার টোকা তিনি বুঝতে পারেন নি।
বৃষ্টিভেজা সেই সন্ধ্যায় সাদা পোশাকে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা জিএনএসবি’র দুজন অফিসার ডাবলিনে তাঁর বাড়ির দরজায় টোকা দিয়েছিলো। সে-টোকা ছিলো বইটিতে উপস্থাপিত সামাজিক ব্যবস্থার বিকৃতি আর দুর্বৃত্তির ঘটনাবলির সূত্রপাত। লোক দুটো সর্পতুল্য শীতল আর অপলক চোখে তাকিয়ে এলিশকে সালাম ঠুকে অত্যন্ত ভদ্র আর মার্জিতভাবে তাঁর স্বামী সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করলো। যাওয়ার সময় ওদের একজন বলে গেলো, “চিন্তা করার কিছুু নেই, মিসেস স্ট্যাক। আমরা আর আপনার সময় নষ্ট করতে চাই না।”
এলিশের চরিত্রটি লিঞ্চ নির্মাণ করেছেন খুব যতেœর সঙ্গে। লেখক এ চরিত্রটিকে স্নেহমমতা আর দাঁত কামড়ানো ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার অফিসার দুজন কেন এসেছেলো, তারা তাঁর স্বামী ল্যারিকে নিয়ে কী করতে চায়, সেটা তিনি বুঝেও যেন বুঝতে পারছিলেন না। সে-রাত পরে তিনি স্বামীকে বললেন, “কথাগুলো যদি তুমি শুনতে। গত কয়েক মাস ধরে যেসব জিনিস ঘটে যাচ্ছে, সেগুলোর ব্যাপারেই তারা বলছিলো।” জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর থেকে সারা দেশ নানা আশঙ্কায় সিঁটিয়ে ছিলো। তারপরও ল্যারি স্ট্যাক মনে করেছিলেন, শিক্ষক ইউনিয়ন নিয়ে তাঁর কাজকর্মকে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বলে গণ্য করা হবে না। জোর দিয়ে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, “দেশে এখনো সাংবিধানিক অধিকার বলে একটা জিনিস রয়েছে।” অথচ তারপরও শ্রমিকদের একটা বিক্ষোভ মিছিল পুলিশ হামলা চালিয়ে ভেঙে দেয়। ল্যারিকে আটক করা হয়, তাঁর কাছে এলিশকে বা কোনো আইনজীবীকে যেতে দেয়া হয় না, এবং তারপর এতদিন তিনি সম্পূর্ণ গায়েব হয়ে যান। পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের এক পর্যায়ে এলিশের বড় ছেলেটিও লাপাত্তা হয়ে যায়। এলিশের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। তার এতদিনের চেনা শহর, দেশ, পরিবেশ, পরিপাশর্^ সবকিছুই বদলে যেতে থাকে, ভেঙে পড়তে থাকে টুকরো টুকরো হয়ে।
অস্থির সময়কালের প্রেক্ষাপটে রচিত এ কাহিনিতে ইউনিয়ন নেতা ল্যারি স্ট্যাকের মতো যাদেরকে শাসক গোষ্ঠী তাদের শত্রু বলে মনে করেছে, তাদের এভাবে রহস্যজনকভাবে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কারণে একসময় গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি হয়, আর তার হাত ধরে আসে অর্থনৈতিক পতন। এলিশ স্ট্যাক তাঁর স্বামী-পুত্রকে উদ্ধার করতে বা তাঁর দুর্ভাগ্যের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন কিনা, পাঠককে সেটা জানানোর দিকে এই শ^াসরুদ্ধকর কাহিনি এগিয়ে গেছে।
লিঞ্চ যদিও এক কাল্পনিক প্রেক্ষাপটে কাহিনিটি নির্মাণ করেছেন, আমাদের মতো তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোতে এ ধরনের ঘটনা মোটেও অপরিচিত নয়। দেশে দেশে এর সংখ্যা আর ব্যাপকতা দিন দিন কমার বদলে যেন বেড়েই চলেছে। সেদিক থেকে প্রফেট সং আমাদের কাছে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক।
কিন্তু বইটার নাম কেন ‘প্রফেট সং’ হলো, এ প্রশ্ন অনেকের মনে জাগতে পারে। বইটিকে অনেকে ‘প্রফেটিক মাস্টারপিস’ আখ্যাও দিয়েছেন। কারণ এ বইয়ে লিঞ্চ একজন প্রফেট বা নবীর মতোই উৎকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ বা উগ্র সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা থেকে নব্য ফ্যাসিবাদের উদ্ভবের নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, যে-ব্যাপারে আগে রবীন্দ্রনাথ-সহ দেশি-বিদেশি অনেক লেখক, চিন্তাবিদও ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। বইটিতে ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে চলেছে অব্যাহতভাবে এবং মজার ব্যাপার হলো, সারা বইটিতে কোথাও কোনো অনুচ্ছেদ বিভাজন করা হয় নি। বইটির ভাষা কাব্যরসসমৃদ্ধ, আবার একই সঙ্গে মর্মভেদী, তীক্ষè শীতল ছুরির মতো।
লিঞ্চের অন্যান্য উপন্যাস
‘প্রফেট সং’ পল লিঞ্চের পঞ্চম উপন্যাস। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘রেড স্কাই অন দা মর্নিং’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর আটলান্টিকের উভয় তীরেই সাহিত্য সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। বইটি ফ্রান্সের প্রি দ্যু মেইয়র লিভ্র্ অত্রঞ্জে (শ্রেষ্ঠ বিদেশি বই পুরস্কার)-এর অন্যতম ফাইনালিস্ট হয় এবং প্রি দু প্র্যেমিয়ের রোমান (প্রথম উপন্যাস পুরস্কার)-এর জন্যেও মনোনীত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ওটা আমাজন ডট কম-এর বুক অব দা মান্থ হয় এবং ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর)-এর ‘অল থিংস কনসিডারড’ প্রোগ্রামে বইটি তুলে দরে লিঞ্চকে আখ্যায়িত করা হয় ‘একজন জহুরি তরুণ লেখক’ হিসেবে। দা আইরিশ টাইমস, দা টরন্টো স্টার, আইরিশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং সানডে বিজনেস পোস্ট প্রভৃতি প্রভাবশালী পত্রিকার মতে ওটা ছিলো ‘বছরের সেরা বই’।
২০১৪-তে প্রকাশিত দ্বিতীয় বই ‘দ্যা ব্ল্যাক স্নো’-ও আমাজনের ‘মাসের সেরা বই’ হয়েছিলো। বইটা শ্রেষ্ঠ বিদেশি উপন্যাস হিসেবে ফ্রান্সের পুস্তক ব্যবসায়ীদের দেয়া পুরস্কার ‘প্রি লিব্র্ আ নু’ এবং সর্বপ্রথম ‘প্রি দে লেকত্যুর প্রিভাত’ অর্জন করে। সানডে টাইমস বইটাকে বর্ণনা করে একটা ‘সুদক্ষ সৃষ্টি’ হিসেবে আর টরন্টো স্টার ‘তীব্র আর মর্মভেদী’ হিসেবে। এনপিআর-এর অল থিংস কনসিডারড অনুষ্ঠানে আলোচক অ্যালান শিউজ বলেন, লিঞ্চের রচনাশৈলীর স্থান “নোবেল বিজয়ী কবি সিমাস হিনি আর করম্যাক ম্যাকার্থির মাঝখানে কোথাও”।
২০১৭-তে প্রকাশিত ‘গ্রেস’ বিশ^ব্যাপী সাড়া ফেলে দেয়। ওয়াশিংটন পোস্ট বইটাকে বর্ণনা করে, “নাড়া দেয়ার মতো একটা কাজ আর কালের স্বপ্নবিভ্রম সৃষ্টিকারী সৌন্দর্য…” হিসেবে, যেটার রচনাশৈলী জন স্টেইনবেকের ‘দা গ্রেপস অব র্যাদ’ আর কর্ম্যাক ম্যাকার্থির ‘দা রোড’-এর সংমিশ্রণ। এটা সে-বছরের কেরি গ্রুপ আইরিশ নভেল পুরস্কার অর্জন করে। ফ্রান্সে এটা অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে ইউরোপীয় সাহিত্যে প্রি জঁ মনে’র জন্যে শর্টলিস্টেডও হয়। এটা ছিলো গার্ডিয়ান, আইরিশ ইনডিপেন্ডেন্ট, কার্কুস আর স্কোয়্যার পত্রিকায় বুক অব দা ইয়ার, দা প্যারিস রিভিউ-তে স্টাফ পিক এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউতে এডিটরস’ চয়েস।
চতুর্থ উপন্যাস ‘বিয়ন্ড দ্যা সি’-ও ২০১৯-এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়ে যুক্তরাজ্যে, আয়ারল্যান্ডে, অস্ট্রেলিয়ায় এবং যুক্তরাষ্ট্রে সমালোচকদের বিপুল প্রশংসা পায়। ২০২১-এ ফ্রান্সে বইটির ফরাসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বইটিকে ‘সন্ম্হোক’ বলে উল্লেখ করে। গার্ডিয়ান লেখে, “ভীতিজনক কিন্তু সুন্দর”। সানডে টাইমস বলে, এ বইয়ে “মেলভিল, দস্তয়েভস্কি আর উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। আইরিশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সাহিত্য সমালোচক সেবাস্তিয়ান বেরি বইটাকে একটা ‘দক্ষ সৃজনকর্ম’ বলে উল্লেখ করে বছরের সেরা বই হিসেবে নির্বাচন করেন।
পাদটিকা: পল লিঞ্চের কোনো বই এখনো পর্যন্ত আমার পড়া হয় নি। গুডরিডস ও অন্যান্য ওয়েব পেজ থেকে বইয়ের সারাংশ আর সমালোচনা পড়ে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করলাম। এখন ‘প্রফেট সং’-এর পিডিএফ নামিয়ে নিয়ে পড়া শুরু করেছি। পাঠশেষে তার আলোচনা নিয়ে আবার আপনাদের দরবারে হাজির হওয়ার ইচ্ছে রইলো।
জ্যোতির্ময় নন্দী, কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক