মাসুদ আনোয়ার
প্রথমে দীর্ঘ টানে লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, তারপর ছোট ছোট লয় : লাইলাহা ইল্লাল্লাহ… লাইলাহা ইল্লাল্লাহ….তারপর আবার দীর্ঘ টান : লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ…
অনেকক্ষণ ধরে জিকির চলছে, দূরে; তবে মাইকের আওয়াজে বেশ উঁচু ও স্পষ্ট। বিরতিহীন জিকিরের সুর বিরক্তিকর নয় বরং ভালোই লাগাচ্ছে। সম্মিলিত কণ্ঠের জিকির, একই তালে স্বরগ্রামের ওঠানামা। তবলা হলে জমত ভালো।
জিকিরের সাথে তবলা! তওবা আস্তাগফিলুল্লাহ! নিঃসন্দেহে বেদাতি কাজ। কিন্তু কেন? ওস্তাদ তবলচির তবলা তার হাতের গোলাম। নিপুণ হাতের টোকায় যা বলাবে, তা-ই বলবে।
জিকিরের মজলিশে তবলচির মন জিকিরই করবে, তবলা সে জিকিরের অরবকে সরব করবে বোলে। ইল্লাল্লাহ্… ইল্লাল্লাহ্।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে। জিকিরের সুর মন টানছে ওদিকে, এক নাগাড়ে শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। নেই কোনো উপাস্য আল্লাহ ছাড়া, মুহম্মদ তার প্রেরিত পুরুষ। স্রষ্টার সংকীর্তন। স্রষ্টা আছেন কোথাও; হয়তো এই রাতের কালো আকাশে, জ¦লজ¦লে তারায়, কিংবা অনুভূত অদৃশ্য শীতল বাতাসে। স্রষ্টা বিরাজ করছেন নীরব বৃক্ষে, মূক মাটিতে অথবা মুখর জনপদের উচ্চারণে, শ্রবণে, স্মরণে, এমনকী হয়তো বিস্মরণেও।
কিন্তু এই মুহূর্তে সেও স্রষ্টা হতে চাইছে। এই মুহূর্তে ওর বুকের ভেতর প্রচ- এক মোচড়, তলপেটে খালি খালি ভাব। এই মুহূর্তে সে চাইছে প্রসারিত হতে, চাইছে সঙ্কুচিত হতে হতে নিজের ভেতর বিন্দুবৎ হয়ে যেতে। এই আলোড়ন, এই প্রচ- আন্দোলন তাকে তৃপ্তি-অতৃপ্তির মধ্যবিন্দুতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ঝাঁকাচ্ছে, ঝাঁকাচ্ছে এবং স্রষ্টা আছেন এই ক্রান্তিলগ্নে অনতিক্রান্ত জ্ঞানে অজ্ঞানে।
অতএব কান, তুই শোন। মন, তুই চিন্তা কর। আর বুদ্ধি, হে আমার বুদ্ধি, তুই আবেগের সঙ্গে মিলিত হ। তোদের মিলনে শিল্পসৃষ্টি হোক।
অতঃপর সে টেবিলে কাগজ বিছাল, হাতে কলম নিল। বামহাতের তালুয় চিবুক রেখে ঊর্ধ্বনেত্রে দেয়ালের দিকে তাকাল। দেয়ালসংলগ্ন ছাদের কিনারায় একটা টিকটিকি, ধূসর রঙের পেট মেলে দিয়ে এক পা দু’পা করে এগোচ্ছে সামনে ওটার সামনে কিছুই নেই; কিন্তু ও জানে, ও কী খুঁজছে।
আর ও যা খুঁজছে, তাও কি জানে সে কি খুঁজছে? জানে জানে। সবাই জানে সবাই কী খুঁজছে।
কিন্তু মন, তুই এসব কী চিন্তা করছিস? আর বুদ্ধি, তুই-ই কেন আবেগকে খুঁজে নিচ্ছিস না? কল্পনার বাসরে তোদের না মিলনের কথা ছিল! সেখানে টিকটিকি কেন? ওর ওই বিশ্রী পেটটাই তোর বিষয় হলো? ওর উদরপূর্তির চিন্তাটাই তোর উপজীব্য হলো?
হাহ্! উদরপূর্তিই তো বটে। তাছাড়া আর কী? টিকটিকিটার গজখানেক ডানে একটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রকাশিত রঙিন ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারটার পাতা ওল্টানো মার্চ মাসে। রঙিন ছবিটা একটা পাহাড়ের। পাহাড়ের গায়ে জুমচাষ। তিনটা স্বাস্থ্যবতী মারমা মেয়ে হলদে মুখে হাসছে ওখানে। তাদের কপালের সাথে আটকানো ফিতেয় বাঁধা থুরং ঝুলছে পিঠ থেকে। সামনে ঝুঁকে পাহাড়ে ওঠার তালে তালে ঢেউজাগা শরীর। শরীর শরীর!
আহ, শরীর! মন তুই শরীরের মাদকতায় মত্ত হচ্ছিস! তাহলে শিল্পসৃষ্টি কী করে হবে?
কীসের শিল্প? কীসের সৃষ্টি? কে স্রষ্টা আর কী সৃষ্ট? কারো সাথে কারো কোনো সম্পর্ক আছে? আছে কি?
এই তো চলছে লাইলাহা ইল্লাল্লাহ। কিছু মানুষ তাদের বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটাচ্ছে, তাদের বাকশক্তিকে ব্যবহার করছে ভক্তির উপকরণ হিসেবে। বিনিময়ে দুনিয়াতে এবং আখেরাতে ভালো থাকার নিশ্চয়তা অর্জন।
কিন্তু কে সে উপাস্য, কোথায়, কত বড়, কীরকম? কয়টা সৃষ্টি পেরেছে সে মহা মহা মহা শক্তিমান, শূন্যতার মতো সর্বত্র বিস্তৃত উপাস্য স্রষ্টার বিপরীতে নিজের অতি অতি অতি ক্ষুদ্র অস্তিত্বকে মহিমান্বিতভাবে অনুভব করতে? তাহলে কীভাবে শিল্পসৃষ্টি হবে!
মন, তুই টিকটিকির ধূসর উদর, পূর্তির কথা তোকে ভাবতেই হবে। তুই পীতাভ রিরংসা, চরিতার্থতার কথা তোকে কল্পনা করতেই হবে! তাহলে আন নামিয়ে দেয়াল থেকে ওই তিনটা স্বাস্থ্যবতী যুবতীকে, তারপর শরীরের নিচে ফেলে….শরীরের নিচে ফেলে দলিত মথিত কর।
ক্যালেন্ডারের পাতার নিচ থেকে ফড় ফড় আওয়াজ তুলে বেরিয়ে আসে আরেকটা টিকটিকি। ফড় ফড় শব্দে হকচকিয়ে গিয়ে প্রথম টিকটিকিটা হঠা’ ছুট লাগায় পেছন দিকে। বিঘতখানেক গিযে থেমে ঘাড় ফেরায়। দ্বিতীয় টিকটিকিটার দিকে। দ্বিতীয় টিকটিকি লেজ নাড়ে। আস্তে আস্তে এগোয় প্রথমটার দিকে। যুদ্ধং দেহি!
নাকি দেহিপদপল্লবমুদারম!……তোমার পদযুগল দাও আমাকে।
মন, তুই শরীর হয়ে গেছিস। তোর দ্বারা শিল্পসৃষ্টি হবে না। শরীর, তুই মনকে আবিষ্ট করছিস,তুই শিল্পসৃষ্টি বুঝবি না।
সে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল নিজের খাটে। হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে আঙুল মটকাল। টেবিলের ওপর কলমের চাপায় ধূসর নিউজপ্রিন্ট, ছাদ থেকে ঝোলানো ষাটশক্তির হলদে বাতি, দেয়ালে ডেল্টা লাইফের তিন যুবতী, দৃশ্যমান দুই কামার্ত টিকটিকি, জানালা দিয়ে এক চিলতে অন্ধকার আকাশ আর নৈশ বাতাসের সামান্য শব্দের সাথে বাহিত জিকিরের আওয়াজ… এবং সে একা। চমৎকার এক শূন্যতায় আক্রান্ত হওয়ার মতো পরিবেশ। এবং স্রষ্টাও একা! বিদ্যুৎ ঝলকের মতো উঠে বসে সে শোয়া থেকে, এবং সে মুহূর্তে বিদ্যুৎ চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ে আলোর আড়াল থেকে। ধূস নিউজপ্রিন্ট, তিন যুবতী আর জিকিরের আওয়াজ অতীত হয়ে যায় নিমিষেই।
কিন্তু জিকির থেকে যায়। ইল্লাল্লাহ… ইল্লাল্লাহ বাজতে থাকে অপরূপ শব্দহীন বোলে। বাজতে থাকে ধূসর নিউজপ্রিন্টে এখনো অলিখিত কবিতার অবশ্যম্ভাবী আবৃত্তির মতো, তিন যুবতীর অশ্রুত হাসির অননুভবেয় শব্দের মতো, বাজতে থাকে বাতাসের মতো আর পূর্বে শোনা কোনো এক মেঘলা রাতে বৃষ্টিপাতের মতো।
অন্ধকার তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় কামার্ত দুটি টিকটিকি থেকে, তিনটি স্বাস্থ্যবতী যুবতী শরীর থেকে…আর সে চোখ মুদে ক্রমে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে অন্ধকার থেকে।…ক্রমেই….
মাসুদ আনোয়ার, কথা সাহিত্যিক