এখন সময়:রাত ৯:১৬- আজ: শনিবার-১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ৯:১৬- আজ: শনিবার
১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

ব্যক্তিচেতনা আর অন্তর্বেদনার এক গভীর অন্তর্দৃষ্টির বাতিঘর কবি আকতার হোসাইনের শ্রেষ্ঠ কবিতা

জুয়েল বড়ুয়া বাপ্পু:

জীবনের শাশ্বত ভাবাবেগকে স্পর্শ করার নামই কি কবিতা!।একজন কবি কেন কবিতা লেখেন অথবা একজন কবিতার পাঠকের কেনই বা কবিতা ভালো লাগে?। কবি এবং কবিতার পাঠকের মিথস্ক্রিয়াটা কোথায়?। আমার মনে হয় কবিতার লেখক এবং কবিতার পাঠকের মিথস্ক্রিয়াটা উভয়ের নিজেদের জন্য। কবিতা লিখতে কিংবা পড়তে আমাদের ভালো লাগে নিজেদের জন্য-নিজেদের হৃদয়ের জন্য। উভয়ের বুকের ভেতরে কবিতার শব্দগুলো যেন নির্মল আনন্দের মতো করে এসে হাজির হয়। বুকের ভেতরে অজানা কিছু একটা বদলে যায়। কোথাও থেকে দমকা একটি উজ্জ্বলতা এসে লাগে। যা চোখে ধরা পড়ারই না তা যেন চোখটাকে বদলে দিয়ে যায়। এই যে শব্দের আতœদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে কবি ও কবিতার পাঠকের নিজেদের গহনতম সত্তা। এই গহনতম সত্তাটির অনুরণন কেবল কবিতা’য় খুঁজে পাওয়া যায়। কবিতা পাঠের সুখ নিয়ে একজন পাঠক কবিকে আবিস্কার করেন। কবিতার প্রতিটি বাক্য বা  শব্দের সাথে মিশে যান,কবিতার ঘ্রাণ গ্রহন করেন এরপর উপলব্ধি করেন কবিতার মর্মবাণী। যেখানে সমস্ত চেতনা,বোধ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে কবির ইশারা ও রহস্যে। সেই রহস্যের সীমাহীন বৃত্তে আটকে পড়েন কবি ও কবিতার পাঠক।

একজন প্রকৃত কবি প্রতি মুহূর্তে নিজের গভীরে ডুব দিয়ে গভীরতর এক গোপন শ্রুতিসৌন্দর্য অনুসন্ধান করেন। এরপর রক্তে কলম ডুবিয়ে লিখে যান এক একটি শব্দ। সেই এক একটি শব্দের মিথস্ক্রিয়ায় হয়ে উঠে এক একটি কবিতা। এমনিভাবেই এঁকে যান কবিতার চিত্রপট। অবশেষে কবির সেই যাত্রাপথের এক অনুপুঙ্খ দলিল হয়ে উঠে এক একটি কবিতা।“কবিতা, একজন কবির অন্তর্গত অভিজ্ঞতাকে বোধ থেকে বোধিতে পৌঁছে দেয়। এই জায়গায় কবি তার সৃষ্টিকে তার কাব্যিক সত্যকে তার অভিজ্ঞতাকে সঞ্চারনের জন্য একটি সেতু তৈরি করেন পাঠকের সাথে”। ঠিক এমনিভাবেই কবি আকতার হোসাইন কবিতার দীর্ঘ যাত্রাপথ মাড়িয়ে হয়ে উঠেছেন বাংলা কবিতার সম্পদ। লেখালেখির দীর্ঘ যাত্রাপথে বেশ কয়েকটি কবিতা ও ছড়ার বইয়ের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।

আকতার হোসাইন কবি ও শিশুসাহিত্যিক। ১০ আগস্ট, ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী কধুরখীল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।। লেখালেখির পাশাপাশি সম্পাদনা করেছেন কবিতার ছোট কাগজ পঙ্ক্তিমালা। যুক্ত ছিলেন তৎকালীন ছোট কাগজ মৃগয়ার সাথে। ১৯৭৭সালে দৈনিক আজাদী পত্রিকার আগামীদের আসরে প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। সেই থেকে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিরন্তর লিখে চলছেন। কবিতার জন্য পেয়েছেন কথন সাহিত্য পুরস্কার। শিশুসাহিত্য অবদানের জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক প্রদত্ত একুশে পদক-২০২০।

“শ্রেষ্ঠ কবিতা”-শ্রেষ্ঠ কবিতা একজন কবির বহুবর্ণিল অভিযাত্রার অনুপম একটি দলিল। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে নির্বাচিত কবিতা নিয়ে কবি আকতার হোসাইন শ্রেষ্ঠ কবিতা” প্রকাশ করেছেন। শ্রেষ্ঠ কবিতা” গ্রন্থটিতে খুঁজে পাওয়া যায় একজন কবির অভিযাত্রায় নিজেকে আবিষ্কার করার বিষয়টি। উপলব্ধি করা যায় একজন কবির মনোজগতে যে কী পরিমাণ বহুরৈখিক বিষয় কাজ করে।

কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ যে বিশেষ অন্তর্দৃষ্টি দাবি করে, একজন সমর্থ শিল্পী তাঁর সহজাত শিল্পবোধ দিয়ে কবিতার কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। প্রচ্ছদশিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর কবি আকতার হোসাইনের শ্রেষ্ঠ কবিতা” কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদের যথার্থ সুবিচার করেছেন। প্রচ্ছদটির আবরণের অনুপম শৈলীতায় কবি ও কবিতাকে ধারন করার জন্য প্রচ্ছদ শিল্পীর ধন্যবাদ প্রাপ্য। ধন্যবাদ প্রাপ্য শ্রেষ্ঠ কবিতা” কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক চন্দ্রবিন্দু”। চন্দ্রবিন্দু’কে একটা হৃদয়ঙ্গম ভালোবাসা জানাতে হয়।লেখক যদি বইয়ের জনক হয়ে থাকে। প্রকাশকরা বইয়ের দ্বিতীয় জনক। প্রকাশকের হাতেই বইয়ের সৃষ্টির পূর্ণত্ব হয়। চন্দ্রবিন্দু”- শ্রেষ্ঠ কবিতা” কাব্যগ্রন্থটি রুচিশীল মন-মননে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন।

“শ্রেষ্ঠ কবিতা” কাব্যগ্রন্থটি কবির ব্যক্তিচেতনা আর অন্তর্বেদনার এক গভীর অন্তর্দৃষ্টির বাতিঘর। অনুভবের বৈচিত্র্য এবং প্রকাশভঙ্গির সারল্য কখনো কখনো কবিতার সম্পদ হয়ে উঠতে পারে সেই সত্যটি কবি আকতার হোসাইন  শ্রেষ্ঠ কবিতা” কাব্যগ্রন্থে প্রতীয়মান হয়ে উঠে। প্রচ্ছদের পাতা উল্টাতেই বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি, সাহিত্য গবেষক, সাংবাদিক- হাফিজ রশিদ খান কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে যথার্থ মূল্যায়ন করেই ফ্ল্যাপে লিখেছেন-আকতার হোসাইন-এর কবিতাযাত্রা আমাদের সমপদেই শুরু হয়েছিল,সঠিক শনাক্তকরণের দিক থেকে বিগত শতকের আশি’র দশকে। শিশু-কিশোরমনের উদার, কৌতূহলী ভুবনেও তার সৃজনশীল বিচরণ আছে ছড়ায়-ছন্দে, কাব্যকথার মজলিশে। দীর্ঘ পথচলায় তার সম্ভারে যুক্ত হয়েছে কবিতার জন্য বহুরঙা  ঋদ্ধ গুলবাগ। তা থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতার মোড়কে সজ্জিত এই চয়নিকাটি আকতার হোসাইন-এর সত্তার মুকুট হয়ে উঠেছে। এখানে সন্নিবেশিত কবিতাগুলো কবির যাপিত অনুভব ও অনুরণনের রেশ ধরে বহুদূর যেতে চায় প্রেমে-ক্ষোভে-ক্রোধে আর আলিঙ্গনে”।

কবি আকতার হোসাইন  শ্রেষ্ঠ কবিতা” কাব্যগ্রন্থে সুনিপুন সূচারু কবিত্বের সূক্ষè বুননের বিস্তার ঘটিয়েছেন। এঁকেছেন নিজস্ব বোধের চিত্রপট। কবিতার মধ্য দিয়ে তুলে এনেছেন সমকালের স্মৃতি কিংবা স্বপ্নকে। একই সঙ্গে কবি আকতার হোসাইন “শ্রেষ্ঠ কবিতা” গ্রন্থে দেখিয়েছেন সমকালকে অতিক্রম করার সার্থক প্রচেষ্টা। কবি সময়কে ধারণ করেছেন। মহাকাল ভাবুক না ভাবুক কিন্তু একজন কবিকে সময়ের কথা কালের কথা ভাবতে হয়। কবি জানে সূচনা ও সমাপ্তিবিন্দু মহাকাল নিজেই জানে না। কারণ সময়ের মৃত্যু নেই। কবির মৃত্যু আছে বলেই কবি সময়ের কথা ভাবেন না। ভাবেন এ কারণে যে একটি ক্ষুদ্র ফুল ধূলিকণা থেকে মানুষ সমাজ, প্রকৃতি, প্রাণী-জগত জীবন জীবনের রহস্য, যুদ্ধ-মহামারি এবং বিশ্ব ব্রহ্মা-ের কোনো কিছুই কাব্যবিষয় ও চিন্তার বাইরে নয়”।

“শ্রেষ্ঠ কবিতা” কাব্যগ্রন্থ পাঠে দেখতে পাওয়া যায় কবির যাপিত জীবনের খুঁটিনাটি যাপন কীভাবে কবিতার অনুসঙ্গ হয়ে ওঠেছে। নির্মলার জন্য কষ্ট শিরোনামের কবিতায়,কবি তার তুলিতে অশ্রু,বিষাদ ও বেদনার রঙ মেখে জীবনের ছবি আঁকতে চেয়েছেন।-কালো পলিথিন ঢেকেছে চিবুক নাক/মুখরা বৃষ্টি আড়াল করেছে তাকে/রিকশা এগুলো, চিকন গলির বাঁক/নিমিষে আড়াল করলো নির্মলাকে।”/…নির্মলা জানে পথ-ঘাট জুড়ে শুধু/শক্তিমত্ত কামাতুর ‘টাইসন’/কবির গহিন ‘মহিষকুড়া’র বুকে/হরিণকে তাই ভাবে বুনো বাইসন।” কি এক মর্মস্পর্শী গভীর বেদনার্ত অনুভব!। অন্তর্দৃষ্টির চোখ নিয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ প্রাণে কবি তুলে এনেছেন নির্মলাদের উপেক্ষিত জীবনের নিরেট বাস্তবতা। কবিতার গভীরে চোখ রেখে দেখি, জীবনকে দেখার কবির স্বতঃস্ফূর্ততা ও স্বচ্ছতারএই অনুপম দৃষ্টি পাঠককে অভিভূত করবেই।

দু’চোখে ঝিলিক দেয় কবিতার কয়েকটি চরণ-“স্মৃতিরা জাতিস্মর, শয্যা নেয় চুপিসারে পাশে/যৌবন পুড়িয়াছে যে তরুণী তীব্র আশ্লেষে/জানি না এখন সে কুপি হাতে ঘনছায়া শীতে/কার মুখ খুঁজে ফেরে ধুলোজমা স্মৃতি-আরশিতে।”-রক্তে কলম ডুবিয়ে যেন হিন্দোল জীবনের কথাই লিখেছেন। পারাপারহীন ভালোবাসা আর কান্নাকে কবিতায় এনে বসিয়েছেন তিনি। অসাধারণ মুগ্ধময়তায় ভরা এই পঙতিগুলো বড় বেদনার মতো বেজে যায় বুকের কাছে। বিরাণশ্বাসে যেন কেঁপে ওঠে বুকের অতলভূমি। এমন মায়াবী ঘোরলাগা  আকুতিতে ডুবে গিয়ে পাঠকের বিহবল হৃদয় আনমনে বলে উঠবে এতো আমারই বেদনার জলতরঙ্গ।

দুঃখ পেলে কবিতায়-যখন তুমি কাঁদতে থাকো,তখন তোমার নখে চুলে/জীবন কাঁদে,গর্ভে তোমার শিল্প-শিশু/বসুন্ধরার লোভে শুধু হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে থাকে/তখন তুমি মা হয়ে যাও,শিল্পশোভন রক্ত ঝরাও/প্রসবব্যথা না এলে কি দেবশিশুর জন্ম ঘটে/কষ্টে তুমি কিন্নরী হও,তপ্তদগ্ধ আর্তনাদে/প্রবল বেগে সামনে ছোটো,তখন তুমি শিল্পিত হও।”/ -কবির এমন উচ্চারণ একজন পাঠকের ভাবনাকে ও কিছু সময়ের জন্য ব্লক করে দিবেই। এক অদৃশ্য বলয়ের কাছে পাঠক ক্ষণিকের জন্য আটকে থাকবেই। এমন কবিতা- কবিতায় চোখ রাখলেই পড়া হয়ে যায় না,চোখকে পাততে হয় পরতে পরতে না হলে সেই শব্দের মায়াজাল অনুরণন তুলবে না মস্তিষ্কের নিউরনে।“এ কবিতার শব্দ সাধারণ হয়েও অসাধারণ আবার অসাধারণ হয়ে ও সাধারণ”।

এ ভাবেই কবিতা থেকে কবিতাই তিনি দেখিয়েছেন আমাদের জীবনজুড়ে বহমান নিরেট বাস্তবতাকে।সংসারের ঘানি টানা পূর্বপুরুষ থেকে উত্তর পুরুষের অমোঘ দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে স্বপ্নের দায় নিয়ে ছুটে চলা জীবনচক্র কিংবা স্বপ্ন নিয়ে মানুষের যে আমৃত্যু সিসিফাস।স্বপ্নকে আলিঙ্গন করে টিকে থাকার যে নির্মম আকুতি কবির কবিতায় তা উঠে এসছে অবলীলায়- “স্বপ্ন-আক্রান্ত পুরুষ আমি/স্বপ্ন আমার পিতামহকে দেউলে করেছিল/আমার পিতাকে তাড়িয়েছে বুনো মোষের উন্মত্ততায়…/আমার দেউলে পিতামহ নিভে যাবার আগে/তার সন্তানকে কিছু স্বপ্ন দিয়েছিলেন/স্বপ্নবিদ্ব নিরীহ পিতার উওরাধিকারে/স্বপ্নই এখন আমার শেষ সম্বল।

তোমাকে প্রার্থনার মতো ডাকি কবিতায়, প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসার তীব্রতায় কবি প্রেমিকার অভিমান ভেঙেছেন এই বলে-“তোমাকে প্রার্থনার মতো ডাকি,হে ঈশ্বরী,তবু চোখ খোলো না”-ওফ কি এক ঘোর লাগা আকুতি!।কি অদ্ভুত মায়া জড়ানো শব্দের প্রেমময় আবেদন। এমন ঘোরলাগা আকুতিতে অভিমানি প্রেমিকা কি চুপ করে থাকতে পারে!।

ধূলিসান্ত¦না কবিতায় ‘মায়ের বাঁশের ঠুনকির ব্যাংক থেকে পয়সা হাতিয়ে দৌড়ায় সূর্যমেলায়’- যেন আমাদের জীবনের ভেতরে ডুব দিয়ে থাকা জীবন থেকে কবি তুলে নিয়ে আসছেন স্মৃতির নস্টালজিয়া। পাঠককে যেন নিজের সঙ্গী করে হাঁটতে বেড়িয়েছেন এক নস্টালজিক হৃদয়বৃত্তির পদযাত্রায়।যেখানে বিষাদের ব্যাবচ্ছেদ করে স্মৃতিরাও নিঃসঙ্গ হয়ে নৈঃশব্দ্যের কাছে ফিরে গেছে।

কবি নদীপাড়ের মানুষ বলে তুলে নিয়ে এসেছেন নদী পাড়ের গল্প, নদীর গল্প। এবং জল-জীবনের সুখ-বেদনার কাব্যকথা। কবি তার নিজের সাথে কথোপকথনের কথা বার বার বলার চেষ্টা করেছেন। কবির মনের ভেতর, মস্তিস্কে ভেতর অবিরাম বয়ে গেছে কথার নদী। তাই পাঠককে নিজের অনুসঙ্গ করে খুঁজে বেরিয়েছেন ফেসবুক কবিতায় একটি প্রশ্নের উওর-‘ফেসবুক কি আতœদর্শন/না কি নিখুঁত সাঁটানো মুখোশ/নাগরিক হিপোক্রেসিতে নিবিড় বুনোটে একটি আতœমগ্ন মায়াজাল!/ কবি এখানে পাঠকের মননের সাথে প্রশ্নবাণে দৃশ্য-অদৃশ্যের দ্বৈততার সম্মোহনের এক চিত্রপট এঁকেছেন। অথচ কবিতার লাইনগুলোর গভীরে দৃষ্টিপাত করলেই পাঠক বুঝতে পারবে কবি চেয়েছেন পাঠক নিজেই খুঁজে নিবে দৃশ্যবান প্রশ্নের অদৃশ্যবান উত্তরটি।বিস্ময়জনিত মুগ্ধতায় পাঠক আবিস্কার করবে প্রশ্ন এবং উত্তরটা কবি একই লাইনগুলোর সাথে জুড়ে দিয়েছেন।ফেসবুকে যেখানে আমরা কেবল নিজেদেরকে সুখী দেখানোর চেষ্টায় লালায়িত থাকি। সেটা তো মুখোশ।নিজেকে যে মুখোশের মধ্যে আবৃত করে রাখি সেটা কিভাবে আতœদর্শন হতে পারে?।

কবি পারিপার্শ্বিক অসঙ্গতি ও অন্যায়ের বিরুদ্বে সরব হয়েছেন। ছায়াকবিতার পঙ্ক্তিগুলো যতটা না প্রতিবাদের,তার চেয়ে বেশি প্রতিস্পর্ধিতার। ছায়াকবিতা পড়তে পড়তে পাঠক রাষ্ট্রের- সমাজের নষ্ট অবয়ব চোখের সামনে দেখতে পাবে। জীবনঘেঁষা দৃশ্যপট পাঠককে থামিয়ে দিবে। ছায়াকবিতায় কবির উচ্চারণ- ‘এসো, সেই কৃপণ ভালো মানুষটার দুর্ভাগ্য নিয়ে ভাবি, যে পেনশনের টাকায় কেনা সঞ্চয়পত্রের লাভ অথবা সুদে শেষ জীবনটা টেনে নিবে বলে নিশ্চিন্ত ছিল,অথচ হিসেবি রাষ্ট্র দিন দিন তাতে বাগড়া বসিয়ে এখন শুধু পথের কাঙাল করার বাকি!’। পাঠকের মনে হবে কবি যেন শব্দে শব্দে বেহালার সুর তুলেছেন। পাঠকের বুক জুড়ে নেমে আসবে শুধু দীর্ঘশ্বাস। পাঠক ও পৃথিবীর দুঃখীতম আত্মার মানুষগুলোর মতো করে চুপচাপ সান্ত¦না খুঁজে নেবে ছায়াকবিতার  শেষ লাইনে-‘দয়ালু ঈশ্বর ভরা পুকুরে মৎসদান করেন’।

মেঘ মেয়ে কবিতাটি-মেঘমেয়ে! ইঁদুর-করাত-দাঁতে/কেটে নিচ্ছে সুবর্ণ ফসল/ভূস্বামী নই,ঋতগ্রস্ত রুগ্ন বর্গাচাষি/উদয়াস্ত খাঁটুনি শেষে/বাতিল মালের মতো পড়ে থাকি ভাঙা গৃহকোণে’/ কবিতাটি পড়ে মনে হয় এক নিখাদ জীবনের কবিতা। ছোট ছোট বাক্য,সহজ-সরল শব্দ। অথচ কী গভীর তত্ত্ব ঢুকিয়ে দিয়েছেন শুধুমাত্র কয়েকটি শব্দের গাঁথুনিতে।

এ ছাড়াও তোমার কাছে রেখেছিলাম জমা/অঘোষিত প্রিয়তমা/ছুঁয়ে দেখা যেতো/লাল বানারসী কাঁদে/ভালোবাসা দক্ষিণে গেছে/নিদানকাল/তোমার আগুন বুকে/জলের চোখে জল/দহন/মনখারাপের গল্প/জলের দাগ/হাড়ের হরিণী/গল্পটা মনে পড়ে যায় বলে/জীবন/বিস্ময়কাল/কালের সংকট/তোমাকে প্রার্থনার মতো ডাকি/ভেসে আছি গার্হস্থ্য জলে/ভিটিতে পুকুর হবে/প্রণয়ের ভাষা/ক্ষুধা/ অসহায় আয়না/বিচ্ছেদ/অন্তিমে শবাধার/সম্ভ্রান্ত ভয়/প্রতœনদী/ঘুঘু চরে স্মৃতির বাড়িতে/চরজাগা নদী/ইস্টিমারে সিটি মারে/…সহ  মোট একশত একান্নটি কবিতা।

কবি আকতার হোসাইনের শ্রেষ্ঠ কবিতা” গ্রন্থটি পড়তে পড়তে একজন পাঠক কবিতাকে খুঁজবেন জীবনের ভেতর,নিসর্গ ও নস্টালজিকতার ভেতর,স্বপ্ন ও কল্পনার ভেতর। কবির নিজস্ব একটি কাব্যভাষা ও কন্ঠস্বর বিস্তৃত হয়েছে শাশ্বতের দিকে, সার্বজনীনতার দিকে। এর মধ্যে কবির মনোজগতের মাঝে বিরাজমান অস্থিরতা তীব্রতর বলে প্রতীয়মান হয়। কবিতার ভেতর ভালোবাসা, নিঃসঙ্গতা, নৈঃশব্দ্য ক্লান্তি, হতাশা, বিষাদ এবং অবসাদের কথা এসেছে বারবার।

অসাধারণ কবিতায় একের পর এক ভাষা শৈলীর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। আমরা কেবল এর নির্যাস নিতে পারি। ভাষার সবচেয়ে সূক্ষ্ম, সংবেদনশীল, সৃজনমুখর দিকগুলো কবি তুলে এনেছেন শ্রেষ্ঠ কবিতা” কাব্যগ্রন্থে। মানুষের বিস্ময়, স্মৃতি, স্বপ্ন, অনুভূতি, আবেগ, রহস্যানুভূতি কল্পনার এক অপরূপ মিশ্রণ ঘটিয়েছেন প্রতিটি কবিতায় তার নিজস্ব মৌলিক স্বরে। পাঠশেষে পাঠকের ভেতরে জাগে এক ধরনের বিস্ময়জনিত মুগ্ধতা। প্রতিটি কবিতা যেন হয়ে উঠেছে এক সংবেদনশীল মনের ঝরে পড়া কাব্য।

পরিশেষে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মার্জিনে মন্তব্য” বইয়ের উদৃতির আলোকে বলি- কবিতার জন্য যদি কারো টান থাকে সে কেবল কবিতা পড়তে চাইবে না,কবিতার ভেতরে ও সে নিঃশ্বাস নিতে চাইবে।কবিতা যাকে স্পর্শ করে সে আসলে জীবনের স্পর্শ পায়। কবিতায় যে বাঁচে জীবনেও সে বাঁচে। দুঃখময় কবিতাও আমাদের গভীর অর্থে সুখী করে”। কবি আকতার হোসাইনের শ্রেষ্ঠ কবিতা” কাব্যগ্রন্থটি একটি শৈল্পিক মনস্তাপের কাব্যগ্রন্থ।পড়তে পড়তে আপনি নিজেই অনুভব করবেন এক জীবন স্পর্শিত উপলব্ধিবোধ। নির্দ্বিধায় বলা যায় কাব্যগ্রন্থটি কবিতার পাঠকদের জন্য সুখপাঠ্য হবে। সেই উপলব্ধিবোধের নির্যাসে কাব্যগ্রন্থটি পড়া শেষ করে পাঠক আনমনে বলে উঠবেন-কবি আপনাকে ধন্যবাদ।

বই পরিচিতি-

শ্রেষ্ঠ কবিতা

আকতার হোসাইন

প্রকাশক, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন

পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬০, প্রকাশকাল ২০২২ ইং সাল, মূল্য ৪০০ টাকা।

 

 

জুয়েল বড়ুয়া বাপ্পু, প্রাবন্ধিক

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে